আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – অঙ্গ ভঙ্গি নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
অঙ্গ ভঙ্গি নাচের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
নাচের ইতিহাস লেখকদের সৌভাগ্য যে, তাঁদের শুধু শুধু বিতর্কের মধ্যে থাকতে হবে না। প্রারম্ভিক নাচের সুস্পষ্ট তত্ত্বের অবতরণা আছে। অধিকন্তু তিনি প্রতিষ্ঠিত সত্যসমূহের স্বাভাবিক প্রাপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। এই সত্য ঘটনাসমূহ উঁচুস্তরের জন্তুগুলির অতিপরিচিত নাচের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত।
বৃটিশ গায়ানার বরোসিয়া জেলায় আগুন দেখেন যে, প্রায় কুড়িটি উজ্জ্বল কমলা হলুদ রঙের পাহাড়ী মুরগীর ছানা একত্রে বিভিন্ন নাচের ভঙ্গিতে সমবেত হ মাঝখানে একটা মোরগ নাচের মত ভঙ্গিতে অঙ্গভঙ্গি করে সে মুক্ত স্থানের আশায় গোল হয়ে পাখা খুলে দেন ছড়ায়।
ঝোপর অন্য ডালে বসে থাকা অন্যরা অদ্ভূত শব্দে নাচের প্রশংসা প্রকাশ করে। একজন এইভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে বিচিত্র চিৎকারে দর্শকদের সারিতে চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য একজন সে স্থান নেয়।
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর পূর্বে কেপইয়র্কে ম্যাকলারন এক পায়ে ভয় করা পাখিদের নাচ প্রত্যক্ষ করেন। স্থানীয় ভাবে এই পাখিদের নাম “ন্যাটিভ কমপেনিয়নস”। সাদা ও ধূসর বর্ণের পালক বিশিষ্ট লম্বা পাওয়ালা এরা প্রায় উর্কের মত লম্বা। একটা আড়াল থেকে লুকায়ে দেখা গেল পাখিগুলি একটা শুল্ক প্রশন্ত জলাভূমির মধ্যে নাচ শুরু করে।
সেখানে প্রায় কয়েকশত পাখি, তাদের নাচ কোয়াড্রিল নাচের ধরনের, তাদের ছন্দ ও সৌন্দর্য এত সুষম যে, কোন কোয়াড্রিল নায়কে হার মানায়। এক একজনের সাফল্যের প্রাবল্যে কেউ আগায়ে যায় কেউবা পিছায়ে থাকে তাদের লম্বা লম্বা পা তুলে কখন নখের উপর ভর করে।
মাঝে মাঝে এক পাখি অন্যকে সুন্দরভাবে বাউ করে, একজোড়া কখন এক পা তুলে উল্লাসে লাফাতে লাফাতে অন্য গ্রুপকে ঘুরে যাদের মাথা উপরে নিচে পাশে দুলে দুলে সাথীর দিকে অগ্রসর হয়। এক সময় দেখা যায় তারা বিশাল দোদুল্যমান উৎফুল্ল উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাদের লম্বা কণ্ঠ উপরের দিকে তাকান, দোলান পিঠগুলি সাগরের ঢেউ এর মত মনে হয়।
হঠাৎ কোন জরুরী তলবের মত তারা এদিকে সেদিক আন্দোলিত হতে লাগল, কেউ কেউ উপর দিয়ে উপরে উঠার জন্য চক্কর দিতে থাকে কেউ খোসগল্পের আসরের মত দলবদ্ধ এমনই জোড়ায় জোড়ায় এক পায়ে লাফাতে লাফাতে বাউ করে সামনে পিছনে চতুর্দিকে ছড়ায়ে পড়ে।
সবচেয়ে মূল্যবান ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আসে টেনরিফ ল্যাবরেটরীতে বন-মানুষ গবেষণায়। সেখানে কয়েকটা শিম্পাঞ্জীকে মানুষের সংস্পর্শহীনভাবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে লালন পালন করা হয়। মনোবিজ্ঞানী উলফ্যাংগ কোহলার ঐ ল্যাবরেটরীতে ছয় বৎসর দায়িত্বে থেকে প্রুশিয়ার বৈজ্ঞানিক একাডেমীকে এক অবাক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, বন-মানুষগুলি নাচে।
তিনি একটি মেয়ে শিম্পাঞ্জী সম্বন্ধে বলেন যে, সেটা একদিন হঠাৎ এক পা তুলে লাফাতে চেষ্টা করে পরে অন্য পায়ে লাফাতে থাকে একটি অদ্ভূত উত্তেজক বৈশিষ্ট্যে। তদন্তকরীগণ প্রায় উল্লেখ করেন যা আমাদের অবশ্যই উচিত এই সবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যে, সাদা মানুষদের আসতে দেখলে কালো মানুষ অত্যাধিক উত্তেজনায় নাচতে থাকে।
এক পা থেকে অন্য পা এই দুই পর্যবেক্ষণে নাচের কারণ মানসিক উত্তেজনা ও ভয়। কোহেলার আরো পর্যবেক্ষণ করেন যে, বন-মানুষটা দুই হাত প্রসারিত করে দ্রুত ঘুরতে থাকলে এর সঙ্গে একটু সামনে অগ্রসর হলে একটা মুভমেন্টের (দেহ ভঙ্গির) সূত্রপাত হয়। এইভাবে কোন খোলা স্থানে ঘুরতে ঘুরতে অগ্রসর হলে এটাই একটা প্রকৃত গেলাক-নাচ হয়ে থাকে।
“তাদের কৌতুকপূর্ণ খেলায় একজন অন্যজনকে টানতে টানতে মাঠের মধ্যে একটা দন্ডের কাছে নিয়ে আসে। যতক্ষণ তারা গোল চক্কর শুরু না করে ততক্ষণ তাদের উল্লাস উৎফুল্লতায় ভরা লক্ষবৃক্ষ শান্ত হয় না। একটার পর একটা জীব- জন্তুও এসে এক এক জনের পিছনে ফ্যাশন প্যারেডের মত দত্তকে কেন্দ্রবিন্দু করে মার্চ করে ঘুরতে থাকে। তখন তাড়াতাড়ি তাদের মুভমেন্ট পরিবর্তন করে।
তারা তখন শুধু হাঁটে না কদমে চলতে থাকে এক পাকে ঝাঁকানি দিয়ে অন্য পাকে ইষৎ নিচে করে, ভিন্ন ছন্দে হলেও তাল রেখে অন্যের সঙ্গে পা মিলায়ে চলার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে তাদের মাথা হেলাতে থাকে উপরে নিচে দুলায়ে ‘হা’ করে পা ঝাঁকি দিয়ে আদিম ‘গোলক নাচ’ করতে আনন্দ পায়। ঘনঘন পরিবর্তীত হয়। একবার দেখা গেল একটা প্রাণী চক্করের মাঝে কৌতুক করে পিছনে হাঁটা শুরু করে। মাঝে মাঝে তাদের একজন
মার্চ করতে করতে ওকর হয়, মাঝের দক্ত বা বাক্সের কাছাকাছি পৌঁছে তাকে কেন্দ্র করে তখন গোলক-নাচ ডিম্বাকৃতির আকার নেয়। এই নাচে শিল্পান্তী দড়ি, লতা-পাতা ও ছিন্নবস্ত্র দিয়ে নিজেকে সাজায়ে উর্ধমুখি চক্কর দিতে দিতে ঘুরতে থাকে এইভাবে মানুষের চেয়ে নিম্নস্তরে নাচের প্রকৃত প্রয়োজনীয় শিল্প-সম্ভার ক্রমান্বয়ে উন্নত হয়। যেমন গঠন-আকৃতিসমূহ,গোল, ডিম্বাকৃতি, দন্তকে কেন্দ্রবিন্দু করে সামনে এবং পিছনে যাওয়া: মুভমেন্টের ক্ষেত্রে ছোট লাফ, ছন্দে পদাঘাত, চক্ৰৱ খাওয়া এবং বেশভূষার মাধ্যমে।
এই সাক্ষ্য দ্বারা বুঝা যায়, আমরা মাঝে মধ্যে নাচহীন জনগোষ্ঠীর যে রিপোর্ট পাই তা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। পূর্বসূত্রে উরুদ্বয়ের “চারুয়া” ব্রাজিলের “গুয়ারনীদের কোন সমবেত নাচ নাই। কিন্তু আজ জানা গেছে যে, গোরানীদের হর্ষোৎফুর গাউড কাটিং নাচ যা নিশ্চিতভাবে বলা যায় সম্প্রতিকালে প্রচলিত না।
এই নাচ এতকম হয় যে এর কারণ হিসাবে বলা যায় এই নাচ খুব পবিত্র যা সব সময় প্রদর্শন করা যায় না, বিদেশী ভ্রমণকারীদের অবিশ্বাসের জন্য বলা যায় এই নাচ শুধু শীতকালে প্রদর্শনের জন্য সীমাবদ্ধ। অধিকন্তু বিশ্বাসযোগ্য তদন্তকারীর রিপোর্টে কিছু নাচহীন জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায় : মালাক্কার গভীর জঙ্গলে বামন কেস্তা, বেতকা, ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন অধিবাসীদের অংশ, রিডেন-কুবু সুমাত্রায় এবং টোয়েলা গ্লিবিসে তারা ফল সংগ্রহ করে, জন্তু আটক করে প্রতিদিনের খাদ্যে সন্তুষ্ট থেকে আগামীকালের চিন্তা না করে এইভাবে জঙ্গলে জীবন ধারণ করে।
সমাজ-জীবন, খেলা, উৎসব ও গান-বাজনা ছাড়াও এমনকি অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বিশ্বাসের চিন্তা চেতনার অস্তিত্বহীন জীবন-যাপন করে। আমরা এখানে কোন লুপ্ত কৃষ্টিধারার সূত্র উদ্ধারের জন্য কাজ করছি না কি ? এখনই আমাদের সহসা কোন সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না যে, লেজহীন বন-মানুষ নাচের ক্ষমতা রাখে।
নাচের প্রাথমিক পর্ব থেকেই মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এখানে আমরা যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি দেখা যাবে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। নাচ যদি কোন বর্বর পূর্ব-পুরুষেরই উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত তালযন্ত্র বিশেষ, যা অতিরিক্ত শক্তি ও আনন্দ-স্ফূর্তির উৎস, যেটা সমস্ত মানবজাতির মধ্যে বিরাজমান, তবে নৃতত্ত্ববিদ ও সামাজেক ইতিহাসবেত্তাদের কাছে এর কিছু গুরুত্ব হতে পারে।
যদি এটা প্রতিষ্ঠা করা যায় যে, পূর্বে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রবৃত্তিসমূহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন পন্থায় উন্নতি লাভ করেছে আর সেই শক্তি ও নিদর্শন যদি মানব সভ্যতায় পরিদৃশ্যমান হয়ে থাকে, তবে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় নাচের ইতিহাস সমগ্র মানবজাতির সমীক্ষায় এক বিরাট অবদান রেখেছে।
এইরূপ শরীরবৃত্তির ইতিহাস বিশেষ করে দেহ ভঙ্গি সম্পর্কে শুরু করা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু নাচের দেহ ভঙ্গি আলাদা আলাদা খন্ডে বিভক্ত হয় না কেননা নাচ কম্পোজিশন শুধু ক্ষুদ্র দেহ ভঙ্গির অংশকে বুঝায় না। একজনের সমস্ত শরীর ও তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক বল শরীরের কোন অংশ কি করবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়।
এই কারণে আমরা প্রাচীন দুটা নাচের সম্পূর্ন বর্ণনা দিয়ে শুরু করতে পারি, তার একটা সিংহলের শ্রীলঙ্কা ভেড্ডাদের প্রান্তিক এক অংশ অন্যটা আন্দামানীয়দের। এই দুই জনগোষ্ঠী বিবর্তনের প্রটোলিথিক যুগেই অবস্থান করে এবং আদিম অধিবাসীদের মধ্যে এদের গণনা করা হয়।
সরাসিন ভ্রাতৃদ্বয়ের লেখা সিংহলের খন্ডে উল্লেখযোগ্য বর্ণনার মধ্যে ভেড্ডাদের “তীর নাচ” এর যে ছবি আমরা পাই, “শুধু পুরুষেরা নাচে। একটা তীর মাটিরতে গাঁথা থাকে সেটাকে ঘিরে তারা একে অপরকে স্পর্শ না করে আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকে। প্রত্যেকেই বিচিত্র দেহ ভঙ্গি দেখায়।’
এখানে আমরা প্রথমে পায়ের কাজ প্রত্যক্ষ করব। প্রত্যেকে বায়ে ঘুরে ডান পায়ে থামে। সে বাঁ পায়ে খেঁচুনি দিয়ে সামনে রাখে শরীরকে পিছনে ঘুরায়। এরপর সে তার অর্ধ ঘুরা শেষ করে বাঁ পায়ে থামে এবং সেইভাবে কম্পমান ঝাঁপটামারা দেহ ভঙ্গি ডান পায়ে করে। অর্থঘুরা এবং এখন পা ব্যবহার করে অর্ধঘুরার পরে ভর রেখে এইভাবে চলতে থাকে, তীরকে ঘিরে পিছন দিকে তারা আস্তে আস্তে ঘুরে।
এইভাবে তারা নাচের সময় পাশের অন্য কারো খেয়াল না করে নাচতে থাকে তাদের একমাত্র লক্ষ্য তীরকে ঘিরে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে ঘুরা। এইরূপ তারা কেউ একই সঠিক দেহ ভঙ্গি একই সময়ে করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ কেউ বাম পা ঘুরালে তার প্রতিবেশী হয়ত ডান পা ঘুরায় এটা প্রায় ঘটে কারো মাথা কারে পিট সামনে সামনে হয় তবে নিশ্চিত যে, কেউ, প্রত্যক্ষভাবে ধাক্কা খাওয়ার অবস্থান নেয় না।
যখন কোন নাচুয়ে লাফ বা দোলায় না থেকে তার পা পিছনে মাটিতে ছেঁচড়াতে থাকলে তার পা বেশী নড়ে বরং বাহুদ্বয় বেশী প্রয়োজনীয় কাজ করে। যখন শরীর ঘুরতে থাকে তখন তারা দুলতে থাকে, যখন অর্ধঘুরার শেষেও তারা প্রচন্ডভাবে দুলতে থাকে নাচুয়েগণ পেটে হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করতে থাকে তাল-যন্ত্রের বিকল্প হিসাবে। প্রতি অর্ধঘুরা শেষে মাথা পিছনে ফেলে, নাচের ভঙ্গিতে সামনে আনে ও বাহুদ্বয় উভয় পার্শ্বে ছড়ায়ে ঘুরা আরম্ভ করে। যখন
তাদের মাথা নিচু করে কেশরের মত চুলের কুন্ডলী ঘোড়ার লেজের মত মুখমণ্ডল ছেয়ে ফেলে। প্রত্যেক অর্ধরা শেষে চুলের কুন্ডলী পিছনে ফিরে যায় এইভাবে চুলের কৃত্তলী আকাশে উড়তে থাকে। একবার পিছনে থেকে ডানে আবার সামনে থেকে বাঁয়ে এইরূপ বার বার তীরকে ঘিরে কোন দিকে যাবে সেটার উপর নির্দিষ্ট করে চলতে থাকে।
আমরা নিশ্চিত না যে, তারা ঘড়ির কাটার দিকে বা উল্টা দিকে চলে, উপরের বর্ণনা ঘড়ির কাটার উল্টাদিকের নামের সময়ে। খুব ভী হয়ে তারা চিৎকার করতে করতে হাঁপায়ে একঘেয়ে গানে ভাল ঠুকতে থাকে। সমস্থ শরীর দিয়ে সর দর করে ঘাম করে।
তারা পেটে যতো প্রচন্ড আঘাত করতে থাকে চিৎকার আরো উচ্চকণ্ঠে পনিত হতে থাকে। তারপর একটা সময় আ একের পর এক ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য অবসন্ন থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে আগের কথা বিড়বিড় করে, সমস্ত শরীর কাঁপাতে থাকে। হঠাৎ সবাই একসঙ্গে উঠে পড়ে তখন নাচ শেষ হয়।
এই নাটকের দৃশ্য মর্মস্পর্শী। ক্রমাগত উত্তেজনাপূর্ণ, ঝর করে ঘামে ভিজা লোকগুলি পিঠের উপর সটান মাটিতে পড়ে ক্রমাগত কাঁপতে থাকে, এই সব মিলে তাদের ক্রমাগত উচ্চ চিৎকার দর্শকরেও এত উত্তেজিত করে যে, তাদেরকে সংযত হবার প্রয়োজন পড়ে যতক্ষণ না এই বন্য-নাচ তার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে শেষ হয়।
সারাসিন ভ্রাতৃদ্বয়ের এটাই হল বর্ণনা। এখন আমরা আন্দমানবাসীদের আদিম-নাডের দ্বিতীয় একটা উদাহরণ উল্লেখ করছি। প্রত্যেক নাচুয়ে যেকোন দিকে ঘুরে যেকোন হেহভঙ্গি করে অন্যের সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক সেটা বিবেচ্য না মূল কথা তালের সঙ্গে তাল মিলায়ে নাচা। সে ডান পায়ে আস্তে লাফ দেয় বাঁ পা তুলে নিচু হয়ে বাট করে তারপর আবার ডান পায়ে করে * (স্বরলিপি-১) এইসব শরীর দোলা, হাতে তালি ও বোর্ডে পদাঘাত সমবেতভাবে চলে।
(স্বরলিপি-২) একটা ধাপ আরো যোগ করা যায়: (স্বরলিপি-৩) মধ্য-শরীর কোমর পর্যন্ত বাঁকানো, পিঠ প্রায় গোল করে নাঁকান হাঁটু বাঁকা থাকে বাহুদ্বয় সামনে লম্বা, কাঁধ উঁচুতে, আঙ্গুলগুলি বড়শীর মত-গান বাজনার মূল উপাদান যা মনে হয় কোন এক সময় গ্রীকগণ পারস্যবাসীর কাছে শিখেছিল।
এই দেহ ভঙ্গি, ভাবভঙ্গিতে তারা একস্থানে কিছুক্ষণ নাচে তারপরে গোলকের মধ্যে চলে যায়। যখন তখন নাচুয়ে তার ইচ্ছামত বিচিত্র পদক্ষেপ নাচে যোগ করে। উত্তর আন্দামানের মহিলা নাচুয়ে এইরকম স্কীমে নাচে * (স্বরলিপি-৪)
মাচুয়ে খুব ঘন ঘন থামে হাঁটু জোড়া করে বাউ করে, একে অপরের দিকে হাত দোলায়। এই দুই নাচের মধ্যে তুলনা করলে কিছু অপ্রয়োজনীয় দেহ ভঙ্গির বর্ণনা আমাদের অগোচরে থেকে গেলেও কিন্তু মে কাটার মত তত্ত্ব আমরা স্বীকার করতে ভুল করব না। যেমন ভেড়াদের কঠিন দেহ-মোচড় ও মুখ-বিকৃতি অন্যদিকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সুষম, উন্মত্ত অবস্থায় পরিমিত দেহ সঞ্চালন, মাংসপেশী বক্রকরা, দানপাওয়া, ক্রমেগ্রক পাশ দেবার নির্দিষ্ট রীতি-পদ্ধতি, গড়ায়ে দেওয়া, ক্ষুদ্র লাফ এবং বাঁকান।
যেখানে এটা বাড়িরের চাপান ব্যাপার নাচ সেখানে শঙ্কিত, আনন্দ বর্জিত যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত তাড়িত কর্মকাণ্ড সেখানে নাচ মুক্ত উল্লাসপূর্ণ। যদি কোন আন্দামানীয়কে নাচ কেন জিজ্ঞেস করা হয় তার উত্তর হবে আনন্দের জন্য। সে নাচে শিকার ধরার সাফল্যের জন্য কিন্তু কখনই ব্যর্থতার হতাশার না।
এখানে মনে হয় মিশরীয়দের যাদের নাচ hbj অর্থ আনন্দে থাকা এবং গ্রীকগন ভুল মনে করে তাদের নাচ শব্দ Choros আনে Chara বা আনন্দ থেকে। অন্যদিকে ভোগণ কখনও আনন্দের জন্য নাচে না।
এই দুই জনগোষ্ঠী প্রায় সমপর্যায়ের আদিম হয়েও কৃষ্টিগত মাপকাঠিতে ধরা না গেলেও প্রকৃতিগত পার্থক্রাতাদের অনেক বেশী আন্দামানীয়গণ অবশ্যই নাচবে তবে ভেড়াদের মত না। নাচ জানা এবং নাচ না জানা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এডেন এখন পরিষ্কার। মানুষেরও প্রভেন হয় যারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাধ হয়ে যান্ত্রিক ছন্দের প্রকাশ ঘটায় এবং যারা স্বতঃকৃত হর্ষোৎফুল্ল জগতের নাচ চর্চা করে।
এই তুলনামূলক পর্যবেক্ষণে আর একটা পয়েন্ট হল আন্দামানীয়গণ জীব-জন্তুর নাচের সঙ্গে পরিচিত যেটা ফোগণ না। তবে কি একই মৌলিক স্বভাবের জনগোষ্ঠীতে জীব-জন্তু-নাচ, সমস্ত অনুকরণপ্রবণ ও মুখ্যভিনয়ের নাচ আরোপিত করা যার? ফাদার স্পীডট সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, আফ্রিকার ও এশিয়ার পিগমিদের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল নাচে লোক নির্বাচন, জীব-জন্তু এবং প্রাকৃতিক বিষয়-বন্ধ: আফ্রিকানগণ খুব সুখী, যেখানে এশিয়ার পিগমিরা মাচের মধ্যে কোন রকম আনন্দ উচ্ছাস প্রকাশ করে না।
আফ্রিকান পিগমিগণ সুনিশ্চিতভাবে নাচুয়ে জাতি। তারা প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন কাঠামো ও বিচিত্র সেহকঙ্গিমায় মাছে। জনৈক আবিষ্কারকের তথ্যে এবং সাম্প্রতিককালের “কংগোরিলা চলচ্চিত্রের দৃশ্যে যার সমর্থন পাওয়া যায় যে, নিম্নে- নাচের অবসন্ন একঘেয়েমী থেকে এটা একটা সুখময় পরিবর্তন।
মিশরীয়গণ স্বীকার করে যে, তিন হাজার বৎসর খৃষ্টপূর্বের কাছাকাছি সময়ে শৈল্পিক উপহার স্বরূপ নাচের জন্য এবং তাদের দেবদেবী আরাধনায় বামন নিযুক্ত করতে হয়। এটা মিশরীয়দের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান যে, দক্ষিণ দিকের ‘পান্ট’ দেশ থেকে নাচুয়ে-বামন রাজাকে প্রদান করা।
পিগমি বুশম্যানগণ নাচের সকল ক্ষেত্রে ওস্তাদ, তারা দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ধর্মীয় নাচ, জংলী, কণ্ঠসাধ্য এক পায়ের লাফান এবং ভালবাসায় মাতাল যুবকের প্রচন্ড দেহবিক্ষেপের নাচ করতে পারে। তারা নাচের প্রতি এত আবেগময় যে “বুয়র যুদ্ধের সময় তারা গোলাগুলি এবং ঘেরাও এর মধ্যেও সমস্ত দল নাচতে থাকে।
অন্যদিকে জনৈক আবিষ্কারক বলেন তিনি কখন মালাক্কার বামনদের নাচতে দেখেন নাই। সিমংনাচে পুরুষেরা অংশগ্রহণ করে না মেয়েরা শুধু থাকবে তাদের হাঁটু দিয়ে ঘুরে শরীর খানিকটা দুলায়ে বেন্ড করে তখন বাহুদ্বয় শরীরের পাশে রাখে সামনের অংশ সামনে বাড়ায়ে দেয়। এটা প্রাথমিক পর্বের উন্নতি ।
একজন তদন্তকারীর তদন্তেও তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় যে, ক্যালিফোর্ণিয়ার মাইডু ও সাটা নামক দুটা ট্রাইবের নাচের তুলনার মধ্যে জীব-জন্তু নাচের পারস্পারিক সম্পর্ক, হর্ষ-নাচ ও নাচের ক্ষমতা আমাদের কাছে চমৎকার উদাহরণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। মাইডুদের জীব-জন্তু নাচের একটি সম্পূর্ণ সিরিজ আছে ও দেহ ভঙ্গির এক বিচিত্র সমাহার আছে।
লাফ দেয়া, আস্তে আস্তে সময়ে তাল রাখা, পদাঘাত করা, দোলা, গাছের গুড়ি ঘুরা, উপরে উঠা, পার্শ্বে ধরে তোলা, বাহু দোলান, শাখা তরঙ্গায়িত করা, সাঁতার কাটা, স্পর্শ করা ইত্যাদি। এটা সম্ভবত সাটাগণ এক বা অধিক দেহ ভঙ্গিতে করে যেগুলির সঙ্গে জীব-জন্তুর নাচের মিল দেখা যায় না।
কিন্তু আমাদের তাদের প্রত্যেক পদাঘাতেই উৎসাহ যোগায়, যুবতী উৎসর্গ, চাষাবাদ, আগুন উৎসব, মাথার চুল ও চামড়া কাটার উৎসব, এবং যে সমস্ত অগণিত বিভিন্ন উৎসব তারা পালন করে তার মধ্যে সত্যি বলতে তাদের অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত বিরামহীনভাবে একটা সিজন (সময়) থাকে যেখানে পূর্ব নির্ধারিত বিচিত্র ধরনের নাচ তাদের করতে হয়।
সাটাদের নাচের কর্তব্য পালন করতে হয় যুবতী উৎসর্গ, মহিলাদের কৃত্রিম যুদ্ধ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছাড়াও যুদ্ধ-নাচের মধ্যে। আর কিছু না। পুনরায় উপসংহার একই রকম। যে সমস্ত জনগোষ্ঠী জীব-জন্তুর নাচের দ্বারা প্রভাবান্বিত তাদের নাচে বিচিত্র দেহ ভঙ্গি এবং স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসে ভরপুর এবং যাদের জীব-জন্তুর নাচ জানা নাই তাদের আছে অন্য কিছু দেহ ভঙ্গি আর নাচের প্রতি খুব অল্পই আগ্রহ থাকতে দেখা যায়।
এই তুলনাকে আরো গভীরে নেয়া গেলে সে ধারণাকে আরো সঠিক ও শক্তিশালী করা যাবে। কেন ফলটা কদাচিৎ উল্টা হবে তা এখন পরিস্কার এবং এত স্পষ্ট যে, পরবর্তীতে এই সম্পর্কে একটা মৌলিক সত্য প্রকাশ পাবে।সব লোক নাচে সমান পারদর্শী হবে সেটা ঠিক না। পরবর্তী উপসংহার আরো অখন্ডনীয়।
কারো নিজের বা অন্যের শরীরের গতি সঞ্চালনে আগ্রহ, তার চারপার্শ্বের জীবন ও জগৎ এর ভঙ্গিমা বুঝবার ক্ষমতা, অঙ্গ-ভঙ্গি ও চন্দ্রের পার্থক্য প্রকাশ করার ক্ষমতা, তাদের উপর বর্তায় যারা নাচের প্রতিভায় ভাগ্যবান। তীক্ষ্ণ ধারণা তাদেরকে অনুকরণ ও প্রতিসৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকতে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করে। অপ্রতক্ষ্য অনুকরণের মাঝে সমস্ত কার্যস্পৃহা চিন্তার আগে এসে যা প্রতিভাত করে সেই “প্রত্যক্ষ অনুকরণ”।
আরও দেখুনঃ