মুখোশ নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – মুখোশ নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

মুখোশ নাচ

 

মুখোশ নাচ

 

যখন এই দুই ধরন পরস্পরকে অতিক্রম করে এবং একে অপরকে পথ করে দেয় তার ফলাফল প্রায় সময় আরো বেশী। অধোগত অথবা নিষ্প্রভর চেয়ে আর কিছু হয় না। কিন্তু যখন সময় ও অবস্থান সহায়ক হয় তারা হয়ত একত্রে তৃতীয় ধারার মধ্য আসে এবং উঁচু স্তরে উঠে সেখানে তারা কখন একা অবস্থান নিতে পারে না।

যেখানে গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং হর্ষোল্লাসের অভিজ্ঞতা আত্মসচেতনতাকে বিদীর্ণ করে এবং যেখানে সতেজ প্রফুল্লতা অশারীরিক এবং সচেতন মানবিক অংশ হারায়ে যায় কিন্তু আধ্যাত্মিক অংশ নতুন অস্তিত্বে রূপ নেয় যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিতে ইন্দ্রিয় নির্ভর হয়, সেই জগতে মুখোশ নাচের মৌলিকত্ব বিরাজমান।

একনকি মুখোশ ছাড়াও শুধু নাচ ব্যক্তিকে মোহাবিষ্ট অবস্থায় নিমগ্ন করতে সক্ষম, যা আমরা পূর্বের উদাহরণে দেখিছি যে, ভেড়া (শাম্যান) পুরোহিত এবং ওয়নায়ম এইজদের মধ্যে, প্রতিহত করতে অথবা তার চেতনা মুক্ত করতে, সম্পূর্ণ লোপ করতে অথবা একেবারে সম্পূর্ণ আত্মোপলব্ধিতে এবং তার উপর অন্য ইচ্ছা, একটা দৈব ইচ্ছা আরোপ করতেঃ যা নাচুয়েকে “ভর” করে।

কিন্তু ওয়নায়ম ওইজদের “ভর প্রাপ্তি” হল সর্বপ্রাণবাদী তত্ত্ব; তাদের জন্য সবকিছুই আত্মার কাছে একান্তভাবে আবদ্ধ, নিজেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা কোন প্রয়োজনীয় ব্যাপারই না। মুখোশ নাচে উল্টাটা সত্য, যেটা সাধারণ অনুকরণাত্মক মাচের মত তা সর্বপ্রাণবাদী না  বাহ্যিক গঠনশৈলী (আকৃতি) প্রধান প্রয়োজনীয় দিক, এই গঠনশৈলীই (আকৃতি) যথার্থ আত্মা এটার ভিতরে আকর্ষণ করে, সেটা কোথায় হতে পারে তা কোন ব্যাপার না।

মুখোশ কৃষ্টি একটা মূল মৌলিকাদিক আকৃতিগতভাবে থাকে যার আত্মাসম্মোহিত দৈবশক্তি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে প্রায়ই জীব-জন্তুর আকৃতিতে, এবং সম্পূর্ণ ভরপ্রাপ্তি ও নিজের স্ব-আকৃতি, স্বশরীরে বিকশিত হয়ে পরে দৃশ্যমান রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে।

যাদুমন্ত্রের সাফল্যের নিগূঢ় প্রয়োজনীয় দিক্‌ কারো নিজের আকৃতি অদৃশ্য করে দেয়ার মধ্যে থাকে। এমন কেউ যাদুমন্ত্রের কার্যকারণ বুঝতে চায় সে ধ্বংস হয়ে যাবে ও নিজের জীবনকে বিপদগ্রস্থ করবে যতক্ষণ না ব্যবহৃত ব্যক্তিকে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয় এবং বাইরে জানায় যে সে মারা গেছে।

এমনকি মুখোশহীন থেকে মুখোশ নাচের রূপান্তরের এক পর্যায়ে অংশগ্রহনকারীগণও তাদের ব্যক্তিত্বকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয় : ক্যালিফোর্নিয়ার সাটাদের মধ্যে মেয়েদের সূচনায় (বয়ঃপ্রাপ্তি) বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়ে স্থানীয় নৃত্যরত নাচুয়েদের লক্ষ্য করে গাছের পাতা দিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে নিজেদের পরিচয় গোপন করে নাচতে থাকে।

এমনকি সাদাসিদা নাচও নিজে থেকে অদিম উত্তেজনা ছড়াতে চায় যদিও সে হর্ষোল্লাসে ঘেরের দৈহিক বন্ধন শিথিল করার প্রয়োজন বোধ করে অথবা অনুকরণাত্মক নাচে জীবজন্তুকে অনুকরণ করতে চায় তাদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য সবকিছু করে থাকে।

কিন্তু সে মানুষের আকৃতি সরায়ে রেখে কতখানি অধিক ফলপ্রসু হতে পারবে, সে অন্যের কাছ থেকে হাওলাত করে কতখানি ক্রিয়াশীল হতে পারবে বিশেষ করে যখন মুখমণ্ডলে জন্যই আত্মার অবস্থান। অন্য মুখ লাগানর অর্থ আর একটা আত্মা স্বীকার করা। আমরা এই বিকল্প মুখকে তার সমস্ত আঙ্গিক এবং প্রথাসিদ্ধ সাজসজ্জাকে মুখোশ বলে থাকি।

যদিও এটা প্রায় নতুন তৈরী করা হয় এবং ব্যবহার করার পর নষ্ট করে পুড়ায়ে ফেলা হয়, মুখোশ শয়তানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু ফুটায়ে তোলে না এটা এর মুখমন্ডলও বটে। কলম্বিয়ার ক্যাজাবাদের মতানুসারে প্রথম পুরোহিত “শয়তানের সঙ্গে সন্ধি করে, যাতে তারা (শয়তান) জানায় কি নাচ-গান অনুষ্ঠিত করবে যাতে তাদের প্রয়োজনীয় গুণাবলী মানবজাতির কল্যাণে আসবে এবং তাদের ক্ষতিকারক দিক প্রতিরোধ করবে”।

পুরোহিত “শয়তানের মুখমন্ডল সরায়ে নেয় অথবা তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় সবায় যাতে মানুষ তাদেরকে নাচের মধ্যে মুখোশরূপে পরিধান করতে পারে”। সেই কারণে মুখোশ- নাচের কৃষ্টি এত অধঃপতিত হয়েছে যে, শ্যাম কম্বোডিয়াতে (বর্তমানে থাই কম্বোডিয়া) রোগাক্রান্ত নাচুয়ে তার নিজের মুখোশের কাছে প্রার্থনা করে।

যে কেউ মুখোশ পরিধান করলে নিজের পরিচয় ত্যাগ করে অন্যের পরিচিতি নেয়। অন্যের আত্মার অংশ হবার ইচ্ছা সবদিক থেকে এত প্রবল হয় যে, জাভাবাসীগণ এক টুকরা চামড়া মুখোশের সঙ্গে সেলাই করে তাতে দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকে যাতে দৈব ক্রিয়া ঘনীভূত হয়ে ভরপ্রাপ্তি ঘটে।

কিন্তু এটা কোন ব্যাপার না কেমন করে নতুন পরিচিতি কতটুক আত্মীকরণ হয়েছে, নাচুয়ে মুখোশের প্রতিনিধিত্বকারীর মত কথা বলে ও ব্যবহার করে; সত্যি বলতে কি আত্মীয়-স্বজন তারমধ্যে তাদের প্রায়ত জনকে খুঁজে পায়। “এটা আমার স্বামী, ওটা আমার সন্তান” তারা বলে, কিন্তু “এটা আমার স্বামীর মত” বলে না।

মুখোশের সূচনা সম্ভবতঃ নাচের সাজসজ্জার প্রাথমিক যুগের সময় থেকে চিহ্নিত করা যাবে। নাচের সাজসজ্জা শুধুমাত্র সময়ের গতিধারার ব্যাপার না। অনেক নাচ পূর্ব-পুরুষের পোষাকে অনুষ্ঠিত হয় আবার অনেকগুলি ন্যাংটা হয়ে।

কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য এটা স্পষ্ট যে, নাচুয়েগণ তাদের প্রাকৃতিক সাড়া সাবধানে সাড়ে, এমন যে তারা সেব করে, রংচং নিজে লাগায়, সুন্দর পোষাক পরে উজ্জল অলংকারে ভূষিত করে-এমনকি উলফ্যাংগ কোহেলারের টেনরিফ শিম্পাঞ্জীও ঝুলতে পছন্দ করে “সব ধরনের জিনিষ তাদের শরীরে থাকে, উৎকৃষ্ট সকল দোলান এবং ঝলঝলে তার, আঙ্গুর লতা এবং বস্ত্রখন্ড” : নাচ প্রাণ-প্রাচুর্যের শক্তিরূপে, অন্য জগতে উত্তরণের পথে এর সঙ্গে বয়ে আনে উৎসবমুখর অলংকারিক উপাদান।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই অলংকারিতা হয়ত খুবই বিচিত্র হতে পারে ঃ প্রায় শুধুমাত্র কয়েক লাইন শরীরে পাতাল করে রঞ্জিত; কখন কাঁচের মত; কখন কখন পাখির লেজের মত একগুচ্ছ পালক, মস্তকাবরণ হতে পারে তিন ফুট উঁচু; অথবা সাদা মানুষের কাপড় চোপড়।

কিন্তু যে স্থানেই হউক না কেন নাচের সঙ্গে একটা ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে ও এই সৌন্দর্যসুষমা যেটা এই গ্রন্থের এই অংশে বিস্তারিত বর্ণনার স্থান না-একটা অথবা অপর দুটার মধ্যে যা মূলশক্তি জোগায় তার সঙ্গে আমরা পরিচিত এই জন্য যে, রং, গঠনশৈলী ও বিষয়বস্তুর মাধ্যমে যাদুমন্ত্র গভীর মোহাবিষ্ট করতে সচেষ্ট হয়।

একদিকে এট নাচুয়েকে প্রতিদিনের আত্ম-সচেতনাতা থেকে নিজেকে তুলে নিতে, নিজেকে নিজের থেকে মুক্ত করতে এবং তাকে প্রাণবন্ত জগতে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। অন্যদিকে এই অলংকারিকতাকে কল্পনাপ্রবণ অনুকরণাত্মক নাচের বৈশিষ্ট্যে গুরুত্ব দেয় । জীবজন্তুর নাচে পোষাক-পরিচ্ছদ এবং গুণাবলী অবশ্যই অনুকৃত জীবজন্তুর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের উপর হতে হবে।

ক্যালিফোর্ণিয়ার মাইডু হাঁস-নাচুয়েগণ মাথায় জালের টুপি পরে যেটা নরম পালক দিয়ে ঢাকা থাকে, নতুন আয়ারল্যান্ডের টোটেম নাচুয়েগণ রাইনোসাস পাখির বাঁকান এবং রং করা মাথা মুখে ধরে রাখে, ব্রাজিলের কবুউগণ পাতলা কাঠির সঙ্গে তার দিয়ে বাঁধা হালকা কাঠের পাখি, মাছ অথবা গুইসাপের আকৃতি বহন করে, প্রত্যেক জোড়া নাচুয়ে কাঠি তাদের বাহুর নিচে বহন করে যাতে অনুকৃতি (পাখি, মাছ) তাদের সামনে দোলা খেতে পারে।

আমরা এখনও ইউরোপের মাটিতে একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব দেখতে পাই ঃ উদাহরণ স্বরূপ ইংল্যান্ডে এবং দক্ষিণ-ফ্রান্সের ম্যালোরকায়, উত্তর-স্পেনে নাচুয়েগণ কার্ড বোর্ডের খেলার ঘোড়ার কটিবদ্ধ লাগায় এবং ম্যালোরকাতে ঈগল অনুকৃতিও চলে।

মুখোশেরও দুই রকমের অর্থ আছে। আমরা যতদূর দেখি, এটা বহির্মুখীতা বহন করে, কল্পনা জীবজন্তুর অনুকরণাত্মক বৈশিষ্ট্য কালচার করে অথবা অন্য প্রাণীর অনুকৃতি করে। অস্ট্রেলিয়া আমাদের এই সম্পর্কে বিশদ বিবরণ যোগন দেয়। অন্তর্মুখী কৃষ্টিতে এটা কোন বাস্তব আকারে প্রতিনিধিত্ব করে না কিন্তু তারচেয়ে একটা দৈবশক্তি যেটা শ্যামান (পুরোহিত) অথবা মুখোশ কারিগর স্বপ্নে রূপান্তরিত হতে দেখেছে।

যদিও মুখোশ তার বন্য এবং লাম্পট্যপূর্ণ ফ্যান্টাসীকে প্রায় কোন অর্থেই পবিত্র অথবা উদারভাবাপন্ন করে না কিন্তু তার চেয়ে বিকৃত করে বিদ্রুপাত্মক পর্যায়ে, আমরা জে, ডাব্লউ, হায়ারের মন্তব্য স্মরণ করতে পারি যে, ‘স্বতঃস্ফূর্ত বরং অদ্ভুত ধরণের ও বিদ্রুপত্মক ধারণা সত্যিকারের সংমিশ্রণ আমাদের কাছে কত বৈচিত্রময় লাগে” অবচেতন মনের অভিজ্ঞতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এটা।

অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর (ফ্যান্টাসটিক) উচ্চস্তরে এবং রং-প্রাচুর্যের শিল্পনৈপূণ্যের অবিচ্ছেদ্য অবস্থানে যেটা সবচেয়ে প্রভাবিত করে তা সন্দেহাতীতভাবে দেখা যায় উত্তর মেলেনেশিয়ায়। কি বিস্ময়কর জগৎ! শৃঙ্খলমুক্ত, সমস্ত জাগতিক বন্ধনমুক্ত, সৃজনশীল ফ্যান্টাসী নতুন আঙ্গিকে প্রক্রিয়াশীল যা প্রকৃতি দুই কঠিন ভাগে বিভক্ত করেছে ধরন এবং শ্রেণীতে।

একটা আকৃতি কোন রকমে সম্পূর্ণভাবে মানবিক দৃশ্যমান হয়ে উঠে, জঙ্গীপাখির প্রকান্ড ঠোঁটের উদ্ভব ঘটে, বিরাট মুখের মধ্যে দাঁত দেখা যায়, জিহ্বার পরিবর্তে এক মিটার লম্বা পোকা বিচ্ছুরিত হয়; লেজের বদলে লোভাতুর হাঁসের গলা অথবা কোবরা সাপের ফণা বাহির হয়। শরীরের অন্যান্য অংশ ও অবাস্তব পাস্থায় বিকৃত করা হয়।

শামুকের মত চোখ পাকায়ে বাহিরে দাঁড়ায়; ধড়ের সঙ্গে গলাছাড়া মাথা আঁটা, অথবা গলা মাথা ছাড়া ধড় থেকে উঠে, উপরের দিকে কাত হওয়ার মনে হয় খোলা মুখ দুইভাগে বিভক্ত, অথবা যেখানে গলা ও মাথা হওয়া উচিত, একটা তীক্ষ্ণ শঙ্কু (মোচাকৃতিবস্তু) হয়ত লাগান আছে।

অসম্ভব রকমের খিলানওয়ালা কপাল লম্বা মুখ-মন্ডলের অপেক্ষাকৃত উঁচুতে ছড়ান; দুই মুখ-মন্ডল একটার উপরে আরেকটা পরস্পরের দিকে দৃষ্টি রাখে; লোকটা একটা খাম্বাস্বরূপ দুই চোখ মধ্যখানে এবং একটা মুখ পায়ের উপরে। সকল অনুপাতিক হার কেড়ে নেয়, মাথার আকৃতি আকাশে পঞ্চাশ গজ উর্ধ্বের উপরে উঠে।

মুখোশগুলি এমনকি যাদুঘরের তাকের উপরে কাঁচের আধারে থেকেও নাচুয়েও স্থানীয় পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও তাদের কিছু না রহস্যজনক ও পৈশাচিক চরিত্রকে সংরক্ষিত করে। কিন্তু নিজে আত্ম-জগতের বাইরে, জীর্ন দশায় ও বিশ্বাসপ্রবণতায় উপরে তাকায় এবং অতি স্পর্শকতার, জঙ্গল থেকে ভয় প্রদর্শন করে আগে এসে ধায় ও কাছাকাছি থেকে ছন্দে চলে অমানবিক পদক্ষেপে, বেন্ড হয়ে অস্বাভাবিক দোলায়, ভূতের শব্দে—কি ভয়াল নাটক!

অবশ্যই ছেলেদের সূচনালগ্নে প্রথম যখন তারা ভয়ংকর মুখোশের উপর চোখ রাখে কি কাঁপুনী না তাদের মেরুদন্ডের মধ্য দিয়ে দৌড়ায়ে উঠানামা করে! আমরা সকলেই মুখোশ নাচের যথার্থ সূচনালগ্নের সেই রাজ্যে পা রেখে এসেছি  সেই স্বপ্নের জগৎ যেখানে আমাদের ভয়ংকর, বিভৎস ও ভয়াল অনুভূতিকে আমাদের যুক্তি ও বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তাদেরকে এলোমেলোভাবে অবিবেচনায় ভীতিসঞ্চারক অপচ্ছায়ায় কেন্দ্রীভূত করেছি।

পরবর্তী কৃষ্টির স্তরে মুখোশ ছোট হতে হতে শুধুমাত্র চিকন চোখ ও নাকে অবশিষ্ট আছে। বিশেষ করে জাপানী মুখোশের ইতিহাসে এই পরিবর্তন পরিস্কারভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই রূপান্তরের শেষ পর্যায়ে পূর্ব-এশিয়ায় “মুখোশহীনতায়” পরিবর্তিত হবার যুগসন্ধিক্ষণ হতে পারে; মুখোশের কঠোরতাই মুখমন্ডলে রংচং লাগাতে বাধ্য করে যা নিবিড় কোন প্রকার দৈহিক প্রকাশভঙ্গি নিষেধ করে এবং মুখাভিনয় করে, যেটা ই, জীমেট চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন une elegie a froid. অনুকরণাত্মক নাচের অঙ্গভঙ্গির অনেক কিছু মুখোশ ব্যবহারের জন্য প্রকৃতিগত দৃঢ় সংশ্লিষ্টতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।

যেমন আমাদের স্বাপ্নীল মানসদৃশ্যে তারা বাস্তব, বস্তুগত ও বোধগম্যতা ছেড়ে চলে এবং অবচেতন মনের অযৌক্তিক ধারার সৃষ্টিক্ষম উদ্ভট আজগবী চিত্রকল্পনাকে অনুসরণ করে । অনুকরণাত্মক নাচ ছেড়ে সেখানে প্রায় বিকৃত নাচের উদ্ভব ঘটে। নাচের (থিম) মূলভাব, বিষয়বস্তু মোটেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয় না।

মানুষের ও প্রকৃতির জীবনের কোন বিরাট ঘটনা এবং জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান করার বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়, পূর্বের মত নাচুয়েগণ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ অনুধাবন করতে পারে এবং ব্যক্তির অথবা জনগোষ্ঠীর জীবনে কি সুফল বয়ে আনতেপারে তা বর্ণনা করে। মুখোশ নাচে যে পয়েন্ট পার্থক্য করে সেটা হল কল্পনাপ্রবণ নাচ ও কল্পনাহীন নাচের কৃষ্টির বৈচিত্রতার সম্মিলিত রূপ।

যখন নিউ আয়ারল্যান্ডের নাচুয়েগণ দেখায় তাদের টোটেম (গোষ্ঠী প্রতীক) রাইনোসার পাখি শত্রুর দিকে সলজ্জভাবে তাকায় অথবা টোটেম পায়রা সাপের দ্বারা প্ররোচিত হয় যখন উর্বরতা (জীবনী-শক্তি) ও জীবন লিঙ্গপ্রতীক ধর্মীয় উৎসবে প্রাণোবন্তহয়ে উঠে, এই সকল প্রকাশভঙ্গি অনুকরণাত্মক এবং বহির্মুখী নাচের ভূখন্ড থেকে সম্পুর্ণভাবে চলে এসেছে।

গ্রান চ্যাকোর লেনগুয়া মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তির সূচনাকালে শয়তান অপদেবতা মুখোশের আড়ালে জঙ্গল থেকে দৌড়ায়ে বাহির হয় এবং কুমারীদের ঘিরে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় যতক্ষণ না নারীগণ তার চারদিকে ঘিরে নাচের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে অপদেবতার পিছু পিছু তাড়া করে তাড়ায়ে দেয় : অনুকরণাত্মক মূল শিল্পউপাদানের অল্প একটু হেরফেরের মধ্যে এটা কল্পনাহীন, যাদুকরী ঘূর্ণিয়মান অন্তর্মুখী কৃষ্টি।

উত্তর-পশ্চিম ব্রাজিলের কবিউদের এটা সম্পূর্ণ প্রতীকস্বরূপ যে, মুখোশহীন কালের পরে মাঠের রক্ষক দেবতা “কিউ”র কাছ থেকে তারা প্রথম মুখোশ নাচ শিখেছে যেটা তারা নিজেরা স্বীকার করে ঃ বহির্মুখী শিকারীর জগৎ ও টোটেম বিশ্বাসী এবং অন্তর্মুখী ভূমিকর্ষকারীদের মধ্যে মুখোশ নাচ একই সঙ্গে উদ্ভব হয়েছে।

কোন মৌলিক কৃষ্টিধারায় মুখোশ নাই এবং একইরূপে তারা অনেক মধ্য এবং পরবর্তী উপজাতীয় কৃষ্টিতে অনুপস্থিত উদাহরণস্বরূপ ঃ পলেনেশিয়ান, মাইক্রোনেশিয়ান, আইনু এবং আরো অনেকের মধ্যে নাই। নৃতাত্বিকদের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কযুক্ত সময়সূচী এই কালকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে : মুখোশ তথাকথিক “অসবর্ণ বিবাহ এবং মাতৃতান্ত্রিক” অথবা “মাতৃতান্ত্রিক দুইশ্রেণী কৃষ্টি”র মধ্যে এত অদ্ভুত যে, গ্রেবনার তাদের “মুখোশ কৃষ্টি” নামকরণ করতে পেরেছেন।

এটা উপজাতীয় কৃষ্টির মিওলিথিক স্তরের যেটা আমরা এই বইয়ের দ্বিতীয় অংশে মেগিনের অনুসরণে নাম দিয়েছি “আরলি প্লান্টর কাপ-ডি পয়িং কালচার” । আমাদের অবশ্যই বলতে হবে যে, এটা সত্যিকারভাবে এই কৃষ্টি না কিন্তু এটা সব সময় মনে হবে টোটেম কৃষ্টির সঙ্গে মিশেছে ও অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

মুখোশ নাচ থেকে বর্তমান কালের ইউরোপে দুটা প্রধান পথের উন্নয়ন হয়েছে। প্রথমটা একটা নিম্নগামী পথ ক্যাথলিক দেশসমূহে সম্পূর্ণ কার্নিভ্যালে (কার্নিভ্যাল-রোমান ক্যাথলিকদের লেন্টের উপবাসের পূর্বকালীন আনন্দোৎসব।

আনন্দমেলা, মেরীগো রাউন্ড, সাইজ শো ইত্যাদি) বিকৃত ও অপবিত্রভাবে সোজা দেখা যায়, যেটা পুরাতন উর্বরা উৎসবের শুধুমাত্র মুখোশ, ছদ্মবেশ (ভন্ডামী) ও যৌনতা ছাড়া কিছুই সংরক্ষিত করে নাই কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছে এমনকি শিশুদের জগতেও তারা মুখোশ ও ছদ্মবেশে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তে প্রাচীন মানুষের প্রবৃত্তি মিটায় “বিশ্বাস জন্মাবার অবিরাম স্পৃহায়” ।

দক্ষিণ ব্যাভারিয়ার একটা বিশদ বিবরণে দেখা যায় যে, এমনকি আজ পর্যন্ত বিশেষ করে স্থায়ীবসতকারী অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন পাথর যুগের কতখানি প্রত্যক্ষ যোগাগোগ আছে এবং কত পরিস্কর ও বিচিত্রভাবে তার যাত্রার প্রারম্ভের ভিত্তির স্তর হাজার হাজার বৎসর ভেদ করে বের হয়ে আসে। সমস্ত বিকৃতির মধ্যেও এখানে লক্ষণীয় যে, মুখোশ বহনকারীর প্রত্যোহিক ব্যক্তিত্ব গোপন করার সব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে ।

“বোকা বৃহস্পতির সকাল ৮ টায় শুরু হয়, ক্যার্নিভ্যালের গত তিন রাতের পর, পারটেন কিরচেনের সব বয়সের পুরুষ ছদ্মবেশে যায়-প্রত্যেক পুরুষ Gsichtl বা মুখোশ পরে যা কাঠ বাঁকা করে সজীব করে আঁকা হয়। এটা শক্ত করে বাঁধা হয় যদিও সেটা মাথার উপর ক্রস করে রাখা তারগুলি দ্বারা সরান যাবে, চুল সাদা কাপড়ে ঢাকা, Gsichtl এর এবং কাপড়ের উপরে মাথার পোষাক বাঁধা থাকে। খুব দক্ষতার সঙ্গে হস্ত চালনার মধ্য দিয়ে ভারী Gsichtl সময় সময় তুলে বিয়ারের মগ যাবার ব্যবস্থা করা হত।

ছদ্মবেশধারী তার বাহির হওয়া মুখ দুইহাত দিয়ে ঢাকে তারপর পান করার পর মুখোশ ফ্লাসের মত ঝটকা বেগে নামায়। ছদ্মবেশ ধরার প্রথম শর্তই হল নিজের পরিচিতি গোপন রাখা এবং অন্যের ছদ্মবেশ গায়ে পরে বা যেচে বাহির করার চেষ্টা খুবই খারাপ বলে বিবেচিত হয়।

 

মুখোশ নাচ

 

কিন্তু কোন সহজাত প্রশ্নের মধ্যে দলের কেউ যদি পরিচিতি ফাঁস হওয়ার মত বিপদাপন্ন হয়, সে তার এবং Gsichil সাজসজ্জ অবিশ্বাস্য রকম ক্ষীপ্রতার মধ্যে পরিবর্তন করতে পারে। অন্যান্য মুখোশধারীগণ তাকে ছোট ঘরে স্লিপ করতে পাহাড়া দেয় যেটা আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়; কয়েক মিনিটের পর একই আকৃতি ফিরে আসে কিন্তু অন্য লোক তার মধ্যে থাকে এবং এই ধরনের ঘটনা বারবার পুনারাবৃত্তির ঘটনা একই সন্ধ্যায় প্রয়োজন হতে পারে”।

দ্বিতীয় উত্তরণের পথ নির্দেশ করে যা আমরা দেখেছি মুখোশ নাচ থেকে নাটক।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment