ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস: সঙ্গীতের মত নৃত্যেরও প্রাচীনত্বের হদিস করতে না পেরে প্রাচীন শংকারেরা পুরোণাদির আশ্রয় গ্রহণ করে বলেছেন তৌর্যরিকের আদিগরে, মহাদেবই এ সৃষ্টিকর্তা। মহাদেবের ডমর, ধ্বনি থেকে উদ্বৃত হল ছন্দের অনুরণন এবং এর সঙ্গে দেহছন্দের সংযক্তি রূপায়িত হল নৃত্যে।
Table of Contents
ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য
ব্রহ্মা প্রথমে মহাদেবের কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা করে তাঁর পশিষ্য নারদ, র, হ তু ও ভরতকে শিক্ষা দেন। পরে ভরতনি পৃথিবীতে সঙ্গীত (নৃত্য, গীত ও বাদ্য) প্রচার করেন। যাইহোক, একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে মানব জন্মের প্রথম থেকেই সঙ্গীত হয়েছে তার সঙ্গী, যুগে যুগে কেবলমাত্র তার রূপের পরিবর্তন ঘটেছে।
ভারতীয় ননৃত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে নিম্নলিখিত পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা যায় :
(১) প্রাক্-বিদিক যুগে
(২) বৈদিক যুগ
(c) বৈদিকোত্তর যুগে
(8) মধ্যयগ মুসলিম যুগে
(৫) আধুনিক কল
প্ৰাক্-বৈদিক যুগ :
এই যুগের নৃত্যকলার কোনও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় না। সিদ্ধ, সভ্যতার নিদর্শনাদির মধ্যে কিছ, নতর এবং নৃত্যরতা নর্তক-নতার্কীর মূর্তি পাওয়া গেছে। তাছাড়া তন্ত্রীত্তে বীণা, বাঁশী ইত্যাদি নানা বাদ্যযস্তাদিও পাওয়া গেছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে এই যুগে বাদ্যযন্তাদি সহযোগে নৃত্যের বহুল প্রচলন ছিল।
বৈদিক যুগ : বৈদিক যুগে প্রধানতঃ যাগযজ্ঞের প্রয়োজমেই সংগীতিক অনুষ্ঠানাদি হত। বেদে মণ্ডল ননৃত্যের উল্লেখ আছে। স্তোত্র গান এবং বীনা বাদ্যের সঙ্গে ‘মহাব্রত’ অনুষ্ঠানে স্ত্রীলোকেরা জনপর্ণে কলসী মাথায় নিয়ে অগ্নির চারিদিকে ঘরে ঘরে নৃত্য করত বৃষ্টির কামনা করে। অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষ পর্বেও এই একইভাবে ‘মাধদেং’ এই অংশটুকু গান করতে করতে তারা নৃত্য করত। ঋকবেদে বিবাহসহ অন্যান্য নানাপ্রকার উৎসব উপলক্ষ্যে নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায় এবংদেবরাজ ইন্দ্র স্বরং ননৃত্য করতেন বলেও এতে উল্লেখ আছে। কঠোপনিষুদে যম ও নচিকতা সংবাদে গীতির সঙ্গ নতের উল্লেখ আছে। কৃষ্ণ যজবে´দে ‘ইরাতি’ নামে একটি শব্দ পাওয়া যায় যার অর্থ হল আবৃত্তিসহ ন ত্য। এই যযুগেও নৃত্যকলার কোনও বিশেষ রূপের পরিচয় পাওয়া যায় না।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 3 ভরতনাট্যম নৃত্যরত শিল্পী [ Bharatnatym Mudra ]](/wp-content/uploads/2022/05/ভরতনাট্যম-নৃত্যরত-শিল্পী-Bharatnatym-Mudra-3-300x169.jpg)
বৈদিকোর যুগ :
এই যাগকে মহাকাব্যের যুগে বলেও অভিহিত করা হয়। নৃত্যচর্চা যে যাগেও অব্যাহত ছিল তা বোঝা যায় রামায়ণ, বহাভারত, বিভিন্ন পরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে ননৃত্যের উল্লেখ দেখে। ‘বরাহপরাণ’-এ দেবোদ্দেশ্যে নৃত্যের বিধি উল্লিখিত আছে। ‘হরিভক্তিবিলাস’ এ আছে:
নৃত্যতং শ্রীপতেরগ্নে ত লিক বাদ নৈভূশমা।
‘পদ্মপুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণভক্তের ননৃত্যের শত্রু,
পভ্যাৎ ভূমে দিশো দূগভ্যাম
দ্যোভ্যান্তামন্দলং দিবঃ।
বহুধোৎসার্থ’তে রাজন, কৃষ্ণভক্তস্য নৃত্যতঃ ।।
অর্থাৎ, হে রাজন কৃষ্ণভক্তের নৃত্যে জগতের সব অমঙ্গল বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাঁর বাহয়ে আকাশের এবং পদস্বর পৃথিবীর নয়নযগেল দিক, সমমূহের অমঙ্গল দূরীভূত করে। বাল্মীকি মনির তত্ত্ব বধানে লব ও কুশ রাজসভায় নৃত্য এবং গীতের মাধ্যমে যে অপর্বে র মারণ গান করেছিলেন তা শ্রবণ করে শ্রীরামচন্দ্র তাঁদের পরস্কৃত করে ছিলেন। মহাভারতেও নৃত্যের বহ, উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্জুন নৃত্যকলার বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং বিরাট কন্যা উত্তরার নৃত্যগর, নিষাক্ত হয়েছিলেন। ভাগবত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ ও গোপাঁদের রাসনৃত্য, কালীয়দমন নত, বালগোপালের ননী চুরি নৃত্য ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
“মহাবংশ’-এ সিংহলরাজ পরাক্রম বাহর (ST) সুন্দরী নৃত্যপটিয়সী রাণীর উল্লেখ আছে। বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কানসূত্রে’ গ্রন্থে ননৃত্যকে ৬৪ কনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। “দিব্যা বদান’-এ রাজা বুদ্রায়ণের বীণাবাদন এবং রাণী চন্দ্রাবতীর নৃত্যের উল্লেখ আছে। ‘মহাবংশ’-তেও সিংহলরাজ পরাক্রম-বাহর সুন্দরী নৃত্যপ টয়সী রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায় ।

মহাকবি কালিদাসের একাধিক গ্রন্থসহ বহু সংস্কৃত গ্রন্থে নৃত্যের উল্লেখ আছে। মালবিকাগ্লিমিতমের নারিকার মধ্যে কালিদাস নতে র যে রূপের পরিচয় দিয়েছেন তা শিব এবং পার্বতীর তাণ্ডব এবং লাসা নৃত্যের মিলিত রূপে। ভরতের নাট্যশাস্ত্র, হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে ছালিকা, আসারিত, হল্লসিক ইত্যাদি নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। নাত্যের এই প্রাধান্য থেকে বোঝা যায় যে এই যুগে সমাজ জীবনে ব্যাপক ভাবে ন্যূতে র অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। বিভিন্ন জাতকে নৃত্যগীতের উল্লেখ আছে।
এই সকল জাতকে নতোগতিপটিয়সী একাধিক নটীর উল্লেখ পাওয়া যা— বাসবদত্তা, শ্যামা, শ্রীমতী ইত্যাদি। জাতক ব্যতীত ভরতের ‘নাট্যশান্ত’ নারদের ‘সঙ্গীত মরদ’ ও ‘নারদীয় শিক্ষা’। নন্দিকেশ্বরের ‘অভিনয় দর্পণ’, ‘নত’ন নির্ণয়’, ‘নত্যশাস্ত’, ‘নৃতাবিলাস’, ‘নত্যসব স্ব অশোক মল্ল বিরচিত ‘নৃত্যাধ্যায়’, ‘সংঙ্গীত নারায়ণ’। শাঙ্গ’দেবের ‘সঙ্গীত-রত্নাকর’। পণ্ডেরীক বিঠঠলের নতন নির্ণয়’। দামোদরের ‘সঙ্গীত-দর্পণ’; অহোবলের ‘সঙ্গীত-পারিজাত’ ইত্যাদি প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রগুলিতেও নৃত্যের উল্লেখযোগ্য আলোচনা আছে ।
এই সময় মৌর্য বংশ হতে আরম্ভ করে গংগুযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজত্বে নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় নৃত্যকলার যে সমধিক বিকাশ হয়েছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায় নানা গহোশিল্পে স্থাপত্য এবং ভাষ্কর্যে। এদের মধ্যে সাঁচি ও বারহাতের ভাস্কর্য অজন্তা, ইলোরা, বাঘগ্হা প্রভৃতির প্রাচীরগাত্রে নৃত্যরত নরনারীর চিত্র, অমরাবতী, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো এবং কোনারক ইত্যাদি মন্দির-স্থাপত্যে নর্তকীর নৃত্যভঙ্গিমা গলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া মন্দিরগুলির সঙ্গে একটি করে নাটমণ্ডপ সংযোজনের উদ্দেশ্যই ছিল নতগতি দ্বারা দেবদেবীর পুজোচনা করা এবং এর জন্য বিশেষ এক শ্রেণীর নৃত্যপটিয়সী কুমারী কন্যাদের নিযুক্ত করা হত, যাদের বলা হয় দেবদাসী
নৃত্যকলার দক্ষিণ ভারতও পেছিরে ছিল না। একাধিক দক্ষিণ ভারতীয় সাহিত্যে নৃত্যকলার অন্তর্গত বেশভূষা, মঞ্চসজ্জা ইত্যাদি বিষয় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দেখা যায়। চিদাম্বরম মন্দিরের গোপরেমে দেখা যায় পাথরে খোদাই করা ১০৮টি নৃত্যরত মর্তি।
তাছাড়া অহীহোলের দুর্গামন্দির, মামল্লপরেমের মন্দির ইত্যাদিতেও নৃত্যরত মূর্তি দুলক্ষ্য নয়। বেজওয়াদার মল্লেশ্বর মন্দির গাত্রে কাঠিনৃত্যের একটি অপরূপ চিত্র উৎকীর্ণ আছে। এই যাগে নৃত্যকলার এত ব্যাপক প্রসার হয়েছিল যে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে শিল্প এবং সাহিত্যের মধ্যে এবং এই যগেই মার্গ নৃত্যের আঙ্গিক নিয়ে সরে, হয়ে গিয়েছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই সময়ই ভারতীয় নৃত্যকলা সমগ্র এশিয়াখণ্ডে পরিব্যপ্ত হয়েছিল। এক কথায়, এই যাগকে নৃত্যকলার স্বর্ণযুগ বলা চলে।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 6 ভরতনাট্যম হস্ত মুদ্রা ১১ [ Bharatnatyam Hasthamudra 11 ]](/wp-content/uploads/2022/05/Bharatnatyam-Hasthamudra-11-300x225.jpg)
মধ্যযুগ:
মধ্যয,গের সঙ্গীতকে দুটি স্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমটিকে বলা যায় প্রাক-ম,সলীম যংগ এবং দ্বিতীয়টিকে বলা যায় মুসলীম যগে। কারণ ভারতে ম,সলমানদের আগমনের পর্বে পর্যন্ত সঙ্গীতের যে স্বতন্ত্র রূপটি বিদ্যমান ছিল সেটি মুসলমানী শাসনের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমলে পরিবর্তিত হয়ে একটি স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে।
এই সময় মুলত নবাব-বাদশা, রাজা-মহারাজাদের মনোরঞ্জনার্থে নর্তকীদের প্রয়োজন হত। সাধারণ মানুষের সেই জলসাঘরে বা বাগানবাড়িতে প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই স্বভাবতই এই সময় শৃঙ্গারসসপ্রধান নৃত্যেরই হল আদর। এই যাগে নৃত্য সস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। হিন্দুস্থানী বা উত্তর ভারতীয় এবং দক্ষিণী বা দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্য। এর মধ্যে মসলিম প্রভাব বর্জিত দক্ষণ ভারতীয় নৃত্যে ভারতীয় নৃত্যের রূপটি অনেকাংশে অবিকৃত থাকল।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 7 একজন মহিলা ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী [ A female Bharatanatyam dancer ]](/wp-content/uploads/2022/05/A-female-Bharatanatyam-dancer-300x200.jpg)
আধুনিক কাল:
আধনিক কালের প্রথমার্ধে অর্থাৎ ১৭৫৭ খ্রীঃ হতে প্রথম দুই তিন দশক পর্যন্ত ইংরাজ রাজত্বের প্রারম্ভিক পর্বে। সঙ্গীতের স্রোত আবার মন্থর হয়ে আসে। রাজা-মহারাজার দরবারচ্যুত সঙ্গীত অঙ্গবিছু, অশিক্ষিত এবং বাইজীদের কুক্ষিগত হয়ে সাধারণের অপাংত্তের হল। জনসাধারণের সঙ্গে এর আর নাড়ীর যোগ রইল না, এমনকি এই সময় মধ্যবিত্ত সমাজ সঙ্গীত শিক্ষায় কোন উৎসাহ তো দিতই না বরং সঙ্গতি-শিক্ষক শিক্ষার্থী কিংবা শিল্পীকে হেয়জ্ঞান করত। সঙ্গীতের আনাগোনা ছিল বিলাসী ধনী জমিদার বা রাজা-মহারাজার বৈঠকখানা পর্যন্ত কিছু শিক্ষিত ভদ্রসমাজের সঙ্গীতের প্রতি এই উপেক্ষা বা উদাসীনতা সঙ্গীতের অগ্রগতি একেবারে রদ্ধ করতে পারেনি, কিছুটা স্তিনিত করেছিল মাত্র।
আধুনিক কালের দ্বিতীয়ার্ধ অর্থাৎ ১৮০০ শতাব্দী হতে বাইজী এবং অঙ্গ কিছু মসলমান ওস্তাদদের অচলায়তন ভেদ করে সঙ্গীত আবার জনসাধারণের দরবারে তথা হৃদয়ে নিজের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিল। আমরা একে একে পেলাম ঈশ্বরপ্রসাদজী ভানজী, দলহাজ্বী (গিরিধারীজী) বৃন্দাদীন, কালকাপ্রসাদ, ভৈরোপ্রসাদ ইত্যাদি দিকপাল নৃত্যশিল্পীদের।
এরপর নৃত্যকে যাঁরা আরও পরিশীলিত এবং উন্নততর করে নৃত্যের ইতিহাসে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদের মধ্যে উদরশঙ্কর, শম্ভু মহারাজ, রক্মিণী দেবী, বিরজ, মহারাজ, অচ্ছন মহারাজ, গোপীকিবণ, বালা সরস্বতী, শঙ্করণ নবদ্বীপাদ, পঃ রামনারায়ণ মিশ্র, সাঁতারাদেবী, গরু, আমবী সিংহ, গর, পাকা সিংহ সূত্রেধারী ক্ষেত্রীতোবা দেবী, গল্প, বিপিন সিংহ ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 8 ভরতনাট্যমে পোশাক [ Costumes in Bharatanatyam ]](/wp-content/uploads/2022/05/Costumes-in-Bharatanatyam-300x232.jpg)
নৃত্যে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রাদি:
বাদ্যের সঙ্গে ননৃত্যের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় নৃত্যে নানাপ্রকার বাদ যন্ত্রাদির ব্যবহার দেখা যায়। কেবলমাত্র কালভেদে এই সকল বাদ্যযন্ত্রাদির রূপের তথা আবৱবিক পরিবর্তনসহ কিছু সংযোজন ঘটেছে মাত্র। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতীয় নৃত্যে ব্যবহৃত অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রাদির মধ্যে কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হল, যেমন: বীণা, মন্দিরা, সুরশঙ্গোর, বেহালা, নাগেশ্বরম, পঙ্গী, মদঙ্গম, করতাল, তরী, সারেঙ্গী, নফরী, বন্দর,দিকা, বাঁশী, হারমোনিরম, রবাব, তবলা পাখোয়াজ, খোল এস্রাজ, ঢোল, খঞ্জরী, চেডা, ঘণ্টা, গঙ ইত্যাদি।
নৃত্য সম্বন্ধীয় গ্রন্থ :
(প্রাচীন হতে আধুনিক কাল): নৃত্য সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদির মধ্যে ভারতের “নাট্যশাস্ত্র” সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রামাণিক গ্রন্থ বলে আজও স্বীকৃত। অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থাদির মধ্যে – নন্দীকেশ্বরের ‘অভিনয় দর্পণ’, ‘নতানির্ণয়’, ‘নত্যেশান্ত’, ‘নৃত্যবিলাস’, ‘নৃত্যসব”। অশোক মল্লের ‘নৃত্যাধ্যার’, সঙ্গীতনারা ইলাঙ্গের আদিগম, রচিত তালিম গ্রন্থ ‘শিলগুদিকারম’ (খ্রীঃ পড়ে ভয়-6থ শতক )। তামিল গ্রন্থ ‘নটনাদী বাদ্যরঞ্জনম”, কবি কর্ণ “পয়ে রচিত সংস্কৃত গ্রন্থ ‘আনন্দ-বন্দাবন’, শাঙ্গ’ দেবের ‘সঙ্গীত-রঙ্গাকর’। নারদের ‘সঙ্গীত মকরন্দ’, দামোদরের ‘সঙ্গীত-দর্পণ শঙ্করের ‘সঙ্গতি দামোদর’ ইত্যাদি।
আধুনিক কালের গ্রন্থাদির মধ্যে হিন্দী ভাষায় রচিত বদ্রীপ্রসাদ শত্রুর ‘নৃত্যকলা বিজ্ঞান’, লক্ষীনারায়ণ গঙ্গে’র ‘কথক মৃত্য’, অবিনাশচন্দ্র পান্ডের ‘কথাকলি নৃত্যকলা, সাবিত্রী দেবী বর্মার ‘নারী কা রূপশঙ্গার’, বাংলা ভাষায় রচিত মঞ্জলিকা রায়চৌধরীর ‘নৃত্যে ভারত’, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতের নৃত্যকলা’, মণি বর্ধনের ‘বাঙলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈকিরা’।
মণিপুরী ভাষায় লিখিত দর্শনা ঝাবেরী ও কলাবতী দেবীর ‘মণিপুরী নর্তন, এবং ইংরাজী ভাষায় রচিত ফরিয়ান বাওয়ার্সের (Faubian Bowers ) “The Dance in India,, রূবী গানারের ( Ruby Ginner) ‘Gatewy to the Dance,’ এ, কে, কুমারস্বামী ‘Dances of Shiva’, প্রবেশ ব্যানাজীর ‘Dauce of India’, গরু, সদর দত্ত The Folk Dances os Bengal কে. এ্যামব্রতুসের (Kay Ambrose ) Classical Dances and Costumes of India’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বলাবাহুল্য যে উপযুক্ত তালিকার বাইরেও নৃত্যসম্বন্ধীর বহ, গ্রন্থ আছে যার সম্পর্ণে তালিকা এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।
বিভিন্ন নৃত্যশৈলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
কথক নৃত্য :
উত্তর ভারতের অন্যতম ধ্রুপদী নৃত্যকলা হচ্ছে কথক এবং লক্ষৌ ও জয়পরেকেই এই নৃত্যের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়। ভরত নাট্যমের মত নাচের তিনটি উপাদানই এতে আছে—নত্ত অর্থাৎ বিশদ্ধে ইন্দভিত্তিক নাচ, নৃত্য অর্থাৎ রস প্রকাশের উপযোগী নাচ, নাট্য বা অভিনৱসমদ্ধ নাচ। কথক প্রধানতঃ ‘নত্ত’, মদ্রোর ব্যবহার এতে খুবই কম। সংক্ষা তাঁর পায়ের কাজই এই নাচের প্রাণ” (ভারত কোষ)।
কথাকলি নৃত্য :
দক্ষিণ ভারতের কেরলের নাচ কথাকলি। এই নৃত্যের বিষয়বস্তু রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী এবং সাধারণতঃ এই নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণে অথবা মক্তোঙ্গনে। আমাদের দেশের যাতান,ষ্ঠানের মতই মণ্ডপের বিশেষ একটি স্থানে নৃত্যানণ্ঠান হয় এবং দর্শকরা এর চারদিকে বসে থাকেন। রাত্রি ৮টার পর এই নত্যান,ঠান পর্বের সূচনা হয় এবং অরণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা পতন হয়। কথাকলি নৃত্য সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 12 শ্রীরাম পট্টাভিষেকম কথাকলি [ SreeRama Pattabhishekam Kathakali ]](/wp-content/uploads/2022/05/SreeRama-Pattabhishekam-Kathakali-300x157.jpg)
ভরতনাট্যম নৃত্য:
‘ভরতনাট্যম’ নামটি নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকের মতে ভরতম, নি এই মার্গ নতোর প্রবতর্ক বলে তাঁর নামান,সরে ভরতনাট্যম নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে ভাব, রাগ ও তাল এই তিনের সমন্বয় এই নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তাই এই তিনটির আদ্যক্ষর ‘ভরতনাট্যম’ নামকরণের প্রেরণা দিয়েছে । তবে এই বিতর্কিত বিষয়ে সঠিক কিছু বলা যায় না। ভরতনাট্যম প্রাচীন নৃত্যরীতির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় রূপে। দক্ষিণ ভারতের ‘সাদিয়’ বা ‘দাসী অট্টম’ বর্তমানে এই নামে প্রচলিত “প্রায় ২০০ বৎসর পর্বে— তাঞ্জোরের ‘নটবান’-দের হস্তে এই নাচের বর্তমান রূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল। ভরতনাট্যম নৃত্য সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 13 ভরতনাট্যমে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে একটি অভিব্যক্তি [ An expression through gesture in Bharatanatyam ]](/wp-content/uploads/2022/05/An-expression-through-gesture-in-Bharatanatyam-252x300.jpg)
মণিপুরী নৃত্য :
ভারতের উত্তর-পর্বে— মণিপুর রাজ্যের নাচ হচ্ছে মণিপুরী নৃত্য। মণিপরের লাই= হারাউবা (লাই-দেবতা এবং হারাউবা =আনন্দ বিধান) উৎসব নাত্য থেকেই মণিপুরী নৃত্যের সূচনা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যানসারে এই পাই-হার উবাকে মোট পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন: (১) কংলৈ হারাউবা, (২) মোইয়াং হারাউবা, (৩) অন্দ্রো হারাউবা, (৪) চকুপা (কয়েং, লৈয়াম) হারাউবা এবং (৫) করুচিৎ হারাউবা। নয়টি অধ্যায়ে এই লাই হারাউবা উৎসব ননৃত্যটি বিন সিত। মণিপুরী নৃত্য সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন।

নটবরী নৃত্য:
শ্রীকৃষ্ণের একাধিক নামের একটি নাম নটবর। তাই কথক নৃত্যের যে অংশ বা অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলামাধর্যে পরিবেশন করা হয় সেই বিশেষ অংশ বা অধ্যায়কে বলা হয় নটবরী নৃত্য। কথিত আছে যে কৃষ্ণভক্ত ঈশ্বরপ্রসাদঙ্গী নটবর শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কথকের নামকরণ করেন ‘নটবরী’।
ওড়িষী নৃত্য :
ওড়িষী উড়িষ্যা দেশের অন্যতম প্রাচীন নৃত্যধারা। কথিক আছে যে আচার্য— অট্টহাস সর্বপ্রথম দেবদাসীদের এই নৃত্য শিক্ষা দেন। এই দেবদাসীদের বলা হয় “মাহারী” এবং দেবদাসদের বলা হয় ‘গটিপ’। ‘মাহারী’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঐশী প্রেম পাগলিনী। ওড়িষী নৃত্যকলার প্রধান অনষ্ঠানগলির মধ্যে উল্লেখ হল ভূমিপ্রণাম, নৃত্য ভরিঝম।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 16 ওড়িশি নৃত্যশিল্পী [ Odissi Dancer ]](/wp-content/uploads/2022/05/Odissi-Dancer-202x300.jpg)
নৃত্যের সেলামীর মত ভূমিপ্রণাম সঞ্চলাচরণ করে নৃত্যের আরম্ভ এবং তরিঝম অংশে লয়ে পরিসমাপ্তি বাদ্যাদির ব্যবহৃত হয় বংশী, পাখোয়াজ, তম্বুরা, পারি মাহুরী, উদম্বরী, ব্রহ্মবীণা, ঘণ্টিতাল, পঢ়তাল ইত্যাদি। ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিই ওড়িষী মলে স্থায়ী ভঙ্গিমা। ভঙ্গিমা আশ্রয় করে চৌকা, চির, লথি, নটবর ও বৈঠি— এই পর্যায়ে দেহভঙ্গির বিভিন্ন জ্যামিতিক বিন্যাস রচনা হয় নৃত্যকলা, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়ে, ৩০২)। উড়িষী নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে রাউৎ, মিনতি দাস, প্রিয়ম্বদা মোহান্তি, সংযত্তা পাণিগ্রাহী ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
ওড়িষী নৃত্যের রূপসজ্জা:
ওড়িষী নৃত্যের রূপসজ্জা কেশসজ্জার উল্লেখ যায় কটিবেণী, পাপচুড়া ও অর্ধ বস্তুক। অন্যান্য নৃত্যের ওড়িষী ননৃত্যশিল্পীরাও নানা ধরণের অলঙ্কার পরিধান করতেন। যেমন কাকর, কেতকী, কোরক, বকুলকলিকা, চপসারিকা, নাগপাশ, মাথামণি, কঙ্কিণী সমর্পী, করকঙ্কন, পাদক-তিলকা ইত্যাদি। পোশাকাদির মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে পট্টশাড়ি, পাথরখচিত গাঢ় ব্লাউজ, ঝোবা, নীবিবদ্ধ ইত্যাদি।
![ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য 17 ওড়িশি নৃত্যনাট্য [ Odissi Dance Drama ]](/wp-content/uploads/2022/05/Odissi-Dance-Drama-300x201.jpg)
কুচিপুড়ি কুচ্চিপুড়া নৃত্য:
অস্ত্রপ্রদেশের নদীর তীরবর্তী কুচ্চিপদী কুচ্চেলপরেম গ্রামে নৃত্যের জন্ম হয়েছে কুচিপাড়ী। সিদ্ধেন্দ্র যোগাঁকে এই নৃত্যের জনক অভিহিত করা হয়। কুচিপাড়ী পরেষেদের নৃত্য, চরিত্রও রূপায়িত পরে,ষদের দ্বারা। বাদ্য এবং সঙ্গীতের সহযোগিতায় এই প্রদর্শিত বাদ্য দির বেহালা, মৃদঙ্গম, বীণা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন: