ভরতনাট্যম নৃত্য

ভরতনাট্যম নৃত্য নিয়ে আজকের আলোচনা। আমরা এই সিরিজে “ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ভারতীয় নৃত্য” নিয়ে আলোচনা করছি।  ‘ভরতনাট্যম’ নামটি নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকের মতে ভরতম, নি এই মার্গ নতোর প্রবতর্ক বলে তাঁর নামান,সরে ভরতনাট্যম নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে ভাব, রাগ ও তাল এই তিনের সমন্বয় এই নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছে, তাই এই তিনটির আদ্যক্ষর ‘ভরতনাট্যম’ নামকরণের প্রেরণা দিয়েছে । তবে এই বিতর্কিত বিষয়ে সঠিক কিছু বলা যায় না। ভরতনাট্যম প্রাচীন নৃত্যরীতির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় রূপে। দক্ষিণ ভারতের ‘সাদিয়’ বা ‘দাসী অট্টম’ বর্তমানে এই নামে প্রচলিত “প্রায় ২০০ বৎসর পর্বে— তাঞ্জোরের ‘নটবান’-দের হস্তে এই নাচের বর্তমান রূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল।

ভরতনাট্যম নৃত্যরত শিল্পী [ Bharatnatym Mudra ]
ভরতনাট্যম নৃত্যরত শিল্পী [ Bharatnatym Mudra ]

ভরতনাট্যম নৃত্য

এই নাচ আঙ্গিক ও রসের বিচারে একান্তভাবে মেয়েদের কামনা আনন্দ ও বিচ্ছেদসংবলিত শৃঙ্গার রসের নাচ। মলে চরিত্রে কৃষ্ণ, কিন্তু শিব ও বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে ও নাচ আছে” ভারতকোষ)। সাদীর’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে চতুর বা নিপুণে। চতুর্বেদ থেকে এই নৃত্যের সার সংগৃহীত হয়েছে বলেই একে ‘চতুর’ বা ‘সদীরনাট্য’ বলা হয়ে থাকে। এই নৃত্যের গায়িকাদের বলা হয় “পদ্মিণণ।

আডাউ:

প্রাথমিক স্তরে ভরতনাট্য নৃত্যের সূচনা হয় আডাউ-এর ম ধ্যমে। অঙ্গহারের শিল্প রংপায়ন এবং শাস্ত্রীয়করণের মাধ্যমে হয় আডাউর রংপায়ন। মোট ষোলটি শ্রেণীতে আড উ বিভক্ত। প্রতিটি শ্রেণীর আডাউয়ের শিল্প কর্মে’র মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যও আছে।

নিয়ে মাত্র ছয় প্রকার আডাউ-এর উল্লেখ করা হলঃ

(১) পাক্কা আডাউ :

কোনাকুনি গতিসম্পন্ন আভাউকে বলা হয় পাক্কা আডাউ।

(২) এট্টু আডাউ :

( তৎ থেই তাহা বিভাগ) :-

তৎ থেই তা হা | ধিৎ থেই তা হা

(৩) টাট মেট আডাউঃ

গোড়ালী এবং পদতল দ্বারা পর্যায়ক্রমে মাটিতে আঘাত করলে বলা হয় টাট মেট আডাউ।

(৪) মেট্, আডাউ :

বাম অথবা দক্ষিণ পদ প্রসারিত করে গাটিতে আঘাত করে পববিস্থায় ফিরে আসাকে বলা হয় মেট্র, আডাউ।

(৫) ভট্ট। আডাউ :

এই আডাউয়ে কেবলমাত্র পদতলের দ্বারা মাটিতে আঘাত করা হয়।

(৬) নাট্ট। আডাউ :

বাম অথবা দক্ষিণ পদের অগ্রভাগ দিয়ে মাটিতে অঘাত করাকে বলা হয় নাট্টা আডাট।

 

একজন মহিলা ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী একটি অভিব্যক্তি করছেন [ A female Bharatanatyam dancer making an expression ]
একজন মহিলা ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী একটি অভিব্যক্তি করছেন [ A female Bharatanatyam dancer making an expression ]

ভরতনাট্যম নৃত্যের অংশ:

ভরতনাট্যম নৃত্যের ছয়টি অংশ – আলারি পদ, যতিস্বরম, শব্দমা, বর্ণই, প্লিয় এবং পদম। নিম্নে এই ছয়টি অংশের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলঃ

আলারিপুঃ

আলারিপ, শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রস্ফুটিত বা বিকশিত করা। এই অংশে শিল্পী দেবতা-প্রণাম এবং সমবেত দর্শকমণ্ডলীকে অভিবাদনও তাদের আশীবাদ প্রার্থনা করেন। দৃষ্টি ও গ্রীবাকর্মের মাধ্যমে শিল্পী ধীরে ধীরে পদ্মের পাপড়ির মত তার দেহভঙ্গিমাকে প্রস্ফুটিত করে তোলেন। এই আলারি পাই হচ্ছে ভরতনাট নাত্যের ভূমিকা বা প্রথম পর্যায়।

যতিস্বরম্ :

দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় যতিস্বরম। খতির (বোলপরম ) সঙ্গে স্বরমের (সরগম) গ্রন্থন হয় বলে এই অংশের নাম বতিস্বরম। কোন ভাব প্রকাশ ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র হস্ত, পদ, গ্রীবা ও দৃষ্টির দ্বারাই এক একটি যতি শেষ করে সমে আসা হয় এবং পরবর্তী যতিা কাজ আরম্ভ করা হয়। এই ভাবে পাঁচ-সাতটি যতি কোন বিশেষ তাল এবং সরগম, সহযোগে পরিবেশিত হবার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

শব্দম্ বা সপ্তম :

তৃতীয় পর্যায়ে অনষ্ঠিত হয় শব্দমা। সংস্কৃতের ‘যশোগীতি’ অর্থাৎ দেবতা বা রাজার মহত্ব, শৌর্য, বীর্য’ ইত্যাদি গীতের সঙ্গের নৃত্যাভিয়ের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয় সঞ্চারী ভাবপ্রধান এই অংশ অভিবন্দনান্তে সমাপ্ত হয়।

বর্ণম্ :

(চতুর্থ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণম। এই পর্যায়টি যেমন দীর্ঘ´ তেমনই জটিল, কারণ এখানে রাগ, ভাব ও তালের ত্রিবেণী সঙ্গমের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য নত্ত ও নাট্যের সমন্বয় ঘটেছে। বর্ণমের দুইটি প্রকার আছে: পদবণম, এবং তানবর্ণমা পদবর্ণ মে সাহিত্যের সঙ্গে বিরমণম, (দ্রুত এবং জটিল যতি) প্রদর্শিত হয় এবং ভানবর্ণমে থাকে কেবলমাত্র দ্রুত ছন্দের প্রাধান্য।

তিল্লানাঃ

(এই পর্যায়ে ‘তিল্লান৷’ গাঁতের সঙ্গে সঙ্গে এই নৃত্য চলতে থাকে বলে একে ভিন্ন না, আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গহার, করণ, চারী প্রভৃতির সংযোগে ভরতনাট ম ননৃত্যের এই অংশ একটি অবর্ণনীয় নান্দনিক পরিবেশের সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে আবার খত্তে হয় নানা ছন্দবৈচিত্র্যের কাজ অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় যে এই অংশেই ভরতনাট ম নতের মাধর্যের শ্রেষ্ঠমত প্রকাশ ঘটে।

পদম্ :

পদম্ও গীতের সঙ্গে পরিবেশিত হয় এবং এই গীতগুলি মূলতঃ প্রেমসংগীত। পুরন্দর দাস, ক্ষেত্রায়া, জয়দেব প্রভৃতি কবির পদাবলী প্রেমসংগীত গলির উৎস।

উপরিউক্ত ছয়টি অংশের পর উপসংহারে করা হয় ‘শ্লোকম্’ নামে একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ গ্রন্থ হতে শ্লোগলি আবৃত্তি করে গাঁত ও তাল সংযোগে নানাপ্রকার মদ্রা ও মখভাবের মাধ্যনে তার অর্থকে প্রকাশ করা হয়।

 

একজন মহিলা ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী [ A female Bharatanatyam dancer ]
একজন মহিলা ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী [ A female Bharatanatyam dancer ]

ভরতনাট্যম নৃত্যের বাদ্যযন্ত্রাদি:

ভরতনাট্যম নৃত্যের বাদ্যযন্ত্রাদির মধ্যে মদঙ্গ, মন্দিরা (ঝাল), বাঁশী, ৰাণ, বেহালা, তম্বুরা, নাগেশ্বরণ, নফরী, সারেঙ্গী, করতাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ভরতনাট্যম নৃত্যের তাল:

তালাদির মধ্যে বিভিন্ন মাত্রাসংখ্যাসম্পন্ন প্রধানতঃ নিম্নলিখিত সপ্ত তালের প্রয়াগ দেখা যায়, যেমন—আড়াতালম, একতালম, এরাবম, জাম্বাই, তির, পড়াই, মিট্টিগ্রাম ও রকম ।

অঙ্গহার এবং শাস্ত্রীয়সংগীতের সহযোগ:

অগণিত করণ অঙ্গহার এবং শাস্ত্রীয়সংগীতের সহযোগে ভরতনাট্যম ভারতীয় নৃত্যাদির মধ্যে এক বৈচিত্র্যময় এবং সমর্থ নৃত্যকলার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

ভরতনাট্যম নৃত্যের রূপসজ্জা:

অধুনা এই নৃত্যে পর্বের ডোরাকাটা শাড়ির (তুইয়া শেল) পরিবর্তে পায়জামার মত পোশাক ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া উত্তরীয় ও নীবিবদ্ধও ( বন্দি) থাকে। স্কম্বের উত্তরাঁয়ের নাম হচ্ছে ‘লোকু’। অন্যান্য পোশাকের মধ্যে কচি´প চুমকির কাজ), খচিত রবিকে (ব্লাউজ), রাকুডী (বেণীর উপরস্থ রঙীন পাথর খচিত গোল বড় ব্রোচ ), তালেব নাঘই ( সিথির দুই পার্শ্বস্থ ব্রোচ ), সীমন্তের দড়ুই পার্শ্বে— ‘চন্দ্র’ ও ‘সংয” নামে দুইটি ব্রোচ, ছুটি (সিথির সম্মুখস্থ লকেট), জন্ডাই ভিল্লা (বেণীমধ্যস্থ পাথরখচিত ব্রোচগলি), কুঞ্চলম (বেণীপ্রান্তস্থ তিনটি ঝুমকাগচ্ছে), ঝিমকি ( লম্বমান ঝুমকা ), তোড (কর্ণভূষণের উপরস্থ পাথর), মাটল (কানের ঝুমকা এবং কেশ সহযোগকারী শিকল), ওয়াস্কি (হস্তস্থিত বাজ,বন্ধ) এবং নাসিকার জন্য পল্লাকে (নোলক ), নথ, বেশরী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ভরতনাট্যমের বর্ণম অংশটি অভিব্যক্তিপূর্ণ নৃত্যের উপর জোর দেয় [ The Varnam part of Bharatanatyam emphasizes expressive dance ]
ভরতনাট্যমের বর্ণম অংশটি অভিব্যক্তিপূর্ণ নৃত্যের উপর জোর দেয় [ The Varnam part of Bharatanatyam emphasizes expressive dance ]

ভরতনাট্যম নৃত্যের উল্লেখ্য শিল্পী:

এই নৃত্যের উল্লেখ্য শিল্পীদের মধ্যে কয়েকটি নাম হলঃ শ্রীকৃষ্ণ আমার, মীনাক্ষীসুন্দরণ পিল্লাই, গণেশম পিল্লাই, রামচন্দ্র পিল্লাই, বালা সরস্বতী, রুক্মিণী দেবী, শাস্তা রাও, রাম গোপাল, স্বামিনী কৃষ্ণমতি’, ইন্দ্রাণী রহমান, কমলা লক্ষণ, চন্দ্রকলা ইত্যাদি।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment