আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা সুনীল কোঠারী , যা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য এর অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা সুনীল কোঠারী
বিদূষী লেখিকা ড. কপিলা বাৎসায়ন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্ল্যাসিকাল ডান্স ইন আর্ট অ্যান্ড লিটারেচর’ এ মন্তব্য করেছেন, ‘বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের নাট্যশাস্ত্র কেবলমাত্র নাটক সম্বন্ধীয় প্রবন্ধাবলী তো নয়- যেমন কেউ কেউ মনে করেন কিংবা শুধু নৃত্যবিষয়ক প্রবন্ধও নয়, যেমন অনেকে বিশ্বাস করেন।
আসলে, ভরতের নাট্যশাস্ত্রতে তিনি যেমনভাবে নাট্য প্রণালীর নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার ভিতর থেকেই ভারতীয় নৃত্যের কৌশলগুলো চয়ন করে নিতে হবে এবং সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধি খাটিয়ে নৃত্যের নিয়মাবলী বেছে ফেলতে হবে। একবার এই ব্যবস্থাটি করে নিলেই আমাদের নৃত্যশৈলীর স্বতন্ত্র চরিত্র ফুটে উঠবে।
ভারতের নাট্যশাস্ত্র পড়তে বসলে ড. বাৎসায়নের এই মন্তব্যটি মনে রাখা প্রয়োজন। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত না করে পড়তে গেলে আমরা ভুল বুঝে অনেক কিছু ধরে নিতে পারি, যার তথ্যগত কোনোই ভিত্তি নেই । ১৮৭৪ খৃস্টাব্দে জার্মানিতে, হাইমান একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান, যার ভিতরে ছিল নাট্যশাস্ত্রের প্রথম চৌদ্দটি পরিচ্ছেদ।
জে, এসেট পরে সেটি ছাপান, যার ফলে ভারততত্ত্বের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল । নাট্যশাস্ত্রের অধ্যায়নে প্রয়াত ড. ভি রাঘবনের মতো পণ্ডিতদের অবদান অসাধারণ, যেমন সম্পাদনায় তেমন তুলনামূলক গবেষণায়, তালিকাভুক্ত করায় ও তথ্যবিতরণে। তার অনুগামীরা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন শাস্ত্রীয় তত্ত্বগুলোকে প্রয়োগ মাধ্যমে সম্পৃক্ত করে দিতে।
এ কথা সত্য যে শাস্ত্র পরে গড়ে উঠেছিল, প্রথমেই তো প্রয়োগ। কিন্তু শাস্ত্রের মূল্য অসাধারণ, কারণ তাতে রীতিনীতি ও অনুশাসনগুলো বেঁধে দেয়া হয়েছে, যার উচ্চতম আদর্শগুলো আমাদের ধরে রাখা কর্তব্য। বহু শতাব্দীর ক্রমবৃদ্ধি থেকে তো ভারতীয় নৃত্যকলা এমন উন্নত স্তরে এসে পৌঁছেছে।
যেহেতু নৃত্যকলা একটি গতিময় শিল্প মাধ্যম তাই তাকে পুরোপুরি স্থিতিশীলতায় বেধে রাখা যায় না। কঠোর নিয়মে আবদ্ধ থাকলে নৃত্যকে অর্থহীন করে ফেলা হয়। নৃত্যের মুক্ত উদ্দীপনাকে যারা বুঝতে পারেন না, তারাই প্রথাগত পরম্পরাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে যান।
এমনকি গুরুশিষ্য পরম্পরা পদ্ধতিতে যে শিল্প ঐতিহ্যকে মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত করা হয়, তারও ভিতরে কোনো গুরুর প্রতিভার বৈশিষ্ট্য অথবা একটা কালান্তরের ছাপ স্পষ্ট থেকে যায়। সেই জন্য নাট্যশাস্ত্র থেকে পরে লেখা গ্রন্থগুলোতে আমরা কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি !
প্রযুক্তিগত ভাষায় যাকে ‘হস্ত’ বলা হয় অথবা জনপ্রিয় ভাষায় ‘মুদ্রা’ ; সেই মুদ্রার সংখ্যা নাট্যশাস্ত্রতে যতগুলো পাই, নন্দীকেশ্বরের অভিনয়দর্পণে তা পাই না, শাঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকরে, জয়সেনাপতির নৃত্যরত্নাবলীতে কিংবা শুভঙ্করের হস্তমুক্তাবলীতেও তা পাওয়া যায় না।
তার কারণ, নৃত্যকলার প্রয়োগ কর্মে নানাবিকল্পকে মেনে নেওয়া হয়েছে, আর বিভিন্ন শতাব্দীর প্রচলিত অভ্যাসগুলোতেও গ্রন্থে লিখিতভাবে স্বীকার করা হয়েছে। দুই হাজার বছরেরও আগের এই শিল্পশৈলীটি নানা গবষেণাগ্রন্থে সঙ্কলনভূক্ত করা হয়েছে। আশ্চর্য লাগে ভারতে যে মৌখিক পদ্ধতিতে এই শিল্প গুরুশিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে বর্তমানকালেও প্রচলিত হয়ে চলেছে।
স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে আমাদের প্রাজ্ঞ গবেষক গোষ্ঠী, পণ্ডিতরা ও নৃত্যশিল্পীরা সাগ্রহে তত্ত্বের সন্ধানে পুরাতন ইতিহাসের পথে ফিরেছেন, প্রয়োগও শাস্ত্রের মধ্যে সেতু বন্ধনের কাজে। এটা তো হওয়াই স্বাভাবিক ।
আমাদের নৃত্যশিল্প যদি এতই প্রাচীন হয় তাহলে আমাদের পুরাতন পুঁথিগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বুঝে নিতে হবে এবং ভাস্কর্যে, চিত্রকলায় ও সাহিত্যে আমাদের নৃত্যশিল্পের ইতিহাস কেমনভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে, তাও জানতে হবে। এই বিষয়ে প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা করেছিলেন ড. কপিলা বাৎসায়ন, প্রয়াত ড. বাসুদেবশরণ আগরওয়ালের অধীনে।
নৃত্যকলার প্রণালীবদ্ধ গবেষণার ভিত্তিস্থাপন করেন ড. বাৎসায়ন এবং সেই গবেষণায় উপকৃত হয়েছেন তার অনুগামী বহু শিক্ষাব্রতী গবেষক। আমি নিজেই কর্মক্ষেত্রে ও তত্ত্ব অধ্যয়নে কপিলাদেবীর গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেছি।
যদিও আমি প্রথমেই সাম্প্রতিক প্রথাগুলোর একটি নিরীক্ষা দিয়ে শুরু করি এবং সমকালীন নৃত্যশৈলী পর্যবেক্ষণ করে তার সঙ্গে নাট্যশাস্ত্রের সম্পর্ক স্থাপন করি। শাস্ত্রীয় কাঠামো নিয়ে গবেষণা আমি আরও পরে করেছি। অন্য যারা গবেষণা করেছেন তারা প্রধানত নৃত্যশিল্পী।
ড. কপিলা বাৎসায়নও একসময়ে নৃত্যকলাবিদ ছিলেন, যদিও তিনি পরে অন্য পেশায় মনোনিবেশ করে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মক্ষেত্রে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগ দেন।
অন্য দুই নৃত্যশিল্পী, যেমন ড. পদ্মা সুব্রাহ্মণিয়ম, মাদ্রাজ থেকে, আর ড. কণক রেলে, বোম্বাই থেকে, যথাক্রমে ভরতনাট্যম ও মোহিনীআট্টম বিষয়ে গবেষণা করেন ও নিজেদের নৃত্যরচনায় তাদের আবিস্কৃত তথ্য ব্যবহার করেন। নৃত্যশিল্পীদের ভিতরে কথকের ড. সীতা পুভাইয়া সর্বপ্রথম নৃত্যকলা ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা নিবেদন করেন বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নৃত্য সমালোচকদের মধ্যে ভাগ্যক্রমে আমিই প্রথম নৃত্যকলায় পিএইচডি লাভ করি, বরোদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৭ সালে। সেখানে ১৯৫০ সালে একটি নৃত্যকলা বিভাগ স্থাপিত হয়, প্রাজ্ঞ পথিকৃৎ গবেষক অধ্যাপক মোহন খোকনের নেতৃত্বে।
রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসবের বছরে, ১৯৬১ সালে, কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, যার ফলে উদয়শঙ্করের অধ্যক্ষতায় পরিচালিত নৃত্য, নাট্য ও সংগীত শিক্ষার আকাদেমীটিকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হলো এবং ১৯৬২ সালে নৃত্যকলা বিভাগ শুরু হয়ে গেল।
এখন সেখানে রীতিমতো প্রণালীবদ্ধভাবে ধারাবাহিক শিক্ষা দেওয়া হয় প্রয়োগভিত্তিক এবং শাস্ত্রীয় শিক্ষণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্তির জন্য। ডক্টরেট উপাধি-অর্জনের ব্যবস্থাও রয়েছে। ভারতীয় নৃত্যকলার ছয়টি প্রধান অঙ্গ, যথা : কথক, ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, কুচিপুদী ও ওড়িশী থেকে যে কোনো একটি বেছে নিতে পারেন ছাত্রছাত্রীরা।
ভারতের এতগুলো শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার শিক্ষণব্যবস্থা একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথই প্রথম নৃত্যকলাকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং এখন সেখানে নৃত্যবিভাগে মণিপুরী ও কথাকলি শিক্ষা দেওয়া হয়, স্নাতক ডিগ্রি পর্যন্ত, প্রয়োগে ও তত্ত্ববিদ্যায়।
বিশ্বভারতীতে এবার নৃত্যে স্নাতকোত্তর উপাধি দেওয়ার চেষ্টাও আরম্ভ হয়ে গেছে। কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোর ও মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ রয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ ও সিকন্দ্রাবাদের সরকারি কলেজগুলোতেও সংস্কৃতি বিভাগের অধীনে নৃত্যকলা শেখানো হয়, যেমন হয় উড়িষ্যার ভূবনেশ্বরে।
সংগীত বিভাগ এবং অন্যান্য কিছু বিভাগীয় শিক্ষার ভিতরে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবেও নৃত্যকলা শেখানো হয়ে থাকে, যেমন বোম্বাইয়ের এস এন ডি টি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চণ্ডীগড়ের মহিলা কলেজে। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরেকটি নৃত্যশিক্ষার কলেজ হলো বোম্বাই শহরের নালন্দা নৃত্যকলা মহাবিদ্যালয়।
মধ্যপ্রদেশের খায়রাগড়ে একটি অদ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইন্দিরা সংগীতকলা মহাবিদ্যালয়, যেখানে ভারতে সর্বপ্রথম শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্য (কথক ও ভরতনাট্যম) শিক্ষার সঙ্গে চিত্রকলা ও ভাস্কর্য শেখানো হয় বিহারের মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা চলছে, গয়া শহরে।
মাদ্রাজের বিখ্যাত কলাক্ষেত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাদানে আগ্রহী হয়েছেন ইউজিসির কর্তৃপক্ষ, রুক্মিণী দেবীর স্মরণে। মোটামুটি জরিপ করে দেখলেই লক্ষ্য করা যায় যে নৃত্যকলা আজকের দিনে একটি কেতাবি বিদ্যার্জনের বিষয় হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে এবং নাচের সমঝদারেরা এখন চেষ্টা করলেই পিএইচডি উপাধি জয় করে নিতে পারেন।
আধুনিক নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে, এই নতুন প্রজন্মে, প্রয়োগ কৌশল ও শাস্ত্রজ্ঞানে দক্ষ ও সচেতন ছাত্রছাত্রী অনেকেই দেখা দিয়েছেন। নৃত্যকলার সমকালীন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দুটি জিনিস লক্ষ্য করা যায়। প্রথম, অনেক নৃত্যশিল্পী আধুনিক নৃত্যের কৌশলে নাট্যশাস্ত্র নিয়মাবলী আরোপ করছেন।
দ্বিতীয়, প্রশাসনিক তথ্য ও ভাস্কর্যের উদাহরণের সহায়তার প্রাচীন শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পকে পুনরায় গড়ে তুলছেন অনেকে। রুক্মিণী দেবী ও তার নৃত্যগোষ্ঠী প্রথম চেষ্টাটির দিকেই ঝুঁকেছিলেন, অপরদিকে, ড. পদ্মা সুব্রাহ্মণিয়ম, ভরতনাট্যমম মাধ্যমের ভিতরে প্রাচীন তথ্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন তুলে দিয়ে, আদি শাস্ত্রীয় নৃত্যকলাকে নতুন করে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
চিদাম্বরম, বৃহদীশ্বর এবং শাঙ্গপাণির মতন মন্দিরের করণ ভাস্কর্য আবিষ্কার করে তার গবেষণা পদ্ধতি সত্যই উল্লেখযোগ্য হয়েছে। এ ভাস্কর্যের সমকালীনসংগীত যদিও তিনি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেননি, কিন্তু করণ ভাস্কর্যের অনুকরণে তার নৃত্যভঙ্গিমাগুলো বাস্তবিকই নৃত্যকলায় নতুন একটা মাত্রা এনে দিয়েছে।
ড. সুব্রাহ্মণিয়মের ভরতনাট্যম শৈলী, যাকে তিনি ভরতনৃত্যম বলে থাকেন সৌন্দর্যশাস্ত্রের আদর্শ কতটা ধরে রাখতে পেরেছে, কিংবা কতটা শোভনতা নয়তো ঔচিত্য বোধ তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, এ বিষয়ে এখনও তর্ক করা যেতে পারে। তার সব ভঙ্গিমাই যে যথাযথ, তা বলতে পারব না, মাঝে মাঝে তার নাচের ভাষা তো এস্পেরান্টোর মতো অস্বাভাবিক মনে হয়।
দাক্ষিণ্যতের সমালোচকেরা ওর নৃত্যকে আবিয়াল বলে ডাকেন, নানারকমের সবজি মিশিয়ে একটা তরকারির ঘণ্টা জাতীয়! বিধিগত সম্প্রদায়ের ভরতনাট্যমের তুলনায় ড. সুব্রহ্মনিয়মের নৃত্যশৈলী কেমন যেন গিমিকবহুল লাগে, মাঝে মাঝে অতি নাটকীয়ও বলা যায়। এই করণ ভাস্কর্যগুলো অন্যভাবেও তো সাজানো যেত।
ভাস্কর্যের সঙ্গে নৃত্যের এই অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গবেষণাটি কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান কাজ, নিঃসন্দেহে বলতে পারি । অন্যদিকে, গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ওড়িশি নৃত্যকে নতুন জীবন দান করেছেন স্বীয় প্রতিভা, কল্পনাশক্তি ও সৃজনীকৌশলের গুণে, মাত্র বছর পঁচিশেকের ভিতরে। তার সৃষ্টি যেন শাস্ত্রীয় বিধানের অনুমোদনও লাভ করেছে।
যদিও তিনি অন্য নৃত্যকলাবিদদের মতো নাট্যশাস্ত্র থেকে ক্ষণেক্ষণেই উদ্ধৃতি তোলেন না। তবু তারই সৃজনীশক্তি নাট্যশাস্ত্রকে যেন আলোকিত করে তোলে। গুরু বিপিন সিংহ তেমনি মণিপুরী নৃত্যকলার রাসলীলা, সংকীর্তন ও পুংচলম ইত্যাদি থেকে চয়ন করে, শাস্ত্রীয় বৃন্দনৃত্যের ও একক নৃত্যের চমৎকার একটি সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন।
গুরু ভেমপস্তি চিন্নাসত্যম এইভাবেই তার কল্পনাশক্তির সাহায্যে কুচিপুদীর শাস্ত্রীয় চরিত্রটি উজ্জ্বল করে এঁকেছেন। বিরজু মহারাজ কথকের শৈলীতে, বিশেষত বিশুদ্ধ নৃত্তরূপে, এক আশ্চর্য মাত্রা যোগ করেছেন, মনোহারী সৌন্দর্যের ও নীতিগত ঐতিহ্যের মিশ্রণে।
কথক নৃত্যের নিয়মাবলী বিশ্লেষণ ও সমর্থন করে লেখা কোনো গ্রন্থ পাওয়া যায়নি, যেমন আমরা ভরতনাট্যম ও কুচিপুদির ক্ষেত্রে অভিনয় দর্পণের সাহায্য পেয়েছি। নর্তনসর্বস্ত গ্রন্থটির কথা শোনা যায় কিন্তু রায়গড়ের ভূতপূর্ব রাজা চক্রবরসিংহের বংশধরদের হাতে তা চাপা পড়ে আছে।
রাজার ভাগিনেয় বা ভ্রাতুষ্পুত্রটি গ্রন্থটি হাত ছাড়াও করেন না, কোনো গবেষককে পড়তে দিতেও চান না। ড. মদ্ৰাক্রান্তা বসু গবেষণা করেছেন পুণ্ডরীক ভিঠলের নর্তননির্ণিয় সম্পর্কে, যে বইটির প্রকাশের আশায় আমরা আগ্রসহকারে অপেক্ষা করছি।
কথক নৃত্যশিল্পের শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে পুনর্গঠন এবং প্রয়োগকলা ও পুঁথিগত নিয়মাবলীর সম্পর্ক স্থাপনে খুবই সাহায্য করবে তার গবেষণা বইটি। নাট্যশাস্ত্রতে মুখজাভিনয় অংশটি কথাকলি নৃত্যশৈলীতে চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে। দৃষ্টিভেদ, ভ্রুভেদ, চোখের তারার বিচলন, গণ্ডদেশ বা চিবুকের ওঠানামা, গ্রীবাভেদ প্রভৃতি ছোট বড় সব ভঙ্গিমাই নাট্যাশাস্ত্রের ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে।
নাট্যশাস্ত্রতে একাহার্য লাস্যাঙ্গ এবং অনেকাহার্য শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে; যাতে মনে হয়, নৃত্যের ক্ষেত্রে নাটকেরই মতো একক ও বৃন্দচরিত্র চিত্রিত করার পদ্ধতি বোঝানো হয়েছে। বেশির ভাগ একক নৃত্যই প্রথম পদ্ধতির অন্তর্গত এবং নৃত্যনাট্যরূপগুলো দ্বিতীয় বিভাগে পড়ে।
একাহার্য পদ্ধতিতে একই নর্তকি অনেকগুলো ভূমিকা ফুটিয়ে তুলতে পারেন এবং সব শাস্ত্রীয় নৃত্যকলাতেই এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। নৃত্যনাট্যগুলোতে কিন্তু একাধিক অভিনেতা ও নর্তকি পৃথক পৃথক চরিত্র অভিনয় করেন।
প্রতিটি নৃত্যশৈলীই নাট্যধর্মী অথবা রীতিবদ্ধ অভিনয় এবং লোকধর্মী অথবা বাস্তবানুগ অভিনয় ব্যবহার করে থাকে, যদিও নাট্যধর্মী শৈলীর উপরেই বেশির ভাগ নৃত্যশিল্প নির্ভর করে থাকে। অভিনয় করার সময়ে নৃত্যশিল্পীরা অনেক সময়ে বাস্তবানুগ লোকধর্মী শৈলী প্রয়োগ করেন ।
কিন্তু ঔচিত্য বোধ বজায় রাখতে হলে সূক্ষ্ম বিচারশক্তি দিয়ে দুই শৈলীর ভারসাম্য বেঁধে নিতে হবে। নৃত্যশৈলীতে আরও নানা প্রকার ভঙ্গিমার বিভাজন রয়েছে, যেমন কোমল বা লাস্য এবং পৌরুষময় বা তাণ্ডব।
অভিনয়ের চারটি ভাগের ভিতরে বাচিকাভিনয় এখন প্রায় সব নৃত্যশৈলীতেই শুধু গায়কের দায়িত্ব, যিনি গান গেয়ে যান, ও নৃত্যশিল্পী সেই গানের কথাগুলো অভিনয় করে দেখান। কথাকলি শিল্পে নৃত্যশিল্পী কখনোই বাক্য ব্যবহার করেন না। দানবীয় চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে তীব্র স্বরে চিৎকার করে থাকে শুধু।
অন্যান্য শৈলীতে, নৃত্যশিল্পীর কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট হলে, তিনি গানও করে থাকেন, এবং কুচিপুদীতে কিছু বাক্যালাপও থাকে । প্রতিটি পৃথক নৃত্যশৈলী বহু বছরের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগকৌশলে কিছু কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছে। প্রতিটি সম্প্রদায় তার নিজের যুক্তিতেই বেড়ে উঠেছে সুতরাং নাট্যশাস্ত্রের সকল নিয়মই যে এদের প্রলনের সঙ্গে মিলবে তা বলা যায় না।
নাট্যশাস্ত্র অধ্যায়নের সময় মনে রাখতে হবে যে শুধু নৃত্যকলার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত না আমাদের বরং ভারতীয় নৃত্যের প্রাণবন্ত ধারাবাহিকতার ঐতিহ্যটিকে যথার্থরূপে বোঝাতে হবে। বহতা নদীর মতো নৃত্যধারা ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে তার রূপান্তর প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করাও যায় না।

নাট্যশাস্ত্রের সারমর্মটি আমাদের বুঝে নিতে হবে এবং সেই সঙ্গ চিরন্তন, অকাট্য রসতত্ত্বটিও। সব কিছুর শেষে রসসৃজন করার ক্ষমতা, বা রসনিষ্পত্তি দিয়েই উঁচু মানের শিল্পীকে চেনা যেতে পারে, সেটাই তো আদতে কষ্টিপাথর।
আধুনিক কালেই আমরা মায়লাপুর শিল্পী গৌরী আম্মাকে বালা সরস্বতীর রাজকীয় অভিনয়, কালনিধি নারায়ণ ও তার চমৎকার অভিনয়শৈলী ভরতনাট্যমের মাধ্যমে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি। কুচিপুদীতে বেদাস্তম সত্যম তার নারী চরিত্র অভিনয়ে প্রসিদ্ধ, কথকে শম্ভু মহারাজ ও বিরজু মহারাজ এবং ওড়িশিতে গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র নৃত্যশিল্পে মুগ্ধ করেছেন।
কথাকলিতে গুরু কুঞ্জকুরুপ, কলামণ্ডলম কৃষ্ণন নায়ার এবং কলামণ্ডলম গোপী আছেন । কুড়িআট্টম নৃত্যে দেখেছি মণি মাধব চাকিয়ার এবং আম্মানুর মাধব চাকিয়ারকে; মোহিনীআট্টমে কল্যাণী কুট্টি আম্মা আছেন, আর মণিপুরীতে গুরু বিপিন সিংহ ও গুরু আমুবি সিংহ।
সেরাইকেল্লা ছৌ নাচের গুরু কেদারনাথ সাহু এবং পুরুলিয়ায় আছেন গম্ভীর সিং মুড়া, ময়ূরভঞ্জের ছৌ গুরু হলেন কৃষ্ণচন্দ্র পট্টনায়ক এবং কলাক্ষেত্রের নৃত্যনাট্যগুলো তৈরি করেছেন স্বয়ং রুক্মিণী দেবী। এদের সকলেরই মৌলিক চিন্তাধারায় নাট্যশাস্ত্রের মূলনীতিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, অথচ উচ্চগ্রামে চিৎকার করে তা প্রচার করতে হয় না, কোনো কোনো শিল্পীর মতো।
এসব গুরু ও শিল্পীদের নৃত্যকলায় নাট্যশাস্ত্রের সারমর্ম যেন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, তাই সেই শিল্প তাদের রক্তস্রোতে বইছে মনে হয়। পণ্ডিতমণ্ডলী ও ছিদ্রান্বেষীদের ওরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সারাজীবন নৃত্যশিল্পের সাধনা করলেও নাট্যশাস্ত্রের ঐতিহ্যগত বিস্তার ও গভীরতার আঁচ পাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই উপলব্ধি একবার হয়ে গেলে আর বিপদের ঝুঁকি নিতে হয় না। এবং এসব গুরুদের মহত্ব সম্পর্কে সচেতনতা আসে। নাট্যশাস্ত্রের বিষয়ে গবেষণার পরে আমাদের ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ সম্পর্কে সঠিক ওজন সঞ্চারিত হয়।
নবরস : যদিও নাট্যশাস্ত্রে শুধু আটটি রস বর্ণিত আছে, পরের শাস্ত্রকারেরা শান্তরসকে নবম রস বলে গ্রহণ করেছেন। প্রত্যেক নৃত্যকলায় এই নবরস প্রতিবিম্বিত হয়ে থাকে, কোনো শিল্পী একটি নৃত্যের মধ্যে সবকটি নিবেদন করেন (নাট্যশাস্ত্রের শ্লোক থেকে তুলে একটি তালিকা পড়ে যাওয়ার মতো), অন্য একজন হয়তো গীতিকবিতার মৌলিক অবদানরূপে নবরসকে ব্যবহার করেন।
উদাহরণস্বরূপ রাম শ্লোকটি যেমন, ‘শৃঙ্গারম, ক্ষিতিনন্দিনী বিরহনে, বীরম, ধর্নভঙ্গনে, কারুন্যম বালীভজনে, রৌদ্রম রাবণমর্দণে, অদ্ভুতম সিন্ধুগিরি স্থাপনে, হাস্যম শূর্পণখামুখে, বীভৎসম অন্যমুখে, ভয়ম অঘে, শান্তম মুনিজনে।’ কথাকলিতে নবরসের বর্ণনা বেশি নাটকীয় যেহেতু এই নৃত্যশৈলী নাট্যরূপী এবং নাটকে নবরসের বর্ণনা আরো সার্থক হয়ে ওঠে।
নাট্যশাস্ত্রে অষ্টনায়িকার উল্লেখ আছে, এই আটটি চরিত্রের নায়িকা বিভিন্ন মানসিক গুণ সম্বলিত হয়ে তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে আসেন। এই প্রতীকীরূপগুলো নাট্যশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিস্কার ফুটিয়ে তোলে। নায়ক-নায়িকার মনোবৃত্তির এই বর্ণনাগুলো সবচেয়ে সার্থকভাবে চিত্রিত হয়েছে কবি জয়দেবের সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দতে (১২শ শতক)।
এই কাব্যে রাধার বিভিন্ন মানসিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে নায়িকা চরিত্রের মাধ্যমে। শুধু প্রোষিতভর্তৃকা যে নায়িকার প্রভু প্রবাসে কর্মব্যস্ত এখানে স্থান পাননি। নাট্যশাস্ত্রে অষ্টনায়িকা শ্লোকগুলো রয়েছে সামান্যাভিনয় অংশে (২২ পরিচ্ছেদে), সর্বপ্রকার লক্ষণগুলো বর্ণিত হয়ে।
এই লক্ষণগুলো নৃত্যে দেখানোর কথা নয়, শুধুই নায়িকার মানসিক অবস্থা ও তার স্বাভাবিক প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার জন্য এগুলো তালিকাভূক্ত করা হয়। নায়িকাদের সংস্কার অনুযায়ী তাদের আরও ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা: উত্তমা, মধ্যমা ও অধমা, আর সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী স্বীয়া (নায়কের সহিত বিবাহিতা) এবং পরকীয়া (অন্য পুরুষের স্ত্রী কিন্তু নায়কের প্রেমিকা)।
ধনঞ্জয়ন দশরূপকে নায়িকা বর্ণনায় আশ্চর্য বৈচিত্র্য প্রকাশ করেছেন। প্রধান আটটি নায়িকার বর্ণনা হলো :
অভিসারিকা : মিলনের আশায় সুসজ্জিতা ।
বিরহোৎকণ্ঠিতা : বিরহ দুঃখে কাতর।
কলহান্তরিতা : কলহের কারণে নায়কের সঙ্গ ছিন্ন।
স্বাধীনাপতিকা : স্বামীকে নিজের অধীনে যিনি রাখেন।
খণ্ডিতা : প্রেমিকের প্রতি রাগভাবাপন্ন।
বিপ্রলব্ধা : প্রেমিকের দ্বারা প্রবঞ্চিতা।
প্রোষিতভর্তৃকা : প্রবাসে যাত্রাকারী স্বামী যার ।
অভিসারিকা : প্রেমিকের সঙ্গ লাভে ভ্রাম্যমান ।
নাট্যশাস্ত্রে নির্দেশ আছে যে নায়িকাদের বর্ণনায় শুধু গীত ও মৃদুছন্দে নৃত্য ব্যবহার হবে। ক্ষেত্রাইয়া ও অন্যান্য কবিদের অসংখ্য পদম এবং যবালি ভরতনাট্যম, কুচিপুদী ও মোহিনীআট্টমে, ঠুমরী জাতীয় সংগীত কথকে, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব পদাবলী মণিপুরীতে,
বনমালী, কবিসূর্য বলদের রথ ও উপেন্দ্র ভঞ্জের গান ওড়িশিতে এবং গীতগোবিন্দের অষ্টপদীতে নায়িকা রাধার বিভিন্ন মানসিক অবস্থার বর্ণনা, সবই নাট্যশাস্ত্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খৃষ্টজন্মের দুই শতক পরের মধ্যে লিখিত যে নাট্যশাস্ত্র, তার ভিতরে মানব প্রকৃতির বর্ণনা,
আবেগ ও অনভূতির বিশ্লেষণ, সবই বিশ্বজনীন বাস্তবতায় প্রকাশ পায় এবং পরবর্তী যুগের কাব্যতে প্রতিবিম্বিত হতে থাকে এবং নৃত্যকলাতেও এখনো আশ্চর্যভাবে ধরা পড়ে।
ভারতের নানা প্রদেশে যে বিশিষ্ট নৃত্যশৈলী গড়ে উঠেছে, যাতে নিও ক্ল্যাসিক (অথবা নব্যশাস্ত্রীয়) বলা যেতে পারে, সেগুলো নাট্যশাস্ত্রের নিয়মাবলীর ভিন্ন ভিন্ন অংশে জোর দিয়ে প্রাদেশিক ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যের দিকে আলোকপাত করে চলেছে ।
‘ভাবাভি ভাবানুভাব সংযোগ দৃশ্য নিষ্পত্তিহিঃ রসসূত্র’ নৃত্যকলার অভিনয়াংশে সব ক্ষেত্রে ব্যবহার্য করা যায়, নৃত্যশিল্পীর মনোধর্ম ও কল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। শুধু কথাকলি শৈলীতে মুখজাভিনয় অনেক বেশি সুগঠিত।
নাট্যধর্মীর উপর সব নৃত্যকলাই নির্ভর করে যেমন চোখে জল আসা অভিনয় করে দেখতে হলে হস্তাভিনয় দ্বারা গালের ওপর অশ্রুধারা দেখানো হয়, চোখের জল না ফেলেই। নাট্যধর্মী অভিনয়ে একটা বিশ্বজনীন শৈলী আছে যা শাস্ত্রীয় নৃত্যকৌশলে মানিয়ে যায়।
লোকদর্শীয় বাস্তবরূপী অভিনয়ে দর্শকদের তৎক্ষণাৎ আকৃষ্ট করা যায় কারণ মুখের ভাবগুলো চট করে ধরে নিতে পারে দর্শকেরা। নাট্যধর্মীতে ব্যঞ্জনার উপায়গুলোকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। নাট্যধর্মী অভিনয় বুঝতে হলে সৌন্দর্যতত্ত্ব ও নিয়মাবলী জানা দরকার, যা পার্থিব দৃষ্টিকে সাধারণ কাব্যজগতে নিয়ে যেতে পারে।
নৃত্য বিশুদ্ধনৃত্যকে বলা হয়, যার ভঙ্গিমা সুকল্পিত এবং সমন্বয়যুক্ত মঞ্চোপযোগী দেহসঞ্চালনে ও মুদ্রায় সজ্জিত। তাল ও লয়ের সঙ্গতি এর অপরিহার্য অঙ্গ। নৃত্যভঙ্গিমায় কোনো বিশেষ অর্থ বা প্রতীক খুঁজে পাওয়া যায় না শুধুই সামঞ্জস্য, ঐকতান ও সৌন্দর্য বোধসৃজনই এর একমাত্র লক্ষ, কিছু ব্যাখ্যা করা নয়।
নৃত্য কিন্তু অভিব্যক্তিমূলক শিল্প যা সংগীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। হস্তমুদ্রা, মুখভঙ্গিমা ও অঙ্গসঞ্চালনের সহায়তায় গানের ভাবার্থ বিশদ রূপে ব্যাখ্যা করাই এর কাজ। নাট্য অথবা নাটকে দীর্ঘ গীতিকাব্য রচনা করে নৃত্যনাট্যের গায়ক-গায়িকাদের দিয়ে গাওয়ানো হয়, সুতরাং কণ্ঠসংগীতশিল্পীরা বাচিকাভিনয়ের দায়িত্ব গানের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।
এগুলোর মধ্যে কথোপকথন ব্যবহৃত হয়, যেমন ভাগবত মেলা নাটকে, কুচিপুদী নৃত্যনাট্যে, কুরভঞ্জী নাটকে, মণিপুরী রাসলীলায়, আসামের অঙ্গীয়নটে ও শাস্ত্রীয় নৃত্যে। আধুনিক নৃত্যপরিকল্পনায় কিন্তু কথোপকথনের ব্যবহার অতি সীমিত, শুধুই সাবেকি ভাগবত মেলা নাটকে অথবা কুচিপুদী নৃত্যনাট্যের প্রাচীন কেন্দ্রগুলোতে যা দেখা যায়।
কথাকলিতে তো কথোপকথনের ব্যবহারই নেই। বাচিকা, আঙ্গিকা, আহার্যা ও সাত্ত্বিকা, এই চার প্রকার অভিনয় কমবেশিভাবে সব নৃত্যনাট্যেই ব্যবহার হয়। কুচিপুদীতে যেমন সাত্ত্বিকা অভিনয় দেখা যায়, যখন নৃত্যশিল্পী গানের বাণীর সঙ্গে হস্তমুদ্রার সম্পর্ক শুধু না বুঝিয়ে, আন্তরিক ও গভীর অভিনয়ের দ্বারা শিল্পীর মানসিক বেদনা বা দুঃখ দৈহিক ভঙ্গির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন।
সাত্ত্বিকাভিনয় তাই শিখিয়ে দেওয়া অসম্ভব। অন্যান্য অভিনয়গুলো অনুকরণের দ্বারা শিখে নেওয়া যায়। কথাকলিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে দেহের প্রতিটি অঙ্গ ও পেশিকে চালিত করা হয়, মানসিক আবেগকে দৈহিক প্রকাশ মাধ্যমে ফুটিয়ে দেওয়ার জন্য। কথাকলি শিল্পী তাই ক্ষুদ্রতম মানসিক পরিবর্তনকে স্পষ্টরূপে অভিব্যক্ত করেন।
সব জড়িয়ে বলতে গেলে, নাট্যশাস্ত্র তালিকাভূক্ত ও লিপিবদ্ধ করে সর্বপ্রকার নৃত্যকৌশলগুলোকে, নবরস ও অষ্টনায়িকাদের শ্রেণীবদ্ধ করে, নৃত্য, নাট্য, সংগীত, কাব্য, বিভিন্ন নাট্যশালার গঠন পদ্ধতি এবং নাট্যসম্বন্ধীয় নানা বিষয়বস্তুর বর্ণনা নথিভূক্ত করে।
তাই নাট্যশাস্ত্রের প্রতিটি টীকা মন দিয়ে পড়া, আঞ্চলিক প্রয়োগকৌশল লক্ষ্য করা, বিভিন্ন রীতি, আচার ও রূপান্তরগুলো বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। নৃত্য ও নাট্যের মাধ্যমে নাট্যশাস্ত্রের সম্পূর্ণরূপ প্রকাশ করা শুধু একজন গবেষকের পক্ষে অসম্ভব।
অনেক অংশের ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা, অনেক শব্দের সঠিক অর্থ এখনো স্থির করা যায়নি, বিভিন্ন অর্থ নানা লোকে ব্যবহার করে চলেছে। সুতরাং ঔচিত্যের মূলনীতি চোখের সামনে রেখে আমাদের সতর্কভাবে নিয়মাবলী চয়ন করে যেতে হবে।
শাস্ত্রীয় নৃত্যকলায় আমরা দেবদেবীর কাহিনী, পুরাণের নায়ক-নায়িকাদের কথা, রামায়ণের ও মহাভারতের গল্প, হিন্দু জীবনধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানতে পাই। সত্যেরই জয় হবে অসত্যের পরাজয়, শুভাশুভের দ্বন্দ্বে শুভই জয়লাভ করবে অবশেষে এই শিক্ষাই নৃত্যের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
এই সীমাবদ্ধ নিয়মের মধ্যে শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে, এবং তার ভিতরেই অর্থ খুঁজে নিতে হবে। সঞ্চারীভাব: স্থায়ীভাবের ভিতরে রতি একটি মনোরম ভাব, যা কাম্যবস্তু, ঋতুবৈচিত্র্য, পুষ্পমাল্য উপভোগ ইত্যাদি অনুভূতি প্রকাশ করে এবং অবশ্যই নারী পুরুষের মিলনের কথা ।
শৃঙ্গারের দুটি রূপ আছে, সম্ভোগ ও বিপ্রলম্ব : মিল ও বিরহ। সেগুলো আবার সঞ্চারীভাবে প্রখাম পায় যার সংখ্যা তেত্রিশ, এবং সেগুলো প্রধানভাবগুলোর সঙ্গে ব্যবহৃত হয় এবং তাকে অলংকৃত করে।
নায়িকা যখন তার প্রিয়তমের অপেক্ষায় আছেন, মিলনের জন্য তার প্রস্তুতিও চলছে, তিনি শয্যা পেতে ফুল দিয়ে তাকে সাজালেন ও সুগন্ধি সিঞ্চন করলেন, তখন একটি সুখানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আয়নায় নিজেকে দেখা, অতীত মিলনের কথা চিন্তা করা, সুখস্মৃতি ও নায়কের সঙ্গে মনে মনে আলাপ করা, এসবই সঞ্চারীভাবের পর্যায়ে সাজানো হয় ।
মাঝেমাঝে নৃত্যশিল্পী প্রধান ভাবটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কবিতার স্তবক থেকে কিছুটা তুলে নিয়ে একটি কাহিনী অভিনয় করে দেখান। যেমন, কালিনাগকে পরাজিত করায় কৃষ্ণকে সেই কাহিনীর বর্ণনায় চিত্রিত করতে হবে একাহার্যভাবে, যাতে শ্রীকৃষ্ণের এই বীররূপটি দর্শকের চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে।
কিংবা জগদোদ্ধারণ কৃষ্ণকে প্রকাশ করতে হলে, বালগোপালের মৃত্তিকা ভক্ষণ ও যশোদার রোষ ও ভৎসনা, গোপালের মুখের ভিতরে ত্রিভূবন দেখতে পাওয়া, সবই অভিনয় করে দেখাতে হবে। কৃষ্ণকে বিষ্ণুরূপে নিখিল বিশ্বের রক্ষক হিসাবে দেখানো প্রয়োজন, দশাবতার রূপেও। একক নৃত্যে তাই এই প্রথায় অভিনয়ের মধ্যে সঞ্চারীভাব প্রয়োগ করা হয় ।
নবরস: রামচন্দ্র যখন সীতার সঙ্গে সঙ্গে বাগানে ঘুরে বেড়ান তখন শৃঙ্গাররস প্রকাশ পায়, যখন তিনি শিবের ধনু ভেঙে ফেলেন বীররসের প্রকাশ হয়। যে রাক্ষস কাকরূপে সীতার বক্ষে মুখ দিয়েছিল, রাম ক্রোধবশে তাকে চোখের আগুনে ভস্ম করে দেন, সীতার করুণাভিক্ষায় রাম তাকে প্রাণদান করেন এখানে করুন রস ব্যবহার হয়।
রামের রৌদ্ররস দেখতে পাই রাবণবধের কালে, বিস্ময় বোধ হয় যখন বানরসৈন্য ভারত ও লঙ্কার মাঝে সেতু বন্ধন করেন। হাস্যরস প্রকাশ পায় যখন লক্ষন শূর্পণখার নাকটি কেটে ফেলেন, তার অশোভন আচরণের জন্য।
আদর্শস্বামী রামচন্দ্র পরনারীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ঘৃণাভাব দেখিয়ে, তিনি পাপ কাজকে ভয় করেন ও মুনিজনের সান্নিধ্যে পূজায় বসলে শান্ত রস প্রকাশ পায়। তাণ্ডব লক্ষণ, নাট্যশাস্ত্রের চতুর্থ পরিচ্ছেদ, যাতে ১০৮টি নৃত্যকলার বর্ণনা আছে। এগুলোকে করণ বলা হয় যেগুলো বোঝা সহজ নয়, যদি না আমরা সপ্তম, নবম, দশম ও একাদশ পরিচ্ছেদগুলোও পাঠ করি।
দেহের বিভিন্ন অংশ, যেমন পা, উরু, কটিদেশ, বিভিন্ন নৃত্তহস্ত সঞ্চালন এখানে আলোচিত হয়েছে। নৃত্য কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চারী। দশম পরিচ্ছেদে চারীগুলোর বর্ণনা রয়েছে। নাট্যশাস্ত্র অধ্যায়নের সময়ে পরিচ্ছেদগুলো ভালো মতে বুঝে প্রতিটি নৃত্যকৌশলের বিচিত্র ভঙ্গিমাগুলো আয়ত্তে আনতে হবে, যাতে নৃত্যের ক্রমবিবর্তন বোঝা যায়।
অভিনব ভারতীয় অভিনব গুপ্তের টীকাভাষ্যে অনেক উপকার পাওয়া যায়, যদিও অনেক শব্দের অর্থ বিভ্রান্তিকর এবং বর্ণনার প্রসঙ্গ অনুসারে মানে বুঝে নিতে হয়। ড. কপিলা বাৎসায়ন ও ড. পদ্মা সুব্রাহ্মনিয়মের মতো গবেষকেরা নাট্যশাস্ত্রের সহায়তায় নৃত্যকৌশলগুলো বিশ্লেষণ করেন এবং নিজেদের প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা নৃত্যভঙ্গিমার অনেকগুলোই শনাক্ত করতে পেরেছেন।
কলাক্ষেত্র কেন্দ্রটি নানা সংস্কৃতিজ্ঞ পণ্ডিতদের সাহায্যে ও নাট্যশাস্ত্রের, অভিনয় দর্পণের ও সংগীতারত্নাকরের অধ্যায়নের ভিতর দিয়ে নিজেদের কাজ করে চলেছেন।
ভরতনাট্টমের ঐতিহ্যটি অভিনয় দর্পণকেই অনুসরণ করে এবং কলাক্ষেত্রের নিয়মাবলী ও বিনিয়োগগুলো সেই কারণেই সবচেয়ে সন্তোষজনক। বোম্বাইয়ের শুরু পার্বতীকুমার সম্প্রতি নৃত্যের মাধ্যমে অভিনয় দর্পণের সবকয়টি শ্লোককে প্রদর্শিত করেছেন।
যদিও আমি মনে করি যে আমাদের নৃত্যশিল্পীরা ও গবেষকেরা দলবদ্ধ হয়ে যদি একজোটে কাজ করেন তবেই আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ ধারণায় শাস্ত্রীয় নৃত্যকলাকে বেধে রাখতে পারি। দুঃখের বিষয়, এখন অবধি সে চেষ্টা করা হয়নি এবং সেই জন্যেই নৃত্যশিল্পের এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা।
আরও দেখুনঃ