আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – হর্ষোল্লাস নাচের বিরাট বিস্ফোরণ।যা “যুগ যুগব্যাপী নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।
হর্ষোল্লাস নাচের বিরাট বিস্ফোরণ
এই বইয়ের শুরুতেই বার বার বলে রাখা প্রয়োজন যে, বৃহত্তর ক্ষেত্রে হর্ষোল্লাস সকল নাচেই সংরক্ষিত আছে; এমনকি অধিকাংশ রক্ষণশীল সামাজিক নাচেও হর্ষোল্লাস নাচের অপ্রতিরোধ্য প্রবণতায় এবং নাচের মধ্যে ও মাধ্যমে আত্মজগৎও বিশ্বজগৎ পরিত্যাগ করে। এটা আমরা এখানে পুনরায় আলোচনা করব না; এটা স্বাভাবিক জীবনে খাপ খায় এবং উন্নত মৌলিক উপাদান রূপে হয়তবা স্বীকৃত।
অন্যদিকে বইয়ের পূর্ববর্তী অংশে আমাদের আছে বাধ্যবাধকতার অসংখ্য উদাহরণ এবং সুতীব্র আত্মসমর্পণ ও এত বিপথগামীতা আছে যে, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অবশ্যই বিবেচিত হবে বিকৃত ও জড়াগ্রস্থ বলে । আমরা এখানে পাশ্চাত্যের মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় তাদের ক্রম অধঃগতির পথ নিয়ে আলোচনা করব ।
একাদ্বশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রমাগত অসংখ্য রিপোর্টে পাওয়া যায় যে, কেউ মারা গেছে সেইদিনে অথবা খৃষ্টিয়ান কোন উৎসবে নারী-পুরুষগণ হঠাৎ উন্মত্ত হয়ে গীর্জার অঙ্গনে নাচ গান শুরু করে, পুরোহিতের বাধা সত্ত্বেও দৈব্য প্রার্থনাকে ব্যবহৃত করে থামতে অস্বীকার করে, তার ফলশ্রুতিতে সারা বৎসর নাচতে পারবে না এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পরে যদি না কোন সহানুভূতিশীল আর্চবিশপ এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
হর্ষোল্লাস নাচের বিরাট বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ নাচের একটা ভয়ানক মূল শিল্প উপাদান যেটা হ্যান্স খ্রীষ্টিয়ান এন্ডারসন তার জনপ্রিয় রূপকথার সঙ্গে ছোট কারেনের গল্পের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করে, যাতে সে কখনই কোন বিশ্রামের সময় পেতে না যতক্ষণ জল্লাদ পা না কেটে ফেলত ।
১৪৬৬ খৃষ্টাব্দে ব্রিসিয়াএসে বহেমিয়ান লিওভন রজমিটাল একটা অদ্ভুত উদাহরণ লক্ষ্য করেন। তিনি দেখতে পেলেন প্রথা অনুযায়ী বৎসরের নির্দিষ্ট দিনে বিশাল জনতার ভিড় ঃ যারা পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে এসে সমবেত হয়ে পর্বতের উপর সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নাচতে থাকে যাতে তাদেরকে সম্পূর্ণ অবসন্ন অবস্থায় মালগাড়ীতে করে নিতে হয়। একদিন নাচুয়েগণ এই পর্বতে কর্পাস ডমিনিকাম বয়ে নবার সময় অভিবাদন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেবতার শাস্তি স্বরূপ তারা এটা করতে বাধ্য হয় ।
যাইহোক, সাধারণতঃ এইসকল উন্মত্তনাচ গীর্জার সংলগ্ন আঙ্গিনায় করা হয়। এখানে প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে নাচুয়েগণ তাদের মৃত জনের সঙ্গে যোগাযেগের জন্য চিৎকার করে। এটা ছিল সাহিত্যের ভাষায় একটা danse macabre. যারজন্য আরবীতে কবর (kabr) অর্থ (“grave”) গ্রেভ, মার (makbara) গীর্জার আঙ্গিনা চত্বর (“Churchyard”) এবং মকাবর (Makabr) গীর্জার আঙ্গিনাসমূহ (“Churchyards”) এখানে নিঃসন্দেহে বলা যাবে যে, নামটা আরবী থেকে এসেছে, আমরা যেমন জানি মৃতের নাচের অন্যতম একটা মূল শিকড় আরবদের মধ্যে গ্রথিত।
হাজার বৎসর ধরে যাজকীয় পরিষদ এইসকল Obscocni motus, saltationes seu choreae (অশালীন নাচ) গীর্জা ও গীর্জার চত্বরে অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধাচারণ করে আসছে প্রত্যেক সময় খারাপের মূল উৎপাটন করতে হবে এবং প্রত্যেক সময়ই সেই প্রচেষ্ট ব্যর্থ হয়েছে।
এই উৎসব নাচগুলি কি এবং কেমন করে করা হয় সে সম্পর্কে খুবকমই কখন বলা হয়েছে। শুধুমাত্র একজন লেখক দ্বাদশ শতাব্দীতে জিরেলডাস ক্যাম্বব্রেনসি (GIRALDUS CAMBRENSIS) তার Itinerariunm Cambriae এ কিছু প্রকৃত বর্ণনা আমাদের জন্য রেখেছেন :
“দেখা যাবে পুরুষগণ অথবা মেয়েরা, কখন গীর্জার আঙ্গিনায়, কখন নাচছে যেটা গানের সঙ্গে গীর্জার আঙ্গিনা ঘিরে চলে, সম্মোহ হয়ে হঠাৎ মাটিতে পড়ে থাকে তারপর উন্মত্ত হয়ে লাফ দিয়ে উপরে উঠে এবং ভোজ-উৎসব দিনগুলিতে যে সমস্ত বেআইনী কাজ তারা করে তা তাদের হাত, পা দিয়ে তার অনুকরণ করে লোকজনের সামনে; দেখাযাবে একজন এক হতে লাঙ্গল ধরে আছে অন্যহাত থাকতে পারে ডাঙ্গান ষাড়গুলির উপর, প্রচলিত ককৰ্ণ গান দিয়ে তাদের শ্রমের কষ্ট উপশম করছে :
মুচির পেশা একজন অনুকরণ করে, অন্যজন চামাড়ের। আবার দেখা যাবে একটা মেয়ে পেঁজাতুলার দন্ডদিয়ে সুতা কাটে এবং মাকুতে তা আবার ভরছে; অন্যজন হাঁটছে বুনটের জন্য সুতা সাজাচ্ছে; অন্যজন সেখান থেকে মাকু ছুড়ে মনে হয় তাঁত বুনে। নৈবেদ্য সহযোগে গীর্জায় আনা হচ্ছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বেদী পর্যন্ত, আপনি অবাক হয়ে দেখতে পাবেন হঠাৎ করে তারা সজাগ হয়ে উঠে তাদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে।”
এই সকল নাচে যা উন্মোচিত হয় তা মূর্তি পূজার ধ্বংসাবশেষ না, কিন্তু হর্ষোল্লাসের অন্তর্নিহিত জীবনের খন্ড, যা প্রস্তর যুগ থেকে বিরক্তিকর ও অসংখ্য জাতির মধ্যে অন্তপ্রবাহে লুক্কায়িত কিন্তু কখন নির্বাপিত হয় নাই এবং যেটা অবশ্য সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সহায়ক মূহুর্তে বেড়িয়ে আসে।
যখন একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি পুনরায় সচল হয়ে উঠে প্রথমে কিছু আংশিক অগ্নুৎপাত হয় তারপর একদিন বিরাট ভয়াবহ আকার নিয়ে বের হয়ে এসে পুড়ায়ে ধ্বংস সাধন করে জীবন্ত সবকিছু কবর দেয়। তদ্বরূপ প্রায় চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্য থেকে ঐ অপ্রতিরোধ্য নাচের উন্মাদনা জন্মনেয় নাচের বাইরে সম্ভবতঃ মহামারীকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে যেটা ডাক্তারদের কাছে Chorea major (কোরিয়া মেজর) ও ষাধারণ লোকের কাছে সেন্ট ভিটাসের নাচ যা রাইন উপত্যকায় ছড়ায়ে পড়েঃ
এখানে আমাদের লোজনের মধ্যে,
নাচের উন্মত্ততা এসে ঠেকে।
প্রত্যেক শহরে এখন কিছুনা কিছু
সম্মোহের মধ্যে পড়ে গেছে।
এটা তাদের তাড়িত করে চিরদিন রাত,
খুব কমই দমনেবার সময় পায়, যদিও কতক পথে খসে পরে
এবং কেউ কেউ মৃত্যুর সাক্ষাৎ পায়।
মহামারীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত, দীর্ঘ যুদ্ধ, সীমাহীন ভাগ্যবিড়াম্বনা, নিজের অস্তিত্বের গভীরতায় উদ্বেলিত, বিভিন্ন স্থান থেকে পশ্চিমমুখী স্থানচ্যুত লোকজনের আভ্যর্থনাকারী। এককভাবে অথবা হাতে হাত রেখে তারা গোল করে এবং ভীষণ লাফ দিয়ে সংঘবন্ধ নাচকে বিচ্ছিন্ন করে- কয়েক ঘন্টা ধরে একসঙ্গে যতক্ষণ না তারা ধরাশায়ী হয়ে মুখে ফেনা নির্গত করে।
হর্ষোল্লাস নাচের বিরাট বিস্ফোরণ যাই বকবক করুক, মূৰ্চ্ছাগ্রস্থ মানসিক বিকৃতি দর্শকদের আচ্ছন্ন করে যার জন্য কাঁপতে কাঁপতে ও মুখাবয়ব বিকৃত করে তারা গোলকের মধ্যে প্রবেশ করে এবং ভীতগ্রস্থ বাধ্যবাধকতায় নাচে অংশগ্রহণ করে। অপশক্তি কয়েক মাসব্যাপী অবস্থান করে, ডাক্তার ও পুরোহিত ক্ষমতাহীন। এটা ক্রমাগত নতুন নতুন রূপে উদ্ভব হয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে নতুন বিস্ফারণ ঘটে এবং তার পুনরাবৃত্তি ঘটে সপ্তদশ শতাব্দীর অনেক ভিতর পর্যন্ত ।
একই সময় ইটালীতে তার শিহরণ লাগে এবং অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে অন্য ধরনের নাচের বাতিক দেখা যায় তাহল-ট্রান্টইজম। অ্যাপুলিয়ন মাকড়সার কামড়ের কারণে এই মানসিক পীড়া হয়ে বলে মনে করা হয়। কামড়ের জন্য বিষাদ রোগ থেকে শুধুমাত্র দক্ষিণ ইটালীর বন্য লাফ নাচ tarantella, যেটা মাকড়সার মত তার নাম নিয়েছে ট্রেনটাম শহর থেকে যা সাময়িক মুক্তি এনেছে।
জার্মানীর সেন্ট ভিটাস নাচের বিপরীতে সেখানের অঙ্গভঙ্গি জ্বরের মত তারচেয়ে রোগ মুক্তির জন্য রোগীর কাছ থেকে পাওয়া একরকম সহায়তা। কিন্তু জার্মানীর মত এটা দর্শকদের আচ্ছন্ন করে এবং তাদের মধ্যে সেই একই বাতিকগ্রস্থ বিষণ্ণতা প্রবিষ্ট করে।
ট্রানটেলা কি ধরনের নাচ? গথে বলেন নেপলস্ ে“নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে খুব সাধারণ ব্যাপার। কম করে হলেও তিন জন এটাতে অংশগ্রহণ করে। তাদের একজন ট্রাম্বুরীন বাজায় এবং এটার ঘন্টা নাড়ায় বার বার কিন্তু এটা আঘাত করে না, অন্য দুইজন হাতে করতাল নিয়ে নাচের পদ চালনা করে। সমস্ত স্থূল নাচের মত তাদের মধ্যে পদক্ষেপে কোন স্বাতন্ত্র বা লাস্যময়তা নাই ।
এমন কি মেয়েরা পা দিয়ে তাল রাখে একই স্থানে ক্ষণিকের জন্য ঘুরার সময়ে ফিরে স্থানপরিবর্তন করে এবং এই রকম। তারপর একজন নাচুয়ে তার করতাল ট্রাম্বুরীণের সঙ্গে অদলবদল করে এক স্থানে স্থির দাঁড়ায় যখন তৃতীয়জন নাচতে শুরু করে।
এই ভাবে তারা নিজেরাই উপভোগ করে সময় কাটায় দর্শকদের প্রতি কোন সচেতনতা নাই । এই নাচ শুধুমাত্র মেয়েদের আনন্দ স্ফুর্তির জন্য, কোন ছেলে ট্রাম্বুরীন স্পর্শ করতে পারবে না।” গথে যা বর্ণনা করেছেন সেটা অস্পষ্ট ও কোনভাবে বেঁচে যাওয়া শহুরে অংশ। নাচের বাতিকগ্রস্থ ট্রনটেলা সেইমত দেখায়না।
এটার প্রকৃত ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিকে একটা সুন্দর আধুনিক বর্ণনা এটাকে ঘনিষ্ট করে রোমান saltarello ও তাসকান tresca র সঙ্গে । এই বর্ণনা কেমন করে নাচুয়ে হামাগুঁড়ি খায় ও তার মহিলা যুগলকে আদর করে এবং তারপর যদিও বসা অবস্থানে দ্রুততার সঙ্গে তাকে পুনরায় পরিত্যাগ করে; কেমন করে হাজারো চক্কর দেয় ও কৌশল করে একাকী ধরে রাখে এবং তারপর তার পাটনারের প্রতি ধাবিত হয়।
তার নর্তন কুঁন্দন ও নির্বোধ আচরণ হাস্যেদ্দীপক তথাপি তা আকর্ষণীয় ভাবে হাল্কা ও নম্র। এখন তার আচরণ অহংকারী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এখন আবার অসন্তুষ্ট ও বিস্তৃত। পদদ্বয় ও বাহুদ্বয় এমনকি আঙ্গুলগুলি সজোরে ট্রাম্বুরীন বাজাতে থাকে, তার উপর কটাক্ষ্য, উদ্দীপনা, অবসন্নতা হঠৎ করে দৃঢ়তার সঙ্গে ও নিঃলজ্জভাবে ভাবভঙ্গির পুনরায় প্রকাশ ঘটায়। মেয়েটি তার কোণ থেকে বেরিয়ে আসে, এখন সে একরোখা ও ইচ্ছাপ্রবণ ।
তার হাসি কথা বলে তার চোখ মদিরাময়। সে তার স্কার্ট দোলায় ; কোনা তুলে মনে হয় তাতে কিছু রাখতে চায়, অথবা সে তার বাহু মাথার উপর তুলে যেন হুক ঝুলে আছে অন্যহাত হৃদয় ছুয়ে যায়। এখন সে কেন্দ্রবিন্দুতে তাকে ঘিরে পুরুষ নাচুয়ে ঘিরে ধরে। রিল্ক সজোরে বলেন“ কি ঃ
সে নাচ, যেন পরী বনদেবতা আবিস্কার করেছে, প্রাচীনও যেন পুনরাবিষ্কৃত হয়ে উঠে এসেছে নবসাজে, আদিম স্মৃতি কথায় জড়ান-চাতুর্যে, বন্যতায় ও মাদকতায়, পুরুষগণ পুনরায় ছাগলের উৎক্ষেপের সঙ্গে এবং মেয়েরা বনদেবী আর্টেমিসের অনুচরবর্গ থাকে । আমরা সম্ভবত আরো পথ দেখতে পাব ট্রান্টইজম (tarantism ) উপাদানের মধ্যে দিয়ে এই পৈশাচিক, আদিম ট্রানটিলার (tarantilla) চেয়ে গথের নির্জীব শহুরে নাচের মধ্যে, যাতে মেয়েরা “তাদের যৌবনের সবচেয়ে সুখময় সময়গুলি নেচে যায়।”
জোহান হারমান ভন রিডিল যে গথের পরিভ্রমণের কিছু পূর্বে এই সকল নাচের মধ্যে রহস্যময় যোগাযোগ গভীরভাবে পরীক্ষা করেছেন, অটরানটোতে দেখেন বাইশ বৎসরের এক মেয়ে বিরামহীনভাবে দশ ঘন্টা ধরে নাচে এবং খবর পাওয়া যায় কোন রকম পানাহার ছাড়াই এটা ছত্রিশ ঘন্টা ধরে চলে।
তিনি এটাতে আরোপ করেন টরেন্টটুলা দক্ষিণ ইটালীর সাধারণ কামাতুর মিড সামার থেকে কম যন্ত্রনাদায়ক এবং মনে করেন নাচের মাধ্যমে অধিক রক্তসঞ্চালনের ফলশ্রুতিতে আরোগ্য লাভ হয়। কিন্তু নাচুয়েগণ প্রধানতঃ কৃষকের মেয়ে হর্ষোল্লাস নাচের বিরাট বিস্ফোরণ।
তাদের কি রক্তসঞ্চালনের জন্য কোন ধরনের ব্যায়ামের প্রয়োজন থাকতে পারে? কেমন করে দারিদ্র-পিড়ীত যুক্তিবাদের আদান-প্রদান অষ্টাদশ শতাব্দী হতে পারে! কেমন করে তারা ভয়ঙ্কর, দৈবতুল্য উন্মত্ত হর্ষোল্লাসজনক নাচের সামনে মলিত হতে পারে!
সেই আলোকে এই সকল ব্যাপার শুধু তারাই অনুধাবন করতে পারবে যখন তাদের কেউই শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কারো মনে মধ্যযুগীয় লোকজনের বৈশিষ্ট্যময় তীব্র উত্তেজনাকর মনোবৃত্তি সংক্রামিত হতে পারবে না। নাচের ইতিহাস উত্তরে বাতিকপূর্ণ যেমন দক্ষিণে রেকর্ড সুস্পষ্ট উদাহরণ।
১২৩৩ খৃষ্টাব্দে “Great Hallelujah”র মত কি জানা যায় তারমধ্যে, ইটালীর সমস্ত লোকজন হর্ষোল্লাসের ঝোঁকের পাল্লায় পড়ে অনুতাপসূচক ধর্মোপদেশকের অনুসরণে ঘুরে, সঙ্গে বহন করে শাখা ও জ্বলন্ত মোমবাতি । ১২৩৭ খৃষ্টাব্দে তার চার বৎসর পর জার্মানীতে রিপোর্ট পাওয়া যায় ERFURT এর একশোরও বেশী শিশু হঠাৎ করে কেমন ব্যাধিগ্রস্থ মতিভ্রমে অপ্রতিরোধ্য বাধ্যবাধকতায় ARNSTADT এর উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়।

তাদের অনেকে পরিশ্রান্ত হয়ে মারা যায়; অন্যেরা সারা জীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পরে। সেই থেকে এটা হল সেই গল্পের একটা প্রথম ধাপ যা “হ্যামিলিয়নের চিত্রবিচিত্র’ বংশীবাদক” যে তার প্রতিটি বাঁশীবাজায়ে শিশুদের মোহগ্রস্থ করে পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলঃ
ছেলের যতই হৃদয় গর্বিত হউক,
মেয়েরা যতটুকুই শুরু করে থাক,
আমি তার স্পন্দনে সুরেলাসুর সৃজন হই
এবং অবশ্য সব আসে আমার চেতনায়।
যদি শিশুদের বিকল্পে পোপ, সম্রাট, পর্যটক, সৈনিক, ভিক্ষুক ও মহীয়ধীনারী এবং চিত্রবিচিত্র বংশী বাদককে ধরা হয়,আমরা আমাদের দেখতে পাব পান্ডুর বিশ্বের মৃতের নাচের মাঝপথে আছি। জীবন্তের শ্রেণী থেকে নির্দয় কেউ একজন, নাচুয়ের পরে আর একজন নাচুয়ের সমনজারি করে। কেউই রক্ষা পাবেনা না নারী, না শিশু, না সম্রাট, না কৃষক ঃ
His cruell dance no man mortall can stentnor lede his cruell coars afte his intent……….. চতুর্দশ শতাব্দীর সমাপ্তি থেকে কবি ও চিত্রশিল্পীগণ বিধৃত করেছে কেমন করে মৃত্যের কঙ্কাল আকৃতি মরণশীলদের মধ্যে অসাবধানে গোপনে প্রবেশ করে এবং তাদেরকে নিয়ে যায় তাদের আনন্দ ও গৌরবে, তাদের আশা ও হতাশায়, কখন কখন যুক্ত করে লম্বা শিকলে, হাতে হাত রেখে, কখন দুই দুই করে।
একদা আমরা মানুষ ছিলাম যেমন তোমরা এখন;
একদিন কিন্তু তোমরা হবেই আমাদের মতন।
তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে মক্কার এক রাজা (বাদশা) এইরূপ লিখেছেন এবং এই মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী সেই থেকে কখনই নীরব হতে পারে নাই। আরব-বিশ্ব থেকে এটার পথ দেখা যায় পাশ্চাত্যের দিকে চলে গেছে এবং সকল ভাষায় সমাধিক্ষেত্রের প্রবেশ দ্বারে সতর্কবাণী সজাগ হয়ে আছে :
যেমন তোমরা আছ, আমরাও ছিলাম একদিন
যেমন আমরা আছি তোমরাও হবে আগ-দিন।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে তিন মৃত লোকের নাটকীয় পুরাণ কাহিনীর মধ্যে এই ধারণা সাহিত্যের আঙ্গিক পেয়েছে, একদা বড় দেবতাগণ তিনজন উচ্চ মর্যাদাবান মানুষের কাছে মৃত্যুর মুখে পার্থিব ঐশ্বর্যের অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে ধর্মোপদেশ প্রচার করছিলেন।
চূড়ান্তভাবে চিত্রশিল্পী এই সকৃতজ্ঞ বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম হয়-চতুর্দশ শতাব্দী থেকে প্রথম পিসাতে (PISA) ক্যাম্পো সন্টোর মধ্যে (Campo Santo) দেয়াল চিত্রে কিংবদন্তীর কাহিনী, আকৃতি ও রং এ উৎকীর্ণ হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত “ট্রাম্প অব ডেথ “Trumph of Death” চিত্রে। এইরূপ চিত্রের সম্পূর্ণ অভিভূতকরণ শক্তির চেয়ে কেমন করে শেষ বিচারের দিন ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের অন্তঃসার শূন্যতা বিশ্বাসীদের মনে অধিক বিভীষিকাময়তা প্রতিফলিত করবে? (প্লেট-১৮, ১৯)।
কেন মধ্য-যুগে প্রয়োজন হয় মৃতের সংঘবদ্ধনাচের ধারণা প্রবিষ্ট করতে এবং মৃত্যুর পূর্বে সাম্যতা ? সেখানে তিনটি অন্তপ্রবাহিত চিন্তাচেতনা সুস্পষ্টরূপে কাজ করে :
১। নাচের মধ্যে জীবিত ও মৃতের সম্পর্ক স্থাপন;
২। নাচে অঙ্গভঙ্গির আকৃতি যা মৃতের কাছে অদ্ভু
৩। মৃতের নাচ জীবিতদের মধ্যে মৃত্যুর ও জীবন থেকে বিদায় নেবার সতর্কবাণী।
প্রথম দুই চিন্তা-চেতনা বহু পিছনের দিকে আদি লোক-কৃষ্টিতে নিয়ে যায়। নাচে জীবিত ও মৃতের মিলনের চুড়ান্ত পর্যায়হল একটা ধারণা, পূর্ব-পুরুষের পূজা থেকে ধর্মের অবির্ভাব যা সকল সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক নাচের এই শক্তি আছে। ক্যালিফোর্ণিয়ার ইন্ডিয়ানগণ একজন নারী কে ঘিরে ঘুরে, মৃতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
অধিকন্ত নাচে নিজেকে আড়াল করে অন্য কিছু সাজ ব্যবহার করে; এই মিলান প্রতিমূর্তি স্থাপনের পর্যায়ে পৌঁছে যাতে মৃতকে পুতুলের আকৃতিতে অথবা মুখোশ নাচুয়ে তৈরী করে। সুমাত্রার বটাকগণ তাদের নাচে মৃত প্রধানের প্রতিকৃতির পথ ধরে পুতুল-নাচের সূত্রপাত করে। পশ্চিম-আফ্রিকার ইউরুবাগণ কবর দেবার পূর্বে একজন শবাচ্ছাদন বস্ত্র পরিধান করে প্রতিকৃতির মুখোশ লাগায়ে নাচ শুরু করে।
প্রথম ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুকে অস্বীকার করা হয় শবাচ্ছদন বস্ত্র দিয়ে সে আর কোনভাবে জীবিতদের অধিকারী রূপে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কতক তিব্বতীয় মঠের একটা প্রথা আমাদেরকে আর একধাপ আগায়ে নিয়ে যায় ঃ দুই ভাঁড় ছাড়াও জীবন্তদের সংঘবদ্ধ নাচে আরো দুই আকৃতি দেখা যায় খুলিসহ এবং পরণে সাদা রং এর টাইট করে আঁটা পোষাক-পরিচ্ছদ যার উপর কঙ্কালের চিত্র চিত্রিত করা থাকে। এটা কোন ভাবেই কোন এক মৃত ব্যক্তির প্রশ্ন না কিন্তু মৃত্যুর চিন্তা-চেতনা যা হল জীবন্ত সবকিছুর শেষন্তর স্বরূপ।
দ্বিতীয় ধারণা হল-নাচ অঙ্গ-ভঙ্গির আকৃতির মত যা মৃতের কাছে অদ্ভুত ব্যাপক মহাজাগতিক চিন্তাধারার উৎস থেকে সমগ্র অতিপার্থিব, অন্যজাগতিক গতি হল নাচ। নক্ষত্রসমূহ, দেবতাসকল এবং আত্মাসমূহ সবাই নাচে। এমনকি প্রস্তরযুগের লোকজন মৃতের নাচের ভয়াবহ ছবিতে এই চিন্তাধারা সুদৃঢ় আকৃতি দিয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটা দৃশ্য পূর্ব ব্রাজিলের চ্যাভেনটিন ইন্ডিয়ানদের : কঙ্কালগুলির অভ্যার্থনাকারী নাচের মধ্যে চক্কর খায় উন্মত্ত হাউকাউ এর মধ্যে। গলিত গোস্ত হাড় থেকে ঝুলে এবং তাদের চোখ কুঞ্চিত ও শুষ্ক ডুবন্ত কোঠরে। পরিবেশ ছিল ভারিক্কী নোংরা দূর্গন্ধময় এইরূপে ইন্ডিয়ানগণ শিখেছে যে ঐখানে কোন স্বর্গের আর্শিবাদ তাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। যাইহোক, নক্ষত্রমণ্ডল হয়ত ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ও আকর্ষণ করবে। এটা সম্পূর্ণভাবে একই মধ্যযুগীয় দৃশ্যপট যেটা গথে দেখেছেনঃ
তাদের উরুর হাড় বক্র করে লম্বা পা নাড়ায়
এবং বন্য ছিল তাদের নাচন কিন্তু নমনীয়;
প্রতি হাড় আড়া আড়িতে করে ঠুন আর ঝুন
কাঠের উপর কাঠের বারি শোনায় যেমন !
অতীন্দ্রিয়পূর্ণ মৃতের নাচ হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময় অপচ্ছায়া।অঙ্গভঙ্গি এই চিন্তাধারা এবং memeto mori ও প্রায় ১৪৯১ খৃষ্টাব্দে মেইঞ্জে একটা কাষ্ঠখোদাই ভলিয়ুমে আরো নির্দয়ভাবে প্রকাশিত যা সংগ্রীহিত আছে ঃ
চলে এস চলেএস তুমি প্রভু ও সাধারণ মানুষ
যতই তুমি উচ্চে উঠ, যেথায় থাক তুমি
অথবা তারুণ্যে বা বৃদ্ধে, অথবা উপরে বা নিচে
তোমাদের সকলকে অবশ্য যেতে হবে নাচ ঘরের মধ্যে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রস্তরযুগ ও মধ্যযুগের মধ্যবর্তী দাঁড়ায় ক্ল্যাসিক্যল প্রাচীনকাল। ইটালীতে পূর্বের গ্রীক উপনিবেশ ক্যাম্পানিয়ার পশ্চিমতীরে অবস্থিত কিউমীতে সমাধিস্তম্ভে একটা রিলীকে নৃত্যরত তিনটি কুঞ্চিত শবদেহ চিত্রিত আছে এবং একইরকম নৃত্যরত কঙ্কাল রোমান পাত্রের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই প্রতীক-প্রীতি তাদের আনন্দঘন উৎসবমুখরতার মধ্যে প্রবেশ করে : অঙ্গভঙ্গি রোমান আপ্যায়নকারীদের রূপার নাচের ছোট কঙ্কাল ভোজ-টেবিলে স্থাপন করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। প্রাচীনবিশারদের জন্য এই প্রতীক সর্বদা Carpe diem তাৎপর্য বহন করে।
হিরোডোটাস আমাদেরকে বলেন, মিশরের অর্থশালীদের ভোজ উৎসবে খাওয়া দাওয়ার পর একজন লোক সব সময় কাঠের মৃতের মূর্তি কফিনে নিয়ে চারদিকে ঘুরত…………….সে পালাক্রমে এটা প্রতিটি মেহমানকে দেখাত এবং বলত ঃ “এই মূর্তি ধরুন তারপর পান করুন এবং আনন্দ উল্লাস করুন; এরমত আপনিও যা হবেন, যখন আপনি মারা যাবেন” ।
কিন্তু মধ্যযুগের আগপর্যন্ত শেষের তিন ধ্যান-ধারণা উন্নতি লাভ করতে পারে নাই : জীবিতদের সঙ্গে মৃতের নাচ মৃতুর সতর্কবাণী ও জীবন থেকে প্রস্থান। সেখানে একটা পুরাণ কাহিনী আছে যে, স্কটল্যান্ডের তৃতীয় আলেকজান্ডারের বল-নাচে একটা ভূত অংশগ্রহণ করত; তার কিছু পরে রাজা মারা যান।
এটা একটা ভিন্নধরনের memeto mori তার আর অধিক না “একদিন মৃত্যু এসে দাঁড়াবে-জীবন উপভোগ করে নাও”, কিন্তু “মৃত্যু শীঘ্র আসবে-জীবনকে তাৎপর্যময় করে নাও।” মৃত্যু বিভীষিকাময় রূপে নিকটে আসে, কাছে অশুভভাবে দাঁড়ায় এবং এর মধ্যে ভীতিময় হাত বাড়ায়ে দেয়।
ক্ষমতাহীন মানুষ অনিবার্য গ্রেফতারী পরওয়ানা মেনে নেয়।অঙ্গভঙ্গি মধ্যযুগের মানুষেরা অন্য কোন নাচের চেয়ে সংঘবদ্ধ নাচের মাধ্যমে নতুন ও বিচিত্র চিন্তা-ধারা গ্রহণ করতে বেশী অভ্যস্ত ছিল। শুধু সেই নাচের গঠনশৈলীর মধ্যে যেটা সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে এবং যাতে সে নিজে অংশগ্রহণ করেছে, তাতে সেই ছবি তার পরিস্কার অভিজ্ঞতার মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে এটার প্রকাশ ঘটায়।
সংঘবদ্ধনাচ অংশগ্রহনকারীদের নিজস্ব ইচ্ছা কেড়ে নেয়-যদিও তারা সম্মোহের মধ্যে তাদের নেতাকে অনুসরণ করে, যে তাদের জন্য পথ খুঁজে বের করে, শিকল বন্ধ করে ও খুলে গিড়া টাইট করে ও ঢিলা করে। কেমন করে কবি ও চিত্রকর সেই সম্পূর্ণ চিন্তা-ধারা মনে উপস্থাপন করতে পারে, সমস্ত কে অবশ্যই একই পথে ও একই লক্ষ্যের দিকে সেই একইরূপ দুঃখ-কষ্টে ও দূর্দশার সঙ্গে, মৃতের নাচের চেয়ে অধিক শক্তি প্রয়োগে যা তাদের সকলকে ঘের নাচের মধ্যে দিয়ে এনেছে ? তারা এটা আরো দ্রুততর করতে পারে কারণ চতুর্দশ শতাব্দীতে লোকজন সংঘবদ্ধনাচে শুধুমাত্র সুখের হর্ষোল্লাস দেখেনাই।
মধ্য-যুগের মানুষ তার নাচগুলি থেকেও শিখেছে, মরণশীল ভয়াবহতার হর্ষোল্লাস এবং নিরাশা। তারা দেখেছে ঐসকল ভয়ানক ছিছিন্ন নাচসমূহ যা লোকজন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং যার অভিশাপ শুধুমাত্র দেবতারঅনুগ্রহ রাহুমুক্ত করতে পারে।
সে সম্প্রতি অভিজ্ঞতা পেয়েছে কেমন করে মরণশীল ভয়াবহতা ও নিরাশা উন্মত্ত নাচেরমধ্যে তীব্রতা পায় এবং কেমন করে বিরাট-ধবংসকারী তার ভিকটিম নাচুয়েদের থেকে কেড়ে নেয়। তার জন্য নাচপরিবর্তন করেছে সুস্থ আনন্দ উপভোগ থেকে বেদনাদায়ক দুর্দশার মধ্যে, উৎসবমুখর উল্লাস থেকে দূর্ভাগ্যজনক মহামারীরমধ্যে এবং ক্রমান্বয়ে পাগলামীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে।
নেতা ইচ্ছামত পথ দেখায় প্রাণবন্ত যুবকদের পুষ্পময় বসন্তের সবুজ ক্ষেত্র থেকে নাচের চিরনতুন দেহের ভাঁজের মধ্যে, মৃত্যু তার উপর চিত্রিত করে সবকিছু জীবন্ত, বিরাট ও ক্ষুদ্র, ধনী ও গরীব, অপ্রতিরোধ্য তালছন্দে- নাচ জীবন্ত ও মৃতের প্রতীক স্বরূপ- কোন তুলনা না করে তীব্র উত্তেজনাকর গথিক আত্মা সম্পূর্ন পরিস্কারভাবে অনুধাবন করা যাবে ।
রংচং করা মৃতের নাচ সবসময় সমকালের প্রকৃত নাচের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিফলিত করতে পারে না। মৃত ব্যক্তির অঙ্গভঙ্গি প্রায় প্রায় অসম্ভবভাবে ও অদ্ভুত ভাবে বিকৃত করা হয়। এটা আংশিকভাবে জিনিষের প্রকৃতিতে পরে। প্রত্যেক জিনিষ বেখাপ্পাভাবে ব্যবহৃত হলে ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া থাকে – মস্তবড় (giant) কেউ বামনের মত থপথপ করে হাঁটলে, একজন শিশু তার বাপের হ্যাট পরলে, পুরুষমানুষ নারীদের পোষাক-পরিচ্ছদ পরলে।
কঙ্কাল যেটা কবরে মিশে যাবার পরিবর্তে সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়ায়, হাঁটে ও জীবিত লোকের মত কার্যকলাপ করলে এইরূপ বেখাপ্পাময়তার অধিকারভুক্ত হয়। খুব প্রাণবন্ত খেঁচুনিযুক্ত রিদিম ও মৃতের খটখটে হাড়ের মাংসহীনের মধ্যে খুবই জীবন্ত মানুষের অঙ্গভঙ্গির চেয়ে আর কি বেশী ব্যতিক্রম হতে পারে ?
এটা কি হতে পারে যে সে প্রকৃতই নাচে সক্রিয়ভাবে ও সচেতনতার সঙ্গে? সত্যই কি সে ঐ সকল বাহুদ্বয়, পদদ্বয় ও পাতা মাড়ায় যেটা মনে হয় না মোটেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে ? তারা কি তাদের মত তার কাছে বাঁধা না যেমন পুতুল-নাচের পুতুলের অঙ্গ যেটা তৈরী করা হয়েছে লাফালাফি করতে ও নাচতে এক অদৃশ্য সুতা প্রভুর হাতের মধ্যে রেখে ?
আমরা মৃতের নাচের ছবির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখি হঠাৎ করে নিশ্চল কঙ্কাল নড়াচড়া করে এবং যেভাবে তারা নড়াচড়া করে তা উৎসাহব্যঞ্জকভাবে আমাদের কাছে পরিচিত। এই ভঙ্গিমা, এই পায়ের অবস্থান,অঙ্গভঙ্গি এই সকল ভাবভঙ্গি যারা করে, আমরা কি তাদেরকে জানতে পারিনা প্রাচীন দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের এশিয়ার মন্দিরের কার্ণিশের কারুকাজ থেকে, অঙ্গোরভাট ও বরোবুদুর থেকে এবং ইন্ডিয়ান জগতের আধুনিক নাচুয়েগণ থেকে যারা হাজার হাজার বৎসরের পুরান ঐতিহ্যের অনুসরণ করে, যেমন পুতুল নাচের ছায়ার খেলায়, খুব প্রান্তিক আঙ্গিকের নাচে, খুবই নৈর্ব্যক্তিক তথাপি ব্যক্তিগতেরও বেশী থেকে?
সম্পূর্ণ মূখ-অভিনয়ের ছিন্নভন্নতা ও বিকৃতির অদ্ভুত আচরণ এরই মধ্যে আমাদের জানা হয়েছে। যখন পৈশাচিক আদি লোক-কৃষ্টি মৃতের মুখোশে বিচিত্র নাচের মধ্যে পুনর্জাগরিত হয় আমরা তা ভয়ার্তের সঙ্গে ধারণ করে থাকি। আমরা এখন অনুধাবন করতে পারি যে, এটা মনের সর্বোৎকৃষ্ট আবিস্কার হতে পারে না যেটা মৃতের নাচ গঠন করে, কিন্তু ঐ রকম আর সকল চিন্তাচেতনার চূড়ান্ত ব্যাপারে এটা হল একটা আজগুবি কল্পনার পুঞ্জীভূত অবস্থান জাঁকজমকশীল স্বপ্ন থেকে তার উৎপত্তি হয়েছে।
আরও দেখুনঃ