আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় প্রাচীন বাংলার নৃত্য প্রসঙ্গে চর্যাপদ সাইমন জাকারিয়া , যা বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রাচীন বাংলার নৃত্য প্রসঙ্গে চর্যাপদ সাইমন জাকারিয়া
প্রাচীনকালে নাটকমাত্রই নৃত্য আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। যার প্রমাণ খোদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে মিলছে। চর্যার ১৭ সংখ্যক পদে বলা হয়েছে-
নাচন্তি বাজিল পান্তি দেবী
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই
এই পদটিকে সাধারণত প্রাচীন বাংলা নাটকের আলোচনাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ পদে যে প্রাচীন বাংলা নৃত্যের কথা বিবৃত আছে, সে কথা অনেকেই হয়তো ভুলে যান। এতদ্ব্যতীত চর্যাপদের আরোধিক স্থানে নৃত্য এবং নৃত্যাহার্যের বর্ণনা পাওয়া যায়, যার সাথে।
অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে তিব্বতের সন্ধ্য বিহারে প্রাপ্ত চর্যাপদকর্তাদের জীবনবনৃত্তান্ত এবং সাধনমুদ্রায় নৃত্যরত, বাদ্যবাদন বা সঙ্গীত পরিবেশনরত পদকর্তাদের রেখাচিত্র এবং চর্যার সমসাময়িককালে নির্মিত সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে প্রাপ্ত টেরাকোটার উৎকীর্ণ নর-নারীরা বিভিন্ন ধরনের নৃত্যভঙ্গি বা অঙ্গভঙ্গির চিত্রগুলো মিলিয়ে নিয়ে আলোচনা করলে প্রাচীন বাংলার নৃত্যরীতি বা নাট্যরীতি সম্পর্কে কতিপয় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতে পারে।
কারণ, বঙ্গীয় নৃত্যরীতি সম্পর্কে আমাদের দ্বিধা আদ্যোধি কাটেনি। আসলেই কি বাংলার নিজস্ব কোনো নৃত্যরীতি আছে? এ প্রশ্ন তো সব সময় আমাদের মনে রয়েছে। কিন্তু উত্তর অন্বেষণের জোরালো তাগিদ তেমনভাবে দেখা যায়নি। তবে, চর্যাপদে ফিরে গেলে বাংলার হাজার বছরের নৃত্যকলা সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যা নিয়ে নতুনভাবে ভাবনা-চিন্তা করা সম্ভব।
চর্যাপদের নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যাহার্য বাংলাভাষার প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যে চর্যাপদেই যেমন প্রথম নাটক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া
যায়, তেমনি নৃত্য শব্দটির ক্ষেত্রেও সে কথাটি অপ্রয়োজনীয় নয়। নৃত্যানুসঙ্গের একাধিক উল্লেখ চর্যাপদে আছে। চর্যাপদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রাচার্য (পুরুষ) নাচছেন আর দেবি (নারী) গান করছেন— এর ফলে বুদ্ধনাটক বিপরীতভাবে অনুষ্ঠিত হলো।
অর্থাৎ সেকালে উৎসবে বা আনন্দানুষ্ঠানে নৃত্যগীতির নাট্য পালা অভিনীত হতো। সেই পালায় স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই অংশগ্রহণ করত। স্ত্রীলোকের পক্ষে নর্তকীর ভূমিকা পুরুষের পক্ষে গায়কের ভূমিকাই ছিল এই নৃত্যগীতির সাধারণ রীতি। এইক চর্যায় প্রাচীনকালের নৃত্যগীত পরিবেশনায় ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
গোপীযন্ত্রের মতো লাউয়ের খোলায় বাঁশের ডাঁটি লাগিয়ে তার সঙ্গে তাঁত বা তন্ত্রী জুড়ে এক রকম বীণার মতো যন্ত্রের উল্লেখ পাচ্ছি। সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্ত্রী/অপহা দাণ্ডী চাকি কিঅত অবধূতী/বাজই আলো সহি হেরুঅ বীণা। সুন তান্ত্রিধ্বনি বিলসই রুণাঃ-সূর্য-লাউয়ে শশী লাগল তন্ত্রী, অনাহত দাও-সব এক করে দিল অবধূতী। ওগো সখি, হেরুক বীণা বাজছে। শোন, তন্ত্রী ধ্বনি কী করুণ সুরে বাজছে। অর্থাৎ এই বাদ্যের সুর তালে নৃত্যগীতি সম্পন্ন হচ্ছে।
ডোম, কাপলিক, নট ইত্যাদি জীবিকার এবং জাতির লোকদের মধ্যে নৃত্য করা কিংবা গীত বাদ্যের সমাদর করা খুবই প্রচলিত ছিল মনে হয়। সেই সময়ে বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরে এমন এক শ্রেণীর লোক বোধ হয় ছিল, যারা নাচ-গান করেই জীবিকা নির্বাহ করত। ১০ সংখ্যক চর্যায় উল্লেখ নড়পেড়া শব্দের অর্থ যদি নটপেটিকা হয় তবে দেখা যায় যে, সেকালে ছোট পেটিকা বা পেটরায় নটনটীর সকল সাজপোশাক থাকত। আর পেটরায় সাজপোশাক রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত পেশাজীবীদের পক্ষে সঙ্গত।
এ পদে নৃত্য পটিয়সী ডোম্বীর সুষম নৃত্যকলার কথা বেশ স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে- এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ী।/তঁহি চড়ি নাচা ডোম্বী বাপুড়ি৷ (একটি সে পদ্মের চৌষট্টিটি পাপড়ি। তাতে চড়ে নাচে ডোম্বী বেচারি) একই পদে পদকর্তা কাহ্নপাদ ডোম্বীর নৃত্যগুণমুগ্ধ হয়ে প্রেম নিবেদনে প্রশ্ন করেছেন, আলো ডোম্বী তু পুছমি সদভাবে।/আইসসি যাসি ডোম্বী কাহেরী নাবে৷ (ওগো ডোম্বী, তোমাকে সৎভাবে জিজ্ঞাসা করছি, ডোম্বী কার নৌকায় তুমি আসা-যাওয়া করো।)
চর্যার এই পদটি থেকে অনেকে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেকালে নিম্নবর্ণের নারী-পুরুষেরা নৃত্যগীতাভিনয় প্রদর্শনের জন্য নানা স্থানে আসা-যাওয়া করত। ১১ সংখ্যক চর্যায় প্রাচীন বাংলার নৃত্য বা নাট্যাহার্য হিসেবে নেউর বা নূপুর, ডমরু এবং নৃত্যকালীন অঙ্গ আভরণ হিসেবে কুণ্ডল ও মুত্তিহার বা মুক্তাহার-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।এতদ্ব্যতীত চর্যার ১৭ ও ১৯ সংখ্যক পদে হেরুঅ বীণা বা হেরুক বীণা, পড়হ বা পটহ, মাদলা বা মাদল করও বা ঢোল, কশালা বা কাঁসি, দুন্দুহি বা দুন্দুভি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে।
চর্যায় বর্ণিত নৃত্যগীত প্রসঙ্গে নতুনভাবে দৃষ্টিপাত করেছেন অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের চর্যার সংগ্রাহক ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-৬৪)। তিনি ১৯৬৩ সালে নেপাল থেকে ১০০টি নতুন চর্যাপদ সংগ্রহ করে আনেন এবং জানান- তার সংগৃহীত চর্যার গানগুলো পাওয়ার সময় পর্যন্ত নেপালে বজ্রাচার্যরা তা নৃত্যগীত সহযোগে পরিবেশন করত এবং নাচ-গানের সময় হাতে লেখা পুঁথি ব্যবহার হতো।
এই রকম ব্যবহারে কোনো পুঁথি নষ্ট হয়ে গেলে তা আবার নকল করে নেওয়া হতো। গবেষকের অত্র বক্তব্য হতে প্রতীয়মান হয় যে, চর্যার পদ বা গানগুলো মূলত নৃত্য ও গীত পরিবেশনার পাণ্ডুলিপি।জীবনবৃত্তান্ত, রেখাচিত্র এবং সোমপুর বিহারের টেরাকোটা চর্যার সময়ে বা পাল আমলে বাংলায় গড়ে ওঠে সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বিহার।
চর্যার অন্তত দুজন পদকর্তা পণ্ডিত ভিক্ষু বা সিদ্ধাচার্য হিসেবে সোমপুর বিহারে অবস্থান করেছেন। অতএব প্রাচীন বাংলা নৃত্যের আলোচনায় পাহাড়পুর (সোমপুর বিহার) ও তার গাত্রে উৎকীর্ণ টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলককে বিবেচনা করা দরকার।
কেননা, গবেষকদের ধারণা, উক্ত টেরাকোটাসমূহে সেই সময়ের বাংলায় প্রচলিত নৃত্য, গীত ও নাট্য পরিবেশনার বহু চিত্র ধৃত আছে। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের গ্রন্থে সন্ধ্য বিহারের প্রাপ্ত তালপত্রে চর্যার আঠারোজন পদকর্তার পরিচয় ও রেখাচিত্রের সন্ধান মিলেছে, যাতে সুস্পষ্টভাবে বেশ কয়েকজন পদকর্তাকে গীতবাদ্যনৃত্য বা প্রাচীন বাংলা নাট্য পরিবেশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চর্যার সর্বাধিক পদের রচয়িতা হচ্ছেন কাপা কাপার জন্ম কিছুটা মতভেদ
থাকলেও, কাহ্নপার সোমপুর বিহার বাস নিয়ে কারো কোনো মতভিন্নতা নেই। দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৬-৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে) কাহ্নুপা পণ্ডিত ভিক্ষু নামে খ্যাত হয়ে সোমপুর বিহারে অবস্থান করেন।কাহ্নুপা নিজে সম্ভবত গীত পরিবেশন করতেন। তিনি তার পদের ভণিতায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন—কাহ্নে গাই তু কাম চণ্ডালী। ডোম্বী তো আগলি নাহি ছিগালী।
(চর্যা-১৮) এখানো কাহ্নে গাই (কাহ্নু গাইছে) ভণিতা দৃষ্টে কাহ্নুপার একাধিক পদে বাদ্য, গীত, নৃত্য প্রসঙ্গ এবং সেকালের বাদ্যযন্ত্র ডমরু, পটহ, মাদল, কারও বা ঢোল, কাঁসি এবং নৃত্যে ব্যবহৃত কিছু সাজ অলঙ্কার বা আভরণ- ঘণ্টা নূপুর, কুণ্ডল, মুক্তাহার, হাড়ের মালার উল্লেখ আছে। অন্যদিকে তিব্বতে প্রাপ্ত রেখাচিত্রে কাপাকে নৃত্যমান দেখা যায়। রেখাচিত্রে কাহ্নুপা দুপা ফাঁক করে নৃত্যের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো।
তার পরনের ধুতি হাঁটুদ্বয়ের উপর পর্যাপ্ত বিস্তৃত, খুব সম্ভবত একটি উত্তরী বাপার ডানকাঁধ হতে বক্ষ বরাবর এসে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কাহ্নুপার বাঁ হাতে কিছু একটা ধরা, তালু ঊর্ধ্বমুখী। ডান হাতটা তির্যকভাবে নিচে নামানো, তবে রেখাচিত্রের অস্পষ্টতার কারণে ডান হাতের ভঙ্গিটা তেমন বোঝা গেল না। কিন্তু এ হাতের নিচে জল থেকে জোড় হস্তে একজন নারীর আকৃতি বোঝা যায়।
এতক্ষণে রেখাচিত্রে কাহ্নুপাকে নৃত্যরত দেখে এবং তার রচিত পদসমূহে নৃত্য গীত বাদ্যের উল্লেখ দেখে কাহ্নুপাকে প্রত্যক্ষভাবেই নৃত্যগীত বা নাট্য সংশ্লিষ্ট বলে অনুমান করা যায়। কাহ্নুপা আবার সিদ্ধাচার্য হিসেবে সোমপুর বিহারে অষ্টম শতকে অবস্থান করেছিলেন, তাই তার উপস্থিতির সময়ে সোমপুর বিহারে গীত, নৃত্য বা নাট্য পরিবেশিত হওয়া একেবারে অমূলক নয়।
অবশ্য, সোমপুর বিহারের টেরাকোটায় নৃত্য, বাদ্য ও নাট্যে ব্যবহৃত সাজ বা পোশাক সম্পর্কে অন্তত তিন ধরনের পরিবেশনা চিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। বহু টেরাকোটায় নারীর নৃত্য ক্রিয়া এবং নরের বাদ্য বা ঢোল বাদন ক্রিয়া দেখা যায়। টেরাকোটায় উৎকীর্ণ একজন বাদ্য বাদককে কাহ্নুর পদে উদ্ধৃত ডমরু বাদনরত বলে অনুমান করা গেছে।কাহ্নপা ব্যতীত আরেকজন চর্যাপদকর্তা বিরূপা ভিক্ষুরূপে সোমপুর বিহারে বাস করতেন। অষ্টম শতকে দেবপালের রাজত্বকালে তিনি সেখানে অবস্থান করেন।
চর্যায় বিরূপার একটি পদের সন্ধান মিলেছে। রেখাচিত্রে বিরূপা মহার্ঘ্য আসনে সমাসীন, বাঁ হাত কোলের কাছে ন্যস্ত, হাতে কথন আছে, ডান হাতের তর্জনী উত্থিত, বৃদ্ধাঙ্গুল স্বাভাবিক কিন্তু অন্য তিনটি আঙুল ঈষৎ বাঁকানো। এ ধরনের রেখাচিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অনেক টেরাকোটা সোমপুর বিহারের দৃষ্ট হয়। এ ছাড়া তান্তিপা, মীনাপার নৃত্য ভঙ্গির রেখাচিত্রের সাথেও এ বিহারের টেরাকোটাগুলোর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
দেবপালের রাজত্বকাল অষ্টম শতকে বর্তমান ডোম্বীপার রেখাচিত্রে দেখা যায়- ডোম্বীপার দুই হস্তে বিশেষ জ্যামিতিক ভঙ্গির মতো ধৃত আছে বিশাল একটি পাইথন। ডান হাত ঊর্ধ্বমুখী সাপের ঊর্ধ্বাংশ এবং বাঁ হাতে সাপের নিম্নাংশ ধৃত। ডোম্বীপার সমসাময়িককালে পাল আমলের সোমপুর বিহারে প্রাপ্ত টেরাকোটায় ডোম্বীপার রেখাচিত্রের মতো সর্বধৃত নৃত্যের দু- একটি চিত্র দৃষ্ট হয়।
যেমন, সেখানে প্রাপ্ত একটি টেরাকোটায় দেখা যায়, দুই হস্তে যথাক্রমে দুটি ত্রিভুজ আকৃতির ভঙ্গিতে একটি মাত্র সাপ ধৃত অবস্থায় একব্যক্তি নৃত্যরত। তার পদদ্বয়ের ভঙ্গি সম্মুখগামী। ব্যক্তিটির গায়ে তেমন কোনো বস্ত্র নেই, পরনে কেবল এক চিলতে কাপড় বেশ আঁটসাঁট করে বেঁধে রাখা। রেখাটিত্রে সর্পধৃত ডোম্বীপা যেখানে বাঘের পিঠে সম্মুখবর্তী, টেরাকোটায় উৎকীর্ণ ব্যক্তিটি সেখানে সর্পধৃত নৃত্যে সম্মুখগামী।
এ ক্ষেত্রে এই দুটি চিত্র থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব নয় যে, সাধনকথার নাটকীয় সাধনমুদ্রাগুলো প্রাচীনকালে নৃত্য বা নাট্যকারে কখনো কখনো নিস্তয় পরিবেশিত হতো। পদকর্তাদের জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে তিব্বতে প্রাপ্ত পদকর্তাদের রেখাচিত্র ও সোমপুর বিহারে প্রাপ্ত টেরাকোটায় উৎকীর্ণ বিভিন্ন ধরনের নৃত্যভঙ্গি, বাদ্যবাদন বা সঙ্গীত পরিবেশন ক্রিয়া, সাধনাসন, কর্ম বা অভিনয়ক্রিয়া ইত্যাদিতে যথেষ্ট সাদৃশ্য দৃষ্টে প্রাচীন বাংলার নৃত্যগীতি বা নাট্য পরিবেশনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু ধারণা করা একেবারে কষ্টসাধ্য নয়।
আরও দেখুনঃ