কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

আজকে আমরা আলোচনা করবো কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

 

কথক নৃত্য ও তার ঘরানা
কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

 

কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

যাঁরা কথকতা করেন, তাঁদের বলা হয় কথক। এই কথক সম্প্রদায়ের প্রাচীনত্ব বোঝা যায় যখন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তার বহুল উল্লেখ দেখি । ব্রহ্মপুরাণে অভিনেতা, গায়ক ও নর্তকিদের ‘কনক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারত ও নাট্যশাসেরও ‘কথক’ শব্দের উল্লেখ আছে। সঙ্গীত-রত্নাকর গ্রন্থে ‘কথক’ নেই কিন্তু ‘কথকা’ আছে। পালি ও নেপালী শব্দকোষ আছে ‘কথিকা’। মহেঞ্জোদড়ো, হরপ,পার মন্দিরগাত্রেও নাকি ‘কথক নৃত্যের মূর্তি দেখা যায় ।

সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত শাহজীর গ্রন্থে যে ধ্রুবপদ নৃত্যের উল্লেখ আছে, অনেকের অনুমান, সেই নতোই নাকি অন্য প্রচলিত ‘কথক’। এই ভাবে দেখা যায়, প্রাচীনকালে যাঁরা ভাষাভিনয়, গাঁত ও নাত্যের মাধ্যমে দেবদেবীর লীলাকীর্তন করতেন বা পৌরাণিক গাথা, উপাখ্যান ইত্যাদি পাঠ করতেন, তাঁরা পরিচিত হতেন কথক, গ্রন্থিক, গাথাকার, পাঠক, বৈতালিক প্রভৃতি বিভিন্ন নামে । কথক সম্প্রদায় কর্তৃক প্রচারিত বলেই এই নৃত্যশৈলীর নাম হয়েচে কথক বা কথক নৃত্যে ।

ভারতবাসী চিরকালই ধর্মপ্রাণ। তাই এদেশের সঙ্গীত, সংস্কৃতিও ধর্মভিত্তিক। নটবরী বা কথক নৃত্যেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে হ্যাঁ, আজকের কথক নৃত্যে সেকালের নটবরী বা কথক শৈলীর গণগত সম্পর খুজতে গেলে হতাশ হতে হবে।

কথক নৃত্যেকে আগে বলা হ’ত নটবরী নৃত্য। কারণ এই নৃত্যে প্রদর্শিত হ’ত দেব মন্দিরে — শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের সামনে। শ্রীকৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ শিল্পী নটবররপে কল্পনা করা হ’ত এবং এর নৃত্যকাহিনী রচিত হ’ত রাধাকৃষ্ণের লীলা-মাহাত্ম্য থেকে। পূজার্চনা ও আরতির পর পবিত্রতা ও চিতার সঙ্গে এই নাতা প্রদর্শিত হত বিগ্রহের সামনে — তার মনোরঞ্জনাথে। আজও যাঁরা বিশদ্ধেতার সঙ্গে কৃষ্ণলীলাকে কথক নৃত্যের দ্বারা রূপদান করেন, তাঁরা একে নটবরী নৃত্যে নামেই অভিহিত করেন ।

 

কথক নৃত্য ও তার ঘরানা
কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

 

আজ আমরা যে-কথক ননৃত্য দেখি, তার মধ্যে বৈদেশিক ( ইসলামী ) প্রভাব পড়েচে অনেক বেশি। যদিও এর কাহিনী আজও সেই রাধাকৃফের লীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়, তব, তার পোষাক-পরিচ্ছদ ও আঙ্গিকের পরিভাষাগুলি বিদেশী প্রভাবে প্রভাবান্বিত। যেমন- রাধা হলেন ‘সাক্ষী’, আগমন হ’ল ‘আমদ’, প্রস্তুত হ’ল ‘অদা’ নमকারী বা প্রণামী হ’ল ‘গলামী’ ইত্যাদি ।

ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আন, মানিক প্ররোদশ-চতুর্দশি শতকে (ইসলামিক যুগে) পারস্য ও খোরাসান থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বহু সুন্দরী নর্তকী (নাচ: ওয়াজ ) আমদানী করা হয় ভারতবর্ষে মুঘল দরবারে নাত্যের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা জানা যায় আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই আকবরী’ গ্রন্থে। যে নতো একদা ছিল প্রধানত দেবতাদের তুষ্টি বিধানের জন্য সেই নতা এখন থেকে পরিণত হ’ল বিলাসের সামগ্রীতে।

ফলে তার মধ্যে ধীরে ধীরে অননুপ্রবেশ করতে লাগল মানবিক প্রবৃত্তিগলির উগ্রতা— ইন্দ্রিয়া সস্তির উপকরণ হিসেবে। অতঃপর উভয় সংস্কৃতির মিলনে কথক নৃত্যশৈলীতে যে-রূপান্তর ঘটল, তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আজকের কথক নাতো ।

ভরতনাট্যম, কথকলী প্রভৃতি নতো যেমন মুদ্রার সাহায্যে ভাষ অভিব্যক্ত হয়, বর্তমানে কথক নাতো তেমনি পাদবিন্যাস ও লয়কারী দ্বারা তা প্রদর্শিত হয় । এতে নাস্তাংশ বেশী। অবশ্য গত্তা ও অfears এতে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় নি। এ দলটি প্রদর্শিত হয় রাধাকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা ও ঠুমরী গানের ভাব-কল্পনার সময় তবলা, মদঙ্গ সাবা হারমোনিয়মের লহরার সঙ্গেই এই নাত্য বেশী প্রচলিত ।

বর্তমানে কথক নাত্যের প্রধানতঃ দুটি ঘরানার পরিচয় পাওয়া যায়। একটি লক্ষেরা অপরটি জয়পরে ঘরানা । বেনারস ঘরানা বলে যে আরেকটি ঘরানার নাম শোনা যায়, তা ঐ জয়পরে ঘরানারই উত্তরাধিকারীদের দ্বারা সৃষ্ট। (সঙ্গীত-শাস্ত্রের যাবতীয় নিয়ম-কাননে পালন করেও নিজস্ব প্রতিভার দ্বারা কোন শৈলীকে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ করাকেই সাঙ্গীতিক ভাষার খরানা বলে চিহ্নিত করা হয় ।

 

কথক নৃত্য ও তার ঘরানা
কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

 

যিনি এ ক্ষেত্রে বিশেষ মন্সিয়ানার পরিচয়  ) ( দেন, তাঁরই নামে ঐ ঘরানার পরিচয় বহন করেন তাঁর বংশ ও শিষ্য পরম্পরা । এমনি ভাবেই গীত, বাদ্য ও নাতো বিভিন্ন ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে । ঘরানা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে ‘সঙ্গীত-পরিচিতি’ উত্তর ভাগে। কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য কথক নাতো পাথক ঘরানার সৃষ্টি হল এবং তার উদ্ভাবক কারা, এবার সে সবন্ধে একটু আলোচনা করা যাক ।

লক্ষ্ণৌ ঘরানা :

কথক নৃত্যের ক্ষেত্রে লক্ষেনী ঘরানাই আজ বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ঊনবিংশ শতকে এই ঘরানার পত্তন করেন এলাহাবাদের ননৃত্যসাধক ঈশ্বরী প্রসাদের প্রপৌর নত্যাচার্য’ ঠাকুরপ্রসাদ। ইশ্বরীপ্রসাদ এই ঘরানার আদি গরে, রূপে পূজো । বংশপরম্পরায় এ’রা সকলেই সঙ্গীত জগতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।

ঈশ্বরীপ্রসাদ ছিলেন এলাহাবাদের হন। ডিয়া তহসিলের বাসিন্দা । ইনি কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। এরপ জনশ্রুতি আছে যে, সে সময়ে নটবরী নাত্যের দুর্দশা দেখে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান নাকি তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন তার পুনের ধারের জন্য । তার তিন পত্রে অড়গ,, খড়গ ও তুলারাম — তিনজনকেই তিনি নৃত্যে শিক্ষা দেন উত্তমরূপে। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর শধে, অড়গ জাই নিত্যচর্চা বহাল রাখেন, অন্য ভাই পিতৃশোকে এই কলাচর্চা পরিত্যাগ করেন।

অড়গ জীরও তিনটি পত্র— প্রগাস (প্রকাশ ), দয়াল ও হরিলাল । এরাও পিতার নিকট যথাযোগ্য শিক্ষা দ্বারা নৃত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অড়গাজীর দেহত্যাগের পর প্রগাসঙ্গী ভাইদের নিয়ে চলে যান লক্ষেরীতে । এ সময়ে লক্ষৌয়ের নবাব ছিলেন অসফউদ্দৌলা (১৭৭৫ – ১০ খৃ.) প্রগাসজী তাঁর দরবারে নৃত্যবিদ, হিসেব নিয়ত্তে হন। প্রগাসঙ্গীর তিন পত্রও কথক নৃত্যে নিপুন হয়ে ওঠেন। এই তিন পত্রের নাম দূর্গ প্রসাদ, ঠাকুরপ্রসাদ ও মান ( মানসিং ) ।

কথক নৃত্যের উন্নতি বিধানে ঠাকুরপ্রসাদের অবদান সমস্ত ননৃত্যবিদরাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন। ইনি ‘নটবরী নৃত্যে’ নামে কথক নৃত্যের নতুন নামকরণ করেন । ঠাকুরপ্রসাদজীর ননৃত্যধারা আজও যাঁরা রক্ষা করে আসছেন, তাঁরাও নত্যক্ষেত্রের দিকপাল বিশেষ । নত্য সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখেন অথচ মহারাজ কালিকা, বিদাদিন তথা ভৈরো প্রসাদের নাম জানেন না এরূপ একজনও নেই।

এরা তিন জনই ঠাকুরপ্রসাদজীর সহোদর দুর্গোপ্রসাদের যোগ্য পত্রে। এই পরিচয় থেকে আরো একটা মজার সমতা লক্ষ্য করার মত। ঈশ্বরীপ্রসাদ থেকে দুর্গাপ্রসাদ পর্যন্ত সকলেরই তিনটি করে পত্র। আবার কালিকাপ্রসাদও তিন পাত্রের জনক । এই তিন পত্রের নাম আচ্ছন, লচ্ছ, ও শম্ভু মহারাজ। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল অচ্ছন মহারাজের ক্ষেত্রে। অচ্ছন মহারাজের তিনটি কন্যা কিন্তু পর একটি—ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী বিরজ, মহারাজ ।

কথক নৃত্য লক্ষেণী ঘরানার ক্রমবিকাশের ঐতিহ্য এই ভাবেই আজও চলে আসচেত্যচাষ’দের শিষ্য-প্রশিষ্য (উভলিঙ্গই ) নির্বিশেষে। ভাবপ্রধান ননৃত্যের জন্যই এই ঘরানা সমধিক প্রসিদ্ধ ।

 

কথক নৃত্য ও তার ঘরানা
কথক নৃত্য ও তার ঘরানা

 

জয়পুর ঘরানা :

জয়পুরে ঘরানার গোড়া পত্তন করেন ভানজেী—প্রায় দেড়শ’ বছর আগে। ইনি ছিলেন শিব ভক্ত এবং জনৈক শৈব সন্ন্যাসীর কাছ থেকে খুব নিপণে ভাবে শিব-তাণ্ডব নতো শিক্ষা করেছিলেন বলে জানা যায় ।

লক্ষেণীয়ের সঙ্গে এই ঘরানার নত্যশৈলীতে বেশ বড় রকমের পার্থক্য আছে। এই ঘরানার নৃত্য লক্ষেীয়ের মত ভাবপ্রধান নয়। লয়কারীর দিকেই এদের লক্ষ্য বেশি, এবং সেগুলি শব্দে টি পায়ের সাহায্যেই প্রদর্শিত হয়। কঠিন কঠিন সংক্ষা লয়ের কাজ এরা অতি সরলতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রদর্শন করেন। তবলা-পাথোয়াজের বোলগুলিকে এরা বিশেষ নৈপণ্যে সহকারে দেখান শধ্যে পদয গল দিয়ে। এই ঘরানার যা কিছু বৈশিষ্ট্য তা প্রধানত এই ক্লিয়ার মধ্যেই সীমিত। অনো এই ঘরানার শিল্পীদের কাছ থেকে কিছ, ‘গৎ-ভাও’-এর প্রদর্শন দেখা যাচ্ছে। এদের তাণ্ডব নৃত্যে বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।

ভানুজী তাঁর পুত্র মালুজীকেও শিব-তান্ডবের শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু মালজোর দ্বিতীয় পত্রে কাজী তাঁদের ঘরানার নত্য ছাড়াও নাসা নাত্যের পাঠ নিয়েছিলেন বৃন্দাবনে গিয়ে। অতঃপর এই ঘরানায় তাণ্ডব ও লাস্য—উভয় প্রকার নৃত্যেরই প্রচলন হয়। কানাজীর পৌত্র এবং গীজীর পত্রে হরিপ্রসাদ ও হন;মানপ্রসাদ ভ্রাতৃদ্বয়ও তাঁদের ঘরানার ঐতিহ্য বিশেষ নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষা করেছিলেন। এই দ’ ভাইয়ের নত্য সে সম এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে সারা ভারতে এরা ‘দেওপর কী জোড়ী’ (দেবপরী-য, গল) নামে পরিচিত ছিলেন।

জয়পুর ঘরানার শিল্পীরা কয়েকটি বিভিন্ন শাখায় বিষয় হয়ে পড়েন। এরা সম্ভবত ভানজোরই বংশ-পরম্পরা। এদের মধ্যে যাঁরা সারা দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেচেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম- চুমীলালজী এবং তাঁর পরে জয়লাল, সুন্দর প্রসাদ, জয়নালজীর কন্যা জয়কুমারী ও পরে রামগোপাল হজালাল নলাল, সোহনলাল। রোশনকুমারী, বেলা অর্ণব, ঝর্ণা সাহা প্রভৃতি। এই ঘরানার বিকাশে রাজস্থানী রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ উল্লেখ্য ।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বেনারস ঘরানা :

রাজস্থানী নত্যকার শ্যামলদাস-ঘরানার জানকী প্রসাদের শিষ্য তথা ভাই দলে হারাম ও গণেশীলাল, রাজস্থান থেকে বসবাস তুলে বারাণসীতে গিয়ে অবস্থান করেন। এদের দ্বারাই নাকি কথক নৃত্যের বেনারস ঘরানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘরানার ননৃত্যে তবলা-পাখোয়াজের বোল অপেক্ষা নাতোর রোলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

পরকারীর এই অঙ্গটা জরপর ঘরানার সঙ্গে খানিকটা মিললেও বেনারস ঘরানার বৈশিষ্টা শখেন লয়কারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। লক্ষে ঘরানার মত সৌন্দর্য সংষ্টির প্রয়াসও তার মধ্যে বিদ্যমান! তাছাড়া উক্ত দুটি ঘরানা থেকে এই ঘরানার শৈলীর ( টেকনিক) মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য প্রতিভাত হয়। সেই জন্যই এই ঘরানাকে চিহ্নিত করা হয় পৃথক ভাবে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment