চাঁদ নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – চাঁদ নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

চাঁদ নাচ

 

চাঁদ নাচ

 

চীনের ধর্মীয় পদ্ধতি খুবই সমৃদ্ধশালী, চাঁদের গতিপথ বিভিন্ন আকৃতির, এটা ঘড়ি কাঁটার মত ঘুরে, কিন্তু প্রত্যেক দিন যে স্থান থেকে উঠে তার বিশেষ দূরত্বে ঘড়ি কাঁটার বিপরীত গতি পথে থাকে। তা ছাড়া চাঁদের গতিপথের আগ্রহের মত চাঁদের আকারের আগ্রহ আছে।

এটা একটা গোলাক না হওয়া পর্যন্ত বাড়তে থাকে এবং কমতে কমতে একটা বিশেষ স্থানে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু একই সময় দৃশ্যমান পূর্ণ গোলাক সাদা থেকে কালোতে তীব্রভাবে রূপান্তরিত হয় এই বাহ্যিক কাঠামো সঙ্কুচিত হতে থাকে।

যখন সাদা অংশ এটার চক্রের চারদিক ঘিরে থাকে যেটা একত্রিত হয় এবং নিঃশেষিত হয়ে যায় কিন্তু যেটা নিজেই গোলাক হয়ে উঠে যখন সাদা হালকা হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায় কি এক অব্যক্ত ধারণার জগৎ। কি এক মহামূল্যবান মূলশিল্প উপাদান! কত যে নতুন শক্তি নাচের জন্য।

কিন্তু এখানেও কল্পনাহীন বৈশিষ্ট্য আছে। ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে সাইপোদের নতুন চাঁদ উঠার দিন (সন্ধ্যায়) “গ্রামে এক অদ্ভুত উত্তেজনা বিরাজ করে। প্রায় আটটা বাজার সয়ম নারীদের এক লম্বা লাইন পাতা দিয়ে সেজে গান গেয়ে গেয়ে অগ্রসর হয়।

তাদের সামনে রাখা গাছে কলাপাতা দিয়ে মাথা এবং কাঁধ বাঁধা আছে, অন্যদের তালপাতা তীর্যকভাবে রাখা যেন একটা গোলক তৈরী হয়েছে মাথাকে কেন্দ্র করে। শেষপ্রান্তে ছোটমেয়েদের এক দম্পতি থাকে। গান গেয়ে তারা একটা বড় গোলক তৈরী করে; প্রথম দুইজন মহিলা গানে নেতৃত্ব নেয় এবং অন্যেরা সময় সময় অংশ নেয়।

তারপর তারা নাচের ভঙ্গিতে ডান পা দিয়ে পদাঘাত করতে থাকে এবং বাহুর নিম্নভাগ উপরে নিচে নাড়াতে থাকে। নাচ-গান ক্রমাগত প্রাণবন্ত এবং অধিক উত্তেজক হতে থাকে। দুইজন শিশু কিছু শুকনা তালপাতা নিয়ে আসে এবং দুটা জলন্ত আগুনের শিখা বানায় একটা গোলকের মধ্যে অপরটা বাইরের দিকে।

শুধুমাত্র কিছু পুরুষ দেখতে পারে। নাচ এক ঘন্টা যাবৎ হতে থাকে তারপর নারীগণ ছড়ায়ে যেতে থাকে। জলন্ত কাঠের কাঠি নিয়ে চতুর্দিক ভাস্বরিত পথে তারা বাড়ী ফেরে। “এখানে অনুকরণাত্মক বিষয়বস্তু সম্ভবতঃ আলো জ্বালানো। যার অর্থ যাতে আবার চাঁদ উঠে।

অনুকরণাত্মক চাঁদ নাচ কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রথমেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। এখানে আমরা বিবেচনা করতে পারি পূর্বেই উল্লেখিত অস্ট্রেলিয়ান ওয়াটচানদিদের, তাদের নামকরা একটা চাঁদ নাচের বর্ণনা পিট এবং স্পেয়ার নাচ। এটা সম্ভবতঃ আকর করেছে এই সাদৃশ্যময় সিদ্ধান্তের জন্য যেঃ

(গর্ত) পিট= ফসল ফলান বীজ-ধারক উর্বরা ভূমি = স্ত্রী যোনিয়ার ।

স্পেয়ার (বল্লম) = চাঁদের রাশ্মি সমৃদ্ধকারী = পুরুষ লিঙ্গের প্রতীক।

গ্রীকগণ এখনও গোলক নাচের জন্য খ্যাত যা তারা বলে এক্লাসমা অথবা হাগরা অচেসিস যাতে নাচুয়েগণ চন্দ্রকলার মত ঢাল বহন করে এবং পর্যয়ক্রমে হাঁটু গেড়ে ফেলে এবং আবার উঠে পরে; তারা এটাকে পারস্যের নাচ বলে অভিহিত করে। কলম্বিয়ার ইউটোটো এবং টামাগণ পরে যাওয়া নাচের গাছকে পদাঘাত করতে থাকে যতক্ষণ না তা ভেঙ্গে যায়; চাঁদ মলিন হয়ে আসে।

কিন্তু এই একই ইউটোটোগণ চাঁদের গতিপথ অনুসারে নতুন চাঁদে গোলক গঠন করে : কিছু নাচুয়ে গোলকের খন্ড খন্ড অংশ গঠন করতে থাকে এবং তা ক্রমান্বয়ে নতুন নাচুয়ের অংশগ্রহণে গোলকপূর্ণ করে। নিউআয়ারল্যান্ডের অনুকরণাত্মক চাঁদ নাচের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন পিকেল নামক একজন মিশনারী যিনি তা কয়েক বৎসর

ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। যদি আমরা তাঁর রিপোর্টকে ভিত্তিস্বরূপ ধরি তাহলে আমরা দেখতে পাব সেখানে নিম্নে উল্লেখিতঃ

১ম চাঁদের গতিপথ : গোলক গঠন শৈলী ।

২য় চন্দ্র কলার স্তরঃপ্রধান মৌলিক শিল্প উপাদান বিদ্যমান : সামনে পিছনে এমনভাবে হাঁটবে মনে হবে সম্পূর্ণ দল ক্রমান্বয়ে নাচের আঙ্গিনার একেবারে ধারে এসে গেছে।

কনজিমিনেশনঃ

(ক ) দুইজন একক নাচুয়ে অথবা দুইদলবদ্ধ সারিতে অথবা সমকেন্দ্রিক গোলকে, যা নাচের সময় কখন কখন আলাদা গোলকে পরিবর্তিত হয়।যুগলভাবে অথবা সারিদ্ধভাবে একে অপরের দিকে ঘুরে।

(খ) চাঁদের হ্রাস বৃদ্ধি ঃ শুরুতে শরীর আনত করে উবু হয়ে বসা পরপর ক্রমান্বয়ে উপরে উঠা আবার অবনত হওয়া এবং সংজ্ঞাহীনের মত মাটিতে পরে থাকে।

(গ)নাচ আরোপ করে অস্ত্র উপরে নিচে করা। সামনে পিছনে হাঁটা।

(ঘ) উভয় সারির বিপরীত অঙ্গভঙ্গি যা চাঁদের দুই অংশের পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং আলো-আঁধারের পর্যায়ক্রম বুঝায় ।

সারিগুলি আলো এবং আঁধার পরিচ্ছদ ব্যবহার করে। শুরুতে ধীরগতি সম্পন্ন দেহভঙ্গি করে ক্রমান্বয়ে দ্রুত স্পন্দনশীল শিহরণ এবং হট্টোগোল। ছ) পূর্ণিমার জন্য সম্পূর্ণ গোলাক, ওভাল আকৃতি অর্ধচন্দ্রের জন্য (ইউটোটো বৃত্তাংশ)।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই ক্রীমের ধারণায় মনে হয় নাচের এক বৃহৎ অংশই নিশ্চিতভাবে চাঁদ সম্বন্ধীয় শ্রেণী বিভাগের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাবে। প্রথমে, গাজেলী উপদ্বীপের নাচে নাচুয়ে দুই থেকে চার সারিতে দাঁড়ায় যারা সামনে পিছনে হাঁটে, উবু হয়, দাঁড়ায়, উর্ধ- লাফ দেয় এবং তাদের বাহু দোলায়, বহন করে পালক অথবা ফুলের বান্ডিল।

অথবা মনুমবো পাপুয়াদের নাচ গোলকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থাকে “জটিল ফিগারে (অঙ্গভঙ্গি) অর্ধেক নাচুয়ে উবু হয়ে বসে এবং অন্য অর্ধেক নাচ চালাতে থাকে” । নিউগিনির সিসিয়ানুগণ ঃ একটা দন্ড ঘিরে পুরুষেরা ভিতর দিকে মহিলাগণ বাইরের দিকে গোল হয়ে দুই গোলকে বিপরীতমুখী বিপরীত অঙ্গভঙ্গি করে। নিকোবারগণ।

চারশত নারী পুরুষ দুই সমকেন্দ্রীক গোলকে পরস্পর বিপরীত দিকে ঘুরে; পর্যায়ক্রমে তাদের বাহু উপরে নিচে করে, কখন ডান দিকে মুখ রাখে কখন বাম দিকে এবং গোলাক সঙ্কুচিত ও প্রসারিত করে; ভিতর গোলকের নাচুয়েগণ হাঁটুগেড়ে নিচু হয়ে মাথা মাটিতে স্পর্শ করে এবং বাইরের গোলকের লোকেরা সোজা তাদের উপর দিয়ে পার হয়ে যায়।

টোগোর ড্যাগবামাদের নাচ সম্পূর্ণভাবে এই রকম সাদৃশ্যময়  দুই সমকেন্দ্রীক গোলক ঢোল বাদককে ঘিরে বিপরীত অঙ্গভঙ্গি সহকারে ঘুরে, কিছু ধাপ যাবার পর নাচুয়েগণ জায়গা পরিবর্তন করে এখন যারা ভিতরের গোলকে ছিল তারা এখন বাইরের গোলকে এসে গেছে।

আবার নিকোবারদের মধ্যে পুরুষদের নাচ প্রশংসনীয়ভাবে বসা, দাঁড়ান, সম্প্রসারণশীল এবং লাফ-ঝাঁপ পূর্ণ। তারপর নিউ আয়ারল্যান্ডে : নাচুয়েগণ চার দলে থাকে, একদল আর একদলের পিছনে, শুরুতে এবং শেষে নাচুয়েগণ উবু হয়ে বসে, তারপর তারা গান আরম্ভ করে, পর্যায়ক্রমে চাঁদের স্তরের প্রতিনিধিরূপে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নাচুয়েগণ সবুজগুচ্ছ হাতে নিয়ে উঠে বেন্ড করে ও মাথা সামনে প্রসারিত করে।

এইভাবে যখন নাচ জমে উঠে সামনের যুগল একেবারে পিছনের শোভাযাত্রায় ঠায় নিয়ে জায়গা বদল করে (Chassez-Croise) তারাপর লাফ দিয়ে সারির প্রথমে আবার ফিরে আসে-পর্যবেক্ষকের মন্তব্য যে, “আমাদের আধুনিক কন্ট্রি নাচের মত” ।

মধ্য এঙ্গোলার বৃত্ত আকারের গোলাকও অবশ্যই চাঁদ সম্পর্কিত। নাচুয়েগণ হাত ধরে গোলকের মধ্যে চক্কর খায়, মাঝে মধ্যে তারা বিপরীত নাচুয়ের দিকে দর্শনীয় পদক্ষেপ করে যেমন কোয়াড্রিল করা হয় এবং কখন তারা হাঁটু ডুবায়ে থাকে, ডান দিকে বামদিকে বেন্ড করে এবং পিছনের দিকে ঝুঁকে পরে।

কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে তারা বিকট চিৎকার করে উঠে এবং কেন্দ্রস্থলে ছুটে গিয়ে বাহুদ্বয় উপরের দিকে আকাশে নিক্ষেপ করে এবং পায়ের অগ্রভাগে উঁচু হয়ে দাঁড়ায় ।সমস্ত দল উর্বোচ্চ মাত্রায় হর্ষোচ্ছাসে মেতে উঠে, তারপর যদিও তারা অতিমাত্রায় পরিশ্রমের কারণে আস্তে ক্লান্ত হয়ে পরে তারা মাটিতে চোখবন্ধ করে লুটায়ে পরে এবং কপাল মাটিতে স্পর্শ করে। এখানে কোন সন্দেহের অবকাশ আছে কি?

গোল হয়ে ঘুরায় একে অপরকে দেখা, ডান, বাম এবং পিছনে বেন্ড করে ক্রিসেন্ট (প্রথম দিকের চন্দ্র কলা) আকৃতি তৈরী করা, বিকট বিকৃত স্বরে হঠাৎ উঠে পরা এবং সকলে একসঙ্গে নেতিয়ে মাটিতে পরা – এই সকলই প্রচলিত চাঁদ- নাচের মূলশিল্প উপাদান রূপে পরিচিত।

ইউরোপীয়ান নাচে চাঁদ নাচের থিম (বিষয়বস্তু) অনুসৃত হয়েও থাকে। ১৪০০ খৃষ্টাব্দে (?) বার্লিনে উভয় লিঙ্গের গোলাক নাচ. (Zwolfmondentanz) বার-চাঁদের নাচ নামে অনুষ্ঠিত হয়। বারজন যুগল কেন্দ্রের দিকে মুখ করে গোল হয়ে প্রথমে নাচে তারপর বাইরের দিকে (হ্রাস এবং বৃদ্ধি) তারা চার দলে বিভক্ত হয়ে পরে (স্তরে অথবা ঋতুতে?), আর একবার গোলক গঠন করে এবং উচ্চ চিৎকারে নাচা শেষ করে।

সম্ভবতঃ সেই সময় ১২০০ থেকে ১৪০০ খৃষ্টাব্দে ব্যাখ্যাহীন ট্রিএলট্রি (Treialtrei) নাচা হত যেটা জার্মানীর আবেগপূর্ণ কবি এবং গায়কদের সময়ে বার-চাঁদের নাচের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত।আমাদের অবশ্যই আরো অন্য মূল শিল্পউপাদান বিবেচনা করতে হবে। সব জনগোষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনীতে নিস্তেজ দেবতার ধারণা বিদ্যমান। পৌরাণিক চিন্তা-ধারায় নিস্তেজ দেবতার অর্থ “আরম্ভ করার জন্য নিস্তেজ হতে হয়।

 

চাঁদ নাচ

 

যে সমস্ত বড় বড় প্রাকৃতিক দেবতাগণ বছর ধরে বাঁচে কিন্তু শেষে মারা যায় এবং বসন্তে নব যৌবন প্রাপ্ত হয়ে আবার জীবন্ত হয়ে উঠে, তাদের জীবন চক্রের প্রথমে ক্ষমতাহীন থাকে এবং খোড়ায়ে হাঁটে না। গ্রীক দেবতা ডায়নোসাস এবং মিশরীয় অসিরিসের ছেলে হারপোক্রেট্সও হয়ত এই ধরনের দেবতা ছিলেন- যেমন গলিত মোমের মত সজীব স্বচ্ছ চাঁদকে কৃষ্ণ-চাঁদের অংশকে জয় করে অতিক্রম করতে হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment