Site icon Dance Gurukul [ নৃত্য গুরুকুল ] GOLN

সৃজনশীল নৃত্য ভাবনা – গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়

সৃজনশীল নৃত্য ভাবনা - গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সৃজনশীল নৃত্য ভাবনা নিয়ে লিখেছেন “গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়”। এই প্রবন্ধটি “ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য” প্রবন্ধ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত।

 

 

সৃজনশীল নৃত্য ভাবনা গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে Creative Dance বা সৃজনশীল নৃত্য কথাটি প্রচলিত। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিষয় হিসাবে এটি স্বীকৃত। নৃত্য প্রতিযোগিতায় অন্যান্য নৃত্যশৈলীর সঙ্গে এটিও সংযোজিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, অন্যান্য নৃত্যশৈলীর মতো এটিও একটি বিশেষ নৃত্যপদ্ধতি। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

অন্যান্য নৃত্যের মতো গুরুমুখী শিক্ষার মাধ্যমে সৃজনশীলতা অর্জন করা যায় না। কারণ বিষয় নৃত্যপদ্ধতি নয় নৃত্যভাবনা । এই সৃজন অভিযাত্রার আদর্শ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

‘Life is perpetually creative because it contains in itself that surplus which ever overflows the boundaries of the immediate time and spaces, restlessly pursuing its adventure of expression in the varied forms of self realisation’. (The meaning of Art).

অর্থাৎ সৃজনশীল প্রকাশকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই শিল্পীর সৃজনশীল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকাশের এই আকাঙ্ক্ষাই আদিম যুগ থেকে মানুষকে সৃজনশীলতায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ :

‘এই একান্ত আকাঙ্ক্ষায় কত প্রাচীন কাল ধরিয়া কত ইঙ্গিত, কত ভাষা, কত লিপি, কত পাথরে খোদাই, কত গাছের ছালের, পাতায়, কাগজে, কত তুলিতে, খোন্তায়, কলমে, কত আঁকজোক, কত প্রয়াস বাঁ দিক হইতে ডাইনে, ডাইন দিক হইতে বাঁয়ে, উপর হইতে নীচে;

 

 

এক সার হইতে অন্য সারে! কী? না, আমি যাহা চিন্তা করিয়াছি, আমি যাহা অনুভব করিয়াছি, তাহা মরিবে না; তাহা মন হইতে মনে, কাল হইতে কারে চিন্তিত হইয়া, অনুসৃত হইয়া প্রবাহিত হইয়া চলিবে।’ তাদের মতে সৃজনের বিচার শিল্প বস্তু বা প্রকাশকে কেন্দ্র করে নয়। তার উৎস সন্ধানে আমাদের যেতে হবে শিল্পী ব্যক্তিত্বের সেই বিশিষ্ট রূপরেখা কল্পনার কাছে।

এই বিশেষ বিশ্লেষণের নাম Factor Analysis। তাদের মতে এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ ও উৎকর্ষ ঘটানো যায় সৃজনী ক্ষমতার মানের। বিরুদ্ধবাদীদের মতে এই পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ইঞ্জনিয়ারদের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রযোজ্য হলেও শিল্পী বা স্রষ্টার ক্ষেত্রে তা একান্ত অবাস্তব ।

এই মনস্তাত্ত্বিক গবেষকরা (Factor analyst) সৃজনশীলতাকে বিজ্ঞানের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে চান, সেজন্য এরা বলেন সৃজনশীলতাও চন্দ্র, সূর্য, মাধ্যকর্ষণের মতো এক জাগতিক বা প্রাকৃতিক বস্তু। সৃজনশীল মানুষ এদের অনুসন্ধিৎসার বিষয়।

এরা মনে করেন, মানব শরীরের কলাকৌশল যেমন আবিস্কার করা যায় তেমনি মানুষের সৃজনশীলতাও তার অন্তনির্হিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষ পরীক্ষায় আবিস্কার করা যায়।

এদের মতানুসারে যদি ধরে নেওয়া যায় ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সম্ভোগোচ্ছার মতো সৃজনশীলতাও শিল্পীর ভেতরের এক স্বাভাবিক ব্যাপার, তাহলেও শিল্পীর শিল্পকর্ম যথার্থ সৃজনশীল হয়ে উঠেছে কিনা যে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সময় আমাদের শিল্পবস্তুকেই বিচার করতে হয়। সৃজনশীলতা নিছক fact নয়। তা মূল্যায়নের সঙ্গে সংপৃক্ত।

যদি ধরাও যায় সৃষ্টির শিকড় শিল্পীর এক বিশেষ মানসিক পরিমণ্ডল (personality traits) এর মধ্যে নিহিত যা সৃজন সুধান্বিত; তা হলেও সৃজনশীলতা নিছক মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া নয়।

সৃজনশীল কর্মে সব সময়েই পুরোযায়ী নবরূপের উত্তরণ ঘটে কিন্তু তার সঙ্গেও অন্তলীনভাবে সংলগ্ন হয়ে থাকে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও অভিজ্ঞতা। সৃজনশীল স্রষ্টাকে তিনটি শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে। তাকে হতে হবে নতুনত্বের দিশারি, মূল্যবান এবং গ্রহণীয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : রস জিনিসটা রসিকের অপেক্ষা রাখে।

কেবলমাত্র নিজের জোরে নিজেকে সে সপ্রমাণ করিতে পারে না।’ (সাহিত্যের পথে)। এ কথাটি সৃজনশীল নৃত্যপরিকল্পকের অবশ্য স্তর্তব্য এই গ্রহণীয়তার কথা মনে রাখলেই তারা ফ্রাস্ট্রেশনের শিকার হবে না- আজ না হলে আগামীকাল আদায় করে নেবেনই সহৃদয় হৃদয়ের নিঃসংশয় ও বিমুদ্ধ স্বীকৃতি ।

নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় দুটি পরস্পর পরিপূরক সূত্র পাওয়া যায়। শিল্প আবেগ (Art impulse) এবং সৃজনশীল প্রেরণা (creative urge)। প্রশ্ন উঠতে পারে শিল্পস্রষ্টা কোনো বিশেষ প্রতিভার অধিকারী।

আলঙ্কারিকেরা সাধারণত প্রতিভার দুটি স্তরের কথা বলে থাকেন— প্রথমটি কারয়িত্রী অর্থাৎ সৃজনমূলক (creative), দ্বিতীয়টি ভাবয়িত্রী অর্থাৎ বিশ্লেষণধর্মী (critical)। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে প্রকৃত স্রষ্টার মধ্যে সৃজনশীল কর্মের সঙ্গে আত্মবিশ্লেষণী শক্তিও নিঃশব্দে তার ভূমিকা পালন করে যায়। তা না হলে সৃষ্টিকর্ম শিল্পের সার্থকতায় উত্তীর্ণ হতে পারে না ।

সৃজন প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি স্তরকে অতিক্রম করতে হয়:

১. Imitation (অনুকরণ)

২. Imagination (কল্পনা)

৩. Intuition (সংজ্ঞা)

৪. Expression (প্রকাশ)

৫. Communication (সঞ্চার)।

সৃজনপ্রেরণার উৎসে আবেগই প্রাথমিকভাব সম্পদ।

 

এই আবেগই পরিমিতবোধের মধ্য দিয়ে পরিশীলিত পরম ইতিতে উত্তীর্ণ হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে সৃজনশীলতার বিকাশে গুরুমুখী বিদ্যা বা শিল্প বিদ্যালয় কতটা সহায়ক হতে পারে। যে কোনো সৃষ্টিকর্মেই শিক্ষা অব্যশই একটি শর্ত, কিন্তু তা ছাড়াও একটি প্রেরণা সৃজনশীলতাকে উদ্বোধিত করে।

এ প্রসঙ্গে লিও টলস্টয়ের উদ্ধৃতি : ‘শিল্পী যখন শিল্পকর্ম ধৃত অতি সূক্ষ্ম পরিমাপগুলোর নির্ভুল প্রয়োগ করতে পারেন— একমাত্র তখনই সংক্রমণ ঘটে, এবং শিল্পী এ বিষয়ে যে পরিমাণে সিদ্ধিলাভ করেন সে পরিমাণে সংক্রমণও ঘটে থাকে। বাহ্যিক কোনো উপায়ের সাহায্যে মানুষকে এ সমস্ত সূক্ষ্মতম পরিমাপগুলো শেখানো সম্পূর্ণ অসম্ভব।

একমাত্র অনুভূতি প্রভাবিত হলেই শিল্পী সেগুলোর সন্ধান পান। কোনো শিক্ষাই নৃত্য-শিল্পীকে সংগীতের ছন্দলয়ের নির্ভুল মর্মগ্রহণে সাহায্য করতে পারে না, তেমনি কোনো শিক্ষাই সংগীতশিল্পীকে তার সুরের সুক্ষ্মতম কেন্দ্র সম্পর্কে অবহিত করতে পারে না।

অথবা কোনো চিত্রশিল্পীকে সম্ভাব্য সকল রেখার মধ্যে যথোপযোগী রেখা আঁকতে সহায়তা করে না কিংবা কোনো কবিকে যোগ্যতম শব্দরাজির স্বার্থক বিন্যাস উদ্ভাবনে সাহায্য করতে অক্ষম। কেবলমাত্র অনুভূতির সাহায্যেই এ সমস্ত শৈল্পিক সুক্ষ্মজ্ঞান আয়ত্ত করা সম্ভব।

‘ অবশ্যই এই অনুভূতিকে অনেকে দৈবীপ্রেরণা বা অলৌকিক প্রতিভা বলে যে ব্যাখ্যা দেন তা আদৌ সঙ্গত নয়। মনের যে গভীরলোকে সৃজনচেতনার জন্ম তার রহস্য আজও আমাদের অজানা। বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে তার কতটুকুই বা দেখা যায়। বারোআনাই থাকে দৃষ্টির অগোচরে। অবচেতন মনের সেই আধারে আমাদের চোখ চলে না।

চেতন মনের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তেই আমাদের সংলাপ চলছে। কখনও সে আমাকে উদ্বুদ্ধ করছে, কখনও পিছু টানছে। অবচেতন মন এত প্রত্যক্ষ নয়, কিন্তু সে মৃত বা নিষ্ক্রিয়ও নয়। সে তার স্বরাজ্যে সম্রাটের মতো সক্রিয় নির্দেশক। শিল্পের জন্ম চেতন মনের আলোতে, কিন্তু সৃজন প্রেরণার শিকড় ছাড়িয়ে থাকে অবচেতন মনের মায়াবি আলো- আঁধারিতে।

এ যেন বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অদ্ভুত জলাশয়। আবেগ উৎসারণে কখনও সে অতলস্পর্শী জলপ্রপাত। কখনও শান্ত প্রবাহে, রূপের রোদ্দুরে দেখিয়ে দেয় দূর বন্দরে যাওয়ার পথ। আর তখনই বুকের ভেতর ভেজা মাটিতে অঙ্কুরিত হয় সৃষ্টির বীজ। সৃজনশীল নৃত্যভাবনার বিশ্লেষণে স্বভাবতই দেশবিদেশের বিভিন্ন শিল্পীব্যক্তিত্বের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ বিচার্য।

ইসাডোরা ডানকানের সৃজনশীল শিল্পচিন্তার প্রভাব ও শিল্পসাধনা সে যুগে সমগ্র প্রতীচ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রখ্যাত গবেষক ও নৃত্যভাষা আবিস্কারের অন্যতম স্রষ্টা Ruby Ginner বলেছেন :

‘Educationally, however, the strongest force is that which has found life through a revival of the beautiful simplicity of Greek Art, which serves to miligate the complexity and tumult of modern times. The first exponent of this from was that great artist of the Dance, Isadora duncan, who regarded movement not only as a means of artist expression but a power where with to reform life.’ (Revival of Helenic dance-p. 12.)

এ প্রসঙ্গে ইসাডোরার ভাবনাকে অনুসরণ করা যাক :

‘My Art is just an effort to express the truth of my being in gesture and movement. It has taken me long years to find even one absolutely true movement. Words have a different meaning. Before the public which has thronged my representations, I have had to hesitation. I have given them the most secret impulses on my soul. From the first I have only danced my life. As a Child I danced the spontaneous joy of growing things. As an adolescent I danced with joy turning to apprehension of the pitiless brutality and crushing progress of life’. (My Life : Isadora Duncan p. 8-9).

এই শিল্পভাবনাই পরবর্তীকালে প্রথাগত ব্যালে ট্রেনিং এর পরিবর্তে এক নতুন শিল্পরীতি প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে। এই ভাবনার পরবর্তী পর্যায় :

‘I spent long days and nights in the studios seeking that dance which might be the divine expression of the human spirit through the medium of the body’s movement. For hours I would stand quite still, my two hands folded between my breasts, covering the solar plexus.

My mother often became alarmed to see me remain for such long intervals quite motionless as if in a trance-but I was seeking, and finally discovered, the central spring of all movement, the creator of motor power, the unity from which all diversions of movements are born,

the mirror of vision for the creation of the dance-it was from this discovery that was born the theory on which I founded my school. The ballet school taught the pupils that the spring was found in the center of the back at the base of the spine.

‘From this axis, says the ballet masters, arms, legs and trunk must move freely, giving the result of an articulated puppet. This method produces artificial mechanical movement not worthy of the soul. I, on the contrary, sought the source of the spiritual expression to flow into the channels of the body,

filling it with vibrating light-the centrifugal force reflecting the sprits vision. After many months, when I had learned to concentrate all my force to this one center, I found that thereafter when I listened to music the rays and vibrations of the music streamed to this one fount of light within me-there they reflected themselves in spiritual vision,

not the brains mirror, but the south and this vision I could express them in Dance. I have often tried to explain to artists this first basic theory of my art. Stanislasvky mentions my telling hem of this in his book. My life in Art. (My life : Isasora Duncan p. 58-59) ।

প্রথাগত রীতির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ এক পরিমুক্ত প্রাণময় নৃত্যভাষা অন্বেষণে আজকের এই মুহূর্ত পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের সৃজনশীল শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করছে। ইসাডোরার সেই তির্যক প্রশ্ন আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে :

‘Why should our children bend their knee in that fastidious and servile dance, the minuet, or twirl in the mazes of the false sentimentality of the waltz?

Rather let them come forth with great strides, to dance the language of our pioneers, the fortitude of our heroes, the justice, kindness, purity of our statesmen, and all the inspired love and the tenderness of our mothers.’ (My life – p. 245)

একথা অনস্বীকার্য যে নৃত্য ও চিত্রের ভাষা আন্তর্জাতিক। স্রষ্টার মানসিক কল্পচিত্র প্রকাশের চেতনা বর্তমানের, আবার তার আবেগবৃত্তের পরিধিতে ছড়িয়ে যাকে অতীতের নুড়ি যা বেজে ওঠে নতুন ছন্দে। পেছনে ফেলে যাওয়া পথের স্মৃতি সঙ্গে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ারই আর এক নাম সৃজনশীলতা। ইসাডোরা ডানকানের বিদ্রোহ এই নতুন বিগ্ৰহ তৈরি করেছে।

ইসাডোরার শিল্পচিন্তাকে অনেকে মিষ্টিক, অলৌকিক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তার শিল্পের একদিক হলো জীবনের অতল রহস্যময়তার উদ্ঘাটন, তার অবচেতনের উন্মোচন, আর একদিকে জীবন উঠে আসে তার সমগ্র মহিমা নিয়ে।

এক ধরনের নিরযক্তি তার শিল্পকর্মে আছে, কিন্তু এই নিরাসক্তির আড়ালে কাজ করে তার ভালোবাসা, ব্যঙ্গ, ক্রোধ, প্রতিবাদ। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য :

‘It was a long procession that I saw from a distance. Black and mournful it came. There were men laden and bent under their loads-Coffins-one after another. The coachman showed his horse to a walk, and bent and crossed himself. I looked on in the indistinct dawn, filled with horror.

I asked him what this was. Although I knew no Russian, he managed to convey tome that there were the workmen shot down before-the winter palace the day before the fatal January 5, 1905-because, unarmed, they had come to ask Tsar for help in their distress-for bread for their wives and children.

I told the coachman to stop. The tears ran down my face and were fozen on my cheeks, as this sad, endless procession passed me’.

এই দৃশ্য তার শিল্পচেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

‘If I had never seen it, all my life would have beer different. There before this seemingly endless procession, this tragedy, I wowed myself and my forces to the service of the people and the down- trodden.

দুদিন পরে তার নৃত্যপ্রদর্শনীতে সংযুক্ত হলো “The Funeral’

‘O dark and mournful night without one sign of Dawn.

O sad procession of poor stumbling forms,

Haunted, weeping eyes and poor hard worked rugged hands

Stiffing with their poor black shawls

The sobs and moans beside their dead-

Guards walking stilted on either side.’

চিরন্তন প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবিত শিল্পী দেশ, সমাজ, সমাজব্যবস্থা, খেতে পাওয়া মানুষ আর খেতে না পাওয়া মানুষ— এই দুই মানুষের দ্বন্দ্বে আচ্ছন্ন হলেন। তার শিল্পবোধ এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে গেল। আসরে শিল্প শেষ পর্যন্ত মানুষের ও জীবনের হয়ে ওঠার কথা বলে । এই হয়ে ওঠার (being) মধ্যেই শিল্পের পূর্ণতা।

পরাবাস্তব থেকে বাস্তবকে ধরা এই মননশীল রীতিতে ইসাডোরা তার সৃজনভাবনায় অনন্যা । আমাদের দেশে সৃজনশীল নৃত্য পরিকল্পনার পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ। তার পর নটরাজ উদয়শঙ্কর। সাধনা বসু, মাদাম মেনকা, শান্তি বর্ধন, নরেন্দ্র শর্মা প্রমুখ অনেকেই এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। সে প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনায় পরে আসছি।

এরা অনেকেই কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বক্তব্য রাখেননি। ইসাডোরা প্রসঙ্গ মনে রেখেই বলি শ্রীমতী মঞ্জুশী চাকী সরকার এ প্রসঙ্গে তার নৃত্যাদর্শ ব্যাখ্যা করেছেন। আমার অনুরোধে শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার বিশেষভাবে এই অধ্যায়ের জন্য একটি লেখা পাঠিয়ে আমাকে এবং শিক্ষার্থীদের কৃতজ্ঞ করেছেন। সম্পূর্ণ লেখাটি এখানে মুদ্রিত হলো।

প্রসঙ্গ : নবনৃত্য ॥ মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ‘বাংলার সংস্কৃতিতে ‘নবনৃত্য’ শব্দটির প্রচলন বেশি দিনের নয়। বিংশ শতকের ত্রিশের দশকে ভারতীয় নৃত্যজগতে একটি নতুন ধারা দেখা যায় প্রায় একই সময়ে।

রবীন্দ্রনাথের নৃত্যচেতনার উন্মেষ অনেক আগে শুরু হলেও ১৯২৭ এর ‘নটীর পূজা’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর ত্রিশ দশকের শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন কেন্দ্র করে তিনি সৃজনশীল নৃত্যের আঙ্গিকে একটি স্বকীয় ভাবনার সূচনা করলেন।

শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্য, সিংহলী ক্যান্ডি, পশ্চিমী ব্যালের নৃত্যনির্মিতির পরিকল্পনা, জাভাবলির সাজসজ্জা- এমন নানা ক্ষেত্র থেকে আহরণ করে, স্বাঙ্গীকরণ করে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় নৃত্যের একটি নবরূপ দেওয়ার প্রেরণা দেন। কবির নৃত্যসাহিত্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের সনাতন ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধ থেকেও বৈপ্লবিকভাবে স্বতন্ত্র ও সমকালীন।

উদয়শঙ্করের নৃত্যচর্চা মূলত বাংলার বাইরে হলেও তার সৃজনশীল নৃত্যের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, অনুষ্ঠানের বর্ণাঢ্য সমারোহ বঙ্গভূমির তরুণ তরুণীদের বিশেষ প্রভাবিত করে।

আলমোড়া কেন্দ্র উঠে যাওয়ার পর ১৯৪৩ নাগাদ শঙ্কর গোষ্ঠীর বেশ কিছু শিল্পী কলকাতায় নৃত্যচর্চা শুরু করেন। তাদের কর্মক্ষেত্র হলো ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। এখানে আঙ্গিকচর্চা সীমিত হলেও নৃত্যের ভস্বস্তু অনেক বাস্তবমুখী। এ নৃত্য কেবল শহুরে মঞ্চে নয় গ্রামেগঞ্জেও প্রচারিত হয় ।

রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর ও গণনাট্যসংঘ এই ত্রিধারার মধ্যেই আমাদের নবনৃত্যের চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। আমরা ‘নবনৃত্য’ বলতে বুঝি এমন একটি নৃত্যের ভাষা যা কেবল আঙ্গিকের ক্ষেত্রেই সমকালীন নয়, যার বিষয় ভাবনাও সমকালীন।

‘নবনৃত্যে’ এই আধুনিক মানসিকতা বলতে বুঝি এমন একটি সমাজ ও শিল্পচেতনা, যা খুব সচেতনভাবেই প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সমাজবোধকে কেবল আপত্তিকরই মনে করে না, সাধারণভাবে নরনারীর সম্পর্ককেই অসম্মানজনক মনে করে।

শাস্ত্রীয় নৃত্যের আঙ্গিকের বৈভব, শব্দের বিপুল ভাণ্ডারের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু নৃত্যসাহিত্যের বেশির ভাগই ধর্মের মোড়কে অভিজাত ও শক্তিশালী পুরুষ সমাজের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট। সম্ভবত একমাত্র মনিপুরের বৈষ্ণব নৃত্য ছাড়া সবক্ষেত্রেই নৃত্যশিল্পীরা ছিলেন হয় নির্যাতিতা নারী নয়তো দুর্বল পুরুষ।

মনোরঞ্জনের জন্য নারীর ভূমিকা সেখানে নিবেদিতা দাসী, বহুবল্লভ পুরুষের ভোগ্যা। আমাদের নবনৃত্য চর্চা নৃত্যকে নতুন চোখে দেখা, কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় নৃত্য নয়, প্রতিদিনের ব্যবহৃত বহু ভঙ্গি এক কথায় কেবল প্রচলিত অর্থে নৃত্যভঙ্গি নয়, শরীরী ভাষারই বিচিত্র ও ব্যাপক ব্যবহারই নবনৃত্যের ভাষার ভাণ্ডার। ‘রাসায়নিক সংমিশ্রণে’ ও স্বীকরণের মধ্য দিয়ে একটি সমকালীন নৃত্যভাষা সৃষ্টি হয় নবনৃত্যে, নৃত্যের ভাষা ও ভাবনার মধ্যে একটি শিবসতী সম্পর্ক আছে।

সমকালীন ভাবনা প্রকাশে তাই একটি সমকালীন নৃত্যের ভাষায় অবশ্য প্রয়োজন। সমকালীন নৃত্য ভাষা চর্চা করতে গিয়ে একটি বিধিবদ্ধ প্রশিক্ষণ আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় । শিল্পীরা এক একজন একটি বা দুটি শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চা করে নৃত্যের ভাষা শিক্ষা করে আসে আমাদের কাছে।

আমাদের কাজ এই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের গোষ্ঠীর একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট ভাষা তৈরি করা। প্রশিক্ষণ হয় নবনৃত্যের আঙ্গিকের আটটি ভাগে : ভূমিস্পর্শ, মধ্যভঙ্গি, স্থানক ভেদ, ত্রিভঙ্গভেদ, উল্লম্ফন, ঊধ্বর্গতি, চলন-গতিমাত্রা ও ভঙ্গিসমষ্টি আঙ্গিকচর্চার গোড়া থেকেই শরীরী অভিনয় ও মুখাভিনয়ে লক্ষ্য রাখা হয়।

এই অভিনয়কে আমরা বলি ‘অনুভব’। অনুভবের দুটি রূপ : কোমল ও কঠোর। এখানে লাস্য ও তাণ্ডবের ভাবনা এলেও সেটা লিঙ্গ নিরপেক্ষ। প্রতিটি ভঙ্গিই এই দুভাবে শিক্ষা করা হয়; এতে শিল্পীকে পেশির সঞ্চালন ও অনুভূতির সূক্ষ্মতা সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। নবনৃত্য এখানে কোনো ঘরানা নয়। নৃত্যভাষার ক্রমবিবর্তনের মধ্যেই তার সজীব অভিব্যক্তি। সমাজ ও পরিবেশ সচেতন শিল্পীমানস সমকালীন ভাবনা প্রকাশে একটি আধুনিক মাধ্যম সন্ধান করে।

আধুনিক চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও সাহিত্যের মতোই নবনৃত্যে এক এক ব্যক্তিত্বের শিল্পচেতনায় এক এক শ্রেণীর নৃত্যভাষ্য সম্ভব। নবনৃত্যের নির্মিতির একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য নতুন বা পুরাতন নৃত্যসাহিত্যের সমকালীন নৃত্যভাষ্য দেওয়া। এখানে যিনি নৃত্য নির্মিতি করেন তার মৌলিক ভাবনা ও শিল্পীব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় প্রতিটি সৃষ্টিতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি রবীন্দ্রনাথের গদ্যনাট্য ও নৃত্যনাট্যের সংযোজনে ‘তোমারি মাটির কন্যা’। এখানে কবির দুটি সাহিত্যকে আমার নিজস্ব চিন্তা দিয়ে ভাষ্য দিয়েছি। এক্ষেত্রে, নৃত্য নির্মিতি বা ভাষ্যের ছয়দশক আগে কবির যুগে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আজকের শিল্পীরূপে রবীন্দ্রনাথকে জানতে ও জানাতে চাই আমরা। ‘অরণ্য-অমৃতা’ নৃত্যনাট্যটি যদিও রাজস্থানের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু বিষয়টিকে রাজস্থানী দেখার প্রয়াস এখানে নেই।

বরং পরিবেশ সচেতনতার একটি সর্বমানবিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা আছে। ‘ক্রৌঞ্চকথায়’ একটি পেরুভিয় আবহসংগীতের সঙ্গে দেখা হয়েছে একটি পক্ষীসরোবর। পক্ষী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া খুব পরিচিত ঘটনা। বিলাপের দৃশ্যে সেখানে আর্তধ্বনি শোনা যায় শিল্পীদের কাছ থেকে । ‘শ্রী ও শক্তি’ ও ‘রাগ ও রূপান্তর’ রাগাশ্রয়ী আবহসংগীতের বিমূর্ত নৃত্যভাষ্য।

সনাতন নারী ভাবনাকে অন্যভাবে দেখা হয়েছে এখানে; মৃত্তিকা ও মাতৃকা, সূর্যসন্তবা, দীপান্বিতা, আনন্দজাহুবী, জননী- এই ভাবনারই এক একটি বিমূর্ত সৃষ্টি। সাজসজ্জার দিকেও আমরা ক্রমশ সরলীকরণের দিকে চলেছি, অতিমাত্রায় অলঙ্কার, জাঁকজমক পোশাকের জায়গায় প্রায় নিরাভরণ রূপে নৃত্যের ভাষা সমৃদ্ধতর হয় বলে মনে করি।

নবনৃত্যে গোষ্ঠীনৃত্যের পাশাপাশি একক নৃত্যের প্রচুর সম্ভাবনা। রঞ্জাবতী সরকারের ‘গঙ্গাবতরণ’ মহাভারতের শ্লোকটিকে নিজস্ব ভাষ্য দিয়েছে। তেমনি ‘A Fable for La Gran Sabana’ ও সম্প্রতিকালের ‘ক্যাসান্দ্রা’তে নবনৃত্য সম্পূর্ণ মৌলিক ভাবনা দিয়ে বিদেশী কাহিনীর একটি সর্বমানবিক মাত্রা দিয়েছে।

গ্রীস দেশের নারী ক্যাসান্দ্রার মমত্ত্বদ কাহিনী এখানে আমাদের খনাকে মনে করিয়ে দেয়। নরনৃত্যে এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশী নৃত্যের আঙ্গিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি। মনে হয় আঙ্গিকের ভারতীয়ত্ব আর ভারতীয় নৃত্যভাষার আধুনিকীকরণের অসীম সম্ভাবনাই নবনৃত্যের প্রধান প্রত্যাশা । শ্রীমতী চাকী সরকারের কাছে নৃত্যকলা প্রদর্শন বিলাস বা fashion নয়, এটা তার প্যাশন। আত্ম-উন্মোচনের, আত্ম আবিস্কারের সৃজনই তার লক্ষ্য-আত্মকথনের সুলভ চাতুর্যে তিনি বিশ্বাসী নন।

দুঃখের কথা এই যে সাম্প্রতিক কালে অধিকাংশ অভিকর শিল্পী (Performing Artist) প্রযোজনায় নিজ দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য বিষয়বস্তুর গভীরতাকে মর্যাদা দেন না। যে নৃত্যশৈলীতে তিনি পারদর্শী, যেমন করে হোক প্রয়োগ করতে হবেই। যে কারণে তসলিমা নাসরিনের মৌলবাদ বিরোধিতা চিত্রণে পল্লবী নৃত্যের অনুপ্রবেশ (গোটা ছকটিকে তারসহ রেখে) এসব হাস্যকার প্রয়াস দর্শকমণ্ডলীর কাছে নৃত্যশিল্পীদের পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে।

শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের প্রযোজনার বৈশিষ্ট্য হলো সংক্রমণ। তার প্রযোজনা দেখতে দেখতে একটা আইডিয়া বা ভাব ছবির মতো ভেসে ওঠে। তারপর দেখি ছবিটিকে বারবার বড় পাল্টাচ্ছেন স্রষ্টা। কোনোটাই তথাকথিত প্রথাগত ছাঁচ মাফিক তৈরি নয় । কখনও বৈশাখী ঝড়ের মতো উল্লম্ফনে যৌবন বাউলের ছন্দমাযামত ও ক্রুদ্ধ করে তোলে।

কখনও যোগলালিত নিমগ্নতায় শিশিরবিন্দুতে সিন্ধুদর্শনে আপ্লুত করে। এই যে ভাব বৈচিত্র্য, শৌর্য ও নম্রতার সমন্বয়, প্রতিবাদী চেতনার শৈল্পিক বিস্ফোরণ তা আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করে। নৃত্য আবিস্কারে এই শিল্পীর অদম্য প্রয়াসে ঐক্য, বাক্যের পর মাণিক্য একদিন আমাদের করায়ত্ত হবেই এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।

আগেই বলেছি সৃজনশীল নৃত্যভাবনার পুরোযায়ী পুরোহিত হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই কথাটি প্রমাণ করার জন্য শুধু নৃত্যনাট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে হবে না, খুঁজতে হবে তার মৌলিক ভাবনার উৎস। ভারতের নৃত্যকলার ইতিহাসে ধর্মের প্রভাব ও রক্ষণশীলতা যতখানি দুর্মরতা দেখিয়েছে তার অন্য শিল্পধারায় বিরল। রাজশক্তি, পুরোহিত তন্ত্র নিয়ন্ত্রিত রাজসভা ও মন্দিরকেন্দ্রিক গুরুমুখী চর্চাতেই এ শিল্প আবদ্ধ থেকেছে।

ইতিহাসের ধারা, নৃত্যকলার আবয়বিক ও আন্তররূপের বিশ্লেষণ বা এর নান্দনিক তাৎপর্য সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতার কোনো পরিচয় আমরা রবীন্দ্রনাথের আগে পাই না। প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থগুলোতে যে দিকদর্শী নির্দেশাবলী পাওয়া যায়, তাও পুচ্ছগ্রাহী টীকাকারদের অপব্যাখ্যায় তত্ত্বের অরণ্যে বোধির দিকভ্রান্তি ঘটিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের নৃত্যকল্পনা প্রসঙ্গে কয়েকটি উদ্ধৃতি :

১. ‘মানুষের সহজ চলায় অব্যক্ত থাকে নৃত্য, ছন্দ যেমন প্রচ্ছন্ন থাকে গদ্য ভাষায় । কোনো মানুষের চলাকে বলি সুন্দর কেনোটাকে বলি তার উল্টো। তফাতটা কিসে। কেবল একটা সমস্যা সমাধান নিয়ে।

দেহের ভার সামলিয়ে দেহের চলা একটা সমস্যা। ভাবটাই যদি অত্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়, তা হলেই অসাধিত সমস্যা প্রমাণ করে অপটুতা। যে চলায় সমস্যার সমুৎকৃষ্ট মীমাংসা সেই চলাই সুন্দর’।

২. ‘মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপন দেহে। কেননা তার দেহ ছন্দ রচনার উপযোগী। আবার নৃত্যকলার দেহসঞ্চালনের অর্থহীন সুষমায়।  তাতে কেবলমাত্র ছন্দের আনন্দ।’

৩. ‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে, জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে, দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।’

৪. ‘এক রকমের গায়ে পড়া সৌন্দর্য আছে বা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে অতিলালিত্য গুণে সহজেই আমাদের মন ভোলায়। চোর যেমন দ্বারীকে ঘুষ দিয়ে চুরি করতে ঘরে ঢোকে। সেইজন্য যে আর্ট আভিজাত্যের গৌরব করে সেই আর্ট এই সৌন্দর্যকে আমল দিতেই চায় না।’

৫. ‘ভাব তো রূপক কামনা করে, কিন্তু রূপ যদি ভাবকে মারিয়া একলা রাজত্ব করিতে চায় তবে বিধাতার দণ্ডবিধি অনুসারে তার কপালে মৃত্যু আছে।

 

 

পাথরের টুকরা দিয়া রুটির কাজ চালানো যায় না, বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়া অন্তরের শূন্যতা পূর্ণ করা চলে না। এই পাঁচটি উদ্ধৃতির বক্তব্যের মধ্যেই আমরা সমগ্র বিশ্বের সৃজনশীল মনীষীদের চিন্তাকে খুঁজে পাই এক মননশীল ভাবাদর্শে। বিদেশের স্তানিশ্লাভস্কি, ইসাডোরা ডানকান, মার্থা গ্রাহাম, গর্ডন ক্রেগ, জোন লিটলউড থেকে আমাদের উদয়শঙ্কর, সাধনা বসু, শান্তি বর্ধন, বুলবুল চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার প্রমুখ কেউই এই শিল্পাদর্শের বিরোধী নন, বরং সমধর্মী।

আমি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনার মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলাম, শান্তিনিকেতনের প্রযোজনা অন্যত্র আলোচিত হয়েছে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে রবীন্দ্রনাথ চিরদনিই চলমান জীবনে সমকালের অভিযাত্রী। তিনি স্বচ্ছন্দে পয়ার, সনেট থেকে কল্লোল যুগে গদ্য কবিতার সব পরীক্ষা নিরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

নৃত্যের ক্ষেত্রেও তার এই ইচ্ছা ‘শাপমোচন’, ‘শিশুস্বর্গ’, ‘চণ্ডালিকা’ নবনৃত্য সৃষ্টির আভাস আনে, শাপমোচনের গদ্যাংশে সুর করার মধ্যে যে আধুনিক মনস্কতা তা আজও বিরল। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতে সৃজনশীল নৃত্যভাবনায় তিনিই আমাদের প্রাণপুরুষ। রবীন্দ্রনাথের পরেই এলেন নটরাজ উদয়শঙ্কর।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্পাদর্শের সার্থক সমন্বয়ে নবসৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে সূচিত হলো আধুনিক যুগ। নৃত্য পরিকল্পনায় এল তার সৃষ্টির ছন্দের আধুকিতার প্রবাহ সর্বাভিমুখী জটিলতার মাঝে সামগ্রিকতার অনুসন্ধান। ইউরোপীয় নৃত্যপদ্ধতির রেখাবলী (কোরিওগ্রাফি) ও চিত্রধর্মিতা ভারতীয় মানসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরিকল্পনায় এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হলো। মার্গনৃত্যের নিছক আঙ্গিকসর্বস্বতা থেকে তার বন্ধন মুক্তি ঘটালেন উদয়শঙ্কর।

তার বক্তব্য : ‘আর্টকে যদি জীবন্ত রাখতে হয়, তাহলে তাকে গতিশীল জীবনের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে; তাকে অনড় ব্যাকরণের সূত্রের বন্ধনে বাঁধলেই তার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে। Art must live with life’. রয়্যাল কলেজ অব আর্টস এর চিত্রশিল্পের মেধাবী ছাত্র উদয়শঙ্করের নৃত্যকলার প্রতি বাল্যকাল থেকেই আকর্ষণ ছিল।

তার কথা

‘I remember how I was attracted by the folk dances, Ras, Nautanki and nutch in my boyhood, but cluld not attend the performances except in secret ofr fear of my clders’.

এ থেকে বোঝা যায় যে তার নৃত্য প্রেরণার উৎস তৃণমূলস্তরের লোক জীবন ও লোকসংস্কৃতি, তথাকথিত প্রথাগত নৃত্য নয়।

বাবা শ্যামশঙ্কর চৌধুরী যখন ভারতীয় সৈনিকদের জন্য তার নিজের লেখা একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন- সেখানেই সংগীত নৃত্য ও দৃশ্যপট রচনায় উদয়শঙ্করের প্রথম প্রয়াস।

তার কথায়:

“The production turned out to be a mixture of the tableau, the dance drama and the opera. Its success gave me the faith that the spirit of India could indeed be expressive in simple terms and a well palnned basis. It was my father, a scholar and politician, who completely changed my attitude towards dance, and music whenhe explained how they have always been a part of worship and rituals and were dealt with in the Natyasastra.’

– এ থেকে লক্ষ্যণীয় এই যে চিত্রসূত্র থেকে নৃত্যসূত্র যা এক নিবিড় সখ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ এই পথ ধরেই উদয়শঙ্করের নৃত্যলোকে আবির্ভাব। শাস্ত্র মতে নৃত্যশাস্ত্র সহায়ক না হলে চিত্রসূত্র আয়ত্ত হয় না। “বিনা তু নৃত্যশাস্ত্রেন চিত্রসূত্রং সুদুরবিদম’ (বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ)। প্রসঙ্গটির বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন ড. মনোমোহন ঘোষ:

‘In the Vishnu-dharmottara, it has been said that the canons of painting are difficult to understand without an acquaintance with the canons of dancing. This remark is not intelligible to one who is not aware of the fact that dancing includes abhinaya and was to a great extent responsible for its origin, although in later times it came to be associated more or less exclusively with the performance of natyas.

An acquintance with abhinaya, in fact, gives the student of painting a more or less definite idea about the postures of man according to changes (physical, mental and spiritual) to which they are subjected by the different objects surrounding them.

The value of a treatise onabhinaya lies in the fact that it presents to us a more or less systemetic and elaborate study of the opssible artistic gestures which, when reproduced on stage bynatas, may evoke rasa in th spectators.

Any onw who has some idea about the technique of painting will understand how the descriptions of varying gestures by head, hands, eyes, lips and feet etc, would help a student of painting to acquire skill in depicting the human form inits endless variety of poses.’ (Abhinaya Darpanam Edited by Dr. Manmohan Ghosh p. 15).

উদয়শঙ্কর এর বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা বিশ্লেষণে এই তথ্য মনে রাখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রয়্যাল আর্ট কলেজের মেধাবী ছাত্রের চিত্রসূত্রের এই অভিজ্ঞতাই তার নৃত্য পরিবার ও সমাজে তখন স্বীকৃতি পায়নি।

তার কথায়:

‘When I returned after a decade to India, in the winter of 1929, not as a painter inspite of my degree from the royal College of Arts, but as a dancer, members of my family and my old friends fell scandalised. During my search inthe south, some educated people even warned me against wasting my time and money on such crude and degenerate froms or dancing.’

অথচ এর আগেই তিনি ১৯২৩ খৃস্টাব্দে লন্ডনের আনা পাভলোভার সম্প্রদায়ে দুটি ব্যালের পরিকল্পনা করেছেন।

সেখানেও তার পরিকল্পনা সমৃদ্ধ হয়েছে চিত্রধর্মীতায়।

‘When Pavlova wanted me to create two ballets for her repertoire and partner her inthem, I was thrilled as well as overawed. I threw myself feverishly into the task, studied thousands of reproduction of sculpture, frescos and miniatures. I used to gaze at them fascinated, and the more they held my concentration, the more voluble they became in my imagination they stirred and began ti execute movements.”

শিল্পবস্তু থেকে এই যে সৃজনশীলতা তার অনুরূপ ঘটনা আমরা ইসাডোরা ডানকানের ক্ষেত্রে পাই:

‘At that time it was Botticelli who attracted m youthful imagination.

I sat for days before the ‘Primavera’, the famous painting of Botticelli. Inspired by this picture, I created a dance in which I endeavoured to realise the soft and marvellous movements emanating from it; the soft undulation of the flower covered earth, the circle of mmphs and the flighht of the zephyrs, all assembling about the central figure,

half Aphrodite, half Madona, who indicates the procreation of spreing inone significant gesture. I sat for hours before the picture. I sat there untill i actually saw the flowers growing, the naked feet dancing, the bodies swaying; nitil the messenger of Joycame to me and I thought: `I will dance this picture and give to others this message of love,

spring, procreation of life which had been given to me with such anguish. I will give to them, through the dance, such ecstasy.’ (My Life: Isadora Duncan p. 84).

এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে দেশ কাল পাত্র ভেদ থাকলেও মহৎ ব্যক্তিত্বের সৃজনশীলতার উৎস একই। উদয়শঙ্করের শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে হলে এই পটভূমি মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।

শুধুমাত্র তার প্রয়োগরীতির অন্ধ অনুসরণ নয়। তার মানসচর্যারীতি স্মৃতিধার্য করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতোই উদয়শঙ্করকে রক্ষণশীলদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। G. K. Seshagiri, G. Venkatachalam প্রভৃতি তাকে ধ্রুপদী শিল্পের বিকৃতিকর ও প্রচারধর্মী শিল্পের বাহক রূপে চিহ্নিত করলেন। ওই সময় উদয়শঙ্কর এসব প্রসঙ্গে তার সুষ্পষ্ট বক্তব্য রাখেন।

এই বক্তব্যগুলো থেকে তার সৃজনশীল শিল্পীমানস খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রী শেষাগ্রির প্রসঙ্গ নিয়ে New York Times পত্রিকায় John Martin এর The Dance : Art of India- Shankar criticized as Departing from canons of the Indial classic Dance’ একটি নিবন্ধ লেখেন। অভিযোগের প্রত্যুত্তরে উদয়শঙ্কর :

‘Does he expect that we should go back to 200 years or 500 years ago and blindly imitate what our forefathers were doing at the particular period? The traditions of Indian art have been changing from time to time, and it is impossible to fix upon a particular tradition prevailing at a certain time in the past and call that the only authentic Indian tradition.

All that we could properly dowas to adopt the best from the past and mould it to the requirements of our present day life. That wa real progress lien,’

তার বক্তব্যের সমর্থনে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি পত্রাংশের উল্লেখ করেন-

‘It is beacuse we are sure of your genius that we hope our creations will not be a mere imitation of the past, not burdened with narrow conventions of provincialism.

‘ তার বিরুদ্ধে যখন বলা হয়’ ‘Shankar’s dances are merel glorified froms of street Dance’ g. Venkatachalam তার শিল্পদৃষ্টি প্রসঙ্গে বলেন :

‘He believes that Indial Dance forms could purposefully be used not only for deucating the masses but also for propaganda purpose.

This idea of using art for social or political propaganda is modern and however praiseworthy the motive may be and however original and skilful the conception and creations may be, it certainly is not the best and highest purpose or function of art.’

এই অভিযোগ প্রসঙ্গে উদয়শঙ্কর বলেন :

‘One of the main functions of art is to interpret with Vivid realism the facts of the ceemental life of the common people, of the masses of the average humanity.’ এ প্রসঙ্গে শ্রী সুধী প্রধান সম্পাদিত ও সংকলিত Marxist cultural Movement in India (1936-47) গ্রন্থে দুটি মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম I. P. T. Aর নেতা বিনয় রায়ের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে (Peoples war পত্রিকায় প্রকাশি) গণনাট্য প্রযোজ্য প্রসঙ্গে :

‘This is what we need to day such stratght and simple songs, dances and dreams dealing with daily life of our people. I have also tried a little in this direction. One day I will also applm talent and experience indoing this work as ou are doing.’ দ্বিতীয় বক্তব্য আরও তীক্ষ্ম ও স্পষ্ট:

The Art of Dancing is not meant only tosatisfy the sense of beauty and rhythm of the spectators, it should also try to protry their political and social aspirations. If intricate froms of ‘Pure art’ are to be sacrificed inthe process, the loss would be amply compensated if the cause of humanity is served.

‘ তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলেই পরবর্তীকালে যারা সৃজনশীল নৃত্যকল্পনায় আত্মনিয়োগ করেছেন যেমন শান্তি বর্ধন, নরেন্দ্র শর্মা, শচীন শঙ্কর, অনাদি প্রসাদ, পিনাকী, ঘনশ্যাম, প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ সকলেই গণনাট্য প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উদয়শঙ্কর প্রবর্তিত ধারাই এখনও পর্যন্ত দিকদর্শী একথা অনস্বীকার্য। গণনাট্য আন্দোলনের মাধ্যমেই এরপর সূচিত হলো নৃত্য পরিকল্পনায় সৃজনশীলতার এক নতুন আদর্শ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ প্রসঙ্গে শান্তিবর্ধণ:

“The Age of machine, economic and political consciousness, scientific knowlege and international outlook is bound to bring in a new from and a new content in dances. Behind all this we have the great mainstay of our traditional forms. Dance was popular when its technique, themes and contenst were understood and appreciated by the masses.

To days with a new outlook and new aspirstion, a new form is growing. New ballets in folk forms, easy technique will popularise dancing, releasing a great crieative force among the people who will once more begin to build up great things in keeping with the traditions of this great country, thus creating the real culture and art of the people of this age’.

ওই সময় প্রযোজিত দুটি ব্যালে “They must meet again’ A ballet infolk from on the recent Gandhi Jinna meeting এবং ‘The spirit of India’।

এই দুটি ব্যালের পরিচালক শান্তি বর্ধন, সহকারী ছিলেন শচীনশঙ্কর। এর পরের প্রযোজনা india Immortal’ এ নরেন্দ্র শর্মা শিল্পী ও সহকারী পরিচালক ছিলেন। গণনাট্য আন্দোলনের অন্যান্য The Patriots (দেশপ্রেমিক), Lest we forget. (যেন ভুলে না যাই), The Alluring Trap (বিতংস), ওহ Bondage (শৃঙ্খলের নিপীড়নে), The greal Awakening।

দেশপ্রেমিকের নৃত্য পরিকল্পনা করেন অনাদিপ্রসাদ ও বুলবুল চৌধুরী। জাগতিক নৃত্য পরিকল্পনা পিনাকী আনুরিয়া। বিতংস, যেন ভুলে না যাই, শৃঙ্খলের নিপীড়ণে এগুলোর পরিচালনা বুলবুল চৌধুরী। অনাদি প্রসাদের নৃত্য পরিকল্পনায় ‘Immortal India’ ও শহীদদের ডাক অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। এই পর্বের নৃত্য পরিকল্পকদের মধ্যে শান্তিবর্ধন ও বুলবুল চৌধুরী একমাত্র শিল্পভাবনা সম্পর্কে কিছু বক্তব্য রেখেছেন।

শান্তিবর্ধন প্রসঙ্গে আগেই উল্লেখিত হয়েছে। বুলবুল চৌধুরী ছিলেন এক অসামান্য শিল্পীব্যক্তিত্ব। শক্তিমান ছোটগল্প ও উপন্যাস লেখক হিসাবে তার স্বীকৃতি ছিল। দেশবিভাগের পর পূর্ববাংলার যখন তিনি আকাদেমি স্থাপন করেন, তখনও শিল্পকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসাবে প্রচার করার নিরলস প্রয়াসের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর বিরাগ ভাজন হন।

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শিল্প সংস্কৃতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা আন্দোলনের শরিক ছিলেন। তার ভাষায়: ‘আমার শিল্পভাবনা, সৃজনশীলতার প্রেরণা মানুষ। সৎ মানুষ, গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ, খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষ। যে মানুষ সামনে এগোতে চায়, ভুল পথে ছুটতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয় আবার সঠিক লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য দিক পরিবর্তন করে;

ভুল করে, ভুল সংশোধন করে, মাটিতে কর্দমে পড়ে যায়— আবার অমিত সাহসে পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়; এই মানুষ আর তার মূল্যবোধই আমার সৃষ্টিশক্তির উৎস। এই মানুষেরই সৃষ্টি শিল্পসাহিত্য তাও আমার প্রেরণা। কবির কল্পনার উপত্যাকার প্রথম মেঘ, দূর বন্দরে যাওয়ার পথ, সাগর নদী পাহাড় পেরিয়ে নীল হাঁসের ঝাঁক;

অবন ঠাকুরের তুলির রূপকথা, যামিনী রায়ের মনভোলানো পট; চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, জয়নাল আবেদিন এর শীর্ণ অথচ দৃপ্ত মানুষ; দেব্রত বিশ্বাসের মন্ত্র কণ্ঠে ঠাকুর কবির গান, বিনয় রায়ের লোকচেতনা সম্পৃক্ত গণসংগীত-এ সবই আমাকে নতুন সৃজন কর্মে প্রাণিত করে।’ এত সুন্দর সাবলীলভাবে শিল্পভাবনা প্রসঙ্গে আত্মকথন আর চোখে পড়েনি।

এ থেকেই সেই সময় সেই যুগের ভাবনাকে স্পর্শ করা যায়। একদিকে মানুষ ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা অন্যদিকে কাব্যধর্মী রোমান্টিকতা এই দুই এর সমন্বয়েই যেদিনের সৃষ্টিকর্ম গড়ে উঠেছিল। বুলবুল চৌধুরী প্রথাগতভাবে নৃত্যশিক্ষা করেননি। প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র, চট্টগ্রামের জমিদার বংশের সন্তান। অসামান্য পাণ্ডিত্য, শিকারেও ছিল দক্ষতা।

তিনি বলতেন, ‘নাচ-শিখেছি প্রকৃতি আর মানব জীবনের ছন্দ থেকে। ইসাডোরাই আমার আদর্শ।’ বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে ইউরোপে সংস্কৃতি সফর প্রসঙ্গে তার হাতে গড়া আর এক প্রখ্যাত গণশিল্পী শম্ভু ভট্টাচার্য তার স্মৃতিকথনে বলেছেন : ‘অসাধারণ সৃজনশীল মানুষ ছিলেন বুলবুলদা।

নাচের গল্পগুলো তিনি এমন অসাধারণভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন যাতে ভারতীয় ও প্রাচ্য সংস্কৃতির একটা সামগ্রিক রূপরেখা পশ্চিমের সামনে ফুটে ওঠে। ‘Dream of Hafiz’-এ কবির স্বপ্নের কি মায়াময় নৃত্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে অসামান্য কাহিনীরূপ হাজির করেছিলেন ‘In an Iranian Tavern’-এ। একটি ইরানী সরাইখানায় থাকেন একজন ভবঘুরে কবি।

কবি একদিন দেখলেন এক দস্যু এক তরুণী দাসীকে টানতে টানতে সরাইখানায় হাজির করেছেন। কবির চোখ পড়ল সেই তরুণীর ওপর। তরুণী বাকহীনা, কবির হৃদয়কে দুর্বল করে তুলল সেই তন্বী। তন্বীও অচিরেই কবির প্রতি আকর্ষিত হলেন। এই হৃদয় বিনিময়ে ইর্ষান্বিত হলেন সরাইখানার প্রধানা সুন্দরী নর্তকী।

এদিকে দাসী তরুণীর ও কবির পারস্পরিক দুর্বলতার খবর প্রকাশিত হয়ে পড়ল তরুণীর মালিকের কাছে। সে তরুণ কবির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তরুণীকে নিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনি টানতে টানতে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে দাসী তরুণী কবিকে দিয়ে গিয়েছিল একটি শ্বেত গোলাপ। সরাইখানার প্রধানা নর্তকীর ঈর্ষার আগুন দ্বিগুন জ্বলে উঠল ।

কবির স্বপ্ন, চিন্তা বেদনা সব সেই শ্বেতগোলাপকে ঘিরে। কিছুতেই সেই দাসী তরুণীকে কবির মন থেকে দূরে সরানো যাচ্ছে না। সে যাওয়ার পরেই তার আকাঙ্ক্ষা যেন আরও নিবিড় হয়েছে ওই শ্বেতগোলাপের মধ্য দিয়ে। প্রধানা নর্তকী কবিকে একদিন উপহার দিলেন একটি লাল গোলাপ। কবি প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রধানা নতর্কী দুর্বার।

একদিন রাত্রে কবির সামনে শুরু করলেন তার নাচ। তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম নাচ। সারাজীবন অর্জিত শিল্পনৈপুণ্য দিয়ে, তার সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে, লাস্য দিয়ে, উন্মাদনা দিয়ে নতর্কী নৃত্যপরা। কবি তখনও শ্বেত গোলাপের আবেশে বিভোর। নর্তকী কোমরবন্ধ থেকে নগ্ন করলেন ছুরিকা, আমুল বসিয়ে দিলেন নিজের বুকে।

তারপর সেই রক্তে স্নান করালেন কবির শ্বেত গোলাপকে । শ্বেত গোলাপ হয়ে উঠল রক্ত গোলাপ। এ গল্প যেমন অসম্ভব সংবেদনশীল তেমনি Two lovers’ বুলবুলদার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা শিল্পীমানসের স্বাক্ষর বহন করেছে। ‘Two Lovers’ রূপক গল্প। আরবের খনিজ তেল এখানে সুন্দরী নারী।

তাকে নিয়ে দুই প্রেমিক দুই লোভী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। যে সমস্যা আজকের দুনিয়ার এমন জলন্ত সমস্যা তার আভাস পেয়েছিলেন। বুলবুলদা প্রায় চল্লিশ বছর আগে। ভাবুন দেখি উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যদি এমন ব্যালে করা যেত।’ (এখনও রাতের কালো: শম্ভু ভট্টাচার্যের আত্মকথন-সম্পাদনা : শুভময় মণ্ডল।) বুলবুল চৌধুরীর শিল্পকৃতির গবেষণা ও মূল্যায়ন এখনও হয়নি। বুলবুল চৌধুরীর পথ ধরেই এসে যায় গণনাট্যের নৃত্যশিল্পী শম্ভু ভট্টাচার্য প্রসঙ্গ।

বুলবুল চৌধুরী তার নৃত্যগুরু। তার আদর্শেই তিনি অনুপ্রাণিত। যদিও শিক্ষা, বংশ মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তার সবদিক থেকে গুরুর সঙ্গে তার মিল নেই। তার নিজের কথায় ‘স্কুল জীবনের কথা খুব বেশি মনে পড়ে না আমার । সে জীবনে কোনো রোমাঞ্চ ছিল না, কোনো সুখ স্মৃতিও তাই বেঁচে নেই। …স্কুলে বেশিদিন আমার মন বসল না। বাগবাজারের যাত্রা, রাসযাত্রা, কীর্তন তখন আমায় টানবে ।

… যাত্রা থিয়েটারই চলল, স্কুল বন্ধ হলো। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যা শিখেছি সবই এই পৃথিবীর পাঠশালায়।’ বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে শম্ভু ভট্টাচার্যের সৃজনচেতনার যে ছবি পাওয়া যায় তা খুঁজে দেখা যাক। প্রশ্ন : ‘গণনৃত্য কাকে বলব। আপনি কি নিজেকে গণনৃত্য শিল্পী বলবেন?’ উত্তর ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। গণনৃত্য এসেছে লোকনৃত্য থেকে।

 

কথাকলিতে শ্রী কৃষ্ণ – সত্য জয়দেব বর্মা

শাস্ত্রীয় নৃত্যের সঙ্গে প্রভেদ হলো, এই নৃত্যভঙ্গি কোনো মন্দির গাত্রের ভাস্কর্য থেকে নেওয়া নয়। প্রতিদিনের জনজীবনের চলার ভঙ্গি থেকে এর উদ্ভব। আমি দুচোখ ভরে দেখি। তার দুঃখ, আনন্দ শ্রম আর যন্ত্রণার ছন্দ। সেইখান থেকে উঠে আসে আমার নৃত্যভঙ্গি যা সম্পূর্ণ সৃজনশীল। পথে ঘাটে খুব সাধারণ লোকের কাজ বা গতি থেকে নৃত্যভঙ্গি আমি তৈরি করেছি।

ধ্রুপদী নৃত্যে সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, গণনাট্য সংঘের অবদান প্রসঙ্গে তার বক্তব্য : ‘আমি হারতে শিখিনি— এটাই গণনাট্য আমাকে শিখিয়েছে, আমি পরবর্তী প্রজন্মকে এইটাই বলে যাবো যে তোমরা নিষ্ঠাকে আয়ত্ত করো। মানুষের কাছে শেখো, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে যাও। তাদের প্রবলেমস জান। তবেই তুমি কিছু করতে পারবে।

আর নৃত্য শিক্ষা? জীবজন্তু, মেহনতি মানুষ প্রত্যেকের কাছেই নৃত্য পাওয়া যায়। তুমি যদি একটা কুকুর বা গরুকে দেখো তাহলে বুঝতে পারবে আমি একথা কেন বলছি। সে যখন তার ডান পাটা টানে, তার পেছনে বাঁ পাটাকেও টানে। যখন বাঁ পা টানে তখন পেছনের ডান পাটাকে টানে। তেমনি তুমি যখন যাও হাঁটো, তোমার ডান পা যখন সামনে ডান হাতটা যায় না কিন্তু বাঁ হাতটা চলে যায়।

এই যে চলা, (হাতের মুভমেন্ট করে দেখিয়ে) এই রকম করে মুভমেন্ট হয়। যে মানুষ খাটে না তার থেকে অবশ্য কিছু পাবে না। তো এসব ভাবনা চিন্তা নিয়েই ভাই আমি নাচের মধ্যে আসি, এসেছি, থাকব কিছুকাল; যতদিন বেঁচে থাকব আর কি, ততদিন নাচব। নতুন প্রজন্মের কাছে আর কি বলব? একটা কথা বলছি আমি কিছু পাব বা পেয়ে যাব এই করার জন্য আসিনি।

আমি শিখেছি গণনাট্যে। গণনাট্যের শিক্ষার একটাই কথা সাধারণ মানুষের জন্য তুমি কিছু কর। তাই আমি এখনও আছি, এখনও করছি।’ (সাক্ষাৎকার : অজয় বন্দোপাধ্যায় ॥ নন্দন শারদীয় ১৩৯৯)। এক পয়সার ভেঁপু, জ্যাঠামশাই, মাদক বিরোধী সাক্ষরতা আন্দোলন, পণ প্রথা বিরোধী নৃত্যকল্পনা তার অসামান্য শিল্পকৃতি। আর ‘রানার’ তো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

নাচ সম্পর্কে তার কিছু মন্তব্য চিন্তা ও বিতর্কের অবকাশ রাখে। তার কথায় : ‘মানুষ যেদিন হাঁটতে শিখল । দৌড়াতে শিখল সেদিনই নাচের জন্ম। দক্ষিণের সমস্ত ধ্রুপদী নাচত দেবদাসী সেবাদাসীদের নৃত্যভাবনা থেকে । সুতরাং সৃজনশীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গতিবিন্যাস থেকেই ধ্রুপদী নাচের জন্ম। আসলে সবচেয়ে বড় দরকার সেটা চোখ। চোখের লেন্স দিয়ে দেখ যা কিছু সুন্দর লাগে, নান্দনিক লাগে, তাকেই ধরে রাখ, নাচের মুদ্রায় তুলে নাও।

সুতরাং প্রথমে চাই পর্যবেক্ষণ (observation), তারপর গ্রহণ ক্ষমতা (pick up sense), তারপর গৃহীত জিনিস নিয়ে তদগত হওয়া (concentration)। নাচটা কিন্তু সারাক্ষণের কাজ। অবসরের আংশিক বিনোদন নয়।’ আবার এই প্রসঙ্গে বলছেন : ‘বেশ্যা, শ্রমিক আর নৃত্যশিল্পীতে কোনো তফাৎ নেই। তিনজনেরই শরীর নিয়ে কারবার। তফাৎ শুধু এখানে আমি কোনো বাণী নাচের মধ্য দিয়ে পৌঁছে দিতে চাইছি।

চিরকাল নাচের মধ্য দিয়ে মানুষের যন্ত্রণা, প্রতিরোধ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যন্ত্রণা উত্তরণের কথা বলতে চেয়েছি। এলিটের জন্য শিল্পসৃষ্টিতে আমি আদৌও বিশ্বাসী নই। শিল্পের জন্য শিল্প নয়। মানুষের জন্য। যখন নাচি, ভাবি দেশের জন্য নাচছি। মানুষের কাজ করছি। যেদিন মানুষের কথা বলতে পারব না, সেদিন আর নাচব না।’

আবার এই শিল্পীই যখন তার এক স্বপ্নের পরিকল্পনার কথা বলেন : ‘আর একটি পরিকল্পনা আছে যার হয়তো নাম দেব ‘Rhythm and Melody’। সেখানে কোনো গান থাকবে না । কথাও থাকবে না। নাচের তো নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সেটাকেই আমি পুরোপুরি ধরতে চাইব। সব সময় যে পিছন থেকে গান গেয়ে দিতে হবে বা বলে দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।

প্রত্যেকটি প্রদেশের বাদ্যযন্ত্র নেব। একটি একটি বাদ্যযন্ত্র এককভাবে বাজবে। তার রিদমের সঙ্গে নাচ। সুরগুলো ভেঙে যাবে আবার নতুন করে গড়ে উঠবে। এটাই হয়তো হবে আমার জীবন জিজ্ঞাসা। এর মধ্য দিয়ে হয়তো সেই প্রশ্নটাই তুলতে চাইব যে সমাজটার অবক্ষয়ের জন্য তোমরা এত সমালোচনা করছ। তার জন্য তোমরা কতটুকু করলে? আগে নিজে শুদ্ধ হও।

নিজে শুদ্ধ হওয়ার আজ বড় প্রয়োজন।’ (এখনো রাতের কালো: আত্মকথন ॥ সম্পাদনা শুভময় মণ্ডল) সত্তরোত্তর বৃদ্ধ শুভ্রকেশ অথচ মানসিকতায় চিরযুবক এই শিল্পী আজও নতুন শিল্পচিন্তায় আত্মমগ্ন । গণনৃত্যশিল্পীদের কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে আর একটি নামও বিশেষ স্মরণীয়। তিনি পানু পালন তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা, সমস্যা নিয়ে অতি দ্রুত নৃত্য নকশা নির্মাণে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল।

‘Epidemic starvation’, ‘রক্তবীজ’, ‘দুঃশাসনের রক্তপান’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখ্য। আসলে নাটকের লোক। পথ নাটক এর অন্যতম পথিকৃৎ স্রষ্টা। কিন্তু শরীরবৃত্তে ছন্দ সংলাপ যোজনায় তার ছিল প্রায় অলৌকিক দক্ষতা। আসলে সে সময় গণনাট্যের যে কোনো বিভাগের শিল্পীই অন্য প্রযোজনায় সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন। আন্তরিকতায় সমৃদ্ধ বলে তা শিল্পসম্মতও হয়ে উঠত।

যেমন সুচিত্রা মিত্রও অভিনয় করেছেন, তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন ও নৃত্যাভিনয়ে অংশ নিয়েছেন। আর রেবা রায়চৌধুরী তো এককথায় অলরাউন্ডার আর্টিস্ট। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় নৃত্যনাট্য ‘অহল্যা’ পরিালনা করেন শক্তি নাগ। তার অবশ্য প্রথাগত শিক্ষা ছিল। গণনাট্য আন্দোলনে নৃত্য পরিকল্পনায় আর এক বিস্ময়কর শিল্পী ব্যক্তিত্ব অসিত চট্টোপাধ্যায়।

বেকার জীবনের পটভূমিকায় মিনি ব্যালে ‘কাজ নেই’। অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ধ্রুপদী শিক্ষা, উদয়শঙ্করের মহান ও উদ্ভাবন সৃমদ্ধ ঘরনা, রবীন্দ্রনৃত্যাদর্শের আন্তরিক অনুচর্যা, সামাজিক দায়বদ্ধতা তার সৃষ্টির দিগন্তকে বিস্তারিত করেছে। গণনাট্যে এবং তার প্রতিষ্ঠান ‘রাগিণী’ এবং গ্রামীণ গীতি সংস্থা, গীতবিতান প্রভৃতি সংস্থার মাধ্যমে আমাদের দেশজ ঐতিহ্য, আঙ্গিক,

কাঙ্খিত নাট্যরস সৃজনে বিদেশি কোরিওগ্রাফির সুষম-সমন্বয় সমৃদ্ধ তার বিভিন্ন প্রযোজনা নতুনভাবে কিছু বলার আন্তরিকতায় আমাদের স্মর্তব্য হয়ে থাকবে। আসামে, বঙ্গাল খেদা আন্দোলন প্রতিরোধে তার ও শ্রীমতী প্রিয়ম হাজারিকার যুগ্ম পরিচালনায় ‘হারাধন রঙমন কথা’ গণনাট্য আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

নৃত্যনাট্য রচনা ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকা। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের আদর্শে তিনি বাংলা উপন্যাসের নৃত্য নাট্যরূপের প্রযোজনায় এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কবি’, ‘বেদেনী’, শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারে-আলো’, মাইকেল প্রহসন ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, কৃষ্ণকুমারী, স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যা বাউলির বৃত্তান্ত’,

অচিন্ত্য সেনগুপ্তের রচনা অবলম্বনে ‘অমৃত পুরুষ যিশু’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এই পথ ধরে তিনি পৌঁছালেন আধুনিক সমস্যানির্ভর নৃত্যনাট্য প্রযোজনায়— ‘ফুটপাতে পুরাণের গল্প ও নীলপাখি’ । রিয়্যালিস্টিক বিষয়বস্তু নিয়ে এই দুটি বিতর্কিত প্রযোজনা যেমন প্রমাণ করে তার চলমান জীবনের সহযাত্রা, তেমনি প্রমাণ করে সময়ের ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় দায়বদ্ধতা ।

এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য : ‘ফুটপাতে পুরাণের গল্প- নামের মধ্যেই একটা অসঙ্গতির আভাস। মনে করুন কেন— এ এক উলট পুরাণ যা তুলোট কাগজে লেখা নয়, আধুনিক যন্ত্রে তৈরি বঙ্গলিপিতে লেখা। আর সঙ্গতি কোথায়? নেতারা বলনে যে কোনো মূল্যে জাতীয় সংহতি রক্ষা করতে হবে, সেই নেতাই ভোটের জন্য আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে সমঝোতা করছেন।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লোকসভায় মুসলিম নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছেন। এই অসঙ্গতির পথ ধরেই পুরাণের নায়িখা মাধবী চার যুগ অতিক্রম করে স্ববিরোধী প্রলাপের গুরুদের নাটে এসে দাঁড়াল। এখানে আমরা একটু স্পষ্টতার সঙ্গে একটা সত্যে স্থিত হতে চেয়েছি। কাহিনী বিন্যাস ঘটনা বর্ণনার সীমা ছাড়িয়ে ইতিহাসের সত্য সামাজিক সত্যকে তুলে ধরতে চেয়েছি।

দর্শকদের ধৈর্য্য ও শিল্পবোধের ওপর আস্থা রেখেই এই প্রতিবাদী প্ৰয়োগ পরিকল্পনা, কারণ ফিরে পেতে চাই আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের শুভচেতনা। অনেক সময় মনে হতে পারে দৃষ্টিন্দন দৃশ্য উপস্থাপনার উৎকর্ষের থেকে আমার এই পরিকল্পনায় আধুনিক উপলব্ধির অন্বেষণে সোচ্চার বক্তব্যের প্রাধান্য বেশি।

 

 

আমি সবিনয়ে এ অভিযোগ স্বীকার করে নেব, কারণ সমাজ সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার দাবিতে আমা রমনে হয়েছে একটি কবিতা ‘প্রিয়, ফুল খেলার দিন নয় অদ্য’- এই সংকটময় মুহূর্তে একটু সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজন আছে।” ‘ফুটপাতে পুরাণের গল্প’ পুরোপুরি সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য নির্ভর নৃত্য পরিকল্পনা। এ ধরনের প্রযোজনা এর আগে বিরল।

শ্রী চট্টোপাধ্যায় তার আর একটি প্রযোজনা ‘নীলপাখি’ প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘নীলপাখি মেটারলিঙ্কে “The Blue Bird’ অনুপ্রেরণায় পরিকল্পিত। কিন্তু এ নাটকে মূলের সঙ্গে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কারণ আমরা বাস করছি এমন এক যুগে যেখানে সবুজ অবস্থিত, শৈশব নির্বাসিত।

পৃথিবী এখন ধ্বংসের মুখোমুখি, আগামী এখন বালুচরে মুখ গুঁজে অসহায় উটপাখি। এর মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়েই আমার বেছে নিতে হয় অন্যতম আঙ্গিক এবং সমকালীন ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপট। আমার ‘নীলপাখির’ তিতু-মিতু তাই তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের মতোই অনাথ। ভোগবাদী লালসায় বস্তুবাদী পৃথিবী আকাশের ছাদটাকে পর্যন্ত ফুটো করে দিতে ছাড়ছে না।

মূল্যবোধ হারিয়েছে তার ছন্দ। তাই পুরনো আঙ্গিকে রূপকথার মেজাজে এমন বিবেকহীন যুগের চালচিত্র তুলে ধরা আজ ভারি মুস্কিল, চিরম্ভর রূপকগুলো ভোগবাদের মড়কে আজ বিপর্যস্ত। তাই এই প্রযোজনায় আমি বেছে নিয়েছি সেসব রূপক যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় প্রাত্যহিক।

আসলে আমি চেষ্টা করেছি উপস্থাপিত করতে- যে দূষণ আজ শুধু পরিবেশ ও প্রকৃতিতে নয়, মানব প্রকৃতিতেও পরিব্যাপ্ত। ও ‘নীলপাখি’ নিঃসন্দেহে দুটি দিকদর্শী প্রযোজনা। শুধু উৎকর্য-নিকর্ষ বিচারের মাপকাঠিতে নয়, আন্তরিক প্রয়াসে অভিনন্দনযোগ্য শিল্পভাবনা। এই দুটি প্রযোজনার প্রায় বিশ বছর আগে অসিত চট্টোপাধ্যায় যখন তারাশঙ্করের ‘কবি’ নৃত্যনাট্য পরিকল্পনা প্রসঙ্গে :

কবি প্রতি ছাত্র গীতিগুঞ্জন, নুপুরঞ্জন, উদার উদাস নির্লিপ্ততা, অবাধ সংবেদনশীলতা। তারই সৃষ্ট গীতিমালঞ্চ মধুর অপরিস্ফুট হৃদয়াবেগে রহস্যমণ্ডিত ঠাকুরঝি নিতাই সম্পর্ক, যা ফুলে সুবাসের মতো নিবিড়। একে নৃত্যছন্দের আল্পনায় সাজাই এমন সাধ্য কই আমার।

ঠাকুরঝির যে চলমান প্রতিমা স্বর্ণবিন্দুশীর্ষ কাশফুলের রূপকব্যঞ্জনায় কাব্য মাধুর্যের দ্যোতনায় মধুর মৃদুল ছন্দে উদ্ভাসিত, তারাশঙ্কর তার সঙ্গে বৈরাগীর একতারাটি হাতে নিয়ে সাতসঙ্গত করেছেন। অমর কলাশিল্পীর পথপরিক্রমায় আমিও কুণ্ঠিত চরণে গেরুয়া রঙে বসন বাঁচিয়েছি, একতারাটি হাতে নিয়েছি, ঘুঙুরে আনতে চেয়েছি বৈরাগ্যের ছন্দ, কিন্তু বাউল হতে পেরেছি কিনা জানিনা।

সে বিচারের ভার আপনাদের।’ পেরেছেন তিনি বাউল থেকে প্রতিবাদী, পুরাণ থেকে সমকাল সব ক্ষেত্রে তার অধ্যাবসায় বিস্তারিত। রবীন্দ্র ‘মাধবী কুমার সেন’, ‘বিরহ-মিলন’, ‘তিনকন্যা’, ‘কাজরী’, ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘শেষ সাহানা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘প্রথম পূজা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘বীরপুরুষ’ প্রভৃতির নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন।

পুরাণ অবলম্বনে ‘উমার তপস্যা’, ‘মহুয়া’; শিশু নৃত্যনাট্য, ‘হিংসুটে ধৈত্য’, ‘শামিয়ানা’, ‘গরীবমুচি’, ‘বুড়ির কৌচা’, ‘তুষারমালা’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘বাপ্পাদিত্য’, ‘সুখী রাজপুত্র’ এই তালিকাই প্রমাণ করে অসিত চট্টোপাধ্যায়ের কাজের ক্ষেত্র কতটা ব্যাপক। রবীন্দ্রভাবনা, উদয়শঙ্কর ঘরনা এবং গণনাট্যের ভাবাদর্শ তার চালিকা শক্তি বলে তিনি মনে করেন।

উদয়শঙ্কর সম্প্রদায় থেকে গণনাট্য সংঘ এবং পরে শিল্পীরা অনেকেই বিভিন্ন সংস্থা গঠন করে শিল্পচর্চায় ব্রতী হন। শান্তিবর্ধণের লিটল ব্যালে ট্রুপ এর রামায়ণ ও পঞ্চতন্ত্র প্রযোজনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শচীনশঙ্কর ব্যালে ট্রুপ-এর Fisherman and the Mermaid, Sajjh- savera, Rajyog, Train, Ghost, Waiting, Palki, Cricket, Sringer, memory; নরেন্দ্র শর্মার ‘ভূমিকা’ প্রযোজনা WolfBoy, Conference 70, Man and Masks, Hockey Match, reflections, Sangeeta, Hajjam Tick – Tick, Saagar নব সৃষ্টির ছন্দে শিল্প ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।

শঙ্কর পরিবারের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে শ্রদ্ধেয়া অমলাশঙ্কর Udaishankar India Culture Center এর মাধ্যমে সীতা স্বয়ংবর, বাসবদত্তা, যুগছন্ধ প্রভৃতি প্রযোজনা করেছেন। মমতাশঙ্কর ব্যালে ট্রুপ গঠন করে নৃত্যনাট্য প্রযোজনায় ব্রতী। ‘এককালের একলব্য’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আনন্দশঙ্কর সেন্টার ফর পারফমিং আর্টস শুধুমাত্র উদয়শঙ্কর ঘরনাকে অনুসরণ করে না। সৃজনশীল নৃত্যের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ছোট ছোট মিউজিক কম্পোজিশনের মাধ্যমে একটি মূল বিষয়কে পরিস্ফুট করার প্রয়াসে সত্যিই অভিনবত্ব আছে।

মাদক বিরোধী নৃত্যকল্পনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে The unknown Future, trouble makers, The Happy Banch, Temptation, Affection, Seduction, Feeling High, Adiction, Craving, Street Fight, Withdrawal, Symptoms, Lamentation।

শাস্ত্রীয় নৃত্যরীতি ভেঙে ব্যায়াম, এরোবিকস এর প্রয়োগে অনেক সময়েই সাবলীল সৃষ্টিধর্মী নৃত্যকল্পনায় তনুশ্রীশঙ্কর থিমকে পরিস্ফুট করেন। তবে এদের সব ব্যাপরটা শুধু স্মার্ট তাই নয়, একটু উচ্চগ্রামের ও বিনোদনমূলক। সে তুলনায় মমতাশঙ্করের প্রযোজনায় শঙ্কর ঘরানার বীর্য, লাবণ্য ও পরিমিতবোধ অনেক সুষম ।

এবার আমরা আবার পিছনে ফিরে যাব। প্রশ্ন উঠতে পারে সময়সীমার ধারাবাহিকতা রেখে আলোচনা নয় কেন। তার উত্তর এই যে, একথা অনস্বীকার্য সৃজনশীল নৃত্যভাবনা মূলত রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনা, উদয়শঙ্করের শিল্পদর্শ ও গণনাট্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। সেই পরম্পরা বজায় রাখার জন্যই এভাবে বিভাজন করা একান্ত অপরিহার্য ।

সাধনা বসু তার শিল্পাদর্শ প্রসঙ্গে বলেছেন : “ভাবধারার ক্ষেত্রে আমার নিজের একটা স্বাতন্ত্র্যের কথা উল্লেখ করে রাখি যথোচিত সম্ভ্রম সহকারেই। গতানুগতিকতা কোনোদিনই আমার অন্তরে পায়নি আসন। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটে যাবে অনন্তকাল ধরে এ আমার অসহ্য। অবশ্য পুরনোকে একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। পুরনোকে বাদ দিলে নতুনকে খুঁজে পাওয়া যায় কি?

নাচের ক্ষেত্রেও সেই নীতিই আমি অনুসরণ করছি, বিশেষ করে নৃত্যাংশ রচনার ক্ষেত্রে। তাই আমার তৈরি নাচের মধ্যে পুরনো পটের ওপর নতুনের ছবি আঁকাই আমার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান স্বপ্ন-সাধনা।’ Dream songs of Omar Khayam, Brith of Freedom, Wither Now, Devine Source, Ajanta এসব দিকদর্শী প্রযোজনায় এই স্বচ্ছ শিল্পভাবনাই প্রতিভাতে।

আবার সমকাল যখন রূঢ় বাস্তবতায় তাকে অভিভূত করেছে তখন তার দায়বদ্ধতা তিনি অস্বীকার করেননি। তার কথায় : ‘ঘটনা ১৯৪৪ অব্দের। এখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রলয়ঙ্কর অবস্থা। মন্বন্তর। যুদ্ধের তাড়নায় মানুষ আশ্রয় খুঁজে বেড়িয়েছে, এবার একমুঠো চালের জন্য সে প্রতিটি দুয়ারে করাঘাত করছে।

ডাস্টবিনে কি সাংঘাতিক ভিড়, কুকুর তার খাদ্য খুঁজছে, মানুষ ও তার খাদ্য খুঁজছে। সামান্য ভাতের ফ্যানের জন্য অসহায় জননীদের সে কি লোলুপতা। এক চুমুক ফ্যান পেলেও তো দুঃখিনীর অঞ্চলনিধি, তার বাছার যৎসামান্য ক্ষন্নিবৃত্তি হবে। এই সময় হরেনদার কাছ থেকে মধ্যভরত ভ্রমণের প্রস্তাব।

‘ক্ষুধাকে কেন্দ্র করে নৃত্যসমুহ রচনা করা হরো। ক্ষুধার চেয়ে সময়োপযেগী পটভূমি আর কি থাকতে পারে, তখন যা দেশের অবস্থা, মানুষের কান্নার যে সুর, সর্বহারার আর্তনাদের যে রূপ, সমস্যার যে চেহারা সে ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পটভূমি বলতে ক্ষুধা ছাড়া আর মনে পড়ল না।’

লক্ষ্য করার বিষয় যার শাসিত রাশিয়ায় নিহত শ্রমিকদের শবদেহ ইসাডোরা ডানকানকে যেমন আপ্লুত করেছিল, ঠিক তেমনই মন্বন্তরে আত্মপ্রকাশ ঘটল জীবনশিল্পী সাধনা বসুর। এভাবেই যুগে যুগে সময়ের সীমানা পেরিয়ে মহৎ শিল্পীদের সৃজনশীল ভাবনার একাত্মতা ঘটে।

আরও অনেক শিল্পীর কথা বলা যায়। যারা কোনো বিশেষ ধ্রুপদী নৃত্যরীতিতে অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। কিন্তু রক্ষণণীল ঐতিহ্য নির্ভরতা তাদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত হতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে দেরিতে হলেও তাদের নতুন চেতনায় আত্মপ্রকাশের আর্তি তাদের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।

শ্রীমতী মৃণালিনী সরাভাই এর অভিজ্ঞতায়:

‘And now I turn to my personnal experience, for it is important here to recount my won Journey and quest. For many years the training was ardous nad there ws hardly any vista of Bharata Natyam that I did not search out and make use of in solo recitals,

Yet at the same time there was an immense yearning within to express what I felt, using everyquality and imaginary of all that I have studied. I was a dancer, but I was also an experiencer. the would so complex around me, the changing face of India, the proverty, the richness, the struggle for independence,

all this was as muchmy life as the dance was… I realised early that living was a great drama and Joy and despair, hate, anger, love were all part of the secnario. Personal experience therw me into encounters that transformed themselves into dance images… As an experiencer, to day I let my body speak as it wants to.

While one part of me still remains the traditionally trained dancer teaching and creating old stories for my students to imbibe, the other part moves in another space that is timeless, soaring into designs of m own patterns.’ (The Search for Dacne that is Dance-Seminer/R.B.U. March ‘1986).

শ্রীমতী সরাভাই যখন নবপরিকল্পায় ‘চণ্ডালিকা’ মঞ্চস্থ করলেন, যা বিহারে হরিজন নিগ্রহের বেতার সংবাদ দিয়ে শুরু হয়েছিল তখন তাকে অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। সংবাদপত্রের প্রতিনিধি যখন সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করেন: ‘What is the essential difference between the two productions, Garudev’s and yours?”

উত্তরে তিনি বলেন, ‘His Chandalika was a story of an out cast girl, and how the Buddhist monk changed her. But I have given it another depth of meaning. It deals not only with what is happening to Harijan’s to dayin India. I have taken only the essence, We need water, love. It you start evil, you cannot stop it.

I have taken it on a larger scale of modern civilisation. In the end, I have given it more poignancy; Unless we learn to live together and all men are equal in the world, We cannot live, It is a question of life or extinction… This is gurudev’s, but it is also my Chandalika.

(Pride of the Nation: Tushar Bhatt (An interview with Mirnalini Sarabhai (The Telegraph Sunday Magazine 11.1.87). শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের ‘তোমারই মাটির কন্যা’ সম্পর্কেও অনেক তথাকথিত রবীন্দ্র অনুরাগীর বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। স্বয়ং উদয়শঙ্করও ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘প্রকৃত ও আনন্দ’ প্রযোজনায় এই সমালোচনা (রাবীন্দ্রিক হয়েছে কিনা) থেকে রেহাই পাননি।

অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজে তার রচনার বারবার পরিবর্তন করেছেন। এই একই বৌদ্ধ কাহিনী নিয়ে আরও দুটি লেখার পরিচয় শঙ্খ ঘোষকে ‘তিন চণ্ডালী’ প্রবন্ধে পাওয়া যায়। একজন রবীন্দ্র ভক্ত শান্তিনিকেতনের সতীশচন্দ্র রায়, তার কবিতায় নাম চণ্ডালী। অপরজন মালয়লাম ভাষায় কবি কুমারণ আসান। তার কাব্যের নাম ‘চণ্ডালভিক্ষুকী’ ।

আসানের জন্ম অন্ত্যজ সম্প্রদায়ে । শঙ্খ ঘোষের লেখায় ‘ত্রিবান্দ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম, একেবারে সমুদ্রের ধারে, এদিকে ওদিকে জেলেদের বসতি, তার মাঝখানে এক স্মৃতি ভবন। কৈক্কর নামের সেই গ্রামে জন্মেছিলেন মালয়ালম ভাষার এক কবি কুমারণ আসান, তারই স্মৃতিতে ওই ভবন, গ্রামের মানুষ আর সমস্ত কেরালার গর্ব তাকে নিয়ে।

ভবনের প্রেক্ষাঘরে পৌঁছলে দেখা যাবে মঞ্চের বাইরে ডাইনে বাঁয়ে মস্ত দুখানা তেলরঙের ছবি। তার একটি আসানের নিজের, আর অন্যটিতে আছে এক বৌদ্ধভিক্ষুর সামনে দাঁড়ানো এক নারী। কুয়ো থেকে জল তুলে ভিক্ষুর প্রসারিত হাতে ঢেলে দিচ্ছে সেই নারী, চোখে মুখে তার দিব্য বিভা।

ছবিটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়বে আমাদের ‘চণ্ডালিকা’র কথা, যেন কানে এসে পৌঁছাতে থাকবে দুরাগত সেই ধ্বনি : জল দাও, আমায় জল দাও।’ (তিন চণ্ডালী : শঙ্খ ঘোষ ॥ প্রমা, রজত সংখ্যা ১৯৮৫) কেরলে বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতার অত্যাচারের প্রতিবাদী চেহারা যখন কুমারণ আসানের বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাব্যভাষায় :

‘কোথা থেকে আসে এই দ্বিজ ব্রাহ্মণ’

কোনো উদ্ভদ না কি মেঘ থেকে উড়ে?

না কি সে যোগীর যজ্ঞ আগুন থেকে?

জাত কি রক্তে-মজ্জায়, তার হাড়ে?

চণ্ডালিনীর অচ্ছৎ দেহ, সেও

অনুর্বরা কি থাকে ব্রাহ্মণ বীজে?

ব্রাহ্মণ তার উপবীত শিখা তিলক

জন্ম থেকেই বয়ে নিয়ে আসে নিজে?

এমনি এক দীর্ঘ প্রশ্নমালার শেষে ‘মানুষে মানুষে প্রভেদ কোথায় তবে’ এই জিজ্ঞাসার পর, চণ্ডালভিক্ষুকীর বুদ্ধ বলেন :

আমি বলি শোনো : লোকেরা ক্রুরতা ছাড়া

আর কোনোখানে অন্ত্যজ কিছু নেই।’

(তিন চণ্ডালী : শঙ্খ ঘোষ ॥ প্রমা, রজত সংখা ১৯৮৫)

একই কাহিনীর বীজ দেখা যাচ্ছে দুই কবিকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করে। কাজেই মৃণালিনী সরাভাই যখন বলেন : In ‘Chandalika’ the dance that took from from the ugly incidents against the downtrodden, a memory stirred and in the magic scene, I drew upon the snake worship ritual, that I had watched in my childhood.

‘ অথবা মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার যখন বলেন: ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি রবীন্দ্রনাথের গদ্যনাট্য ও নৃত্যনাট্যের সংযোজনে ‘তোমারি মাটির কন্যা’। এখানে কবির দুইটি সাহিত্যকে আমার নিজস্ব চিন্তা ভাষ্য দিয়েছি। এক্ষেত্রে, নৃত্য-নির্মিতি বা ভাষ্যের ছয় দশক আগে কবির যুগে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আজকের শিল্পীরূপে রবীন্দ্রনাথকে জানতে ও জানাতে চাই।

আমরা ।’- তখন তথাকথিত রবীন্দ্র অনুরাগীদের রবীন্দ্র সৃষ্টি বিপন্ন বলে ক্ষোভ প্রকাশের কোনো অর্থ খুঁজে পাই না। আসলে এটাও এক ধরনের সংকীর্ণ গুরুবাদ বা সংস্কৃতির চলমান অভিযত্রায় বাধা সৃষ্টি করে। যারা প্রকৃত অর্থে শিল্পী তারা কখনই শুধুমাত্র গুরুমুখী নৃত্যচর্চার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারবেন না- আত্মপ্রকাশের তাগিদ তাদের সৃজনশীল অন্বেষণকে জাগিয়ে তুলবেই।

শ্রীমতী কুমুদিনী লাখিয়ার বক্তব্যে: ‘In narrative compositions I have tried to develop Contemporary themes rather than working with the traditional mythological themes. One of the compositions was Dwadha_ `Conflct’, the tale of a middle class, middle-aged housewife and her inner conflict of the reality and her dreams and aspirations.

I expressed the dichotomy by using two different styles of kathak with the music alternating between classical Hindustaniand electronic. Since this was the first time electronic misic was being used inclassical Dance the ‘Times of India’ dance critic gave me a good amount of space in his column,

saying that I was taking the Indian dance ‘from the sublime to rediculas’… To what extent can we be puppets of accepted froms and norms? Can we not dance without sticking a lable of a ‘Curu’ or `GHARANA’ on our foreheads ?’-

 

 

এই প্রশ্ন সৃজনশীল শিল্পীর মনে আসবেই। যার আসবে না তিনি হয়তো দক্ষ নর্তক বা নর্তকী হতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাকে শিল্পী বলা যাবে না। নৃত্যের একটা সার্বজনীন ভাষা আছে । সৃজনশীল শিল্পীদের সমবেত প্রয়াসে গড়ে উঠতে পারে এক আন্তর্জাতিক মহামিলনের ক্ষেত্র। সুখের কথা এ বিষয় কিছু ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে।

শ্রীমতী ইলিয়ানা সিতারিস্টি (Ileana citaristi) প্রস্তাব রেখেছেন: ‘Is a Universal Dance beyond gegraphy, languages, costumers, themes and denominations no more possible… I am sure if we dancers, with different technical experiences but animated by the same honesty towards our search,

could work together, a sort of rejuvenated and Universal dance could emerge, cmplrehending the odl and the new, the East and the West, the discipline of the body and the freedeom of mind.

‘ সৃজনের প্রেরণা ছড়িয়ে আছে আকাশে বাতাসে মাটিতে। মাঠ রাঙা করে লাল কৃষ্ণচূড়া সেও মনে যেমন রঙ লাগায়, রাজপথে অস্থি চর্মাসা রায়ের দোকানের শিশুশ্রমিক তেমনই বীজ বোনে বেদনার।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছোট একটু টুকরো খবর যে গভীর আলোড়ন আনে, তা হয়তো অনেক সময় ধ্রুপদী সৃষ্টি থেকেও পাওয়া যায় না। শুধু একটা কথা মনে রাখতে হবে চোখ, কান, মনের দরজা খোলা রাখতে হবে, অন্ধ্র মরুমনের বন্ধ্যা মাটিতে ফসল ফলানো যায় না ।

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version