অস্ত্ৰ নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – অস্ত্ৰ নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

অস্ত্ৰ নাচ

 

অস্ত্ৰ নাচ

 

খুবই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত  অস্ত্র ব্যবহার এখনও মানুষের খুব প্রিয় খেলা। সম্মুখে পিছনের দিকে মোচড় খাওয় নিরাপদ অবস্থান এবং হঠকারী লাফান, আক্রমণ রচনা ও নিরাপদ স্থানের জন্য দৌড়ান, ভীষণ জোরে আছড়ান, চ জোরে ধাক্কা মারা, নিক্ষেপ করা এবং আঘাত করা, খুব মসৃণ মোচড়ান গতিবেগ — যুদ্ধের কার্যকলাপ এবং নাচ মারামারিতে প্রদর্শিত হয়।

যদি গ্রীসের লোকেরা নাচের মধ্যে যুদ্ধ প্রশিক্ষণের ময়দান লক্ষ্য করে থাকে আবার অন্য দিকে যুদ্ধ বৈচিত্রময়, উন্নত মূলশিল্প উপাদানের দেহ ভঙ্গিমায় উপহার দিয়েছে অনেক কিছু । অভিযাত্রার কথা বিবেচনার জন্য আমরা দুই ধরনের প্রধান গঠনশৈলীর অস্ত্র-নাচকে পার্থক্য করতে পারি-প্রবাল সাদৃশ্য গোল এবং একক নাচ। নাচুয়েগণ এক দিকে অথবা দুইদিকে বিভক্ত হতে পারে ঃ

একদল অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে

দুইদল পরস্পরের বিরুদ্ধে

একজন নাচুয়ে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে দুইজন নাচুয়ে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে

মেলেনেশিয়ানদের অদৃশ্য শত্রুকে দলবদ্ধভাবে প্রতিহত করার চমৎকার উদাহরণ আছে। নতুন আয়ারল্যান্ডে নাচুয়েগণ গঠন করে “একটা ডবল অথবা অনেকগুলি সারি। প্রত্যেকের হাতে থাকে প্রচলিত যুদ্ধের বল্লম। তারা সমস্ত শরীর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ভাবে গতিশীল রাখে দুই পা ও পাতা দ্রুত, লঘু চলনে দেহ ভঙ্গিমা করে অথবা হাঁটুর জোড়ায় বাঁকান অথবা নিক্ষিপ্ত করে ডানে বাঁয়ে, সামনে এবং পিছনে” ।

বল্লম ঘুরান, অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরা, দ্রুত মাথা নিচু করে আঘাত এড়ান-এই সকল দেহ ভঙ্গিমা খুব সাবধানের সঙ্গে মহড়া করা হয় যাতে তারা সবাই একই সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারে।

আমরা এখন বুঝতে পারি যে, গ্রামের আঙ্গিনা থেকে এই যুদ্ধ খেলার আয়োজন কত সতর্কতার সঙ্গে সংগঠিত করতে হয়। এবং নাটকীয় শোভাযাত্রা বিন্যাস করা হয়। ফিজি দ্বীপপুঞ্জের জাঁকজমকশীল অস্ত্র-নাচ বিশেষ অনুষ্ঠানে কয়েক মাস ধরে নাম করা নাচের শিক্ষকের অধীনে অনুশীলন করার পর উপস্থাপন করা হতো যেটা জাপানে অধোগতি না হওয়া পর্যন্ত খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল।

খুব কম করে হলেও ছয়শত নাচুয়ে রংমেখে, সাজসজ্জা করে প্যারেডের আকারে গান গেয়ে, পদাঘাত করে (ফরমেশনে) সামনে অগ্রসর হয়, নাটকীয় থমকানোর পর মারামারি শুরু করে, সামাপ্তি পর্বে তারা ভাবগম্ভীর ভাবে ময়দান অতিক্রম করে যেটা গ্রীক এমব্যাটারিওনের সঙ্গে সাদৃশ্যময়।

যদিও ফিজি নাচে প্রতিপক্ষে কারা হতে পারে তা জানা যায় না, অন্য স্থানে দুই শত্রু ভাবাপন্ন দলে মূলশিল্প উপাদানের পরিস্কার বহিপ্রকাশ ঘটে উদাহরণ স্বরূপ-রুয়ান্ডা ধরা যায়। আমরা অবশ্যই মালে-উপদ্বীপের দিকে লক্ষ্য করব যেটা মূলশিল্প উপাদানে একক সম্মুখ যুদ্ধের গঠনশৈলীর জন্য উল্লেখযোগ্য।

নির্দিষ্ট করে বর্ণিও এবং সুমাত্রা দৃশ্য ও অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে হাতাহাতি যুদ্ধ-নাচে সমৃদ্ধ। এই ধরনের নাচে আমরা তুলনামূলকভাবে “সারকাসিয়ান” দের মধ্যে সঠিক ধারা পাই। একক-নাচ অস্ত্র-নাচের ইতিহাসে দলবদ্ধ-নাচের পরের দিকে প্রকাশ পেয়েছে, যদিও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় প্রাথমিক অবস্থায় মূলশিল্প উপাদানে শত্রুকে বলিদানের উপস্থিতি অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়।

হাতাহাতি যুদ্ধের সঙ্গে শৃঙ্খল বন্ধন নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালের সংযোজন। মূলশিল্প উপাদান হাউসাদের মধ্যে কোন রকম ভাবে নিম্নরূপে প্রয়োগ হয় । নাচরে বৃত্তের মধ্যে সামনে হেঁটে চলে, “প্রতিটি নাচুয়ে তার সামনের জনকে আক্রমণ করে পর মুহূর্তে ঘুরে পিছনের জনের দেয়া ঘুঁসি প্রতিরোধ করে”।

এটা ভ্যাটিকান যাদুঘরে রক্ষিত আশ্চর্যজনক ঐতিহাসিক নিদর্শন পাইরহিচি অস্থিতচিত্র (পটরেইড) থেকে স্পষ্টতই কিছুই না। আমরা সম্ভবতঃ এখানে ইউরোপের সর্বোচ্চ অস্ত্র-নাচ পাই। “পাইরহিচি” শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য এটার বিস্তৃত শিল্পসম্মত কাজের জন্য না।

কিন্তু প্রকৃতির প্রতি তীব্র অনুরাগের জন্যও  এটা ছন্দময় প্রশিক্ষণ, সুবিন্যস্ত যুদ্ধের প্রস্ততি; নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধাগণ একই সময় নেতৃস্থানীয় নাচুয়ে এবং সক্ষম সৈন্যদের সচরাচর বলা যায় যে, তারা নাচেও নৈপূণ্য অর্জন করতে পারদর্শী।

প্রিয়াপাস দেবতা বলেন এশিয়া মাইনরের বিথাইনিয়ানগণের মধ্যে “যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দেবার পেশা গড়ে উঠেছিল এবং তিনি যখন হেরা দেবী কর্তৃক তাঁর ছেলে অ্যারেসকে পাঠদানের জন্য আদৃষ্টহন, যে সত্যিকারভাবে খুবই ছোট কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী এবং বীর্যবান ছিল, তিনি তরবারি ও বল্লম দিয়ে যুদ্ধ করা শিক্ষা।

দেবার পূর্বে তাকে নিপূণ নাচুয়ে তৈরী করে ছিলেন”। যুদ্ধ-নাচের সংরক্ষিত ক্ষেত্র থেকে আমরা অলরেডী বিচ্যুত হয়ে যুদ্ধ নাচে এসে পড়েছি। নাচের মধ্যে যুদ্ধ করতে উঁচু দরের উপস্থিত বুদ্ধি এবং লক্ষ্য ভেদের নিপুণতা থাকা প্রয়োজন যদি কেউ আহত হবে না এবং আহত করবে না এইরূপ ইচ্ছা পোষণ করে।

এইভাবে অস্ত্রের লড়াই হয়ত সম্পূর্ণ হারায়ে যাবে যুদ্ধ নাচে এবং কৃত্রিম নাচের উপাদান সুস্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হবে, আজ-কাল মালায়ানগণ তাদের অস্ত্র ছুড়ে ফেলে খালি হাতে লড়াই করে অথবা আরো উন্নত প্রক্রিয়া–নাচুয়ে মাটিতে গাঁথা ব্লেডের মাঝখানে লাফায়ে পরে এটা মধ্যযুগের ইউরোপের জনপ্রিয় পেশাজীবি ভেলকিবাজকের মূলশিল্প উপাদানের আওতাভুক্ত।

অনেক ছবিতে দেখা যায় তারা বিপজ্জনক ভাবে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে যাচ্ছে। ডেমোক্রিটাসের সেই কৌতুক- গল্প মনে করায়ে দেয়, “যদি তারা আনাড়ি হয়, কৃপণ লোকের ছেলেমেয়েরা এই রকম নাচুয়ের মত হয় যে তরবারির মধ্যম দিয়ে লাফ দেয় ।

পরের জন লাফ দিতে গিয়ে যদি যেখানে পরার কথা তা লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়ে তারা হারে; কিন্তু সেখানে স্থান পাওয়া কঠিন না শুধু অল্প কিছু জায়গা মাত্র পা রাখার জন্য থাকে। এইরূপ এটা ও পূর্ববর্তী জনের সঙ্গে সাদৃশ্যময় যদি তারা তাদের বাপের মত সাবধানী এবং মিতব্যয়ী না হয় তারা স্বভাবতঃই ব্যর্থ হয়।”

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিপরীতমুখী এই নাচের সুপরিকল্পিত ধরন-বিন্যাস উন্মত্ততা অনুরাগী যুদ্ধের হৈহুল্লোর হয়ে পরে এবং জয়ের উত্তাপ সম্মিলিত হয়ে কখন কখন উচ্চ স্তরের কৃষ্টিতে অনুপ্রবেশ করে। ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে স্পেনের ভিক্টোরিয়া শহরে মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাতের জন্য তলোয়ার নাচ নিষিদ্ধ ঘোষনা করতে বাধ্য হয়। নির্দিষ্ট করে মালায়ানদের মধ্যে প্রায়ই এই খেলা ক্রমান্বয়ে রক্তাক্ত লড়াইয়ে পরিণতি হয় এবং এমনকি আজ পর্যন্ত বালির ক্রিস-নাচুয়েগণ প্রায় নিজেদের উপর তীব্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে।

এমনকি মালায়ানদের দ্বারা এই মূলশিল্প উপাদানও প্রায় দূর্বল এবং পরিবর্তিত হয়েছে। যখন তলোয়ারের বদলে লাঠি ব্যবহার হতে শুরু করেছে অস্ত্র-নাচ ও প্রায় প্রায় সম্পূর্ণভাবে আঘাত নাচে পরিণত হয়েছে। ব্রান্ডটস বাইস জাভাবাসীদের জিটিকুয়ানকে নির্যাতনের নাচ বলে বর্ণনা করেছেন, যাতে বিষয়বস্তু কোন যুদ্ধ বা আত্মরক্ষা না কিন্তু তার চেয়েও একটা ধীর সহাস্যে বেদনা নিজের মনে চাপা দিয়ে রাখা।

এই নাচেও তলোয়ার এবং জীবন দন্ড, অস্ত্র-নাচ এবং উর্বরতা নিগূঢ় শক্তির মধ্যে পুরান ঘনিষ্ঠতা রাখে। আরো অভ্রান্তভাবে বলা যায় ওয়াটচানদি অস্ট্রেলিয়ানদের বল্লম-নাচ খুব আদিম অস্ত্র-নাচ। যেটা নাচুয়েগণ নিজেরাই সঙ্গমের প্রতিনিধিত্ব করায় বল্লমকে পুরুষাঙ্গের প্রতীকরূপে।

কিন্তু এই সম্পর্কের অন্তরালে মানুষের মননে গভীর আবেগের রেখাপাত করে। তার জন্য যুদ্ধ উন্মাদনা এবং যৌন উত্তেজনা পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত যেমন হরিণ, যেটা হরিণীর তীব্র কামোদ্দীপনায় সাফল্য লাভ করে। রক্ত-পিপাসা ও যৌনস্পৃহা জীবনে যেমন সহজাত বহমান তেমনি নাচেও এখানে জীবনের নমুনাস্বরূপ বিদ্যমান  যৌন উত্তেজনাপূর্ণ নাচ প্রায় যুদ্ধ নাচে সংযোজিত হয় অথবা যুদ্ধ নাচে অংশগ্রহণকারী নারীগণ যৌন কামনায় উদ্দীপ্ত হয়ে পরে।

সাবেক জার্মান কলোনী নিউগিনিতে এই মূলশিল্প উপাদান অদ্ভুত উপায়ে নির্দেশিত হয় : বিজয় উৎসবে প্রধান যোদ্ধার স্ত্রী কোথাও কোন প্রকার আবরণ ছাড়া (এই অনুষ্ঠান ছাড়া চিন্তা করা যায় না) পুরুষদের ঘেরের মধ্যে ঘুরে নাচে।

সুপ্রাচীন সম্পর্কের আলোকে যুদ্ধ নাচ এবং যৌন-নাচের মধ্যে, বিজয়ের যাদুমন্ত্রে এবং জীবনের যাদুমন্ত্রে, অস্ত্র-নাচের প্রদর্শন ও ছেদনের নিগূঢ় তাৎপর্যে, মেয়েদের প্রতি ধর্মীয় আচার, বিবাহ-বন্ধন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান স্ফটিকের মত স্বচ্ছ হয়ে দেখা দেয়। প্রায় প্রতিটি উর্বরা যাদুমন্ত্র একই সময় আত্মরক্ষার যাদুমন্ত্র এমনকি অস্ত্র-নাচও।

দুই পর্বে উভয়ের সাদৃশ্যের তুলনা অবশ্যম্ভাবী প্রথমতঃ যদি অস্ত্র এবং ঘুষি শত্রু লোককে পালাতে বাধ্য করে, তারা অবশ্যই একই প্রতিক্রিয়ার অদৃশ্য অপশক্তির উপর কার্যকর করবে, দ্বিতীয়তঃ যদি গন্ডগোল মানুষ ভয় পায়, এটা অবশ্যই শয়তানের উপর একই প্রতিক্রিয়া করবে।

প্রথম ধারণার সুন্দর উদাহরণ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা যায়। বর্ণিওর যাজিকার অনুপস্থিত ব্যক্তির পক্ষে তলোয়ার নাচ, উত্তর-অঞ্চলের হিন্দুর খোলা তলোয়ার নাচ যেটা মৃত আত্মীয়ের জন্য মারা যাবার এক বৎসর পরে অনুষ্ঠিত হয় এবং সবার উর্ধে পূর্ব আফ্রিকার মাকনদিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান যুদ্ধ নাচে যুবকের যুদ্ধ-নাচে মৃতের কুঁড়েঘরে আক্রমণ চালায়।

প্রতিবেশী এঙ্গেনী দুই ধারণার দ্বিতীয়টার সাদৃশ্যময় বিশদ বিবরণ দিয়েছেন : শত শত যোদ্ধা শূন্যে বারংবার লাফ দেয় তারপর তারা বিরুদ্ধবাদীর ঢালে আঘাত করে। “লাফ” যেটা মালুক্কার আলফিউরোদের অস্ত্র- নাচের গঠনে অংশ নিয়েছে, পরিস্কার দেখা যাবে যে, এইগুলি উর্বরাশক্তি আকষর্ণের যাদুমন্ত্র ছাড়া যুদ্ধ-নাচ না।

প্রাচীন জাপানীদের “ছন্দময় ঢাল নাচ” টাটে-ফুশি-মাহি এই ক্যাটাগরীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু উচ্চস্তরের (ক্ল্যাসিক্ল) প্রাচীন কালের সভ্য লোকজন খুব পরিচিত বিশদ বিবরণ রেখে গেছেন। ক্রীটের জীয়াস পৌরাণিক কাহিনীতে যুবক-দেবতা যাজকীয় কিউরেটিস দ্বারা ধ্বংসকারী করনস-স্যাটান হতে রক্ষা পায়, তারা তাকে ঘিরে ধরে তার ঢালে তাদের তলোয়ার দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে।

 

অস্ত্ৰ নাচ

 

একই মত রোমের শালী উপাসনার বেদীর চারদিকে নাচে; তাদের ঝন ঝন শব্দের ধাতুর ঢালে তারা তাদের তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে স্যাটার্ন যে সমস্ত জীবন বিচূর্ণ করে দেয়, বীজ ধ্বংসকারী এবং কিউরেটিসের মত স্যালিয়ান যাজকেরাও বীজের অভিভাবক (রক্ষাকারী)। আমাদের পরবর্তী বিভাগে পরবর্তী ইউরোপের তলোয়ার-নাচের আলোচনায় আমরা এই সকল সম্পর্ক প্রমাণ করতে আরো অগ্রসর হব ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment