আসন নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – আসন নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

আসন নাচ

 

আসন নাচ

 

এক স্থানে দোলান কেন্দ্রীভূত নাচ থেকে আমরা সোজা দাঁড়ান নাচ এবং আসন নাচ বা বসা-নাচে চলে এসেছি। যখন দোলার স্থান পায়ের উপরে হয় সক্রিয় নিম্নাঙ্গ স্বাভাবিকভাবে অচল হয়ে পড়ে এই কারণে যে, অপ্রয়োজনীয় শক্তিক্ষয় রোধ করে।

সভ্যতার প্রাথমিক স্তরে দেখা যায় উৎসব অনুষ্ঠানে নাচুয়েগণ এক জায়গায় বসে উপরাঙ্গের ব্যবহার করে। আন্দামানীয়দের বজ্র-নাচে কবিরাজ নাচের অনুষ্ঠানে মাঝখানে উঁচু পাথরে বসে গানের সমবেত সুরে সুর মিলায়ে বাহুদ্বয় দোলায়।

সভ্যতার আরো উঁচু স্তরে আসন নাচ বা বসা-নাচে শুধু নারীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অংশ নেয়। জার্মান কবি এডালবার্ট ভি, চামিশো বিশ্ব-ভ্রমণ বৃত্তান্তের এক অংশে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের রটাক দ্বীপের অধিবাসী সমন্ধে বলেন : “সন্ধ্যায় তারা আগুনের কুন্ডলীর চার পাশ ঘিরে বসে গানের নাচ করে। আনন্দের অতিশায্যে উত্তেজিত হয়ে সকলে শুয়ে পড়ে উচ্চ কন্ঠে সমবেত ভাবে গান গায়” ।

মাইক্রোনেশিয়া ও কালাহারিতে নারীগণ পায়ের গোড়ালীতে বসে, সামোয়াতে পা ক্রস করে বসে। এই নাচগুলি উর্ধাঙ্গের দেহভঙ্গিমার উপযোগী করে বানান, বাহুদ্বয়, হাত, তালি এবং ছোট্ট কাঠের কাঠি দিয়ে নৈপূণের সঙ্গে আঘাত করে।

লিগিবার্ট দ্বীপপুঞ্চের বুটারিটারী ও ক্রেমারে একজন জার্মান অভিযাত্রি পর্যবেক্ষণ করেন যে, হাততাতির খেলায় আমাদের শিশুগণ এখন পর্যন্তও পরিচিত : একটা মেয়ে উৎসবের ঘাসের স্কার্ট পরে রহস্যময়ভাবে বাড়ীর চিলেকোঠায় যাওয়া আরম্ভ করে তাকে তিনজন পুরুষ অনুসরণ করে। চারজন এমনভাবে বসে যেন টেবিলের চারপাশে বসে আছে, গান গায় এবং তাদের কোমর দোলায়।

তারা সামনা সামনি বসে হাতের তালুতে আড়াআড়িভাবে আঘাত করে একসঙ্গে, একজনের বাম হাত হলে অন্য জনের ডান হাত আবার বদলাবদলি করে, এই চারজন একই গোল হয়ে অথবা ডানে, বায়ে এবং ক্রস করে, তারা সাধারণতঃ খুব কমই ভুল করে। এই একই খেলা হিন্দুস্থানে, ক্যামেরুনে, আলগাউ, ক্যাটালোনিয়া (কাসটানা) এবং ইটালীতে পরিচিত।

সাধারণত : পূর্বে আসন নাচ বা বসা-নাচ সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ইয়াপ দ্বীপে যৌনক্রিয়া নাচকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়, পোনাপিতে পূর্ব-পুরুষ, তারা, ফল এবং জন্তুকে ঘিরে নাচ হয়। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের লিকিবে প্রধান ব্যক্তি একটা মাদুরে একদল মহিলার মাঝে বসে নাচের মধ্যে তার ধড় ঘুরায়, হাত মেলায় এবং চোখ ঘুরায়।

পলিওলিথিক উপাদানের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ দেখা যায় যে, নারীগণ পুরুষকে কেন্দ্র করে নাচে এমনকি মাইক্রোনেশিয়ার প্রাথমিক স্তরেও তা বিদ্যমান। এতদসত্ত্বেও আসন নাচ বা বসা-নাচ পরবর্তী স্তরের পর্যায়ভূক্ত। জে, ডাব্লউ, হায়র সম্ভবত সঠিক পন্থায় ছিলেন যে, গ্রুপ ভাগে আসন নাচ বা বসা-নাচে সাময়িক উত্তেজনা আধ্যাত্মিক ভারধারা সম্পন্ন।

মাইক্রোনেশিয়ান মিউজিকও অভ্রান্তভাবে দেখায় আধ্যাত্মিক উচ্ছাস ও সাময়িক উত্তেজনা আধ্যাত্মিক ভাবধারা সম্পন্ন । অধিকাংশ রেকর্ডে সামোয়ান মহিলাদের আসন নাচ বা বসা-নাচ উন্নতির চরম পর্যায়ে গেলেও সর্বতোভাবে ঠিক শিবের মত না। এখন আমরা ক্রেমারের আসন নাচের একটু বিশদ বর্ণানা পর্যালোচনা করব :

একটা দৃশ্য দেখার জন্য একদল লোক বাহিরে জড়ো হয় কেউ গান শুরু করলে অন্যরা তাকে অনুসরণ করে একই সময় গ্রাম্য কুমারী স্থানীয় নাম টাউপু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যায় মাথায় অলঙ্কার, গলায় মালা, বক্ষবন্ধনী, সমস্ত দেহ তেল মাখান, খয়রী রং এর মাদুর অথবা হয়ত শুধু টিটি (সিংহের চামড়া) আবৃত, সে কেন্দ্রস্থলের দিকে হেঁটে যায়।

যেখানে দশজনের সারিবদ্ধ পুরুষ ও মহিলা নাচুয়ে বসে আছে ঠিক তাদের মাঝখানে পাঁচজনকে উভয় পার্শ্বে রেখে গ্রাম্য কুমারী সমবেত গান শেষ হবার কাছাকাছি সময় বসে পড়ে। যখন গান শেষ হয় মাদুরে আঘাতের শব্দ করা হয় যাকে স্থানীয় ভাষায় টা-লে-শিভা বলে সেটা প্রকৃত নাচ শুরুর পূর্বাভাস হিসাবে চিহ্নিত।

এটা হাত নাড়ানর সঙ্গে চলে কিন্তু এই সময় কখন গান গাওয়া হয় না। এই পূর্বাভাস অধিকাংশে খুবই সংক্ষিপ্ত এবং প্রায়ই মিলিত ভাবে নাচা হয়। মাদুরের আঘাত হেস্বার মত লাগে, প্রথমে উভয় কাঠিতে পরে এক কাঠিতে আঘাত করা হয় এতে শব্দের উঠা নামার মত প্যাটান সৃষ্টি হয়। নাচুয়েগণ নিজেদের খালি হাতে তালি দেয় যষ্ঠজন ডবল বিটে (দ্বিগুণ লয়ে) আরম্ভ করে। তখনই পরবর্তী দেহভঙ্গি সম্পন্ন হয় :

ডান বাহু অর্ধেক সম্মুখে প্রসারিত, খালি হাত একই সময় ভেতর থেকে উপর দিকে উঠে ডান উরুতে খালি হাতে থাপ্পর দেয়, বাম বাহু দিয়ে একইভাবে করে; তখনই দুই বহু দিয়ে একই রকম করে; ডান হাত সামনে বাড়ায়ে হাতের পিঠ উপর দিকে বাম হাত ডানকাঁধের কাছে আসে একই সময় তালু উপরের দিকে দুইবার ঘুরে;

বাম দিকে একইভাবে হয়; ডানদিকে দুই হাত প্রসারিত এবং দুইবার তালু ঘুরান নিচ থেকে ভেতর দিকে এবং উপর দিকে: বামে একই রকম; দুই মুষ্ঠি একটা অপরটার উপরে ডান হাঁটুতে থাকে, বিপরীত দিকে দুইবার ঘুরে মনে হয় উপর দিকে একটি কাটি ধরে আছে; একইভাবে বাম দিকে ।

‘পরে কাছের অনেক ধরনের অতিরিক্ত উন্নয়নমুখি হাতের ভঙ্গি, শরীরের পাশে উভয় হাতের পিট টান করে রাখে এবং তারপরে বাহুর পিট, তালু বরাবর উপরে নিক্ষিপ্ত করা হয়। তখন হাতের পিট বাইরে আঘাত করে, উভয় খালি হাত সামনে নিক্ষিপ্ত হয় একই সময়ে দর্শকদের দিকে এবং এইভাবে কিছু সময়ের জন্য ধরে রাখে অথবা হাতদুটা মাদুরে সজোরে আঘাত করে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সম্ভবতঃ এটা কিভাবে তালি-নাচ করা হয় তার একটা উদাহরণ। ঘটনা ও দেহভঙ্গির ধরন অবশ্যই খুবই পার্থক্যপূর্ণ।সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা পর্যবেক্ষণ করা যায় তা হল ইউরোপীয়ান ব্যালের মত দেহভঙ্গি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিস্পন্ন হয়।এই সামঞ্জস্যপূর্ণ, লাস্যময় হাতের ভঙ্গিমা নাচের মান নির্ণয় করে ।

“যখন তালি-নাচ শেষ হয় টাউপু তখন পরিস্কার, উচ্চস্বরে সাধারণতঃ এককভাবে গান ধরে কিন্তু খুব হালকা ছন্দ থাকে । তারমধ্যে প্রথমে সমবেত কণ্ঠে আস্তে আস্তে, আনুষ্ঠানিকভাবে পরে ক্রমান্বয়ে দ্রুত ও উচ্চস্বরে। মাদুর চাপড়ানগণ পাগলের মত ডবল বিটে (দ্বিগুণ ছন্দে) কখনও ডেকটাইলিক (প্রথম আঘাত দুই অনাঘাত) ছন্দে, তাদের বাহু কখন সামনে পিছনে উড়ায়, তাদের শরীর দুলায়, কখন পাশে কখন সামনে এমনকি তাদের পা সামনে লম্বাকরে কাঁপায় ।

এটা একটা হৈ চৈ পূর্ণ সামাজিক কোলহল যেন একটা প্রচন্ড ঝড় যেটা হঠাৎ বিকট শব্দে ক্রমে ক্রমে শান্ত হয় তখন নাচও শেষ হয়” । এটা একটা চমৎকার উদাহরণ যে, কঠিন নিয়ম-কানন সম্পন্ন প্রদর্শণীর নাচ যার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হাত নাড়ান কেমন করে প্রচন্ড গতি সম্পন্ন, হর্ষোৎফুল্ল, খেঁচুনিযুক্ত উড়ন্ত বাহুদ্বয়, বিকট চিৎকার ও কাঁপান পা সম্পন্ন নাচের পাশাপাশি নিজের

অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। সামোয়ানদের হাতের নাচের ধরন তারাই অনুধাবন করতে পারবে যাদের জানা আছে বৌদ্ধদের ধর্মীয় পদ্ধতিতে (মুদ্রা) হাতের ভঙ্গি প্রকাশের বিশেষ মূল্য আছে এবং এটা ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি প্রকাশের ভাষার চিহ্ন বা প্রতীকরূপে বিবেচিত।

একসঙ্গে ধ্যান ও আবৃত্তি তৃতীয় রহস্যের সৃষ্টি করে যাকে বুদ্ধের চতুর্থ মানবজাতির গুণ বলে। হস্ত-নাচের আবসস্থল হিন্দুস্থান। এখান থেকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে পূর্ব দিকে পথ করেছে, এমনকি বৌদ্ধ ধর্মের আওতার বাহিরে জাপান, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া এবং পলিনেশিয়া পর্যন্ত। পশ্চিমে গ্রীসেও স্থানান্তরিত হয় এবং এর আরো দূরে পর্যন্ত । গ্রীসের নাচ এমনকি হাতের নাচ সমন্ধে আমরা পরে বিস্তারিত বর্ণনায় যাব।

হাতের নাচের একটা শাখা কম্বোডিয়ার নাচে এক কবির বর্ণনায় আছেঃ “সেখানে (তারা) এই পরিপাটি ছোট্ট নাচের কুমারী মেয়েরা যেন সুদৃশ্য গতিময় মৃগশিশুর রূপলাভ করে। তাদের লম্বা চিকন এক বাহু কাঁধ থেকে বরাবর সোজা নিচের দিকে টানা।দৃঢ় ভগ্নমূর্তি যদিও এককভাবে হাতের কব্জি পর্যন্ত, খেলোয়াড়ের মত হাত ছড়ান সচ্ছ কর্মচঞ্চল।

 

আসন নাচ

 

বাহঃ কি হাত! বুদ্ধের হাত ঘুমাতে জানে, যেন শোবার সময় শুতে জানে, আঙ্গুলের পাশে আঙ্গুল যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি বসে আছে। রাখা হাতের তালু বা সোজা দাঁড় করে রাখা হাত সদা উৎসারিত শান্ত নিঃশব্দ। কল্পিত হয় এই জেগে আছে!

এই ছড়ান বিক্ষিপ্ত আঙ্গুল মুক্ত ঘুরে ভেতর দিকে যেমন জেরিকোন গোলাপ পাপড়ি। এই আঙ্গুলগুলি আহ্লাদিত ও সুখি অথবা উদ্বিগ্ন লম্বা হাতের গোড়া থেকে সেটা বোঝা যায় যেন আঙ্গুল নাচে। সমস্ত শরীরই চলিষ্ণু—এই সদা ভারসাম্যপূর্ণ শূন্যে বিচরণশীল মহাবিশ্বের গায়ে গায়ে প্রাচ্যের স্বর্ণপ্রভা দেদীপ্যমান। রাইনার, এম, রিল্ক।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment