ভারতের স্থানীয় লোকনৃত্য: ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম লোকনৃত্যের প্রচলন রয়েছে। ভারতে নৃত্য অনেক ধরনের নৃত্য নিয়ে গঠিত,যা সাধারণত ধ্রুপদী বা লোক নৃত্য হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য দিকের মত, ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকারের নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে, যা স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী উন্নত হয়েছে এবং দেশের অন্যান্য অংশ থেকে উপাদান আত্মভূত করেছে। আমরা এই আর্টিকেলে বিভিন্ন স্থানীয় লোকনৃত্যের সাথে পরিচিত হবো।

ভারতের স্থানীয় লোকনৃত্য :
আসাম :
আসামের লোকন তার মধ্যে বিহা নৃত্যের প্রচলনই সর্বাধিক। বৎসরের শেষ দিন (৩১শে চৈত্র) থেকে শব্দে করে প্রায় একমাস ধরে বিহ; উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং সমাজের সর্বস্তরের লোকেরাই এতে অংশ গ্রহণ করে। বিনতা চলে বিহগীতির সঙ্গে এবং এর আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্রাদি হচ্ছে ঢোল, বাঁশী, শিক্ষা ইত্যাদি। গোষ্ঠীবদ্ধভাবে চক্রাকারে ঘরে ঘরে এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
আসামের অন্যান্য লোকনত্যের মধ্যে উল্লেখ্য হল দেওধন বা নাগকনার নৃত্য, ভাওয়ারিয়া, ঢুলিয়া ইত্যাদি। দেওধান বা নাগকন্যার নৃত্য কুমারী কন্যাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় এবং শেষোক্ত নৃত্য দাইটি বাংলার রণন তা রায়বেশে, চালি ইত্যাদির মত প্রচণ্ড উদীপনাময় নৃত্য। এই রণনূত্যগলিতে নানাপ্রকার শারীরিক কসরতের সঙ্গে আক্রমণ ও আত্মরক্ষামমূলক অভিনয় করা হয়। বাদ্যষস্থাদির মধ্যে থাকে শিঙা, জঢোক, বাঁশী ইত্যাদি
আসামের প্রান্তিক উপজাতিদের মধ্যেও বহ প্রকারের লোকনৃত্য প্রচলিত আছে যেমন, মিরি, অফিলাকুব, এয়ালাম, ফাকিৎলাম, বাগরোম্বা, তপ,কিখিলে ইত্যাদি।
বিহার:
বিহারের লোকনত্যের মধ্যে ধর্মমলেক কাহিনীর প্রাধান্য দেখা যায় যেমন, রামলীলা, নারদী, ভগতা, পূজারতি, কুঞ্জবাসী, কামলীলা, নাগলীলা, বংশী লীলা ইত্যাদি। ধর্মমলেক লোকন,ত্যের বাইরে চটুল অদিরসাত্মক ননৃত্যও প্রচলিত আছে; যেমন, নাটুয়া, নাচনী, রসিক ইত্যাদি। অন্যান্য লোকনাত্যের মধ্যে লাঝুরি, পাইকা, যাদুরে, ববে,, দশাই, ঝুমার হোলি উপলক্ষে ডাঙ্গা ও ঝিকা নৃত্য ইত্যাদি উল্লখযোগ্য। তাছাড়া বিহারী মসলমানদের মধ্যে ঝারণী নাচ এবং অনূন্নত। সম্প্রদায়ের মধ্যে কমলাবাই, দফাবাসুলী, চামর ইত্যাদি নাচ বিশেষ জনপ্রিয়।
রাজস্থান :
রাজস্থানের লোকনৃত্যের মধ্যেও বৈচিত্র্যের অভাব নেই। এই অঞ্চলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকনত্যের নাম হল-ডাণ্ডিয়া, রসিয়া, কাছি, থোড়ি, ভালার গাঁদার ঝুমার ইত্যাদি।
গুজরাট :
গজরাটের লোকনৃত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গরবা নৃত্য। অশ্বামাতার উৎসবে নবরাত্রির সময় একটি মঙ্গল দীপকে চক্রাকারে বেষ্টন করে হাতে তালি দিয়ে নাচে। দপবাদ্যম নৃত্যে ঢোলক ও কাঠি সহ হরিজনরা অংশ গ্রহণ করে এবং কুশ্মি কেবলমাত্র মেয়েদের নৃত্য ।
কানাড়া:
লাঠি হাতে ছেলেদের পারিয়া নাচ দক্ষিণ কানাড়া অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। এই নৃত্যের সহযোগী বাদ্যযন্ত্রাদির মধ্যে বাঁশি, মন্দিরা এবং চেন্দ্রা উল্লেখযোগ্য। আর একটি জনপ্রিয় নাচ হচ্ছে পত্তর অঞ্চলের মেরা গোষ্ঠীর নাচ। এটি মেয়েদের নাচ, সাদা শাড়ী পরে পুরুষ ঢাক-বাদককে পরিক্রমা করে এই ননৃত্যটি অনুষ্ঠিত হয়।
তামিলনাড়ু :
এই প্রদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় নৃত্যটির নাম হচ্ছে কুরভোজী। যাযাবর কুরাতি গোষ্ঠীর মধ্যেই এই নৃত্যটি প্রচলিত। এইটি ছাড়া আরও দুইটি উল্লেখযোগ্য নাচ হচ্ছে পরভী আক্ট্রম এবং পিন্নান কোলাট্রাম শেষোক্তটি মেয়েদের নৃত্য এবং দুইটি হাতেই লাঠি ও ফিতে একত্রে নিয়ে এই নৃত্যটি করা হয়। পরভী আটুমে একটি নকল ঘোড়া ব্যবহার করা হয় ।
নিন্মে ভারতের অন্যান্য আরও কয়েকটি স্থানের লোকনৃত্যের বিষয় উল্লেখ করা হল:
নাগাল্যাণ্ড :
নাগারা একাধিক শ্রেণীতে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটি শ্রেণীর নাচেই রয়েছে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। নাগাদের একটি শ্রেণীর নাম হচ্ছে করাই এবং অপর একটি জেমি নাগা। এই করাই নাগাদের নৃত্যের সঙ্গে জেমি নাগাদের খাবালিমা নৃত্যের কোনই সাদৃশ্য নেই। খাম্বালিমা নৃত্যে ছেলে ও মেয়েরা একত্রে অংশ গ্রহণ করে এবং বাদ্য ও গাঁতের সঙ্গে চলে নৃত্য। এদেরই অর একটি নাচের নাম চুয়িরা লিন। সকলশ্রেণীর নাগাদের নাচে বর্ণালী বেশভুষা এবং অলঙ্কার ব্যবহারের একটা প্রবণতা দেখা যায় ।
উড়িষ্যা :
এই প্রদেশের লোকন,ত্যের মধ্যে সাঁওতালি নাচ, মণ্ডারিদের যাদরে নাচ এবং ভাইয়াদের করম নাচ উল্লেখযোগ্য। করম নাচটি অনুষ্ঠিত হয় ভাদ্রমাসের একাদশীর দিনে। করম মানে শস্য। শিবঠাকুরের কাছে এই নৃত্যের মাধ্যমে প্রার্থনা করা হয় চাষীর দীর্ঘজীবন এবং মাঠভরা ফসলের। যাদরে নাচে স্ত্রী পরষ একত্রেই অংশ গ্রহণ করে। নাচটি অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের সন্নিকটে কোনও টিলা বা পাহাড়ের উপরে।
সৌরাষ্ট্র:
সৌরাষ্ট্রের লোকনৃত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দণ্ডীয় রাস, গরবা ও গোফগণ্ঠেন ।
দণ্ডীয় রাস:
এই নৃত্যে অংশগ্রহণকারিদের হাতে থাকে দুইটি ছোট লাঠি। সানাই ও ঢোলের সঙ্গে লাঠিতে তাল দিতে দিতে বৃত্তাকারে এই নাচটি অনুষ্ঠিত হয়।
গৱবা :
হোলি, বসন্তপঞ্চমী, নবরাত্রি এবং শারদ পার্ণিমায় গরবা নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় এবং কৃষ্ণবিষয়ক গানই এর উপজীব্য।
![ভারতের স্থানীয় লোকনৃত্য । লোকনৃত্যের পরিচয় । লোকনৃত্যের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং আবশ্যকতা 5 গরবা নাচ [ Garba Dance ]](/wp-content/uploads/2022/05/Garba-Dance-1-300x169.jpg)
গোফগঠন :
এই নৃত্যটির সঙ্গে দণ্ডীয় রাসের সাজা আছে। দণ্ডীয় রাসের মতো গোফগ,ণ্ঠনও নাচা হয় বৃত্তাকারে, তবে বৃত্তের মধ্যে থাকে একটি বড় কান্ঠখণ্ড এবং তাতে বাঁধা থাকে নানাপ্রকার রঙবেরঙের ফিতে। একটি হাতে লাঠি এবং অন্য হাতে ফিতের একটি প্রান্ত ধরে নাচটি করা হয়। ছেলে মেয়েরা একই সঙ্গে এই নাচে অংশগ্রহণ করে থাকে।
উপরিউক্ত তিনটি লোকনৃত্য ব্যতীত আরও একটি উল্লেখ্য নৃত্য হল ডিপনি নাচ। তাছাড়া শস্যকর্তন উৎসব সহ বিভিন্ন লৌকিক অনুষ্ঠানে আরও নানাপ্রকার লোক নৃত্যের প্রচলন আছে।
মধ্যপ্রদেশ : মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী গোল্ডদের প্রিয় নাচ করমা। এই নৃত্যে ছেলেরা এবং মেয়েরা পৃথক দলবদ্ধভাবে নাচে। মেয়েরা নাচে অর্ধ বৃত্তাকারে এবং ছেলেরা বৃত্তাকারে। তাছাড়া বস্তারের আদিবাসীদের লোকনৃত্যেও দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য। সারা বছর বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের নাচ হয়, যেমন এদের বর্ষাকালীন নাচের নাম গোণ্ডা, ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় হয় নবরাণী উৎসব, শস্য রোপনকালীন নাচ বীজপ তুলী, চৈত্র মাসে চেত দণ্ড, শ্রাবণ মাসে গোডো, মাঘ মাসে দেওয়ারী ইত্যাদি ।
আরও দেখুন: