বাংলার লোকনৃত্য: বাংলাদেশে তিন ধারার লোকনৃত্যের প্রচলন আছে – ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। এসবের মধ্যে ধর্মীয় নৃত্যের সংখ্যাই বেশি। এর পেছনের কারণ হলো, এ নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগে, যখন লোকসমাজে ধর্মীয় প্রভাব ছিল বহুবিস্তৃত। কীর্তননাচ, ব্রতনাচ, বাউলনাচ, গম্ভীরানাচ, জারিনাচ, ফকিরনাচ ইত্যাদির উৎসে বিভিন্ন ধর্মবোধ ও আচার-সংস্কার জড়িত আছে। ঢালিনাচ ও লাঠিনাচে সামাজিক উপযোগ এবং ছোকরানাচ, ঘাটুনাচ ও খেমটানাচে সাংস্কৃতিক বিনোদনের প্রেরণা আছে।

কোনো কোনো লোক নৃত্যে হিন্দু ও ইসলাম এ দুটি ধর্মের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সেগুলো মূলত এই দুই ধর্মের লোকেরাই অংশগ্রহণ করে এবং উপভোগ করে। যেমন লাঠিনাচ ও ঢালিনাচে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদ নেই। আবার ছোকরানাচ, ঘাটুনাচ ও লেটোনাচের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মুসলমান সমাজ হলেও রসোপভোগ ও চিত্তবিনোদনের জন্য এর দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত।
বাংলার লোকনৃত্য:
বাংলাদেশের লোকনৃত্যকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে :
(১) “বাংলার স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ঐতিহ্য-বৈশিষ্ট্যপূর্ণো, বাঙালীর প্রথা আচরণ আচারযত্তে, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের অঙ্গীভূত বাঙালীদের নৃত্য-গাজন, বাউল, রায়বেশে, ঢালি ইত্যাদি।
(২) বাংলার জনসমষ্টির অন্তর্ভুক্তি বাংলার অধিবাসী অবাঙালী প্রান্তিকও পাব—ত্য জাতিভেদ প্রথাপ্যন্ট লোকনত্যাদি যেমন, লেপচাদের ‘ধান’ নাচ, শেরপাদের “বিয়াছম’ নৃত্য; তিত্ত্বতীয়দের “সিঙ্গাছম’, ‘মেপাছম’, ‘চমরছিম’, ‘মুখোশ’ নৃত্য নেপালীদের ‘ডাফু’, ‘মারণী’, ‘মাদল খঞ্জনী’ নৃত্য। সাঁওতালদের ‘মোহরায়’ ‘শলাই’ পরবের নৃত্য; ওঁরাওদের ‘কারাম’ ‘জ্য ঠাথারিয়া’ নৃত্যাদি [ বাংলার লোকনৃত্য ও গীতিবৈচিত্র্য – মনি, বর্ধন, পঃ ৭৬ ]।
নিম্নে বাংলাদেশের কয়েকটি মাত্র উল্লেখযোগ্য লোকনৃত্যের পরিচয় দেওয়া হল:
বাউল :
বউল গানের মত বাউল নৃত্যও বাংলার লোকনত্যের একটি সম্পদ। এই নৃত্যের দুইটি বিভাগ-নতা ও নত্তে। এই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে প্রথমটির অঙ্গকম— ব্যঞ্জনাময় এবং দ্বিতীয়টি ব্যঞ্জনাহীন। কেবলমাত্র একতারা বা দোতারা যন্ত্র হাতে নিয়ে বা লরা একক বা সমবেতভাবে এই নৃত্য করে থাকে। “বাউল নৃত্যে অর্ধবিকশিত, নির্মীলিত, উল্লোবিত, আলে কিত, গুলোকিত, প্রভৃতি অক্ষি কম’র ব্যবহার দৃষ্ট হয়। অক্ষি কম’র বিবিধ ব্যবহার প্রযুক্ত হয় ন তাকালে, আর গানের ডাব অভিনয় করার সময়ে বাউল নৃত্যের সে অংশ নৃত্যাংশ। নৃত্যাংশ চলে গানের সঙ্গে” [ বাংল র লোকনত্যে ও গীতিবৈচিত্র্য-মণি বর্ধন, পঃ ৭৯]।
রায়বেশে:
এইটি রণনত্যের অঙ্গীভূত। বীরভূম জেলার রাজনগর, তাঁতি পাড়া ও চারকল গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে এই নাচ প্রচলিত। জমিদারদের আশ্রিত রায়বেশে গোষ্ঠী কর্তৃক এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হত বলে এর নাম রায়বেশে নৃত্যে। ঢাক-ঢোলের বাজনাসহ গোষ্ঠীরখভাবে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক কসরত বা কৌশল প্রদর্শনই এই ননৃত্যের বৈশিষ্ট্য।
কাঠি :
গড়বেতা অঞ্চলের নতো। আশ্বিন মাসে গাঁতের সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে হাতের কাঠিতে অঘাত করে করে মণ্ডলাকারে ঘরে ধারে এই কাঠি ননৃত্যের অনুষ্ঠান হয়।
লেটো :
বাঁকুড়া, বীরভূম ও মর্শিদাবাদের নৃত্যের প্রচলন আছে। এই নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যবে কর যবর্তী বেশে নত। লেটো গানের সঙ্গেই চলে লেটো নৃত্যে। এর আঞ্চলিক নাম হচ্ছে ‘ডোচেঙ্গ’। একক অথবা দ্বৈতভাবে লেটো নাচ অনুষ্ঠিত হয়।
ঝুমুর:
বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, রাঢ় অঞ্চল এবং বাংলাদেশের সীমান্তের অধিবাসীদের মধ্যে ঝুনার নৃত্যের প্রচলন আছে। মাদল এবং বাঁশীর সঙ্গে গোষ্ঠবি ভাবে এই নত্য অনুষ্ঠিত হয়। নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে ঝুনুর সুরে প্রেমবিষয়ক গান গাওয়া হয়ে থাকে।
ছৌ:
ঝাড়গ্রাম এবং এর সন্নিহিত অঞ্চলের নৃত্য। সাধারণতঃ চৈত্রের গাজন উৎসবে এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ছৌ নৃত্যে নারী-বর্জিত। ঢাক ঢোল বাদ্যের সঙ্গে বলিষ্ঠ অঙ্গভঙ্গী ছৌননৃত্যের বৈশিষ্ট্য। এই নৃত্যের অঙ্গসজ্জার অন্যতম উপকরণ হিসাবে মখোেশ পরবার প্রচলন আছে।
চালি:
সামরিক নৃত্যের অন্তর্গত। বাংলার জমিদার হাড়ী-বাগদি, ডোম প্রভৃতি বিঘ্ন জাতির মধ্য থেকে আক্রমণ এবং আত্মরক্ষার জন্য একদল শক্তিশালী যোদ্ধা প্রন্ততে রাখতেন। এদেরই বলা হত ঢালি। যুদ্ধের উপকরণ হিসাবে বর্শা, ইনডুকি ইত্যাদি এবং আত্মরক্ষার জন্য ঢাল ব্যবহার করত বলে এরা ঢালি নামে পরিচিত হয়। এই নৃত্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে দুই দলের মধ্যে ঢাল ও বর্ণাসহ যত্থের অন রূপে আক্রমণ এবং আত্মরক্ষারপ যুদ্ধের কৌশলাদি প্রদর্শন।
উপরিক্ত নৃত্যগগুলি ছাড়াও আরও বহুপ্রকার নৃত্যের দ্বারা বাংলার লোকনৃত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। এই সকল লোকনতাদির মধ্যে গাজন উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন নৃত্যে যেমন, কালীকাচ, দশাবতার নৃত্য, বোলান গ জনের নৃত্য, ঘোড়া নাচ, বড়াবাড়ীর নৃত্য, বাইচণ্ডীর নৃত্য ইত্যাদি, মংখোশ নৃত্য, পাইকান নৃত্য, পাতা নৃত্য, খেমটা নতা, ঘাটু নতো বোতল নৃত্য, জারি নতা, মেচেনী নৃত্য, ভাদ, টুপুর নৃত্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলার প্রান্তিক এবং পার্বত্য উপজাতিদের মধ্যেও নানা প্রকারের নৃত্যের প্রচলন আছে, যেমন, লবয় নতা, ভুনগার নাচ, ডাশারে ভুয়াং ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: