আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – কল্পনাপ্রবণ নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
কল্পনাপ্রবণ নাচ
নাচের ইতিহাসের শুরুতে স্পষ্ট দুই মৌলিক ধরন আমরা পূর্বাহ্নে প্রতিবেদন করেছি, এইরূপ কৃষ্টিগত ইতিহাসেরও দুই মৌলিক ধরন সাধারণভাবে এসে দাঁড়ায়। একটা আকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা দ্বারা চালিত, অতীন্দ্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক, ক্রমাগত শরীরের বিরুদ্ধে পরিচালিত যদিও শারীরিকভাবে সাফল্য লাভ করে। অন্যটায় মৌলিক ধরন বহির্মুখীয় সৃষ্টি, যার চেতনায় বিশ্বাস আছে এবং সচেতন, সপ্রতিভ, সুঠামদেহী, দূরদর্শী ক্ষমতা বাস্তবে ঘটায় ।
আমরা সাদৃশ্যে অথবা গঠন সৌন্দর্যে কল্পনাপ্রবণ নাচের ধর্মীয় ক্রিয়ায় পার্থক্য হয়ত বিবেচনায় আনতে পারি। জিনিষের সারবস্তুই তার অর্থ গঠন এবং সচলতায় যা কিছু বোঝা যায় তাতে দৃঢ় সংশ্লিষ্ট হওয়া। সুতরাং এইটুকু পর্যাপ্ত যে, চিত্রকলা অথবা নাচে কামনাকৃত ঘটনার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়, যুদ্ধ জয়, শিকারে কামিয়াব, যাতে তার প্রতি নিশ্চিয়তা, যাতে তার উপর আধিপত্য বজায় থাকে ।
কিন্তু এই মানসিকতার পিছনে মূখ অভিনয়ের সহজাত প্রবৃত্তি সক্রিয়। (এছাড়া আর কি হতে পারে?) যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ এবং লোকজনের তীব্র অনুভূতি আছে বুঝা যাবে তারা জন্মগত অভিনেতা এবং যাদের অনুভূতির অভাব আছে তাদের এই প্রতিভা কম।
সাম্প্রতিক কালের কাজে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে যে, উত্তর-পূর্ব গ্রান চ্যকো জেলায় দুই জনগোষ্ঠীর বৈপরীত্য খুবই তীব্র। উদাসীন কাশকিহাদের চেয়ে প্রাণবন্ত চ্যামাকোকোদের দেহভঙ্গির প্রকাশ খুবই পরিস্কার। “আনন্দ উচ্ছাসে এবং ভালবাসা প্রকাশের জন্য চাল-চলন অসংখ্য যেগুলি ইঙ্গিত করে মানুষ, জীব-জন্তু, খাবার জিনিষ অথবা অন্যকোন বস্তুর।
বিশেষ করে চ্যামোকোকোদের মধ্যে চাল চলনের ভাষা নাচে রূপান্তরিত হয় খুবই পরিস্কার রূপে। যে কেউ বলবে যে, এই ইন্ডিয়ানগণ মনের যে কোন সজীব হিন্দোলকে নাচে প্রকাশ করেছে আনন্দ উচ্ছাস, স্নেহের স্পৃহা, অপদেবতার কাছে আকুতি অথবা তাদের বিরুদ্ধে দূর্জয় প্রতিরোধ, ঘূনামিশ্রিত ক্রোধ অথবা মানসিক যন্ত্রণা-অন্যদিকে কাশকিহাদের নাচ দ্বিধাগ্রস্থ বিরাক্তিজমান সামনে পিছনে” ।
এই দুই প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রয়োজনীয় বৈপরীত্য হল তাদের আচার আচরণে তারা ভিন্ন না কিন্তু তার চেয়ে সত্য কথা যে, উদাসীন কাশকিহাগণ কৃষিজীবি এবং আকার ইঙ্গিতকারী চ্যামাকোকোগণ শিকারজীবি। আমাদের গ্রন্থের এইবিভাগের বিষয়বস্তু তৈরী হয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে যেমন ভ্রমণকারী, শিকারজীবি জনগোষ্ঠীর যা আছে তা নিয়ে ।
চ্যামাকোকোদের মত বহির্মুখী লোকেরা শুধুমাত্র ইচ্ছাপোষণ করতে পারে না, তার নির্দিষ্ট বশীভূত আবেগকে প্রতিনিধিত্ব করতে বাধ্য হয়। একজন তদন্তকারী পুনরায় পরীক্ষা করেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকার মার্টসগণ নৌকায় ভ্রমণের সময় নৌকার গান (ভাটিয়ালী) গায় তখন তারা স্বেচ্ছায় নৌকা বাওয়ার গতিতে ভাসতে থাকে এই ধারণা কাজে রূপান্তরিত হয়।
সম্ভবতঃ এই পয়েন্ট থেকে আমরা ঐ সকল হস্ত-শিল্প থেকে নাচের শুরু হবার দিক্ নির্দেশনা পাই যার মূল ফসলকাটা-নাচ, শিকারী-নাচ যেটা সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত আনন্দ উচ্ছাসের সঙ্গে বেঁচে আছে যেমন তাঁতী-নাচ, চিমনীমোছা-নাচ, কাঁচিচালনা-নাচ এই রকম আরো অনেক। কাজের মধ্য দিয়ে কাজের গান জন্ম নেয়, কাজের গান, কাজ বিচ্ছিন্ন হলে পরবর্তী কাজের গতি প্রতিফলিত হয়। তাদের কাজের নাচে রূপান্তরের কারণ, কাজের আশ্চর্য রকমের নির্দিষ্ট গতি সঞ্চার করা।
এইরূপ কল্পনাপ্রবণ নাচের কম আনন্দ-উচ্ছাসপূর্ণ হবার প্রয়োজন নাই, কল্পনাহীন নাচের তুলনায় উটসের হর্ষোৎফুল্ল নাচ এবং মূখাভিনয় নাচের বৈপরীত্য সঠিক না। আমরা এই গ্রন্থের এই বিভাগে মধ্য-যুগের প্রতি অনুরক্ত হস্তশিল্প নাচের কথা বলব যেখানে নাচুয়ে থামতে সক্ষম হয় ততক্ষণ না সে নিষ্ক্রিয় অজ্ঞান হয় শেষতক।
কল্পনাপ্রবণ নাচে নাচুয়ে নিজের যেগ্যতায় সক্ষম। যে ব্যক্তি, জীবজন্তু, যাদুশক্তি বা দেবতা যা সে প্রতিনিধিত্ব করতে চায় তা তার শরীরে নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। নাচুয়ে জীব-জন্তুর যাদুশক্তি অথবা দেবতা হয়ে উঠে। সে অবশ্যই বাস্তবের মতই অভিনয় করবে, সে অবশ্যই কাজ করবে, দিবে ও দোয়া করবে।
কিন্তু এটা বিশেষ প্রযোজনীয় যে, কল্পনাপ্রবণ নাচে সাময়িক উন্মত্ততা নাচ গঠনের অংশ বিশেষ। নাচ ঘটমান সত্য না, অতিরিক্ত উদ্যমের ক্ষয়করণ না তথাপি সমন্বিত ছন্দপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ হর্ষোচ্ছাস প্রকাশ করে (উৎপন্ন), কিন্তু তার চেয়ে বাহ্যিক আকৃতি ধারণ করা জ্ঞানকে বোধগম্য করে-একটা ধারণা (চিন্তা-চেতনা) শুধুমাত্র মূখাভিনয় সম্পর্কীত না, সুসংহত অনুকরণাত্মক ভঙ্গিমা, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা কল্পনার চরিত্রে অবির্ভূত হওয়া অথবা বস্তু পাওয়া।
একটা ঘটনা চিত্রিত কালে নাচুয়ে তার মাষ্টার হয় এবং সে নিজের মাষ্টার হয় আত্মবিসর্জন দিয়ে। জাভানিজ নাচুয়ে একটা খড়কুটার তৈরী ঘোড়ার প্রতিকৃতিতে চড়ে ক্লান্ত হয়ে পরে (প্লেট-৩)। প্রাচীন জার্মানদের মধ্যে হর্ষোচ্ছাস শুরু হয় ঐ মুহুর্তে যখন নাচুয়েগণ জীব-জন্তুর চামড়া পরিধান করে। নিজেকে নিজীব করার জন্য চামড়াই যথেষ্ট এবং জীব-জন্তু যাদুশক্তি অর্জনের সহায়ক।
দেব-দেবীর বিশ্বাস স্থাপনে এই হর্ষোচ্ছাসপূর্ণ মূখাভিনয় ধর্মীয় জীবনের সকল স্তরে উত্তরণের সহযাত্রী হয়েছে। অসিরিস, ডায়ানোসাস, শিব এবং পুরাতন ম্যাক্সিকোর দেবদেবী-গড় পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন ও নাচে মানবদেহ ধারণ করেছেন। অনেক কিছুর মধ্যে নাচে দেবত্ব আরোপণে গুণগতমান হ্রাস হলেও “নাচের দেবতার” সুন্দর চিন্তাধারা বিশ্বকে সৃজনশীল করেছে এবং পরিত্ররূপে ধারণ করেছে।
আরও দেখুনঃ