একক নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – একক নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

একক নাচ

 

একক নাচ

 

সকল নাচই মূলতঃ গভীর উত্তেজনা ও বহুল কর্মস্পৃহার স্বতঃস্ফূর্ত বহিপ্রকাশ। এইরূপ একেবারে শুরুতেই অসংগঠিত ব্যক্তির নাচ সংঘবদ্ধ নাচের পাশে অবস্থান করলে বুঝা যাবে সংঘবদ্ধ নাচ সুসংগঠিত লোকসমাজের উত্তেজনার প্রতিফলন প্রতিনিধিত্ব করে।

আমাদের পূর্বোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে জীবজন্তুর অধ্যয়ন এবং আদিম মানুষের সঙ্গে অভিজ্ঞতা এই বক্তব্যকে সমর্থন দেয়। যথন আদিম মানুষ কোন একজন চলে আসা আগন্তুকে শান্তি প্রস্তাব করে তার গ্রামের (বসবাসের স্থানে) প্রবেশ মুখে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে লাফায় দুলায় অথবা হঠাৎ সাদা-চামড়ার মানুষ দেখলে সে প্রচন্ড ভয়ে নারী-শিশুদের নলখাগড়ার মধ্যে লুকায়ে রেখে হালকা পানিতে যুদ্ধ-নাচ করে, আমাদের এই রকম অতি সাধারণ ধরনের একক (ব্যক্তি) নাচের উদাহরণ আছে।

প্রচন্ড আবেগ প্রবণতা ও প্রবৃত্তিপরায়ণতা ক্রমান্বয়ে প্রতিস্থাপিত হয় তখনই যখন কোন কিছু পরিকল্পিত, সুসংগঠিত হয়ে বের হয়ে এসে একজনের সুনির্দিষ্ট কার্যাবলীতে নাচকে অভিব্যক্তির বহিপ্রকাশের ফরমরূপে আরোপিত করতে পারে।

গ্রানচ্যাকোর গুইচরুর যুবক আনুষ্ঠানিক পোষাক পরে তার কাছে পূর্বে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুবতীর কুঠিরের সামনে আটদিন ধরে প্রচন্ড ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নাচ করে, সুমাত্রার গাজোদের মধ্যে বরকে অবশ্যই মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত নাচতে হয়; উসাই (এডমিরালিটি দ্বীপপুঞ্জ) তে যে একটা শুকর পায় সে হাতে বল্লম নিয়ে সরু মুখের ঢোলের শব্দের সঙ্গে লাফ দেয় এবং নিউ ক্যালিডোণিয়ায় ব্যবসায়ীগণ বাজারে তাদের পণ্যের পোষাক পরে নাচের সঙ্গে প্রদর্শনী করে।

প্রথম ঋতুদর্শনের সময় থেকে মেয়েটি তার স্বাতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও লোক-সমাজের বা সম্প্রাদায়ের প্রতিনিধিত্বকারীর সীমানায় দাঁড়ায়। যখন ক্যালিফোর্নিয়ার ইন্ডিয়ানদের নতুন ঋতুপ্রাপ্ত মেয়ে পূর্বদিকে মুখ করে দশরাত সামনে পিছনে চলে নাচ করে সে নাচের মধ্যে দিয়ে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ নারীত্ব অর্জনের ক্ষমতা লাভ করে; তারচেয়েও অধিক সে সম্প্রদায়ের একজন পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনক্ষম (সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা) সদস্য হয়।

যদি তার নাচের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রদাযের কোন ব্যাপার না হত তবে গ্রামের লোক একনকি পার্শ্বের শহরের আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত অবশ্যই তার বয়ঃপ্রাপ্তি উৎসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে কোন আকর্ষণ পেত না।

বিশেষ করে বৃষ্টি আবাহনের যাদুগিরি ও তদরূপ উৎপাদন বৃদ্ধির ধর্মীয় প্রথায় প্রমাণিত হয়েও কিসের পরিপ্রেক্ষিতে তরুনী কুমারী সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে থাকে যেটা নাচের মধ্যে পূর্বে আলোচিত হয়েছে। উদাহরণের জন্য আমাদেরকে ইউরোপ এমনকি জার্মানীর বাইরে যেতে হবে না।

প্রুশিয়ান লিথুনিয়ায় বসন্ত উৎসবে কুমারীদের সূর্যের দিকে মুখ করে নাচার প্রচলন আছে; বহেমিয়া ও প্লাটিনেটে শুধুমাত্র কুমারীগণ “মে” নাচে অংশ নেওয়ার অনুমতি পায় স্পেনীয় গীর্জা-নাচ ছেলেদের অথবা মেয়েদের সংঘবদ্ধ নাচ।

এই জ্ঞানের মধ্যে আমরা ইউরোপের বাইরে কুমারীদের নাচ বুঝতে পারি; স্লিবিসের ছয়জন মেয়ে সরু গোলকের মধ্য থেকে আস্তে আস্তে প্রায় চক্রশক্তিতে রূপ নেয়, খাসীর কুমারী খুব সকালে তাকে মদ্যপানের আমন্ত্রণজ্ঞাপনকারীর সামনে নাচে এবং দুইজন লোক হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে গ্রামের মুক্ত আঙ্গিনায় আনে;

তাসমানিয়ার মেয়ে পাতার সাজসজ্জা করে পুরুষদের সামনে নাচে দুইহাত মাথার পিছনে দুই পা জোড়া করে হাঁটু দুইদিকে ছড়ান এবং একসঙ্গে সজোরে চট করে ধাক্কা দেয় “পুরুষদের যৌন উত্তেজনা” উত্তেজিত করতে, বলেন বনউইক কিন্তু মূলসূত্রের প্রেক্ষিতে এটা সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা ব্যাখ্যা।

তৎসত্ত্বেও এটা উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির মোহনীশক্তি না যখন ইয়াপ দ্বীপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যুবতী মেয়েরা ধীরে, বাহু ও শরীরের যৌনতাহীন নাচ করে; অথবা যখন ইয়াপেই নতুন চাঁদে পুরুষেরা একটা মেয়েকে মধ্যে রেখে চারদিক ঘিরে বসে এবং বাহু ও শরীরের নম্র ও সজীব প্রকৃতির দেহ ভঙ্গিমা করে এবং সিরানে মহিলা ছাড়া শুধু যুবতীগণ নাচ করার অনুমতি পায়।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

দৃষ্টিভঙ্গিটা সত্যই খুবই ব্যাপকভাবে ছড়ান যে, যে সমস্ত ছেলেমেয়েদের যৌনসঙ্গম হয়নি তারা বিশেষভাবে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক শক্তিপ্রাপ্ত এবং এমনকি প্রাথমিক খৃষ্টান ইতিহাস বলে শিশুরাই বৃষ্টি আবাহন প্রার্থনা করে থাকে। মূলশিল্প উপাদান দূর্বলতর হয়ে কম্বোডিয়ান দরবারী ব্যালেতে প্রকাশ পেয়েছে; নর্তকী মা হবার পরে আর নাচেতেপারে না।

অন্যভাবে এটা আর একবার প্রকাশ পায় প্লেইনস ওজিবওয়ে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যখন অংশগ্রহণকারীগণ বিশেষ নাচের সময় অবশ্যই অনুপস্থিত থাকবে অথবা গালে কালো দাগ লাগায়ে রাখবে। এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায় কেন নতুন সাম্রাজ্যের কালে (১৫০০ খৃঃ পূঃ) মিশরের নাচের ছবি ছোট্টদের বলতে গেলে কচি-মেয়েদের বারবার বর্ণিত করেছে, এমনকি যখন কোন প্রার্থনা নাচের কোনরূপ প্রশ্নের আভাস থাকে না।

কিন্ত জনগোষ্ঠীর সার্বিক প্রতিনিধিত্বকারী অতি উত্তেজিত মোহাবিষ্ট মানুষ এত কল্পনাপ্রবণ যে, তারা সাময়িকভাবে মানবিক অবস্থা ভূলে গিয়ে দৈবক্ষমতার প্রাণবন্ত রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম-কবিরাজ, ওঝা ও ফকির নাচের ইতিহাসের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। তার কর্তব্য অপশক্তির ক্ষমতা (ভূত, প্রেত) দূরীভূত করা, অভিশাপ খন্ডন, রোগ সারান, তার প্রধান মাধ্যম মোহাবিষ্টপূর্ণ নাচ ।

হাঁটু নমনীয় করে শরীর সামনে ঝুঁকে চোখ বন্ধ করে, একপা থেকে অন্য পায়ে লাফিয়ে গোল চক্রের চারদিকে লম্পঝস্প করতে থাকে যতক্ষণ না সে মোহাবিষ্ট অবস্থার স্তরে পৌছে। নাচ আরো দ্রুত হতে থাকে দেহ ভঙ্গি আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং আরো খেঁচুনিপূর্ণ হতে থাকে যতক্ষণ না নাচুয়ে জ্ঞান হারায়ে য়েলে এবং এইভাবে আবার জ্ঞান ফিরে পায়।

হাজার হাজার বৎসরের আবর্তনের মধ্যে ইহুদি এবং প্রাথমিক কালের খৃষ্টানদের নবীগণ যাঁরা মোহাবিষ্ট নাচে “গড” এর দৈবক্ষমতা দেখতেন এবং পুরোহিতসম গোষ্ঠীপ্রধান ও পুরাতন রাজতন্ত্রের রাজাগণ ফকিরের বংশোদ্ভূত। গোষ্ঠীপ্রধান এবং রাজাদের নাচে এই বিশেষ ধরনের প্রথার বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত আছে।

টোনগার পলেনেশিয়ার কৃষ্টিতে শুধমাত্র গোষ্ঠীপ্রধান ও নেতাগণ কঠিন দেহ ভঙ্গিমার নাচ কেমন করে করতে হয় তা জানে। আফ্রিকান নিগ্রো রাজবংশ সমূহের উইনফোর্থের বর্ণনা পড়া ছাড়া আমাদের ভাল কিছু নাই। ম্যাগ্নবেটুদের রাজা মুনসা, যে তার স্ত্রীদের ও যোদ্ধাদের সামনে বিরাট উৎসবে লম্পঝম্প করে ঘুরে “হিংস্র নাচের মধ্যে তার বাহু সকলদিকে বিক্ষিপ্ত করে যেন ভর প্রাপ্তি ঘটেছে”।

এমনকি কৃষ্টির উন্নত স্তরেও রাজার নাচ অবসাদগ্রস্থ হোক সেটা গ্রহণযোগ্য হত না । পুরাতন ম্যাক্সিকোতে যুবরাজগণ প্রতি চার বৎসর পর নাচত। “তারা বাইরের দিকে অবস্থান নিত; মটেচুহকমা নাচে নেতৃত্ব দিত, অন্যরা শোভাযাত্রা অনুসরণ করে দুই মহান রাজা টেককোকোর রাজা ন্যাকাওয়ালপিলি এবং টিপানিকার রাজা টটোওয়াজটলি তার পাশে অবস্থান নেয়, দর্শকগণ ভয়ে কাঁপতে থাকে যখন নাচ চলতে থাকে” ।

প্রাচীন মিশরের ফেরাওগণ মন্দির-দেয়াল লম্বা ও পরিমিত পদক্ষেপে নেচে ঘুরত যাতে সূর্য তার পথ পরিক্রমায় নির্বিগ্নে ঘুরতে পারে, পারস্যের রাজা (সম্রাট) মিথরা দিবসে নাচ করত, এবং ইসরাইলে বাদশা দাউদ (আঃ) ইহুদিদের আইন সংক্রান্ত রচনাবলী রক্ষিত কাঠের সিন্দুককে ঘিরে লাট্টুর মত ঘুরতেন।

 

একক নাচ

 

রাজা-বাদশাদের মতই পৌরহিত্যের উত্তরাধিকার নির্ধারণ হত। বাইবেলোত্তর তালমাড (ইহুদিদের আইন সমন্ধে) সময়ে ইহুদী পুরোহিত রাব্বী হাতে গাছের ডাল নিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠানে নাচে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও মধ্য জার্মানীতে ইহুদী পুরোহিত ও খৃষ্টান পাদ্রী নব বধুর সঙ্গে সর্বপ্রথমে নাচবে। এমনকি বর্তমান কালেও ফিরো দ্বীপপুঞ্জে এই প্রথাগত পোষাকের লোকেরা বিবাহ অনুষ্ঠানে নাচে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment