মূল বিষয় ও ধরন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – মূল বিষয় ও ধরন।যা “যুগ যুগব্যাপী নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

মূল বিষয় ও ধরন

 

মূল বিষয় ও ধরন

 

প্রত্যেক অনুকরণাত্মক নাচ মূখাভিনয়ের জীবাণু বহন করে। প্রত্যেক নাচুয়ে তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে নিজের মধ্যে অনুভব করে জীবন্ত এমনকি প্রাণহীনের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক বস্তু এবং নিজের দেহের মধ্যে পুনসৃজন করে তাদের আকৃতি, তাদের চলন এবং তাদের অস্তিত্ব, একজন অভিনেতা একটা মূখ-অভিনয় বিশেষ।

কিন্তু মূল বিষয় ও ধরন এই মূখ অভিনয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ও বর্তমান থাকে। একবার মনস্তত্ত্ববিদ জাঙ্গ মন্তব্য করেন : “ফ্রয়েডের কথা যে অচেতনতা ‘শুধু ইচ্ছা পোষণ করে’ অচেতন বহির্মুখী টাইপে প্রধানতঃ প্রয়োগ করে” । সত্যি বলতে কি অধিকাংশ অনুকরণাত্মক নাচ হল ইচ্ছা-নাচ।

তারা প্রতিনিধিত্ব করে মানুষের কি প্রয়োজন, কি আশা-আকাঙ্খা, নাচের মাধ্যমে তা পেতে সচেষ্ট হয় ঃ জনগোষ্ঠীর বংশবিস্তার ও পৃথিবীর উর্বরতা, সমৃদ্ধি, তারকার অনুগ্রহ, স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ জীবন, শক্তি, শিকারের ভাগ্য এবং বিজয়। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম আছে।

সংবেদনশীল বোধশক্তি, গঠন আকৃতি ও পুনসৃজনের কামনায় প্রত্যেক ধারণা দৃশ্যমান ও কর্মচঞ্চল অবয়ে মজবুত ভাবে অনুধাবন করার প্রবণতায় কতক প্রবৃত্তির মূল সুগভীরে নিহিত থাকে। এই ধরণের জাতিগুলি ও কৃষ্টিসমূহ কোন রকম সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই অনিবার্যভাবে তাড়িত হয় জীবনের সকল প্রকার ঘটনার ছন্দময় কর্মচাঞ্চল্য পুনসৃজন করতে।

তাই তারা ভবিষ্যতের সঙ্গে আশাহীন খাঁটি বর্তমানের নাচ নাচে। শিশুদের মত তারা শুধুমাত্র বস্তুকে শ্রদ্ধা করতে সক্ষম এবং জীবজন্তুর বৈশিষ্ট্য গানে পুনঃগণনা করে রেকর্ড রাখতে পারে এবং নাচে তাদের দেহভঙ্গি অনুকরণ করতে জানে।

আজকের এই অনুকরণে পূর্ববর্তী কৃষ্টির আকৃতি তারমধ্যে নেয়, আকৃতি-নাচে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রতিকৃতি অথবা বিদ্রুপাত্মক অঙ্গভঙ্গি করে অথবা বন্ধুত্ব, প্রেম, হিংসা এবং ঘৃণার প্রতিচ্ছবি করে। অন্য স্থানে এটা নিস্তেজ দেহভঙ্গির অনুকৃতি যেমন প্রাণহীন বস্তু প্রতিনিধিত্ব হয়।

নির্দিষ্ট করে বলা যায় মেলেনেশিয়া এই ব্যাপারে অক্ষয়। প্রত্যেক নিউ ক্যালিডোনিয়ান গ্রামে মৃতের স্মারক ভোজ উৎসব শেষে তার নিজস্ব অনুকরণ নাচ আছে যার মূল শিল্পউপাদান নেয়া হয়েছে জীবন্ত ও জড়-প্রকৃতি থেকে জীবজন্তুর জীবনের ঘটনা, সাগরের ঢেউয়ের উঠা, ভাঙ্গা ও মিলিয়ে যাওয়া নিয়ে এবং ঝড়ে গাছের ডাল ভাঙ্গা ও শিকড় উৎপাটন নিয়ে।

এই রকমের একটা নিউগিনির নাচের বর্ণনা করেছেন আর, নুহাউস “দুই সারির নাচুয়ে নৌকার প্রতীক নিয়ে, তিনজন নাচের নেতা বৈঠা সাজে চালক হয়, নৌযান প্রতিকূল বাতাসে চলতে গিয়ে পিছনে হটে এই ধারণা সারিবদ্ধ নাচুয়ে অদ্ভুত সুন্দর রূপে প্রকাশ করে, সাগর ক্রমান্বয়ে উত্তাল হয়ে উঠে, মোচড় দিয়ে, লম্পঝম্প করে, লাফ দিয়ে নাচুয়েগণ দ্রুত থেকে দ্রুততর করতে থাকে, নাচের নেতাগণ বৈঠার শক্তিশালী টানে উঠা নামা করে যেন দূর্যোগ অপ্রতিরোধ্য।

ঢেউ মাস্তুলের দড়ি ছিড়ে ফেলে (যে ব্যক্তি দিয়ে হয় সে মূল বিষয় ও ধরন অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়) এইভাবে নৌযানটি আয়ত্তের বাইরে চলে যায় এবং এদিকে সেদিকে ধাবিত হয় লোকজনের লম্পঝম্প বন্য থেকে বন্যতর হয়ে উঠে নৌ-চালকগণ ডান থেকে বাম দিকে জোরে জড় হয় যাতে নৌযান ডুবে না যায়। তারপর নাচ শেষ হয়” ।

পশ্চিম সাইবেরিয়ার অষ্টাকগণ গাছ কাটার মূখাভিনয় নাচেঃ একজন কাঠুরে হয়, অন্যরা গাছের কান্ডের প্রতিনিধিত্বকারী স্থির দাঁড়ায়ে থাকে, পরবর্তী জনেরা তাদের জীবন্ত দেখাতে চায়, তাদের আবৃত করা কাপড়-চোপড় ছুড়ে ফেলে কাঠুরের সঙ্গে নাচতে আরম্ভ করে।

আর্কটিকের অলুশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে দুইজন পুরুষ পাখি-শিকার-নাচ করে, পাখি পরে যায়, ধরা হয়-একজন সুন্দরী মেয়েতে রূপান্তরিত হয় যে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে শিকারীর বাহু সংলগ্নহয়ে যায়। এখানে রূপান্তরের মূল শিল্পউপাদান সুষ্পষ্টভাবে বিরক্তিকর নাচের আয়ত্তের বাইরে সংগঠিত হয়েছে, যেকেউ নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হবে পৌরাণিক কথা ও রূপ-কথার গল্পের থিম (বিষয়-বস্তু) অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল রূপান্তর-নাচ থেকে উৎপন্ন হয় নাই।

এখানে মূল বিষয় ও ধরন  যা ঘটে তা একটা শিল্পকর্ম, যেমন অন্য সব নিউগিনির ভোজ উৎসবের নাচের প্রস্তুতি চলে আগাম থেকে সপ্তাহ, মাস ও বৎসর ধরে যতক্ষণ না প্রত্যেক দেহভঙ্গি ও নাচের অবস্থান সুদক্ষ হয়ে উঠে। এই জন্য শুধু এটার এই দক্ষতা, এই সচেতনতা এবং (ছক বদ্ধ বিস্তার) গণনাপূর্ণ বিন্যাস ও সূত্রবদ্ধকরণ, যেটা আর্টকে খেলা ও উন্নতকরণ থেকে পার্থক্য করে। কিন্তু এই শিল্পকর্ম তা সত্ত্বেও নাটক না ।

এটা প্রত্যাহিক জীবনের একটা বিভাগকে তুলে ধরে কোন রকম শুরুও নাই শেষও নাই। এটা বর্তমান কালেও বর্তমান। প্রকৃত নৃত্যনাট্যের প্রারম্ভ যাত্রাপথ অতিক্রম করে তখনই যখন অতীত সচেতনভাবে শুরু হয় এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে নাচের থিমে প্রবেশ করে।

নাচের থিমে অতীত সম্পর্কিত উপাদান জঙ্গীরূপে উৎসারিত হয়। এখানে এটা জীবন মৃত্যুর ব্যাপারের চেয়ে অবাক করে যে ঘটনা তার স্মরণে ছাপ রাখে এবং তা ক্রমাগত অভিব্যক্তি পুনঃ প্রকাশে তাগিদ দেয়। আমাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি যেটা প্রায় প্রায়ই পুরুষের ঠোঁট খুলে রাখার চেয়ে অবরুদ্ধ করে থাকে।

একই রকমভাবে আদিবাসীগণ তার নিজের গল্প নিজের মতন করে বলতে পছন্দ করে এক অস্থির গানের স্বরে যেটা নাচের সঙ্গে সঙ্গত হয় (পরিবেশিত)। সিয়াসদের মধ্যে ক্যাটলিন “কুকুর নাচ” দেখেছেন “যাতে প্রত্যেক পুরুষ তার নিজের কাজকর্মের গান সজোরে গায় যতক্ষণ অন্য কারো কানে তালা না লাগে” ।

ইন্ডিয়ানদের স্ব-চিৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে এমনকি পরিমিত আত্মজীবনীমূলকবোধে এটা ইতিবৃত্তিকৃত রূপে বলা খুবই অসম্ভব ব্যাপার। এই অংশের অতীত হয়ে উঠে আভিজাত্যহীন সম্পূর্ণ বর্তমান। একজন দেখেন নাচুয়েগণ “তাদের অস্ত্র আগুনের জ্বলকের মত ঘুরায় মনে হয় পরস্পরকে ঐখানেই কেটে টুকরা করে ফেলবে, একই সময় তারা মুখমন্ডল বিকৃত করে বিভরূপে এবং দাঁত শান দেয়, তারা এমন ব্যবহার করে যেন তারা যুদ্ধের মাঝখানে আছে”।

কিন্তু সেই একই কৃষ্টির রাজ্যে এই অতীত স্মৃতি মন্থন চূড়ান্তভাবে উপরে উঠে শিশুসুলভ আত্মপ্রশংসা থেকে নাটকের শেষ সংলাপ ও ইতিহাস হয়ে থাকে। যখন একজন সাক্স ও ফক্স ইন্ডিয়ান সদস্য যুদ্ধে নিহত হলে তাদের মধ্যে সুন্দর নাচের প্রথা আছে যেটা প্রতিদিন এক ঘন্টা করে পনের দিন তার উইগওয়ামের (রেড ইন্ডিয়ানদের চামড়ার চোঙ) সামনে করা হয় এবং তার শোকাভূত বিধবা স্ত্রী যারা রয়ে গেছে তাদের উপহার দেয় এবং গানের মধ্যে বাহুর সাহায্যে তাদের পতিত সহযোগীর বীরত্বপূর্ণ কর্মের প্রশংসা করে।

যখন গ্রান চ্যাকোর টোবাগণ যুদ্ধের অগ্রযাত্রা করে তখন তারা প্রার্থনা নাচ অনুষ্ঠান করে তারমধ্যে গানের মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বপূর্ণ জঙ্গী কাজের প্রশংসা করে। তাদের নাচগুলি অবশ্য কল্পনাহীন রয়ে গেছে। বর্ণনাগুলি বাস্তবসম্মতভাবে প্রতিস্থাপিত করার কোন চেষ্টা করা হয়নি এবং এমনকি ইন্ডিয়ানদের অস্ত্র ঘুরান আবেগপ্রবণ কিন্তু অনুকরণাত্মক না ।

এটা পরিস্থিতিকে পরিচ্ছন্ন করে। স্মরণশক্তি অন্তর্মুখী হয়। এটা প্রয়োজন অনুসারে মানুষের কল্পনাপ্রবণ দিকের কর্মতৎপরতা কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধি না। যদিও থিমসহ স্মৃতি-মন্থন কল্পনাহীন নাচে প্রথম প্রকাশ পাবে। এটা এইরূপ হবে ।

যদিও স্মরণশক্তি একটু আগের ঘটনা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ায়ে ধরে রাখতে পারবে না শুধুমাত্র বর্তমান কেউই-কিন্তু যেটা সুদূর অতীতে তাকে সজোড়ে ধরে আছে যেমন প্রাচীন ভ্রমণগাঁথা এবং প্রাকৃতিক উপাদান স্মৃতি চিহ্ন হয়ে সংরক্ষিত হয়ে আছে, যেমন সচেতন ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারা পূর্ব-পুরুষের ভয়ার্ত প্রগাঢ় ভক্তিতে আকৃতি পায় ।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় অতীত ও বর্তমানের বিভাজন খুবই ধীরে ঘটে। তাতে তার সরল আদিবাসী লোকেরা বাস্তবতা অনুভব করে যেটা আমাদের কাছে আবছা সাদৃশ্য হয়ে উঠে-অতীতের জীবন্ত অস্তিত্ব। এইটা তারই অবদান যেটার সার্বক্ষণিক প্রতিনিধিত্বের জন্য সম্ভব ও অত্যাবশ্যক হয়েছিল ।

যদিও প্রতিনিধিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মনোবৃত্তিকে আহবান করে : কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তি সংবেদজ ব্যক্তির আনুকূল্য চায় যখন সে স্মরণ শক্তিতে মজবুত আঁকড় দেবার ইচ্ছা পোষণ করে, সংবেদজ ব্যক্তি অতীত সচেতন সমৃদ্ধ নাটকের ধারণায় পুরস্কৃত হয়।

এইরূপে আমরা এখানে সেখানে লক্ষ্য করি অনধিকারলদ্ধ চিত্রিত বর্ণনার জগতে সংকীর্ণ পর্যায়ে যুদ্ধের স্মৃতি উৎসব-উদাহরণ স্বরূপ পৃষ্ঠা-২০ এ বর্ণিত ক্যারোলিনসের প্লাউ দ্বীপপুঞ্জের নারীদের নাচে মূল শিল্পউপাদান বলা হয় গত যুদ্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।

এমনকি এইরূপ ব্যাপারের মত সেখানে সমস্ত অপকটতার মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রত্যক্ষ্য শিহরণের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি চ্যালেঞ্জের গূঢ় অর্থকে কম জোড় দেয়। সত্যিকার অর্থে প্লাউতে পুরুষেরা তাদের অজ্ঞাতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় : “সেটা নারীদের নাচ যেটা তারাই শধু ব্যাখ্যা করতে পারে। যখন আমরা পুরুষেরা নাচি নারীগণ তার কিছুই বুঝতে পারে না” ।

আমরা এরই মধ্যে মুখোশ নাচের দুটা মূল শক্তির প্রভাব ও ফলপ্রসূ মিলন দেখেছি ঃ কল্পনাপ্রবণ, অন্তর্মুখী আকৃতিহীন এবং বোধশক্তি সম্পন্ন বহির্মুখী অনুকরণাত্মক। বৃহত্তর উন্নতি যেটা এখন স্থাপিত হয়েছে তা শক্তি ও উদ্যোগ গ্রহণ করে পূর্ব- পুরুষ পূজার কল্পনাপ্রবণ মনোবৃত্তির সঙ্গে অনুকরণাত্মক নাচের লক্ষ্যবস্তুর অনুভূতির একই ধরনের সম্মিলন হতে।

পূর্ব- পুরুষ হয়ে উঠে প্রকৃতির সমস্ত শক্তির বাহন ঃ সে উর্বরা শক্তির অপদেবতা অথবা বিজয়ের অপশক্তি, চাঁদ-দেব অথবা সূর্যদেবতা। যাইহোক, নাচুয়ে ভরপ্রাপ্ত হয়, তার ঈথারে পরিণতি এবং পূর্ব-পুরুষের দেবত্ব আরোপণের দ্বারা সে রূপান্তরিত এই শক্তির মত চলাচল করতে বাধ্য হয়, ঐ সকল মূখিভেনয়ের চক্রের মধ্যে আঁকা হয় উর্বরা-শক্তি, বিজয় ও নক্ষত্রের গতি পথে চলার সুস্পষ্ট কর্মকান্ড।

নাচুয়ের কর্মপদ্ধতির এই সকল সমন্বয় প্রয়োজনীয়ভাবে নাটকে উত্তরণ ঘটে। জাপানের শ্রদ্ধাস্পদ “নো” নাটক এসেছে সিন্টো কুমারী ধর্মযাজিকার ধর্ম-মন্দির নাচ থেকে, যাতে মৃতের আত্মা হাঁটে, হিন্দু অভিনেতা প্রাকৃত (প্রাচীন ভাষা) নট পদবীদ্বারা নাচুয়ে হতে নিজেকে নিজেই স্বীকৃতি দেয় যেটার সমার্থক সংস্কৃত নাট্য নেয়া হয়েছে নার্ট “(নাচ করা বা) নাচা” থেকে।

অর্থবোধক দেহভঙ্গির চেয়ে মানবজাতির বীরত্বপূর্ণ কর্ম ও ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিণতি ক্রমান্বয়ে বর্ণিত করতে অগ্রসর হয়। উর্বরা-শক্তির অপদেবতা ঋতু চক্রের ছন্দময় পরিবর্তনের বিধির নিয়ামকের কাছে অবশ্যই আত্মবিলয় ঘটাবে। সে অবশ্যই বসন্তে ও গ্রীষ্মে আর্শীবাদ বয়ে আনে, কিন্তু একই সময় তারা পূর্ব-পুরুষদের বিশ্বে অদৃশ্য হয়ে যায়, যার স্মৃতি ভক্তি সহযোগে অমূল্য সম্পদরূপে ধারণ করা হয় বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক কৃষি-সভ্যতার কৃষ্টিতে।

জীবজন্তু, পূর্ব-পুরুষ এবং প্রকৃতির শক্তি সহযোগে এবং প্রাকৃতিক নিয়ম বুঝাবার ক্ষমতা, স্বপ্নের অভিজ্ঞতা বা (স্বপ্নাবিষ্টতা) এবং উপজাতীয় ঐতিহ্য অপূর্ব নাটকে সম্মিলিত হয় যেটা একই নিঃশ্বাসে মানুষের ভাগ্যকে মহাজাগতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত করে এবং মহাবিশ্বের উপাদানকে মানুষের প্রেক্ষাপটে রূপান্তর করে।

এই ধরনের উন্নয়নের স্তরে, নাটকীয় ডিথাইরাম্বস গ্রীসের ডায়নোসাস নাচুয়ে অগ্রসর হয়, এ্যাবাইডসে মিশরের উৎসব-নাটকে পুরোহিত ও জনগণ একসঙ্গে অসিরিস (মিশরের প্রাচীন দেবী) এর মৃত্যু ও পুনরুত্থান চিত্রিত করে ।

এ্যাবাইডস উৎসব মিশরের জন্য একটা উন্নতির সর্বোচ্চসীমা, যেটা আমরা জরীপ করতে সক্ষম হয়েছি যদিও খুবই বিক্ষিপ্ত তার প্রমাণ যেটা ধরা যায় তিন হাজার বৎসরের অধিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত-তিনহাজার বৎসর যেটা সংরক্ষিত এলাকায় ঘনীভূত যার পরিস্কার চিত্র এই অধ্যায়ে বর্ণিত : কেমন করে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী প্রবণতায় উচ্চ কৃষ্টির প্রদর্শনীর নাচ উৎপত্তি লাভ করে যেটা পর্যায়ক্রমে পৌরাণিক নাটকে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়।

মিশরীয়দের জন্য যেমন গ্রীকদের জন্যও নাচ হল “আনন্দ” নামই তার নিজের ইঙ্গিত দেয়, দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে থুটমশিশ-১ম (প্রথম) তাঁর মেয়ে হেকচেপসোয়েটকে তাঁর উত্তারাধিকার স্বীকার করবার পর রাজসভার সদস্যগণ আনন্দে আগেয়ে যান, নাচেন এবং হৈহুল্লারে অংশ নেন এবং তাঁর অধীনস্থ সবাই নাচেন ও লম্পঝম্প করেন। সম্পূর্ণভাবে একই সময় একই রকমের অসংগঠিত আনন্দের নাচ আমারনাতে আকৃতি পায়।

কিন্তু কোন নাচের অসংখ্য ছবি বা কোন সাহিত্যকর্মের মাধ্যম সতিকার কোন সামাজিক নাচ প্রকাশ করে না। এমনকি সভ্রান্ত মিশরীয়দের যাদের জীবন স্মৃতিন্তম্ভে রেকর্ড করা, জানে না সংঘবদ্ধ নাচ যাতে অন্যের সঙ্গে অংশ নেয়া যায়, কোন যুগল নাচ বা একক নাচ নাই।

অন্যদিকে যেমন মনে করা হয় কৃষকদের যারা উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির ধর্মীয় প্রথায় উৎসব করে নাচে যেটার প্রমাণ ২৭০০ খৃঃপূঃ গীজায় প্রাপ্ত পঞ্চম রাজবংশের কবরের উপরে রিলিফে উন্নত সংঘবদ্ধ ফসল নাচ উৎকীর্ণ। এটা পরবর্তী সময়ে কোন পরিবর্তন ছাড়াই হয়ত বা হস্তান্তরিত হয় ঃ কোন কোন নাচকে অনায়াসে বৃষ্টি আবাহনের যাদুমন্ত্র বলে ধরা যায়।

কিন্তু এরই মধ্যে সেই সময়ে উচ্চশ্রেণী নাচকে অন্যদের কাছে ছেড়ে দেয়। যেটাও পঞ্চম রাজবংশের অন্তর্গত টম অব “টি”র উপর প্রচলিত শবযাত্রায় নাচের স্কর্ট চিত্রিত, ছাপচিত্রের পাঠোদ্ধারে ব্যাখ্যা করা যায় যে, “হেরেমের অংশ বিশেষ নাচ”। সত্যিভাবে বলা যায়, প্রাক্-রাজবংশের কালের (চতুর্থ সহস্রাব্দে) অলংকৃত পাত্র থেকে দেখা যায় একজন নারী পেশাদার নর্তকীর মত কৃত্রিম পোজ দিয়ে আছে।

(মিশরীয় মন্দির নারী-পুরুষ উভয় নাচুয়েকে বিশেষ শ্রেণীতে পালন করে। ধর্মীয় পদ্ধতিতে আমরা তাদের বার বার দেখতে পাই, যেমন আমাদের বর্ণনায় দেখা যায়, হয় শান্ত নাচে খুব নরম পদক্ষেপে বাহুদ্বয় দুইদিকে প্রসারিত সমকোণী চতুর্ভুজের মত অথবা খুব ভয়হীন এ্যাক্রোব্যাটিক অবস্থানে, সেতুর মত, হাত দাঁড়ান বা হাতে মোমবাতি (প্লেট-৮)।

এখানে যে এ্যাক্রোব্যাটিক নাচ, যার উৎস আমরা হর্ষোল্লাসে লক্ষ্য করেছি তা এখন পর্যন্তও ধর্মীয় কর্মকান্ডের সুচনায় বেঁচে আছে-নিশ্চিন্তভাবে এরই মধ্যে উদ্ধার করা গেছে খাঁটি হর্ষোল্লাস হতে শিল্প নৈপূণ্যে রূপান্তর, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত যাদুতান্ত্রিক শুধুমাত্র জিমন্যাসটিক ব্যায়াম না। অনেকবার গোলাক নাচকে বিভিন্ন অবস্থানের ভঙ্গিতে অঙ্কিত করা হয় যেমন স্থির চলচ্চিত্রের মধ্যে তারা নাচের আকৃতি ধরে আছে। এটা খুবই কষ্টকর না, তাই সেই একই পদ্ধতিতে তর্জমা করলে সে সত্য পাওয়া যায় যে, নাচের জন্য নাম ‘ইবা” অর্থ হল পুরুষের ড্রাট্স খেলা ।

এমনকি সেই সময় সত্যিকার প্রভুত্বকারী কৃষ্টির বলয়ে থেকেও যে সমস্ত দেশ নাচের জন্য খ্যাত সেখানে থেকে একক নাচুয়ে আমদানী করত এমনকি ধর্মীয় পদ্ধতির প্রথার জন্য। স্মৃতি-সৌধ এটার প্রমাণ, কিন্তু তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ মনোমুগ্ধকর আবেগময় চিঠি যেটা রাজা নেফারকেয়ার তার সৈন্যের ফিল্ড মার্শালকে ইথিওপিয়ান বামন নাচুয়ে সম্বন্ধে লেখেন :

“আপনি আপনার চিঠিতে জানিয়েছেন যে, অপশক্তি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে দেবতার উদ্দেশ্যে নাচার জন্য, আপনি একটা ড্যাংগ পিগমি এনেছেন, সে পিগমিদের মত যেটা স্বর্গীয় অধিকর্তা ব্যা-উর-টেইট এসিসার সময় নিয়ে এসেছিলেন।

আপনি আমার দরবারে জানিয়েছেন যে তার মত কাওকে কেউ পূর্বে নিয়ে আসতে পারে নাই সত্বর রাজ দরবারে নৌকা করে চলে আসুন –আপনার সঙ্গে এই পিগমিকে নিয়ে, যাকে আপনি জীবন্ত, পূর্ণাঙ্গ ও প্রাণবন্ত অবস্থায় অপশক্তি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে আনবেন, যেন সে দেবতার নাচ নাচতে পারে, এবং সে যেন আনন্দের কিং নেফারকেয়ারের (যে চিরন্তন জীবন যাপন করে) হৃদয় সুখী করতে পারে।

আপনার সঙ্গে সে যখন নৌকায় বাইরে যাবে বিশ্বস্ত লোকজন তার দুই পাশে নৌকায় থাকবে। সতর্ক থাকবেন যাতে সে পানিতে না পড়ে যায়। যখন রাতে সে ঘুমায়ে যাবে তার পার্শ্বে বিশ্বস্ত লোকজন ঘুমাবে এবং রাতে দশবার তার প্রতি নজর রাখবেন। আমার মহামহিম দেখতে ইচ্ছা পোষণ করেন বিয়া-টা ও পশুনী থেকে পাওয়া উপহার থেকেও এই পগমী অধিক উৎকৃষ্ট।

আপনি যদি এই জীবন্ত, পূর্ণাঙ্গ ও প্রাণবন্ত পিগমি সহকারে রাজদরবারে হাজির হতে পারেন তবে আমার মহামহিম এসেসার সময়ের স্বর্গীয় অধিকর্তা ব্যা-উর-টেইট থেকে আরো অধিক কিছু আপনার জন্য করবে, আমার মহামহিমের একান্ত লালিত ইচ্ছা এই পিগমি দেখে যাওয়া” ।

তৎসত্ত্বেও এই চিঠি তাৎপর্যময় যদিও চিঠি লেখক খুব সম্ভব এখন শুধু একটা বালক। এটা তৃতীয় সহস্রাব্দে ঐ সকল নিলোটিক বামন লোকের আর্টে প্রত্যাবর্তনের প্রমাণ, আজ পর্যন্ত এই সকল বামন লোক পূর্ব আফ্রিকার খ্যাতিমান নাচুয়ে ।

যদি এটা এই সকল নাচে সম্ভব হয় বিশেষ করে সংঘবদ্ধ ও এ্যাক্রোব্যাটিস দৃষ্টিভঙ্গিতে, দূর হতে দেখে স্পষ্টই বোঝা যাবে অন্তর্মুখী, অনুকরণহীন নাচের দিকে বহমান তথাপি সেখানে বহির্মুখী অনুকরণাত্মকের সংমিশ্রণের অভাব নাই যেটা উচ্চকৃষ্টির জন্য অপরিহার্য্য।

কখন কখন কুমারী নাচুয়ে কেমন করে রাজা পরাস্ত শত্রুর প্রতি পড়ে অথবা কেমন করে বাতাস গাছপালা উৎপাটন করে এবং ডালপালা আঘাত করে এবং পুনরায় তারা “সুন্দরী অপহরণ” করে অথবা “জন্মগ্রহণের গোপন তথ্য” অভিনয় করে। এখানে আমরা লক্ষ্য করি যে, পুরাতন আবহাওয়ার যাদুমন্ত্র এবং জন্ম-যাদুতন্ত্র তাদের ভক্তিময়তার তাৎপর্য হারায় এবং শিল্প সম্মত নাচের মূখাভিনয় হয়ে উঠে ।

১৯৯০ খৃঃপূঃ মধ্য সাম্রাজ্যে বীজ বর্দ্ধক দেবতা যে মরে যায় আবার জেগে উঠে, পুরাণ কাহিনী এই মুখাভিনয়ে প্রবিষ্ট হয় ঃ এ্যাবইডসের অসিরিস উৎসবে জানা যায় “সেসোসট্রিস-৩” এর সময় পর্যন্ত অস্তিত্ব বজায় রাখে। ল্যুভরে (মিউজিয়াম) রাখা রিলিফ থেকে বুঝা যায় সেখানে কি ঘটে ছিল।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অবশেষে আমরা দেখতে পেলাম ‘মুখোশ নাচুয়ে” যেটা আমরা অবশ্য চেতাম না যদি নাটকের দিকে প্রসারিত পথে ভ্রমণ করতাম। পুরুষ মানুষ অদ্ভুত ধরনের মাথার ভূষণ নিয়ে দেবতার পুনরুত্থানের জন্য নাচে, “বাজ মাথার” আত্মা জাগরিত দেবতাকে উল্লাসে চিৎকার করে অভ্যর্থনা করে।

এটা সম্ভবত প্রতিবাদিত হতে পারে যে, কবর-ফলক নাটকের উৎপত্তি ঘটায় তার কোন প্রমাণ নাই এবং ফলশ্রুতিতে “মুখোশ নাচুয়ের” আকৃতি প্রতিফলিত হয় খুবই নড়বড়ে অবস্থায়, সম্ভবতঃ পৌরাণিক ঘটনা নিজেই কল্পিত হয় এইরূপে।

কিন্তু নাচুয়ে অভিনেতার কি ভাস্কর থেকে এটার ভিন্ন চিন্তা-চেতনা আছে? গীর্জার দেয়ালে পবিত্র দৃশ্যের পুনস্থাপন এবং মধ্যযুগের ইউরোপের অঙ্কিত চিত্র একই সময় কি পুনরুৎপাদনের প্রতিনিধিত্বকারী এই সকল দৃশ্যের রহস্যময় নাটক? অধিকন্তু প্যারিসে রাখা ছবিতে কবর-ফলক প্রত্যক্ষভাবে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত যেটা পৌরাণিক গল্প কিছু বলে না তার চেয়ে এ্যাবইডসের উৎসরের কথা বলে ।

এর সঙ্গে শুধুমাত্র মিশরীয় নাচের উন্নয়নের কথা সমাপ্ত হল। এটা চিহ্নিত কঠোরতায় এবং ছড়ান দেহভঙ্গিতে এমনকি মেয়েদের নাচেও সর্বোতভাবে বৈশিষ্ট্যময়। প্রায় ১৫০০ খৃঃ পূর্বে এটাতে একটা পরিবর্তন আসে। যেমাত্র নিকট-প্রাচ্য জয় করা হয় সেই সময় এর জাতীয় বৈশিষ্ট্যের মিউজিক হরণ করা হয় এবং তাতে নারীসুলভ এশিয় সম্পর্কিত ছাপ দেয়া হয় যাতে বিজিত দেশের বহিরাগত বীর পুরুষগণ স্থানীয় নাচুয়ের পাশে স্থান করে নিতে পারে।

এই নতুন নাচ, যেটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের চিত্রে বর্ণিত হয়েছে (প্লেট-৮,৯) এবং ভোজ উৎসবে, বিধি নিষেধহীন দেহভঙ্গি, বিরাট পদোত্তলন করা, খাঁড়া ঠায় থাকা এবং কৌণিক দেহ সঞ্চালনে কোন কিছু আর পৌরুষদৃপ্ত নাই। লাইন চলে শান্ত ও সুন্দরভাবে, কোথাও বাঁক খায়না ও লাইন ভাঙ্গে না, এমনকি যেখানে মুড বা মনোভাব আবেগপ্রবণ ও অস্থির হয়ে উঠলে দেহভঙ্গি বন্ধ রাখা হয়। এটাই এশিয়ার মেয়েদের অবদান যারা মিশরীয় নাচে সত্যিকার ভাবে নারীসুলভ ষ্টাইল নিয়ে এসেছে। এখন আমরা এশিয়ার নাচের দিকে যাব।

নাটক ও গল্প, পৌরাণিক কথা ও রূপকথার গল্পে অতিরঞ্জিত কথার প্রয়োজন, যেটা তীব্র ইন্দ্ৰিয়ানুভূতিবোধ সক্ষম ও বাস্তবতায় সত্য বলে বিবেচিত। যাইহোক, তাদের অন্তর্মুখী সংমিশ্রণের প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র অনুশীলন ও সংরক্ষণের জন্য না, কিন্তু কারণ হল পূর্ব প্রভাবিত নারীসুলভ রোপণ কৃষ্টি অন্তর্মুখীতা ধার দেয় প্রত্যেক আর্টের ক্ষমতাকে বিভিন্ন উপাদানে একসঙ্গে দ্রবীভূত এবং তাদেরকে একটা বিশেষ শৈলীতে রূপান্তর করতে।

সাধারণ অনুকরণাত্মক নাচ উপস্থাপন করে দৈহিক আকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং বস্তুর চাল-চলন কিন্তু এটা শুধুমাত্র জীবনের একটা টুকরা, প্রকৃতির একটা তাল, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা একটা পরস্পর সংযুক্ত ও পুনরাবৃত্ত মূলশিল্প উপাদানের সিরিজ যেন প্রকৃতিগত ভাবে থরে থরে সুসজ্জিত একটা সমতল উপরিভাগ।

কম্পোজিশন, নির্মাণশৈলী এবং আবাহ শুধুমাত্র কৃষ্টিতেই অবদান রাখতে পারে যাতে চিত্রায়িত আর্টও বুঝতে পারে কেমন করে শুধুমাত্র মূল শিল্পউপাদানকে সিরিজে সাজালে হয় না কিন্তু কেমন করে তাদের পরস্পর সম্পর্কের মধ্যে, নিপূণ বুননে গেঁথে রাখতে হয় বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য রক্ষাই কাজ ।

যাইহোক, এটাই বিমুগ্ধতা, এই মিলান ক্ষমতায় আছে বৈশিষ্ট্যমন্ডীয়তার শক্তি ঃ সমস্ত অন্তর্মুখী কৃষ্টির প্রবণতা বাস্তবতাকে পরিত্যাগ করে বিমূর্ততার দিকে অগ্রসর হয়। এই কৃষ্টিতে যেটা অলংকরণেও সত্য তা প্রায়ই নাচেও সত্যঃ মূলশিল্প উপাদানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন যাতে তার অর্থ বোঝা যায়, এটা অনুভূতি দ্বারা খাঁটিভাবে বোঝা যাবে না।

এই পথ পরে গতানুগতিক গুণাবলীর দিকে ধাবিত হয়। তলোয়ার ও বল্লম কাঠি দ্বারা পরিবর্তিত হয় এবং অনুষ্ঠান অনুযায়ী দেহ চিত্রিত করার প্রথা প্রচলিত থাকে না । চূড়ান্তভাবে গুণাবলী একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়, হাতে শাখা দোলান, আঙ্গুলের মধ্যে নৈবেদ্য প্রস্ফুটিত হয়, তাছাড়া শুধু অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতই যথেষ্ট ।

জাঁকালো আর্টের দেহভঙ্গির আকার ইঙ্গিতের নাচ ইন্ডিয়াতে উৎপত্তি হয়েছে হাজার হাজার বৎসর আগে। এখান থেকে তা কম করে হলেও ৮ম শতকে পূর্বদিকে বিস্তার লাভ করেছে। এরই মধ্যে বরোবুদুরে হিন্দু জাভানীজ মন্দিরে প্রায় ৮ম শতকের রিলীফে তা বুঝা যায়। ইন্ডিয়া তার নিজের পথে এই আর্টকে বাধ্য করেছে এক জটিল পদ্ধতির নির্দিষ্ট বিধি- বিধানের গন্ডীতে আবদ্ধ হতে।

ভরতের ‘নাট্য-শাস্ত্র’ প্রায় ৫ম শতকে লেখা কিন্তু তুলনামূলকভাবে পুরাতন ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল এবং তার চেয়ে আরো সংক্ষিপ্ত নন্দিকেশরের “অভিনয় দর্পণ” এটার যথার্থ সারগ্রন্থ। এই সকল কাজকর্ম (বই) অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করেছে যাতে নাটকীয় নাচের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু (থিম) ও আবেগ প্রকাশের (রস) প্রয়োজন অনুযায়ী শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রতি পুঙ্খানুপুঙ্খানুরূপে বিস্তারিত বর্ণনা নির্দিষ্ট করা যায়। উদাহরণস্বরূপ ঃ মাথা নাড়ানর তাৎপর্য অস্বীকৃতি, নির্দিষ্ট দিকে বারবার তাকান প্রকাশ করে অনুকম্পা, আশ্চর্য, ভয়, অভিন্নতা, হতাশ, আগুন, পানি পানের প্রথম মুহূর্ত, যুদ্ধের প্রস্তুতি, বিতৃষ্ণা, অস্থির, নিজের দেহের কোন অংশকে ধিক্কার দেয়া ও দ্বন্দ্ব।

মাথার চব্বিশ ধরনের ভঙ্গি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই সকল শুধুমাত্র মাথার ভঙ্গিমা : চারটি আরো বরাদ্দ হয়েছে ঘাড় প্রকাশের জন্য ভুরুর জন্য ছয়টি এবং চব্বিশটি চোখের! মনে হয় খুব কম করে হলেও হাতের জন্য সাতান্নটি অবস্থা স্থির করা হয়েছে সেই অনুসারে। কিন্তু এই সংখ্যার সঙ্গে অবশ্যই অসংখ্য প্রতীক যুক্ত হতে পারে, যার গঠনপ্রকৃতি শরীরের অন্য কোন অংশ ত্যাগ করতে পারবে না। হস্তদ্বয় শুধুমাত্র চিত্রিত করে না আবেগ ও নাটকীয় মূলশিল্প উপাদান ।

যে অবস্থান পতাক নামে পরিচিত—শুধু একটা উল্লেখ করতে যাতে প্রসারিত আঙ্গুলের পাশে বৃদ্ধ আঙ্গুল বেন্ড করা প্রকাশ করে নাচের আরম্ভ, মেঘপুঞ্জ, বন, নিষিদ্ধ দ্রব্য, বক্ষস্থল, রাত, নদী, দেবতাদের জগৎ, ঘোড়া, কর্তন, বাতাস, পিছনে বন্ধ করা, নিরুদ্দেশ, বীরত্ব, দয়া, জ্যোৎস্না, সূর্যের প্রখর রোদ্র, আহ্বান, ঢেউ, রাজপথে হাঁটা, সমতা, চন্দন কাঠের মলম প্রয়োগ (তিলক কাটা) (নাচুয়ে নিজে) নর্তকীর নিজের প্রতিজ্ঞা, নীরবতা, দোয়া, ভালশাসক, তালুতে তালগাছের পাতা (জয় চিহ্ন), আঘাত করা, স্পর্শকরা, ব্যক্তি বিশেষের ইঙ্গিত, মহাসাগর, সুকর্মের পথ, দূরের ব্যক্তির উল্লেখ, একাকী ঘুরা, তলোয়ারের আকৃতি, মাস, বৎসর, বর্ষাঋতু, দিন এবং জ্বলজ্বলে পানি। এই সকল ছাড়াও হাত আরো প্রতীক রূপে দেখায় উর্ধ বিশ্ব, পাতাল, বিভিন্ন দেবতা, সম্রাট, জাতিভেদ (পেশাভিত্তিক) নদী, গাছ এবং জীবজন্তু ।

ইউরোপীয়ানদের জন্য এই মতবাদ বা বিশ্বাসের মমার্থ সহজে অনুধাবন করা দূরের ব্যাপার। আমরা একে সহায়তা করতে না পারলেও এর মধ্যে বিমূর্ততা দেখি, একটা প্রচলিত বিধি বিধানের মধ্যে কঠোরতা আছে যেটা নিরাশ ভাবে আমাদের স্বাধীন ও ব্যক্তিগত শিল্পবোধের আদর্শ থেকে সরায়ে দেয়।

কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, পাশ্চত্যেও আর্টের অনুর্বর থিওরীর (তত্ত্ব) অভাব নাই এবং ঐ প্রাণবন্ত আর্ট এই সকল থিওরীকে অতিক্রম করে গেছে। সকল তত্ত্ব এই উপাদান পর্যালোচনা ও বিচ্ছিন্ন করে-সমস্ত আর্ট তাদেরকে অখন্ড সত্ত্বায় ঐক্যবদ্ধ করে।

একটা একক অঙ্গভঙ্গি টেক্সবুক থেকে নিয়ে পর্যায়ক্রমে (নাচের দৃশ্য থেকে) পৃথক করলে সেটা যে পর্যায়ভুক্ত তাতে যা দৃষ্টিগোচর হয় তা ফাঁকা, নির্জীব, নিগড়িত, এমনকি উদ্ভট, এবং ধারাবাহিক আঙ্গিক অবস্থায় দেহভঙ্গির মধ্যে যৌক্তিক স্বচ্ছ ও বাধ্য হয়ে হয়ত শিল্পসম্মত সৃষ্টির ধারায় এসেছে। এই দারুন অধঃপতিত কালে যে কেউ একজন ভাল হিন্দু নাচুয়েকে দেখে তো এটাই হবে তার অভিজ্ঞতা।

তার নাচ উৎপত্তি করে শক্তিশালী ও টেকসই নান্দনিক প্রতিক্রিয়া-এইরূপ একটা প্রতিক্রিয়া যেমন উৎপন্ন করতে পারে শুধুমাত্র বিরাট শিল্পসম্মত অনুষ্ঠান যাতে ব্যক্তিগত সৃজনীশক্তির ক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট সর্বজনীন ঐক্যবদ্ধ বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত হওয়া যায়।

আমাদের সমস্ত উপভোগের মধ্যে আনন্দঘন এবং গভীর অভিজ্ঞতার মধ্যেও ইন্ডিয়ান নাচে সেখানে বৈদেশিক কিছুটা থেকেও যায় । আমরা নান্দনিক কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু একই সময় এটা অনুভব করি যে, এটা পর্যাপ্ত না, তবে এটা হিন্দুনাচের সম্ভাবনা ক্ষয়ের আরম্ভ না।

যে বাধা আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ অনুধাবন করতে পৃথক করে তা যাইহোক, অলঙ্ঘনীয় না। ইউরোপের আর্টও সম্পূর্ণভাবে বোধশক্তির উপরেও অন্তপ্রবাহিক তা কামনা করা যায় না। মধ্য যুগের কাজকর্ম প্রতীক ভারাক্রান্ত এবং শুধুমাত্র “বুদ্ধবৃত্তি” বলা যায় না কারণ হল যাদেরকে আনন্দ দেয় তাদেরকে জানা ও বুঝাবার উপর তারা নির্ভরশীল না কিন্তু তাদের ভক্তির মূল্য, তাদের ধর্মীয় ও যাদুকারী গুণাবলী তাদের একান্ত উপস্থিতির শক্তি থেকে উৎসারিত হয়।

এটা হল ইতালীয় রেনেসাঁ যেটা আমাদেরকে সেই জগৎ থেকে প্রথম বিচ্ছিন্ন করে, এটা মধ্যযুগীয় অভিজ্ঞতার ঐক্য ও বুঝাপড়া, জ্ঞানের পরিধি ও অনুভূতিকে ধ্বংস করে এবং আমাদেরকে একটা আর্টের দিকে আগায়ে নেয় যেটা সকল প্রতীক-ধর্মীর বাইরে, উপলদ্ধির আবেদন শুধু সৃষ্টি করে, শুধুমাত্র ভাবাবেগপ্রবণ এবং বোধগম্য।

এই দুই মহান বুদ্ধিবৃত্তি প্রবণতার সংগ্রামের ধারায় সংবেদজ ধারা কল্পনাপ্রবণতার উর্ধে স্থান পেয়েছে ইউরোপে, এশিয়া বয়ে যায় কল্পনাপ্রবণতার পথে বিমূর্ত সমৃদ্ধিতে। মুখোশ একটা ভাল উদাহরণ। এটা এশিয়াতে গুরুত্ব হারাচ্ছে, কিন্তু এটার প্রত্যাহার মুখমন্ডলী অনুকৃতি কোন লাভ করে নাই।

যদিও বালি এখন মুখোশ নাচের কেন্দ্রবিন্দু, অধঃপতিত হিন্দু- জাভানিজ আর্ট এটাকে পিছন থেকে ঠেলে দিচ্ছে, কম্বোডিয়ানগণ এটাকে ব্যবহার করে শুধুমাত্র তখন যখন নাচের মেয়ে ডাইনী ও জীবজন্তুর চরিত্র রূপায়ন করে এবং এটা ছাড়া কল্পনাকে দাবী করা খুব বড় ব্যাপার হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশে মুখোশ হীন নাচে নাচুয়ের মুখমন্ডলে সম্পূর্ণ স্থবিরতা প্রয়োজন হয় এবং সত্যিকারভাবে সম্পূর্ণ মাথায়; এই বিমূর্ত আর্টের জন্য মুখমন্ডল ব্যক্তির স্বয়ংকৃতি পর্যাপ্ত পরিমানে ছাড়ায়ে যেতে পারে না ।

এই চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যে অনমনীয় প্রতীকধর্মী আইন ও সনাতন ষ্টাইলে (বৈশিষ্ট্যে) উচ্চস্তরের কৃষ্টি অনুকরণাত্মক নাচকে অধীনস্ত করে। জাপান উপস্থাপন করে তারই বিস্তারিত চিত্র। এখানে আমরা দেখি একদা যা ভীষণ কঠোরতার মধ্যে মন্দিরে ও রাজকীয় দরবারে সৃষ্টি হয়েছিল তা হাজারো খাত বয়ে রেস্তোরা জগতে ছড়ায়ে পরে।

এমনকি ছোট্ট গ্রামের মধ্যে রূপকথার গল্প থেকে যেমন, জেলের ছেলে ও সাগর দেবতার কন্যা, তিনটা ভয়ঙ্কর দানব অথবা স্পুর্ন গাছের গল্প যেটা হঠাৎ এমন ছড়ায়ে পরে সম্রাটকে ছায়া দিতে থাকে গেইসা (জাপানী উৎসর্গীকৃত কুমারী) নেচে দেখায় ইত্যাদি নিয়ে কর্মতৎপরতা (একশ্যান), পরিস্থিতি, ব্যক্তি এবং প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গিক জিনিসপত্র খুব কমই নির্দিষ্ট করা হয় অথবা উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।

হালকা পদাঘাত দিয়ে যুদ্ধ বুঝান হয়; শিশু সুলভ উল্লাসজনক প্রজাপতিকে ধাওয়ান দ্বারা উজ্জ্বলদীপ্ত সাগর তল, পাখার এক প্রান্তে সবুজ পর্দা দিয়ে তরঙ্গায়িত পানি এবং দৈত্য বুঝাতে নাকে তর্জনী আঙ্গুলদ্বয় দুই পাশে রেখে বুঝান হয়।

যেমন জাপানী চিত্রশিল্পী তার তুলির হালকা স্পর্শে দর্শককে যেকোন পরিস্থিতিতে অথবা যে কোন মুডে (মনোবৃত্তি) মুগ্ধ করতে সক্ষম, সুতরাং নাচুয়ে তার ভক্তদের যা কিছু প্রয়োজন তা দ্বারা ভেল্লিবাজি দেখাতে পারে। এটা তলোয়ার ও বল্লমের স্থান নেয়, এটা তীর্থযাত্রীর লাঠির মত অত্যাবশ্যক রূপে সেবা দেয়, যেটা সে মনে করে থপ করে মাটিতে সজোরে পড়ে গেছে অথবা নিজ ভারে নুয়ে গেছে।

নাচুয়ে এটাকে দোলা দেয়, সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে চলে যেতে দেয়, এটা উপরে তুলে ব্যগ্র অভিব্যক্তিতে এবং আমাদের সামনে আছে কলা-কৌশলে কিছু পাবার চেষ্টা। সে তার বাহুতে যত্নের সঙ্গে বহন করে এবং আমরা দেখি স্নেহাতুর বাপ তার শিশুর সঙ্গে। সে এটা পাশে সজোরে ধাক্কা দেয়-এবং একটা লোক বাড়ীর দরজা খুলে দেয় এবং এক দৃষ্টিতে তীব্র আনন্দে প্রস্ফুটিত ফুলের বাগান দেখে।

সে পাখা খুলে এবং মনে হয় একটা এই পড়ছে। পাখা শূন্যে ঘুরে এবং মাটিতে পড়ে যায়-একটা পাতা যেন গাছ থেকে ঝরে যায় ; এটা স্ফীত হয় এবং তার কাঁধের উপর দিয়ে যায়-নদীতে পাল তোলা নৌকা, এটা তার আস্তিনের উপর দিয়ে দৃষ্টি গোচর হয়—চাঁদ উঠেছে যেন।

সংযত ভালবাসায় এবং এই সকল অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতে নাচের সহজ বিশালতা প্রকাশ করা অসম্ভব । এগুলি অবশ্যই অভিজ্ঞতালদ্ধ সেটা বর্ণনা করে পাওয়া যায় না। আমরা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে, চমৎকার বৈশিষ্ট্যের নাচের আর্ট কৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত যেটা চিত্রশিল্পেও বিদ্যমান এবং ভাস্কর্যাদি গঠনমূলক শিল্পের একটা অতুলনীয় ক্ষমতা রাখে যা অপরিহার্য মুহূর্তে একক স্পর্শে উন্মুক্ত করতে পারে প্রাকৃতিক উপাদানের চূড়ান্ত তাৎপর্য।

তুলির ক্ষণস্থায়ী স্পর্শে, ব্যাকাযন্ত্রের কৌনিক মোচড়ে, তারা দেবতা, মানুষ এবং প্রকৃতিকে পরিবর্তীত বাস্তবতায় সজ্জিত করে এবং তাদের রূপান্তর করে কল্পনার রাজ্যে যেখানে বস্তুর প্রগাঢ় অস্তিত্ব তারকালোক ঝাঁপসা হয়ে আসার পরিবর্তে বৈচিত্র্যময় স্বচ্ছতায় আসে, আসে জ্বলজ্বল করে। এটাই হলো অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতের আর্ট। এই ধরনের কৃষ্টিতে এটাকে দেয়া হয়েছে অনুকাণাত্মক নাচকে ক্লাইমেক্সে নিয়ে যেতে।

কিন্তু ইউরোপে, পরিপ্রেক্ষিতের জগতে, অবস্থানের ত্রিমুখী অঙ্কনে, প্রত্যহিক বস্তুর অনুকৃতির যথার্থতায়, আমরা অন্য পথ অনুসরণ করেছি। এটা হিন্দুনাচের সম্ভাবনা ক্ষয়ের আরম্ভ না। যে বাধা আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ অনুধাবন করতে পৃথক করে তা যাইহোক, অলঙ্ঘনীয় না। ইউরোপের আর্টও সম্পূর্ণভাবে বোধশক্তির উপরেও অন্তপ্রবাহিক তা কামনা করা যায় না।

মধ্য যুগের কাজকর্ম প্রতীক ভারাক্রান্ত এবং শুধুমাত্র “বুদ্ধবৃত্তি” বলা যায় না কারণ হল যাদেরকে আনন্দ দেয় তাদেরকে জানা ও বুঝাবার উপর তারা নির্ভরশীল না কিন্তু তাদের ভক্তির মূল্য, তাদের ধর্মীয় ও যাদুকারী গুণাবলী তাদের একান্ত উপস্থিতির শক্তি থেকে উৎসারিত হয়।

এটা হল ইতালীয় রেনেসাঁ যেটা আমাদেরকে সেই জগৎ থেকে প্রথম বিচ্ছিন্ন করে, এটা মধ্যযুগীয় অভিজ্ঞতার ঐক্য ও বুঝাপড়া, জ্ঞানের পরিধি ও অনুভূতিকে ধ্বংস করে এবং আমাদেরকে একটা আর্টের দিকে আগায়ে নেয় যেটা সকল প্রতীক-ধর্মীর বাইরে, উপলদ্ধির আবেদন শুধু সৃষ্টি করে, শুধুমাত্র ভাবাবেগপ্রবণ এবং বোধগম্য।

এই দুই মহান বুদ্ধিবৃত্তি প্রবণতার সংগ্রামের ধারায় সংবেদজ ধারা কল্পনাপ্রবণতার উর্ধে স্থান পেয়েছে ইউরোপে, এশিয়া বয়ে যায় কল্পনাপ্রবণতার পথে বিমূর্ত সমৃদ্ধিতে।

মুখোশ একটা ভাল উদাহরণ। এটা এশিয়াতে গুরুত্ব হারাচ্ছে, কিন্তু এটার প্রত্যাহার মুখমন্ডলী অনুকৃতি কোন লাভ করে নাই। যদিও বালি এখন মুখোশ নাচের কেন্দ্রবিন্দু, অধঃপতিত হিন্দু- জাভানিজ আর্ট এটাকে পিছন থেকে ঠেলে দিচ্ছে, কম্বোডিয়ানগণ এটাকে ব্যবহার করে শুধুমাত্র তখন যখন নাচের মেয়ে ডাইনী ও জীবজন্তুর চরিত্র রূপায়ন করে এবং এটা ছাড়া কল্পনাকে দাবী করা খুব বড় ব্যাপার হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশে মুখোশ হীন নাচে নাচুয়ের মুখমন্ডলে সম্পূর্ণ স্থবিরতা প্রয়োজন হয় এবং সত্যিকারভাবে সম্পূর্ণ মাথায়; এই বিমূর্ত আর্টের জন্য মুখমন্ডল ব্যক্তির স্বয়ংকৃতি পর্যাপ্ত পরিমানে ছাড়ায়ে যেতে পারে না ।

এই চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যে অনমনীয় প্রতীকধর্মী আইন ও সনাতন ষ্টাইলে (বৈশিষ্ট্যে) উচ্চস্তরের কৃষ্টি অনুকরণাত্মক নাচকে অধীনস্ত করে। জাপান উপস্থাপন করে তারই বিস্তারিত চিত্র। এখানে আমরা দেখি একদা যা ভীষণ কঠোরতার মধ্যে মন্দিরে ও রাজকীয় দরবারে সৃষ্টি হয়েছিল তা হাজারো খাত বয়ে রেস্তোরা জগতে ছড়ায়ে পরে। এমনকি ছোট্ট গ্রামের মধ্যে রূপকথার গল্প থেকে যেমন, জেলের ছেলে ও সাগর দেবতার কন্যা, তিনটা ভয়ঙ্কর দানব অথবা স্পুর্ন গাছের গল্প যেটা হঠাৎ এমন ছড়ায়ে পরে সম্রাটকে ছায়া দিতে থাকে গেইসা (জাপানী উৎসর্গীকৃত কুমারী) নেচে দেখায় ইত্যাদি নিয়ে কর্মতৎপরতা (একশ্যান), পরিস্থিতি, ব্যক্তি এবং প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গিক জিনিসপত্র খুব কমই নির্দিষ্ট করা হয় অথবা উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।

হালকা পদাঘাত দিয়ে যুদ্ধ বুঝান হয়; শিশু সুলভ উল্লাসজনক প্রজাপতিকে ধাওয়ান দ্বারা উজ্জ্বলদীপ্ত সাগর তল, পাখার এক প্রান্তে সবুজ পর্দা দিয়ে তরঙ্গায়িত পানি এবং দৈত্য বুঝাতে নাকে তর্জনী আঙ্গুলদ্বয় দুই পাশে রেখে বুঝান হয়। যেমন জাপানী চিত্রশিল্পী তার তুলির হালকা স্পর্শে দর্শককে যেকোন পরিস্থিতিতে অথবা যে কোন মুডে (মনোবৃত্তি) মুগ্ধ করতে সক্ষম, সুতরাং নাচুয়ে তার ভক্তদের যা কিছু প্রয়োজন তা দ্বারা ভেল্লিবাজি দেখাতে পারে।

এটা তলোয়ার ও বল্লমের স্থান নেয়, এটা তীর্থযাত্রীর লাঠির মত অত্যাবশ্যক রূপে সেবা দেয়, যেটা সে মনে করে থপ করে মাটিতে সজোরে পড়ে গেছে অথবা নিজ ভারে নুয়ে গেছে। নাচুয়ে এটাকে দোলা দেয়, সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে চলে যেতে দেয়, এটা উপরে তুলে ব্যগ্র অভিব্যক্তিতে এবং আমাদের সামনে আছে কলা-কৌশলে কিছু পাবার চেষ্টা। সে তার বাহুতে যত্নের সঙ্গে বহন করে এবং আমরা দেখি স্নেহাতুর বাপ তার শিশুর সঙ্গে।

সে এটা পাশে সজোরে ধাক্কা দেয়-এবং একটা লোক বাড়ীর দরজা খুলে দেয় এবং এক দৃষ্টিতে তীব্র আনন্দে প্রস্ফুটিত ফুলের বাগান দেখে। সে পাখা খুলে এবং মনে হয় একটা এই পড়ছে। পাখা শূন্যে ঘুরে এবং মাটিতে পড়ে যায়-একটা পাতা যেন গাছ থেকে ঝরে যায় ; এটা স্ফীত হয় এবং তার কাঁধের উপর দিয়ে যায়-নদীতে পাল তোলা নৌকা, এটা তার আস্তিনের উপর দিয়ে দৃষ্টি গোচর হয়—চাঁদ উঠেছে যেন।

সংযত ভালবাসায় এবং এই সকল অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতে নাচের সহজ বিশালতা প্রকাশ করা অসম্ভব । এগুলি অবশ্যই অভিজ্ঞতালদ্ধ সেটা বর্ণনা করে পাওয়া যায় না। আমরা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে, চমৎকার বৈশিষ্ট্যের নাচের আর্ট কৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত যেটা চিত্রশিল্পেও বিদ্যমান এবং ভাস্কর্যাদি গঠনমূলক শিল্পের একটা অতুলনীয় ক্ষমতা রাখে যা অপরিহার্য মুহূর্তে একক স্পর্শে উন্মুক্ত করতে পারে প্রাকৃতিক উপাদানের চূড়ান্ত তাৎপর্য।

 

মূল বিষয় ও ধরন

 

তুলির ক্ষণস্থায়ী স্পর্শে, ব্যাকাযন্ত্রের কৌনিক মোচড়ে, তারা দেবতা, মানুষ এবং প্রকৃতিকে পরিবর্তীত বাস্তবতায় সজ্জিত করে এবং তাদের রূপান্তর করে কল্পনার রাজ্যে যেখানে বস্তুর প্রগাঢ় অস্তিত্ব তারকালোক ঝাঁপসা হয়ে আসার পরিবর্তে বৈচিত্র্যময় স্বচ্ছতায় আসে, আসে জ্বলজ্বল করে।

এটাই হলো অঙ্গভঙ্গির আকার ইঙ্গিতের আর্ট। এই ধরনের কৃষ্টিতে এটাকে দেয়া হয়েছে অনুকাণাত্মক নাচকে ক্লাইমেক্সে নিয়ে যেতে। কিন্তু ইউরোপে, পরিপ্রেক্ষিতের জগতে, অবস্থানের ত্রিমুখী অঙ্কনে, প্রত্যহিক বস্তুর অনুকৃতির যথার্থতায়, আমরা অন্য পথ অনুসরণ করেছি।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment