আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় -মোচড় নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
মোচড় নাচ
এই নাচের নাম আপাতঃদৃষ্টিতে খেঁচুনি নাচের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে যার বর্ণনা ফকিরতান্ত্রিক (শ্যামনদের) নাচের আলোচনায় একবার করা হয়েছে। এখানে আমরা এ গ্রুপে চিহ্নিত করব ঐ সকল নাচকে যেটা শরীরের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া কিন্তু মৌলিক দেহ ভঙ্গির সঙ্গে সমন্বিত যা সচেতন ভাবে কার্যতঃ উন্নত।
সব মোড়ান নাচের দেহের ভিত্তি সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ শরীরের আনন্দঘন ঘুরা, বাঁকান যেটা আমরা জানি প্রসারিত করা। দীর্ঘ সময় নির্বিগ্নে শান্ত থাকায় শরীরের রক্তজমে যাওয়ার প্রতিকার স্বরূপ। কোন নাচই দুই দৃষ্টিকোণ থেকে নাচা যায় না। সুতরাং আমরা সম্ভবতঃ এইভাবে যেকোন মোড়ান নাচের সঠিক বিভাগ নির্দিষ্ট করতে পারি কিন্তু বিশেষ করে বিজ্ঞানের কাজে না যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে অন্যের অপ্রতুল বর্ণনার উপর।
উভয় লিঙ্গের অংশগ্রহনকারী প্রায় সমান সমান। কিন্তু চালিত দেহ ভঙ্গি একেবারে একচেটিয়াভাবে ছোট পদক্ষেপ সামনে ও পিছনে, এক পায়ে দাঁড়ান, দোলান, ঘুরান এবং শরীর সংকোচন। শুধু মাত্র ওয়াহাই, সিংহলী এবং অষ্টাকদের মোড়ান নাচে লাফ দিতে দেখা যায়।
“আনন্দঘন প্রসার ও ছড়ানই” মোচড় নাচের সংজ্ঞার জন্য পর্যাপ্ত না। এটা অবশ্যই বুঝতে হবে স্বাই চায় পরবর্তীতে ধারণ করতে এবং মোচড়ানোর উপর জোর দিতে, যার সংজ্ঞা প্রকৃতির বিরুদ্ধে, অধিকন্ত প্রত্যেক নাচ বিশেষ করে আদিমথাকে না এবং খবরও রাখে না।
অন্যদিকে প্রকৃতি যা দিয়েছে সেটা এড়ায়ে যায় এবং প্রকৃতির হাতে যা আছে বাধ্য হয়ে খেঁচুনি নাচের মডেল থেকে তা দিয়ে দেহ ভঙ্গির অবয়ভান্ডর সমৃদ্ধ করে এবং এমন কি নিশ্চিন্ত ভাবে বলা যাবে যে অতিকাল্পনিক অবাস্তব গুমট স্বপ্নের দৃশ্য থেকেও।
হায়রের বিবৃতির কথা আমরা স্মরণে আনতে পারি যে, “সত্যিকার সহজাত মিশ্রিত প্রবৃত্তি এবং অদ্ভুত বিচিত্র চিন্তা ভাবনা” যেটা আমাদের কাছে আশ্চর্য মনে হয়। আমরা একই সময়ে গথিক গীর্জার মর্যাদার কথা স্মরণে আনতে পারি। তারাও প্রায় একটা মর্যাদা এবং ভাবভঙ্গি দেখাত সেটা স্বাভাবিক থেকে কিছু না।
তারা স্বাভাবিক ভাব পরিহার করত; সত্যিকার ভাবে তাদের শারীরিক বাধা থেকে মুক্ত বলে মতে হত। তারা মোচড়াত, ভাঙ্গতো, মনে হত কোন হাড় তাতে নাই । একটা হর্ষোচ্ছাস শক্তি তাদের তৈরী করেছে প্রতিদিনের বাস্তবতার গন্ডীর বাইরে।
উত্তর-আমেরিকার উটি এবং সুমাত্রার সাকাইগণ নাচের মধ্যে সামনে আসার সময় পা আড়াআড়ি করে রাখার সময় কঠিন ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত, নাচের একটা অঙ্গভঙ্গি যেটা গথিক কালের নাচের ছবিতে দেখা যায়। এখানে আমরা সমন্বয়হীন কার্যক্রমকে প্রকৃতিগতভাবে ভান-ভন্ডামীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে দেখি ।
মোচড় নাচে বিচিত্র গতি প্রয়োজনীয় অংশ হলেও তার প্রতিক্রিয়া প্রায় দেখা যায় প্রসারিত আবদ্ধ ভঙ্গিমায় বাধাগ্রস্থ ঘুরার মধ্যে। যখন তারা তিন ধারায় তখন তারা একদলে একত্রিত হতে পারে যেটা (ঘোড়ার মুখে লাগান লাগানের লৌহদন্ড) খলিন ও বন্ধনীর (অবলম্বন) অবস্থানের সঙ্গে বর্ণনা করা যেতে পারে।
অষ্টাদশ রাজবংশের মৃত সৎকার নাচ সাধারণভাবে মিশরীয় সম্রাটদের শেষপর্বের নাচ যা কায়রো যাদুঘরে (প্লেট-৯) রক্ষিত চুনা পাথরের জীবন্ত প্রতিকৃতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ । নিকট প্রাচ্যের (প্লেট-১৭) পরবর্তী নাচের ধারার সহযাত্রী হিসাবে গণ্য করা যায় ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোচড়-নাচ খুব বাধ্যবাধকতাপূর্ণ তবুও শিল্পী সুলভ অঙ্গনে অবস্থান নেয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিধিবদ্ধভাবে দেহসংযোগর বাইরে মোচড়ায়। কম্বোডিয়ান দরবার নাচের মহিলা নাচুয়েগণ মহড়া কক্ষে পায়ের অগ্রভাগে বসে, একে অপরের আঙ্গুল পিছনে বাঁকায় যতক্ষণ না সমস্ত জোর বিবশ হয় তারা একে অপরের বাহু জোর করে বাঁকায় যা প্রকৃতিগতভাবে দেহ সংযোগে ঢিলা হয়েছে, একজন যদি কোন অংশ কোনভাবে ভাঙ্গতে চেষ্টা করে যতক্ষণ বাহুকে চল্লিশ ডিগ্রী পিছনে করতে না পারা পর্যন্ত থামে না।
কনুই ব্যায়মে একভাবে বেন্ড করায় তাদের নরম কচি হাড় অস্থিগোলক কে প্রশস্ত করে এবং অস্থি-বন্ধনীতে সম্প্রসারণ ঘটায়। শরীরের প্রত্যেক জোড়ায় কনুই এর মত ঝাঁকানীযুক্ত প্রশিক্ষণ দরকার । কম্বোডিয়ায় এবং বার্মাতেও বাহুদ্বয়, পা এককোণে বেন্ড করা হয়, কাঁধের ব্লেডকে একসঙ্গে ঠেলে দেয়া হয়, তলপেট শক্ত করা হয় এবং সমস্ত শরীর ঐ রকম খিলা ও বদ্ধনীর অবস্থানে থাকে ।
এখানে এবং অসংখ্য অ-ইউরোপীয়ান নাচে, পাশ্চাত্যের দর্শকদের পুতুল নাচের অদৃশ্যতার সমন্ধে ওয়াকিফহাল থাকা বাঞ্চনীয়! একজন বার্মীজ (মায়ানমার) শিশু এই রকম কুমারী নাচের নেতৃত্ব দেয় যে, “পাপেটের মত অন্যের ইচ্ছায় চলে সুতরাং নিরানন্দে লাফায়ে চলে।
প্রত্যেক সময় সে তার হাত-পা ছড়ায় যেন সেগুলি তারে ঝুলছে”। ফিজির নাচুয়ে মহিলাদের পা এই রকম যে “পুতুর-নাচের পা অদৃশ্য তারের সঙ্গে সংযুক্ত। পশ্চিম-আফ্রিকার ফ্যান ও সাইবেরিয়ার অষ্টাকদের নাচ দেখে পর্যবেক্ষকগণ পুতুলনাচের অদৃশ্য তারের কথা স্মরণ করতে পারে।
অষ্টাকদের দেহ ভঙ্গির বর্ণনায় আছে সবচেয়ে উন্মুক্ত এবং অস্বাভাবিক যেটা সেটা একটা কাঠের পুতুল যে রকম করতে পারে। উগান্ডার পিগমিগণ যারা সবচেয়ে নিপূণ নাচুয়ে তারা পর্যবেক্ষককে অনিবার্যভাবে চিন্তা করতে শেখায় যে, তাদের নাচ পুতুল-নাচের ভঙ্গির অচেতন প্যারোডি মাত্র।”
সেখানে পুতুল-নাচের খুব সচেতন সম্পর্ক আছে যেখানে নাচ একটা উচ্চ পর্যায়ের আর্ট হিসাবে বিবেচিত এবং একটা উঁচু স্তরে পৌঁছে। জাভার সুলতান পরিবারের নাচ কোন ভাবে জাভাবাসীদের পেশাদার নাচুয়েদের মধ্যে মডেল হিসাবে ব্যবহার হওয়ায় তার অধঃপতন হয়েছে।
জাভার মঞ্চে জীবন্ত নারী-পুরুষের নাচ এবং পাশাপাশি বৈশিষ্ট্যময় চামড়ার কাটা পুতুল, সাদা পর্দায় প্রাচীন বীর গাঁথা মূখাভিনয়ের মাধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী যেভাবে হউক পার হয়ে এসেছে। যদি ছায়াখেলা সত্যিকার নাচ থেকে নেওয়া হয়ে থাকে তবে প্রমাণিত বাস্তব সত্য যে, নাচ ছায়া-নাটক থেকে বল প্রয়োগে নড়ান ছায়ামূর্তির অঙ্গ বৈশিষ্ট্যের কথা বলে ।

জাভাবাসীদের নাচ সম্পূর্ণ ভাবে দুই ধারায় আছে। যতক্ষণ শরীরের অঙ্গ সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে এবং কোন বাধাগ্রস্থ হবে না ততক্ষণ এটা বিকশিত ও অতুলনীয়। “যদিও অন্যের ইচ্ছায় চালিত” । এই কয়টি শব্দ এই প্রকার নাচের আসল ইতিহাস। সর্ব প্রথমে পুরা খেঁচুনি নাচে যে ইচ্ছা ছিল তা “সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ হারায়” শেষে পুরান ম্যাক্সিকান, পূর্ব-এশিয়ান এবং ইউরোপীয়ান ব্যালে, যেখানে নাচুয়েগণ যদিও অন্যের ইচ্ছায় চলে।
“খেচুনির বস্তু ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু হর্ষোচ্ছাস যে ইচ্ছা থেকে ছড়ায়ে পড়ে তা স্বতঃস্ফূর্ত ও শিল্প নৈপূণ্যে ঢাকা । তথাপি তা তত স্বয়ংক্রিয় না, পুতুল নাচের মত নাচ তাদের মধ্যে কি উচ্চ প্রবৃত্তির মেধা? হিন্দুগণ এই প্রশ্নে তাদের দেশের প্রবচনকে নির্দেশ করবে যে “নাচুয়েদের পুতুল-নাচের তারের উপর পুতুলের মত হওয়া উচিত”।
সাদা মানুষেরাকবি হেনরিখ ভন ক্লেইষ্টের সুন্দর কথায় এর উত্তর হওয়া পছন্দ করবে ঃ একজন জীবন্ত নাচুয়ের চেয়ে এই পুতুলের কি কি সুযোগ আছে? সুযোগ ? সবার আগে একটা নেতিবাচক, আমার প্রিয় বন্ধু উদাহরণস্বরূপ ঃ এটা কখন বাধা হবে না। আপনারা জানেন বাধা বুঝা যাবে যখন মূলবিন্দু অঙ্গভঙ্গির কেন্দ্র থেকে অন্য কোন প্রান্তে থাকে।
যদিও অপারেটর তার তারের সাহায্যে বা সুতা ছাড়া স্বাভাবিকভাবে অন্য কোন বিষয়ে ক্ষমতা রাখে না, বাদ বাকী দেহাংশ হবে যা হওয়া উচিত, নিস্ক্রিয় সত্যিকার দোলন এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সহজ তত্ত্ব অনুসরণ করে-এ একটা চমৎকার গুণ যা আমরা আমাদের নাচুয়েদের মধ্যে খামাখা দেখতে চেষ্টা করি। তখন সত্যই এই সকল পুতুল নাচের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিহীনতার সুফল আছে।
তারা বস্তুর জড়তা সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেই শক্তি যার বিরুদ্ধে নাচ অন্য কিছুর চেয়ে কঠোর চেষ্টা করে কারণ যে শক্তি তাদেরপৃথিবীর সঙ্গে বেঁধে রাখতে পারে তার চেয়ে সেই শক্তি বড় যেটা তাদের উপর ভাসমান রাখে। বামনাকৃতির পাপেট ভূমিতে শুধু ধীরে চলার জন্য এবং ক্ষণস্থায়ী বাধা কাটায়ে তাদের দেহাংশের ঘোরাফেরায় শক্তি সঞ্চারের জন্য ব্যবহার করে।
নাচের অবসাদ নিরসনে আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন আছে সেই মুহুর্তে যেটা দৃশ্যতঃ নিজে নাচা না, যা দিয়ে হয়ত আর কিছু করা যাবে না, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে অদৃশ্য করে দেওয়া।” শেষে আমরা দেখতে পেলাম যে, “ কোন ক্ষেত্রে (বস্তুগত জগতে) প্রতিচ্ছায়া নিষ্প্রভো ও হালকা হয়ে আসে লাবণ্য দৃঢ়ভাবে ক্রমাগত ঔজ্জ্বল্য লাভ করে।
যেমন দুটা লাইন ক্রমাগত যেতে যেতে হঠাৎ একে অপরকে ক্রস করে অন্য পারে অবস্থান নেয়; অথবা খিলান আয়নায় প্রতিচ্ছাবির মত যার আবিরাম গতি সরায়ে নিলে হঠাৎ আমাদের সম্মুখে আবার এসে দাঁড়ায়। এইরূপ বোধ যেখানে ছিল সেই অসীমের দিকে যায়, সুন্দর সেখানে আবার উদ্ভাসিত হয়, এমন অবস্থায় যে, একই সময় এটা অকৃত্রিম আকারে মানব আকৃতি, যার নাই কোন চেতনা অথবা শুধু অনন্তশূন্য —যেটা হল মানব দেহের আদর্শ বা স্রষ্টায়।
আরও দেখুনঃ