প্রকৃত খেঁচুনি নাচ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – প্রকৃত খেঁচুনি নাচ।যা “সারা বিশ্ব জুড়ে নাচ” খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

প্রকৃত খেঁচুনি নাচ

 

প্রকৃত খেঁচুনি নাচ

 

যে সমস্ত জনগোষ্ঠী নাচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং যারা নাচের ব্যাপারে ভিন্ন ধরনের তাদের উভয়কে নাচের মধ্যে বিবেচনা করলে আমরা একটা মৌলিক বৈপরীত্য লক্ষ্য করি যেটা হল, সমন্বিত শরীরের নাচ ও সমন্বয়হীন শরীরের নাচ।

দূর্বল যা এমনকি অশালীন সম্ভবতঃ হেলেনীক বিশ্বের এটাই সেই বৈপরীত্য যেটা প্লেটো উল্লেখ করেছেন যখন তিনি মর্যাদা সম্পন্ন সুন্দর দেহছন্দ একদিকে অন্যদিকে ব্যাঙ্গাত্মক কুৎসিত দেহবিক্ষেপনের মধ্যে দুই ধরনের নাচ পার্থক্য করেছেন।

এই বৈপরীত্যের শুরুতে আমরা হৃদয়াঙ্গম করতে এবং অনেক নাচের দেহ ভঙ্গিমাগুলি সুশৃঙ্খল করতে চেষ্টা করতে পারি। শরীরের বিরোধী তাৎপর্য ও প্রকৃতি হল বাহ্য। বাহ্যিক খেচুনিমূলক নাচ আমরা দেখি ভেড্ডাদের তীর-নাচে। কম্পমান পাকে বেঁচুনিদেয়, হাঁপাতে হাঁপাতে গান বের করে, ভীত সন্তস্ত্র উত্তেজনার মধ্যে নাচুয়েগণ কাজ করে, শরীর দিয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরে, অবসন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে, সমস্ত শরীর কাঁপতে কাঁপদে দুলতে থাকে।

প্রায় এই রকম বর্ণনা দেখা যায়। উত্তর-পূর্ব এশিয়ার চুকচীগণ সময়মত উপরে নিচে লাফ দেয়, চোখ ঘুরায় ডানে বায়ে ও কাঁপন দেহভঙ্গিতে নিজেদের নিক্ষেপ করে। এই রকম সাদৃশ্যপূর্ণ আফ্রিকান নাচের অনেক বিবরণ পাওয়া যায় ।

ওয়নয়ামওইজের ওয়েইর গুপ্ত-সমাজের লোকেরা পূর্ণিমা রাতে গোল হয়ে একত্রিত। তিন থেকে পাঁচ জনের ঢোল বাদক ও কয়েকজন পারদর্শী নাচুয়ে মাঝখানে অবস্থান নেয়। বাদকগণ লাইন করে আসনে বসে অবিরামভাবে চল ছন্দে তাদের বাদ্যযন্ত্র পিটাতে থাকে। নাচুয়েগণ গোলকের মধ্যে গোড়ালী আঘাত করে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে অনেক বার ঘুরতে থাকে ।

নাড়ুয়েদের দিকে বাদ্যযন্ত্রীগণ এক দৃষ্টিতে তাকায় থাকে। হঠাৎ করে নাচুয়েগণ প্রচন্ড গতিতে দুলতে থাকে। তাদের দেহের সমস্ড অঙ্গ প্রত্যাঙ্গ নাড়া যায়, সকল মাংসপেশী খেলতে থাকে তাদের কাঁধের অংশ এত দ্রুত ঘুরতে থাকে যে, মনে হয় সেটা আর শরীরের অংশ না।

তেমনই প্রচন্ড উচ্চ প্রতিশব্দে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেই থাকে বাজাতেই থাকে। আপাদমস্তক ঘর্মাক্ত নাচুয়েগণ আরো সুস্পষ্ট বন্য দেহভঙ্গিমা করতে থাকে। এখন তারা একটা নিশ্চল মূর্তিতে পরিবর্তীত হয় শুধু শরীরের উপরের ভাগের মাংসপেশীর স্পন্দন ফুটতে থাকে। যখন তাদের উত্তেজনা চরমে পৌঁছে হঠাৎ তারা বজ্রাঘাতপ্রাপ্ত (ঠাটা পড়া) ব্যক্তির মত মাটিতে পাথরের মত অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার তারা নতুনভাবে খেলা শুরু করে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সলোমন দ্বীপুঞ্জের নাচের একটা ছকের মত বিবরণ আমাদের আছে। “ধরা ধরা যাক একটা গ্রামের মুক্ত স্থান চারদিকে আদিবাসীদের কুঁড়েঘর দিয়ে ঘেরা। নারিকেল গাছের সারির মাঝে সুউচ্চ ঘন গাছের ডাল-পালায় চারদিকে অন্ধকার। তারা একটা বড় গোলকে নগ্ন হয়ে বসে বা শুয়ে আছে।

দপদপ করে জ্বলা আগুনের কুন্ডলীর আলোতে দেখা যায় প্রবীণ চার বা পাঁচজন লোক চুপে চুপে তীর, ধনুক, বল্লম হাতে নিয়া গোলকের মাঝখানে হেঁটে আসে তাদের অনুসরণ করে যুবকগণ প্রবীণদের মধ্যে রেখে ঢাকার স্পোকের মত ঘিরে থাকে পরে অর্ধ-প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা বাহিরের দিকে বেষ্টনী তৈরী করে।

এবারে প্রবীণগণ একঘেয়ে চীৎকার শুরু করার সঙ্গে সবাই চীৎকার করতে করতে সমস্ত জনতা আস্তে আস্তে কেন্দ্রবিন্দু ঠিক করে ঘুরতে থাকে। সহসা পদক্ষেপ দ্রুত হতে শুরু করলে বাইরের দিকের নাচুয়েদের লম্বা লাফ দিয়ে চলতে হয় সবার সঙ্গে তাল ঠিক রাখার জন্য।

তীব্র চিৎকার, অস্ত্রের ঘট-ঘটানী উর্ধমুখি চড়কী ঘুরানোর মধ্যে উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে এত চরমে পৌঁছতে থাকে যে, নাচুয়েরা আপদমস্তক ঘামে গোসল করে, কেউ কেউ দল ভেঙ্গে বন্য উন্মাদনায় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। এই নাচের সঙ্গে বিকট চিৎকারে গান এতই অবর্ণনীয় বন্যতায় ভরে যে, কেউ প্রত্যক্ষ করলে গা শিহরীত না হয়ে পারে না” ।

এমন অতি প্রাচীন আদি জনগোষ্ঠীর (টাইব) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম বলে প্রতীয়মান হয়। মার্শাল ও গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জের নাচুয়েগণ যা করে সেটা হল দৌড়ায় ও সামনে পিছনে লাফালাফি করে, গেহকে সজোরে নিক্ষেপ করে যেন চমক লাগে, চোখ ঘুরায়ে, বাহু পা দুলায়ে হাত নেড়ে পৈশাচিক শব্দে বন্য চিৎকারে ড্রাম পিটে গান বাজনা করে।

পুরানো মালে নাচে বন্যতা কম কিন্তু হর্ষোৎফুল্ল। আমরা বালির বিস্ময়কর অদ্ভুত নৈশ উৎসব সম্পর্কে জানি। দুই যুবতী শান্ত-নম্র আকর্ষণীয় ভাবে নাচে। যেমন গায়ক গায়িকা ঘনিষ্ঠজুটি হয়ে ঘুরে ফিরে সর্বক্ষণ। তারা একই তালে ডানে বায়ে সুরের আবেশে দুলে অথবা তীব্র শব্দে ঝাঁকানি খায়।

হঠাৎ তারা সকলে উচ্চ চিৎকারে একসঙ্গে উদ্বেলিত হয়ে নিজেদের পিছনে নিয়ে যায়। গোলকের মধ্যে তারা এমন গাদাগাদি করে যে, একজনের উপরে আর একজন মনে হবে বিরাট একটি ফুল ফুটে আছে। অথবা চূড়ান্ত পর্বে অলৌকিক (হু-উ-উ-) শব্দ মনে হয় গভীর পাতাল থেকে ইকো হয়ে ক্রমান্বয়ে দূরে মিলায়ে যাচ্ছে, তারা মাথা এক জায়গায় জড় করে একটা স্তুপাকৃতি করে। “THE ISLE OF DEMONS নামক সদ্যনির্মিত জার্মান চলচ্চিত্রে বালি দ্বীপপুঞ্জে ছবি নেয় ।

এই সকল প্রচন্ড দেহবিক্ষেপ নাচের বর্ণনায় বোঝা যায় যে, সজোরে দেহ বাঁকানো স্বাভাবিক মাংসপেশীর চর্চার মধ্যে দেহকে বন্যতার শিকার হতে হয়। শরীরের কোন অংশের উপর সম্পূর্ণ বা কোন কোন ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তি আয়ত্তে থাকে না সজ্ঞানতা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থাকে কোন ভাবেই কর্মকান্ড বলা যায় না বরং এটা এক রকম ভোগান্তি বা কষ্টসাধ্য কাজ বলা যায় ।

যদিও এই দুঃখজনক নাচ কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এরা কখনই ব্যাপকভাবে ছড়ান না। যদি আমরা সর্তকতার সঙ্গে তাদের প্রসারের পরিধি চিহ্নিত করি তবে আমরা এশিয়াতে ত্রিভূজ আকৃতি দেখতে পাব। যার দূরের কোণ ঢুকচি উপদ্বীপের উত্তর-পূর্ব থেকে মূলক্ষেত্র প্রসারিত সিংহল হয়ে মালে দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে পূর্ব-মাইক্রোনেশিয়া পর্যন্ত। আরো যোগ হতে পারে আফ্রিার পূর্ব-পশ্চিম বান্টু ট্রাইব (জনগোষ্ঠ) এবং ইউরোপে তার উদাহরণ প্রাচীন গ্রীস, বুলগেরীয়ায় স্লাভগণ এবং মধ্যযুগে পশ্চিম ও মধ্যের কতিপয় দল।

ছবিটা এখন পরিস্কার। খেঁচুনি যুক্ত নাচ ফকিরতান্ত্রিক কৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। এটা প্রতিভাত হয় সেখানে যেখানে যাজকীয় মর্যাদা এবং ওঝা অথাবা কবিরাজের হাতে যাদুশক্তির ক্ষমতা থাকে, যার ফলে অদ্ভুত জাতিগত ঝোঁক অথবা কৃষ্টিগত প্রভাব, ধর্মীয়

অভিজ্ঞতা এবং ভক্তির পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে মোহাবিষ্ট পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। আমরা বালিতে গ্রাম্ভিক বৈশিষ্ট্যের পরিষ্কার উদাররণ দেখি। এখানে বৌদ্ধ ধর্ম শুধুমাত্র সর্বপ্রাণবাদীর উপরে অবস্থান করে। আমরা প্রায় স্পষ্টতঃ দেখি এর নিম্নর স্তরে কি আছে।

ডি-ক্যাট-এপ্রোলিনো একজন পুরোহিত কে লক্ষ্য করছেন খুবই হর্ষোৎফুল্ল আবেশে উৎসব যাত্রায় খেঁচুনি দিয়ে যাচ্ছেন। বৌদ্ধ পুরোহিতের পোশাকে আমরা উৎফুর (শাহম্যান) ভিক্ষু বা ফকির দেখি। বালিতে খেঁচুনি যুক্ত নাচ প্যাগোডা পর্যন্ত পৌঁছেছে।

যদি খেঁচুনি যুক্ত নাচ ফকিরতান্ত্রিক কৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তবে আমাদের উচিৎ হবে না আমেরিকাকে এই সারাংশে যুক্ত করা। কিন্তু হায়র অন্য ব্যাপারে দেখান যে, সাধারণভাবে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানগণ সাময়িক উত্তেজনার স্তরের বাইরে উন্নতি করেছে। এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে খেঁচুনি যুক্ত নাচের প্রবণতা আছে।

যদিও ক্যালিফোর্ণিয়গণ সাধারণভাবে খেঁচুনি থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরদের কাছে একটা রিপোর্ট আছে, তথাকথিত কুকসু নামক আরাধনায় সময়িক উত্তেজনাপূর্ণ ও রক্তাক্ত মুখের নাচ দেখা যায়। এটা একটা ধর্মীয় ভক্তি-পদ্ধতি উৎসব যা পরে ক্যালিফোর্ণিয়া (উনটান) ছোট মুখ বিশিষ্ট ড্রাম যুক্ত করে যখন পরবর্তী সাংস্কৃতিক দল সেটা বিশোষণ করে। অতএব, বলা যায় এটা একটা কৃষ্টির প্রভাবের ফল। সত্য, কিন্তু এই রকম পূর্ব অনুমানক্ষম প্রভাব একটা গভীর প্রবৃত্তি অথবা দ্রুত ধারণক্ষম স্বভাব।

 

প্রকৃত খেঁচুনি নাচ

 

এই উদহরণে দেখা যায় “অপরিবর্তনীয় রক্তের ধারা” অথবা “বিবর্তিত কৃষ্টির ধরা” একটা সতর্কপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করে। এটা থেকে, শেষ পর্যন্ত একটা তীব্র বিপরীত অস্তিত্ব প্রকট থাকবে যদি একদিকে অবিমিশ্র রক্ত অন্যদিকে কৃষ্টি অন্য সব থেকে আলাদা হয়েও জাতির অধিকারে থাকে অন্য কথায় বলা যায় দৈহিক নৃতত্ত্ব ও এখনলজি (মানব জাতির ইতিহাস) মিশ্রিত করা বুদ্ধিমানের কাজ না।

কিন্তু যতই আদিম হোক প্রত্যেক ব্যক্তি অসংখ্য সংস্পর্শের ফসল। যদিও কৃষ্টি যাইহোক না কেন, যে কোন ভূখণ্ডে বহন যোগ্য। সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা গ্রহণ করে তাদের অনুকূল অবস্থার উপর নির্ভর করে। এইভাবে জাতিগত ও কৃষ্টিগত প্রভাবের প্রশ্নে যুক্তিহীন দৃঢ়তা মূল সমস্যা বিভাজন করে আরো প্রকট করে তুলে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment