বাঙলায় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা সুভাষ চৌধুরী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাঙলায় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা সুভাষ চৌধুরী , যা বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা এর অন্তর্ভুক্ত।

বাঙলায় ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা সুভাষ চৌধুরী

কলকাতায় ১৯৩৪ সালে অনুষ্ঠিত অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশনের প্রতিবেদনে ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লেখেন: Probably the audience in the Senate House became acquainted with the classic dances of the South for the first time.

The writer had seen some line demonstrations of the art of dancing as practiced in the South, But he confesses that he had never seen anything approaching the standard of Miss Bala Saraswaty and Mr. Sankaran Nambudri. Their exhibition was a revelation to Bengal. This idea of bringing them to Calcutta was excellent.

হরেন্দ্রলাল ঘোষের উদ্যোগে এবং ব্যবস্থাপনায় এই দুজন শিল্পী কলকাতায় এসেছিলেন তাদের নৃত্যশৈলী প্রদর্শনের জন্য। এর আগে বাংলার দর্শকদের সঙ্গে তেমন কোনো সংগীত শিল্পীর পরিচয় ঘটেনি। প্রসঙ্গত ধূর্জটিপ্রসাদের প্রতিবেদনের পরবর্তী অংশ বিশেষ উল্লেখযোগ্য

 

নৃত্যশিল্পী গোপীকৃষ্ণ

 

In Bengal, at present, there are three styles of dancing. The one of Santiniketan, inspired as it is by the Poet, has caught the imagination of the people. Its strong points are lyric grace and the pictorial character of the grouping. As yet, it is illustrative, in as much as songs only, the poet’s songs alone, are danced.

At its worst, it may only be a form of acting, at its best, it representational. The formal clement of this school bears a faint resemblance to the Manipuri, but without its rituals. The Santiniketan style dose not equally divide its attention between rhythm and motto or footwork. Once divorced from music, that would not be a defect, but as the Santiniketan group still dances songs.

the metrical failure interferes with the rhythmic flow. The second style has been recently popularized by Mr. G. S. Dutta, who is a keen student of Bengali folk-lore. Along with the Bratachari Movement, which is the Bengali parallel of the By Scouts Association,

the folk-dances are spreading among aesthetic properties are probably not as yet of a high order. From the samples which the student community they are vigorus and corporative. Some of them have almost a martial fervor. Their physical consequences are all to the good. but there the written has witnessed.

it maybe sand that folk-dances in Bengal did not attain the stylistic perfection of the Kath kali dance of Malabar… The third school is associated with the name of Udaysankar. It is not known to what extent he has given instructions to young men and women outside his troupe,

but very few can doubt his influence on those who have recently taken up dancing either as an occupation or as a hobby. A genuine artist, he has had requisite training in at least one sister art, he has traveled and learnt with a rare humanity. The result has been more than a mere synthesis has been all attained.

খুঁজটিপ্রসাদের প্রতিবেদন যথেষ্ট দীর্ঘ। প্রতিবেদনে শিল্পীদের মূল্যায়নও করেছেন তার অননুকরণীয় ভাষায়। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তার আরও দুটি ছত্রও বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে :Besides these three types, there is probably another, viz., that which is evolving on the stage along with the drama. It has not yet taken a shape and no evolution is possible.

শিল্পীদের মূল্যায়নের প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও প্রতিবেদনে সেই সময়ের বাংলার নৃত্যচর্চার একটি রূপরেখা ফুটে ওঠে। তাতে জানা যায় অন্তত ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা শুরু হওয়া দূরে থাক ভারতীয় বিভিন্ন ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীর সঙ্গে বাংলার দর্শকদের তেমন পরিচয়ও ঘটেনি। কিন্তু এর অনেক আগেই শান্তিনিকেতনে ধ্রুপদী নৃত্যচর্চার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সেই ইতিহাসটুকু এর সঙ্গে যুক্ত করে নিলে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া সহজতর হবে।

শান্তিদেব ঘোষের সাক্ষ্যে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ‘নৃত্যকে শিক্ষণীয় বিদ্যা হিসাবে বিদ্যালয়ে এবং বিশ্বভারতীতে স্থানদানের ইচ্ছায় মণিপুরী নাচ শেখানোর ব্যবস্থা প্রথম গ্রহণ করেন ১৯২০ সালে বুদ্ধিমত্ত সিংহকে এবং ১৯২৫ সালে নবকুমার সিংহকে আগরতলা থেকে আনিয়ে।’ ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুরকে রবীন্দ্রনাথ অনুরোধ করেন একজন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষককে শান্তিনিকেতনে পাঠানোর জন্য।

মহারাজা অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন একজন মৃদঙ্গবাদকসহ বুদ্ধিমত্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে। পরে তিনি নবকুমার সিংহ ও তার ভাই বৈকুণ্ঠ সিংহকে পাঠান। নবকুমার সিংহের শিক্ষকতায় রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র নৃত্যধারা প্রবর্তিত হয় নটীর পূজা (১৯২৭) অভিনয় থেকে।

‘আগরতলার নবকুমার সিংহ চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ধ্রুপদী নৃত্যের শিক্ষক ছিলেন না। কিছুদিন পরই ইম্ফল থেকে দুজন মণিপুরী নৃত্যশিক্ষক আসেন। তারা ছিলেন এক বছর। ১৯২৯ সালে একজন মণিপুরী শিক্ষক আসেন ইম্ফল থেকে। ১৯৩১ সালে কথাকলি নৃত্যশিক্ষার জন্য শান্তিদেব ঘোষ কেবল যাত্রা করেন এবং কিছুদিন ‘কেবল কলামগুমে’ শিক্ষা গ্রহণ করে আসেন।

ওই বছর উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বন্যার্তদের সাহায্যকল্পে কলকাতায় নৃত্যগীতের যে ‘গীতোৎসব’ অনুষ্ঠান হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানসূচিতে কথাকলি নৃত্য যুক্ত হয়েছিল। শিল্পী ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ অবশ্য তখনও ছিলেন শান্তিময়। একভাবে দেখতে গেলে সম্ভবত শান্তিদেব ঘোষই কলকাতায় কথাকলি নৃত্য পরিবেশন কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন।

১৯৩৪ সালে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কল্যাণী আম্মা। তিনি ছিলেন মাত্র তিন মাস । এদের কেউই একটানা শিক্ষাদান করার জন্য শান্তিনিকেতনে থাকেননি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধ্রুপদী নৃত্য শিক্ষায় বারবার ছেদ পড়েছে। ১৯৩৫ সাল থেকে প্রকৃতপক্ষে শান্তিনিকেতনে নিয়মিতভাবে একটানা নৃত্যশিক্ষা এগোতে থাকে। ১৯৩৬ সালে বিশ্বভারতীতে সংগীত ও নৃত্যের একটি পাঠক্রম প্রস্তুত হয়। নীচের পাঠক্রম ছিল :

Indian Dancing :
The course is for four years
1st year: Elementary clsses in Manipuri
Dancing, Elementany class in south Indian Dancing
2nd year : manipuri “Tala” dances, South Indian “Tala” dances, Training in “bole” and
Symbolic “Mudra’.
3rd year : south Indian Kathakali and Ceylonese dance. Rendering of Bengali songs to dances, Study of Poses from old Paintings and frescos 4th year : Mimicry and expression
Composition Dramatic
mterpretation

পাঠক্রম দেখলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না অন্তত ১৯৩৬ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে নিয়মিতভাবে ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী শিক্ষা শুরু হয়েছে। ঠিক একই সময়ে (ডিসেম্বর ১৯৩৬) কলাকাতায় অনুষ্ঠিত অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের নৃত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে ১-৩-৩৬-এর অমৃতবাজার পত্রিকার মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : সেখানে লেখা হচ্ছে :

… But is should be noted that their dances are far superior to those that have become prevalent in modern Bengal-dances which have often practically no science behind tem’.

যাদের নৃত্যানুষ্ঠানের প্রসঙ্গে এই মন্তব্য তারা হলেন রায়গড় স্টেটের প্রফেসর কার্তিক রাম এবং এলাহাবাদের কথক নৃত্যশিল্পী কুমারী আশা ওঝা। সম্মেলনের শিল্পী তালিকায় আর একজন বাঙালি নৃত্যশিল্পীর নাম পাই কুমারী মঞ্জুলিকা ভাদুড়ি।

এসব তথ্য থেকে অন্তত এটুকু স্পষ্ট হয় নির্দিষ্ট ধ্রুপদী নৃত্যশৈণীর চর্চা বা অনুশীলন কলকাতায় তেমনভাবে শুরু হয়নি বরং সেই বিচারে এই কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন রবীন্দ্রনাথ তারই উদ্যোগে এই চর্চা শুরু হয় শান্তিনিকেতনে।

বিভিন্ন নৃত্যশৈলী কিভাবে বাংলায় বিশেষ করে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়ে ওঠে তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিলে হয়তো এই ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে কথাকলি ॥ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সৈনিকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ দলের অন্যতম শিল্পী হিসাবে কলকাতায় আসেন গোপাল পিল্লাই ।

সম্ভবত ১৯৪১ সাল। ত্রিবাঙ্কুরের তিরুভাল্লা গ্রামের মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি তার মামার কাছে নৃত্যশিক্ষা করে ছিলেন বলে জানা যায় । কথাকলি নৃত্যশৈলীতে তার শিক্ষা ঐতিহ্যপূর্ণ হলেও সম্পূর্ণ ছিল (?) এমন সাক্ষী মেলে না। সম্ববত তিনি শিক্ষা সম্পূর্ণ করার আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। কলকাতাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। চল্লিশ দশকের শুরু থেকেই কলকাতায় নিয়মিত শিক্ষাদান আরম্ভ করেন। পঞ্চাশ দশকের গোড়াতেই অবসর নিয়ে দেশে চলে যান।

কথাকলি শিক্ষা প্রসঙ্গে তার সম্পর্কে দুটি ভিন্ন মতামত আছে। একপক্ষ বলেন ‘তিনি original কথাকলি শেখাতেন না।’ অপরপক্ষে প্রবীণ নৃত্যশিলপী প্রহ্লাদ দাস বলেন, তিনি PURE FORM শেখাতেন। শেষের দিকে একটু mix করতেন। প্রহ্লাদ দাস গোপাল পিল্লাইয়ের কাছে কিছুদিন তালিমও নেন।

গোপাল পিল্লাই কলকাতায় গীতবিতান ও নৃত্যভারতীতে শিক্ষাদান করেন। কিন্তু তেমন কোনো স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেননি। ওর কিছু আগেই ১৯৩৭ সালে কেলু নায়ার এসেছেন শান্তিনিকেতনে ১৯৩৭ সালে শান্তিদেব ঘোষ যখন সিংহল থেকে ফিরছিলেন রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনি কেরল কলামণ্ডমের কবি ভালাথোলকে শান্তিনিকেতনের জন্য একজন কথাকলি শিক্ষক পাঠানোর অনুরোধ করেন

। ভালাথোল কেলু নায়ারকে পাঠিয়ে সেই অনুরোধ রক্ষা করেন। এর আগে শান্তিনিকেতনে কথাকলির শিক্ষক ছিলেন ভেলায়ুধ মেনন। কেলু নায়ার ছিলেন কলামগুমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাত্র । প্রথমে শান্তিনিকেতনে পরে কলকাতা এবং টাটানগরে কিছুদিন শিক্ষকতার পর আবার শান্তিনিকেতনে শিক্ষা দান করার পর অবসর গ্রহণ করে দেশে চলে যান।

কথাকলির আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের শ্যামার বজ্রসেন চরিত্রটিকে তিনি যেভাবে মূর্ত করতেন তা আজও অনেকের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। তার কাছে কথাকলি শিখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন ছাত্রছাত্রীর নাম তেমনভাবে উল্লেখ করা না গেলেও এই নৃত্যশৈলীর একটি আদর্শ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এর কিছু পরে আসেন বালকৃষ্ণ মেনন। তিনি প্রথমে শান্তিনিকেতনে পরে কলকাতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন গুরু গোপীনাথের ছাত্র । ত্রিবান্দ্রাম- এর ত্রিভাঙ্কুর স্কুল অফ কেরল-এর ছবছরের নৃত্যের ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হন তিনি। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে ‘কেরলীয় নৃত্যকলাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। বালা কৃষ্ণ মেনন আসার আগে ১৯৩৫ সালে গুরু গোপীনাথ রাগিনী দেবীসহ কলকাতায় অনুষ্ঠান শেষ করে চারদিনের জন্য শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন। একদিন তারা সেখানে নৃত্যাভিনয়ও করেন। তারা নাচের মুদ্রাভিনয় ও সাজসজ্জার পুরনো রীতির অনেকখানি পরিবর্তন করেছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথ এদের নাচ দেখে খুশি হয়েছিলেন বালকৃষ্ণ মেনন ছিলেন এই ধারার উত্তরসূরী তিনি ট্র্যাডিশনাল ফম বদলে আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য আনলেন । মুদ্রা, ভঙ্গি ঠিকই রইল। সাজ, যন্ত্রনুষঙ্গ হলো পরিস্থিতি ও পরিমণ্ডল অনুসারী। পরবর্তীকালে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের নৃত্যপরিচালক হিসাবে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রাখলেন।

বালকৃষ্ণ মেননের এই নৃত্যধারায় শিক্ষিত হয়ে পরবর্তীকালে অনেক শিল্পী রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যাভিনয়ে যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। চল্লিশের দশকে শান্তিনিকেতনে পর পর দুজন কথাকলি নৃত্য শিক্ষক এসেছিলেন। একজন হলেন কৃষ্ণন কুট্টি ওয়ারিয়র। ইনি ছিলেন কেরলা কলামণ্ডলমের ছাত্র। অন্যজন ছিলেন গুরু গোপীনাথের ছাত্র চন্দ্রশেখর । এরা কেউই বেশিদিন থাকেননি ।

১৯৫০ সালে উদয়শঙ্করের সঙ্গে কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এলেন দুজন কথাকলি নৃত্যশিল্পী এন কে শিবশঙ্করণ ও পি রাঘবন। তিলোত্তমায় সুন্দর-উপসুন্দর ভূমিকায় কথাকলির পোশাকসহ এই দুই শিল্পী উদয়শঙ্করের নৃত্যধারায় যে অনুষ্ঠান করেন তা বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ১৯৫৬য় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীতনাটক আকাডেমীর ডিন হলেন উদয়শঙ্কর।

কথাকলি নৃত্য অ্যাকাডেমীর পাঠ্যক্রমভুক্ত হলো। এরা শিক্ষক হয়ে এলেন। এই সময়েই মালয়লী সমাজ সাতদিনব্যাপী ‘কেরালা কালচারাল ফেস্টিভাল’ করলেন ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে । কলকাতায় ‘অরিজিনাল ফর্ম’ এ কথাকলি নৃত্য দেখানো হলো। অভূতপূর্ব উৎসাহের সঞ্চার হলো। বালকৃষ্ণ মেনন তখন CLT-এর অন্যতম শিক্ষক।

শিবশঙ্করণ সেই থেকে রয়ে গেলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পি রাঘবন এখনো যুক্ত হয়ে আছেন উদয়শঙ্কর কালচারাল সেন্টারের সঙ্গে। কলকাতায় কথাকলি নৃত্যশৈলী প্রচারে এদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শিবশঙ্কর রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যেও চরিত্রাভিনয়ে প্রশংসিত হয়েছেন বারবার।

‘মালয়লী সমাজ’ ১৯৫৫ সালে কেরালা কলামণ্ডলমের আর একজন ছাত্রকে এনেছিলেন কলকাতায় কথাকলির অনুষ্ঠান করা এবং শেখানোর জন্য। ১৯৬২ সালে এই শিল্পী শিক্ষক গোবিন্দ কুট্টি রবীন্দ্রভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন অধ্যাপনার কাজে। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের পুরুষ চরিত্র রূপায়ণে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।

পঞ্চাশের দশকে প্রহ্লাদ দাসের প্রচেষ্টায় অন্যতম কথাকলি শিক্ষক গুরু কৃষ্ণনায়ার কলকাতায় এসে কথাকরি শিক্ষাদান করেন একটানা প্রায় আড়াই বছর। তিনি নৃত্যভারতীয় সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকেই শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন হরিদাস নায়ার। প্রখ্যাত কথাকলি নৃত্যগুরু কুঞ্জ কুরূপের সুযোগ্য পুত্র তিনি। কেরল কলামণ্ডলমের ছাত্র।

অত্যন্ত সনিষ্ঠ এবং ঐতিহ্যবাহী পরম্পরাগত তালিমে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সম্ভবত তারই সময়েই প্রথম যথোপযুক্ত বাদ্যযন্ত্রসহ কথাকলি নৃত্যশিক্ষা শুরু হয় শান্তিনিকেতনে। হরিদাস নায়ারের সময়কালেই প্রথম সংগীত নাটক অ্যাকাডেমীর ন্যাশনাল স্কলারশিপ পান তার অন্যতমা ছাত্রী রীতা গাঙ্গুলি । এটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৷

ক্রমে বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কথাকলি নৃত্যশৈলী শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষক নিযুক্ত হন। যেমন শান্তিনিকেতনে এসেছেন শঙ্করনারায়ণ, মুরলী, বাসুউন্নী। এরা সকলেই কলামণ্ডলমে শিক্ষিত। কলকাতায় শেখাচ্ছেন ভেঙ্কট। ইনি কলকাতার কলামণ্ডলমের শিক্ষক।

এতখানি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিন্তু কথাকলি নৃত্যশৈলীর চর্চা ক্রমশ কমে আসছে। বিভিন্ন শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হয়েছে প্রধানত দুটি কারণেই এই পরিস্থিতি। প্রথমত ভাষা। অর্থাৎ যে ভাষায় গান গাওয়া হয় তা সহজবোধ্য নয়, দ্বিতীয়ত অভিনয় বা ভঙ্গির তাণ্ডব অংশের প্রাধান্য।ভরতনাট্যম ॥ ভরতনাট্যম কলকাতায় নিয়মিতভাবে প্রথম শিক্ষা দিতে শুরু করেন প্রহ্লাদ দাস।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মহীশূর মহারাজার দরবারের নৃত্যশিল্পী রামচন্দ্র পিল্লাইয়ের কাছে এই নৃত্যশৈলীর প্রাথমিক তালিম নেন পরে নাট্যকলাকুণ্ডলম বিধান গনেশম পিল্লাইয়ের কাছে শিক্ষা পূর্ণ করেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আর এস আনন্দম বলে একজন কুচিপুড়ী নৃত্যশিল্পী কলকাতায় কুচিপুড়ী ভেঙ্গে এক ধরনের নৃত্যনির্মিতি ভরতনাট্যম বলে শিখিয়ে ছিলেন।

এর আগে শান্তিনিকেতনে বাসুদেবন বলে একজন ছাত্র যে ঢং-এ নাচতেন তা বিধিবদ্ধ নির্দিষ্ট প্রথার নাচ নয় । ভরতনাট্যমের কতকগুলো নৃত্যভঙ্গিকে পায়ের সহজ ছন্দে গেঁথে মনের এক একটি আবেগকে প্রকাশ করার চেষ্টা তিনি করতেন। এ নাচকে বলা যেতে পারে ভরতনাট্যমের নৃত্যভঙ্গির ভিত্তিতে এক প্রকার “Modern Dacne”।

সম্পূর্ণ অনিয়মিত এ ঢং-এর নাচ। বিধিবদ্ধ নিয়মে শেখানো সম্ভব ছিল না বলে বাসুদেবন শান্তিনিকেতনে তার নৃত্যের কোনো স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেননি।’ সম্প্রতিককালের নৃত্যগুরুদের মধ্যে কলকাতায় ভরতনাট্যম নৃত্যশৈলী প্রচারে যার নাম প্রথম উল্লেখ করতে হবে তিনি হলেন মারুথাপ্পা পিল্লাই। পরস্পরাবাহী ভরতনাট্যমের তালিম দিয়েছেন তিনি।

অ্যাকাডেমী অব ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিকের শিক্ষক ছিলেন তিনি। কলকাতায় যারাই এই নৃত্যশৈলীর চর্চা করেছেন তারা প্রায় সকলেই এর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। তাঞ্জোরের বিশিষ্ট পরিবারের এর জন্ম যেখানে ভরতনাট্যম নৃত্যশৈলী পরম্পরাবাহী। এই সময়ের সম্ভবত সামান্য কিছু আগে কলকাতায় তাঞ্জোরের নৃত্যশিল্পী রাজলক্ষ্মী আম্মাও কলকাতায় ভরতনাট্যম শিক্ষাদান করেন। তিনিও ছিলেন ঘরানাদার শিল্পী।

এরই ভগ্নীপতি ছিলেন পণ্ডরীনাথন। পণ্ডরীনাথন প্রথমে মৃদঙ্গম বাজাতেন পরবর্তীকালে ভরতনাট্যমের শিক্ষক হন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন অকালে তার মৃত্যু হয়। এর compositionগুলো তেমন দানা বাধত না। ছোটো ছোটো composition জুড়ে বড়ো করতেন। আসলে তেমন প্রত্যক্ষ শিক্ষা না থাকায় হয়তোবা এমনটি হয়েছিল।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও একজন ভরতনাট্যম শিক্ষক ছিলেন যার নাম জ্ঞানপ্রকাশ । বালাসরস্বতীর সঙ্গে নটুভঙ্গম করতেন বিখ্যাত নৃত্য শিক্ষক এল্লাপ্পা পিল্লাই, তারই সুযোগ্য পুত্র ইনি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন। বেশিদিন থাকেননি। ১৯৫৮ সালে এসেছেন থাক্কুমণি কুট্টি। গোবিন্দন কুট্টির সঙ্গে বিবাহের সূত্রে এর কলকাতায় আসা।

কেরালা কলামণ্ডলমে মোহিনীআটম ও ভরতনাট্যম শিক্ষা করেন। কলকাতায় আসার পর মারুথাপ্পা পিল্লাইয়ের কাছেও চর্চা করেন। মোহিনীআটম বাংলাদেশে এরই সৌজন্যে প্রচারিত হয়েছে। ভরতনাট্যমের ছাত্রছাত্রী অসংখ্য। এখন বহু নাম করা যায়।

কয়েকটি নাম প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য : জয়শ্রী মুন্দকুর, অনিতা মল্লিক, দেবযানী মজুমদার, অপর্ণা রামকৃষ্ণ, প্রিয়দর্শিনী সোমন, পৌলমী চ্যাটার্জি, হৈমন্তী গুহ, উমা ভেঙ্কিট, সুচিস্মিতা সেন, অভয় পাল। সুচিত্র মিত্র থাক্কুমণি কুট্টির কাছে শিক্ষা গ্রহণের পর মাদ্রাজের কলাক্ষেত্রে তালিম নেন।

আশির দশকের শুরুতে আরও একজন ভরতনাট্যম নৃত্যশিক্ষক কলকাতায় এসেছেন মাদ্রাজের কলাক্ষেত্র থেকে তালিমপ্রাপ্ত হয়ে খগেন বর্মন।

রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপক এদের সকলের চেষ্টায় ভরতনাট্যম এখন বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্যশৈলী বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এবং প্রসঙ্গত একথা বলা অন্যায় হবে না যে এই নৃত্যশৈলীতে বাংলার নৃত্যশিল্পীরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন বিশেষ করে নবীন শিল্পীরা। মণিপুরী ॥ মণিপুরী নৃত্যশৈলীর সঙ্গে শান্তিনিকেতনের পরিচয় ঘটেছিল অনেক আগেই সে কথা ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে।

কলকাতায় কিন্তু তেমনভাবে এই নৃত্যশৈলী শিক্ষার উদ্যোগ হয়নি। ১৯৩২ সালের আগে। ব্রজবাসী সিং ১৯৩২ সালে কলকাতায় আসেন। তিনি ছিলেন গুরু আমুবি সিং-এর ছাত্র। কলকাতায় মণিপুরী নৃত্যের প্রতি প্রথমত এবং প্রধানত যদি কেউ আকৃষ্ট হয়ে থাকেন তবে তার অনেকখানি কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন ব্রজবাসী সিংহ।

তাকে অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবু সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি তার ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে মণিপুরী নৃত্য প্রচারের ও প্রসারে যে উৎসাহের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

তার ছোটো ভাই চন্দ্রজয় সিং এবং ভ্রাতৃবধু ইভা সিং কলকাতায় এখনও নিয়মিত শিক্ষাদান করে থাকেন। ১৯৫৬ সালে উদয়শঙ্করের তত্ত্বাবধানে অ্যাকাডেমী অব ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিকের কাজে যোগ দেন নদীয়া সিং। তিনিও আমুবি সিং-এর ছাত্র। আর এসেছেন বিপিন সিং যিনি

মণিপুরী নৃত্যকে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।নদীয়া সিং-এর কাছে শিক্ষালাভ করেন দর্শনা ঝাভেরী, প্রীতি প্যাটেল, শ্রুতি ব্যানার্জিরা, এখন অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত শিল্পী বলে সর্বভারতে পরিচিতি লাভ করেছেন।

মণিপুরী নৃত্যের পরম্পরা বজায় রাখায় যে কয়েকজন শিক্ষক সচেষ্ট থেকেছেন দেবযানী চালিহার নামটি তাদের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখনীয়। তিনি এই নৃত্যশৈলী পেশা হিসাবে গ্রহণ না করেও যে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচার মগ্ন থেকেছেন তা আজকের দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। দেবযানীও আমুবি সিং-এর কাছে তালিম নেন। নদীয়া সিং-এর কাছেও তার শিক্ষা।

মণিপুরী নৃত্যের কেবল আঙ্গিকগত নয় পরম্পরাগত ঐতিহ্যের প্রতি তিনি একান্তই বিশ্বস্ত । এটিও তার বিশিষ্টতা। কলকাতায় বস্তি অঞ্চলে তার নৃত্যশিক্ষার ইতিবৃত্ত আজ সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে। এছাড়া কলকাতায় দীর্ঘদিন যাবৎ আছেন সুধীর সিং। শান্তিনিকেতনে অল্পদিন ছিলেন পরে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মণিপুরী শিক্ষাদান করেন। আতম্বা সিং কলকাতায় মণিপুরী শিক্ষা দেন নৃত্যভারতীতে।

এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে আবার মণিপুরী নাচের শিক্ষক এসেছেন। যাদের মধ্যে রাজকুমার সেনারিক সিং, নীলেম্বর মুখার্জি, মহিম সিং, চন্দ্রজিৎ সিং, এমনকি গুরু আতম্বা সিংহও শান্তিনিকেতনে শিক্ষাদানের জন্য আসেন। অমুবী সিং ও জিতেন্দ্র সিং আজও সেই ধারা অব্যহত রেখেছেন।

একথা বলা অসঙ্গত হবে না শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের প্রচলন ও প্রসারের ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে এবং পরে সারা ভারতে প্রসার লাভ করে । এক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রধান উৎসাহী ও পৃষ্ঠপোষক ।

কথক ॥ ১৯৩৫ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স এলাহাবাদের কুমারী আমা ওঝার কথক নৃত্যানুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয় কলকাতাবাসীর। ১৯৩৬ সালে মণি বর্দ্ধন ‘সীতারাম ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে এলেন।’ ওই সময় প্রহ্লাদ দাস চন্দ্রমা প্রসাদজী যিনি প্রধানত শম্ভু মহারাজের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করতেন তার কাছে তালিম নেন অল্প কিছুদিন।

১৯৩৭ সাল নাগাদ অচ্ছন মহারাজ করকাতায় এসেছিলেন New Theaters-এর Contract-এ চিত্রাভিনেত্রী লালা দেশাইকে শেখাবেন বলে প্রায় এক বছর কলকাতায় ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই এক বছর, কলকাতায় কত্থক নৃত্যচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য সময়।কলকাতায় পরবর্তীকালে যে সব কথক নৃত্যের গুরু স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম পণ্ডিত রামানারায়ণ মিশ্র।

রামনারায়ণ শৈশবে পিতা গোবর্ধন প্রসাদ মিশ্রের কাছে জয়পুর ঘরানা এবং পরে অচ্ছন মহারাজ ও শম্ভু মহারাজের কাছে কথক নৃত্যশৈলী শিক্ষা করেন পঞ্চাশের দশকে তিনি কলকাতায় নৃত্যভারতী ও অন্যান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করা ছাড়াও বহু চলচ্চিত্রাভিনেত্রীকে শিক্ষা দিতেন। তার নৃত্যে অভিনয় অংশ ছিল অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। কলকাতায় তিনি দেহরক্ষা করেন।

জয়পুর ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পী শিক্ষক জয়নাল মিশ্র তার জীবনের শেষ তিনটি বছর কাটান কলকাতায়। যুক্ত ছিলেন ‘বাণীবিদ্যাবীথি’র সঙ্গে। তার এক পুত্র রামগোপাল ও কন্যা জয়কুমারীর প্রচেষ্টায় কলকাতায় এই ঘরানার নৃত্যের প্রসার ঘটে। কথক নৃত্যশৈলী প্রচারে বাংলাদেশে রামগোপাল এবং জয়কুমারীর অবদান সর্বাধিক বললে হয়তো অত্যুক্তি করা হবে না । প্রহ্লাদ দাস এই নৃত্যশৈলীর আর একজন ধারক।

তার শিক্ষার কথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে যখন রামনারায়ণ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন- প্রহ্লাদ দাস তার কাছে তালিম নিলেন। প্রবীণ শিল্পী বেলা অর্ণব যিনি শম্ভু মহারাজের তালিম নিয়ে বাংলাদেশে কথক নৃত্যশৈলী প্রচারে একনিষ্ঠ আছেন তার অবদানের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।

এদের সমবেত প্রচেষ্টায় কখন নৃত্যশৈলীতে বিশিষ্ট শিল্পীদের সন্ধান পেয়েছি। উল্লেখযোগ্য হলেন মায়া চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়, রুবী বন্দোপাধ্যায়, পরিমল কৃষ্ণ, শাশ্বতী সেন, অমিতা দত্ত, মালবিকা মিত্র, সুস্মিতা মিত্র, চিত্রেশ দাস প্রমুখ। এই নৃত্যের প্রসারে বন্দনা সেনের অবদান উল্লেখযোগ্য।

শান্তিনিকেতনে তেমনভাবে কথক নৃত্য শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না হলেও এলাহাবাদের আশা ওঝা যখন মণিপুরী শেখার জন্য ওখানে যান সেখানে সে সময় ‘পরিশোধ’ নৃত্যাভিনয়ের উদ্যোগ হচ্ছিল। ১৯৩৮ সালে পরিশোধ নৃত্যাভিনয়ে উত্তীয় চরিত্রের নাচ তৈরি হলো খাটি কথক নৃত্যশৈলীতে। এই নৃত্যনির্মিত দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ছিল।

শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় এমনটি ঘটেছে বারবারই। যেমন মৃণালিনী সরাভাই যিনি শান্তিনিকেতনে ছাত্রী হিসেবে যোগদানের পূর্বে ভরতনাট্যম শিখে এসেছিলেন। তাকে পরিশোধে বজ্রসেনের ভূমিকা গানের সঙ্গে ভরতনাট্যমের নৃত্যভঙ্গিতে অবিনয় করানো হয় । তেমনি কথাকলি আঙ্গিকে ‘প্রহরী’র ভূমিকায় রূপদান করেন কেলুনায়ার ।

ওড়িশি ॥ সংযুক্তা পানিগ্রাহী খুব অল্প বয়সেই C.L.T তে ওড়িশি নৃত্য প্রদর্শন করেন। কিন্তু এই নৃত্যশৈলী তথা বাংলায় প্রথম শিক্ষাদান করেন মুরলীধর মাঝি। কটকের প্রসিদ্ধ কলাবিকাশ কেন্দ্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি এখানে আসেন। তবে এ কথা সত্য যে ‘পদাতিক’-এর উদ্যোগে গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র এখানে আসার পর থেকে (১৯৮২) ওড়িশি নৃত্যচর্চার প্রতি আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়েছে।

এই সঙ্গে সঙ্গে সংযুক্তা পানিগ্রাহীও কলকাতায় প্রায় নিয়মিতভাবে কিছুদিন শিক্ষা দান করেন। এদের সৌজন্যে সুতপা দত্ত গুপ্ত, অলকা কানুনগো, শর্মিষ্ঠা বসু, পৌষালী ব্যানার্জির মতো শিল্পী সমৃদ্ধ হয় বাংলার ওড়িশি নৃত্য জগৎ। পরবর্তীকালে কেলুচরণ মহাপাত্রের চাত্র গিরিধারী নায়েকও শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছেন ।

বর্তমানে কলকাতা শহরে, ওড়িশি নৃত্যশৈলীর প্রতি বিশেষ আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছে— চর্চাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কুচিপুড়ী : বাংলায় এই নৃত্যশৈলী তেমনভাবে প্রচার লাভ করেনি। এক সময় তারবীণ মেহেরা কলকাতায় শিক্ষা দিতেন। তারও আগে আর এস আনন্দম কুচিপুড়ী ভেঙে ভরতনাট্যম বলে শেখাতেন।

 

প্রাচ্যের নৃত্যকলা সূচিপত্র

 

বর্তমানে এই নৃত্যশৈলী অত্যন্ত নিষ্ঠাবলে যিনি শিক্ষা দেন তার নাম বেদান্তকৃষ্ণ চিন্তামণি। ডেরেক মনরো নামে যিনি পরিচিত। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নৃত্যের ঔপপত্তিক বিষয়ে গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অসামান্য কাজ করে চলেছেন রবীন্দ্রভারতীর নৃত্য বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক সুনীল কোঠারী। তিনি এ বিষযে যথেষ্ট আগ্রহসঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছেন যা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য ।

এক সময় বিভিন্ন গুরুদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এবং কিছু কিছু নৃত্য শিক্ষায়তন বাংলা তথা কলকাতায় ধ্রুপদী নৃত্যর্চার যে বীজ বোপণ করেছিলেন এখন তা প্রায় একটি আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বর্তমানে ধ্রুপদী নৃত্যচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন এবং কেউ কেউ সর্বভারতীয়ভিত্তিতে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শনেও সক্ষম হচ্ছেন।

সবশেষে বাংলায় এই নৃত্য আন্দোলনে যার অবদান সর্বাপেক্ষা অধিক তার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় শান্তিনিকেতন তথা সারা বাংলায় ধ্রুপদী নৃত্যের এত পরিচিত এত চর্চা। এ জন্য যে অসহনীয় যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়েছিল সে আর এক ইতিহাস।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment