আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পুরুলিয়া ছৌ কপিলা বাৎস্যায়ন , যা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য এর অন্তর্ভুক্ত।
পুরুলিয়া ছৌ কপিলা বাৎস্যায়ন
উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ ছৌ ও বিহারের সেরাইকেলা ছৌ গতিভঙ্গি ও নৃত্যশৈলীর দিক থেকে একে অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত, অপরপক্ষে বাংলার পুরুলিয়া ছৌ একই সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যের আরেকটি দিক উন্মোচিত করে ।
শেষোক্ত নৃত্যরূপটি একদিকে ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের স্মারক সামরিক আড়ম্বর ও ধ্রুপদী শৈলী প্রকাশক, আবার অন্যদিকে সেরাইকেলা ছৌয়ের মতো মুখোশ নৃত্যনাট্যের একটি শ্রেণী ।
ময়ূরভঞ্জ ও সেরাইকেলা ছৌয়ের মতো পুরুলিয়া ছৌয়েতেও সাহিত্যঘটিত আকরিক উপাদানসমূহের স্বল্পতা লক্ষণীয়। অথচ এই জাতীয় উপাদান ভারতের নাট্যমঞ্চ ও নৃত্যনাট্য রূপের সঠিক অনুধাবনের জন্য কত না প্রয়োজনীয়। এইদিক থেকে এই ত্রয়ী শিল্পরূপ তিনে মিলে একটি গুচ্ছের মতো।
তারা এমন এক দৃষ্টান্তের কারক, যেখানে ধ্রুপদী বিষয় গ্রামীণ ও উপজাতীয় সমাজে ঢুকে গেছে অথচ সাহিত্যিক বাক ও সুবিন্যস্ত কাব্যিক রূপ ন্যূনতম মাত্রায়ও সেখানে অনুপ্রবেশ করেনি।
যদিও এই নৃত্যরূপগুলোর গল্পাংশ রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণাদি থেকে নেওয়া এবং কখনো কখনো কাব্যসকল হতেও গৃহীত, তা সত্ত্বেও আবৃত্তিমূলক শব্দ এবং গেয় কবিতা, এই জাতীয় রচনার অপরিহার্য উপকরণ হয়েও যেন এখানে একটা গৌণ ভূমিকা পালন করছে। পুরুলিয়া ছৌ কিন্তু সেরাইকেলা ছৌয়ের মতো রাজাদের দ্বারা পরিবেশিত হয় না ।
পরিবর্তে এটি এমন এক জনগোষ্ঠীর অনুশীলনের এক্তিয়ারের মধ্যে রয়েছে, যাদের আর্থসামাজিক পরিভাষা অনুসারে অনুন্নত শ্রেণী বলে অভিহিত করা হয়। অধুনা তারা হয় গ্রামবাসী কৃষিজীবী চাষি, ক্ষেতমজুর নয় তো রিকশাচালক। কিন্তু তাদের অনুন্নত শ্রেণীর লোক কিংবা রিকশাচালক বললেই সব কথা বলা হয় না।
তারা একইসঙ্গে একটা সুসমৃদ্ধ ও সমুন্নত নৃত্য তথা নাট্য ঐতিহ্যের ধারকও বটে। আমাদের তাই আবারও স্থান ও কালের প্রসঙ্গটির কথা চিন্তা করতে হবে। ওই স্থানিক ও কালিক পরিস্থিতির জন্যই ছৌ নৃত্যরূপটির এতদূর সুউচ্চ পরিশীলিত অবস্থা সম্ভব হয়েছে এবং এমন সব ঐতিহাসিক বহুলতার সৃষ্টি হয়েছে, যা নৃত্যরূপটিকে আকারায়িত করেছে।
বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের মতোই পুরুলিয়া ছৌ জনপ্রিয় ও লৌকিক, আবার ভেতরের দিক থেকে দেখতে গেলে বিদগ্ধ ও সুগঠিত । পুরুলিয়া নামক অঞ্চলের ভৌত ভৌগোলিক ও গ্রামীণ বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যান্য সন্নিহিত অঞ্চলের সঙ্গে তার সাযুজ্য ও স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণগুলোকে চিহ্নিত করার পক্ষে নিজেরাই অনেক চাবিকাঠির সন্ধান দেয়।
পুরুলিয়া মাত্র ১৯৫৬ সালে একটি জিলায় পরিণত হয় । অ নুমানিক ২০০০ বর্গমাইল পরিমাণ ভূখণ্ড উত্তরে, পশ্চিমে ও দক্ষিণে বিহার এবং পূর্বে বাংল র দ্বারা পরিবেষ্টিত। পুরুলিয়া আদিতে মানভূম জিলার একটি মহকুমা ছিল, প্রথমে বাংলার পরে বিহার ও উড়িষ্যার। মানভূম জিলা পরে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়, পুরুলিয়া ও ধানবাদ।
পুরুলিয়া একটি জিলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। ধানবাদ বিহারের জিলায় পরিণত হয়। পুরুলিয়া অঞ্চলের মৃত্তিকা বেশির ভাগ অংশে কর্ষণ অযোগ্য, অনুর্বর ও পাহাড়ঘেরা। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সামান্য, যে যে এলাকায় চাষ-আবাদ সম্ভব সেখানে ধানই হলো প্রধান শস্য। অঞ্চলটি বহু তপশীলভুক্ত উপজাতি মানুষ দ্বারা অধ্যুষিত।
এসব তপশিলী জাতি-উপজাতি ভারতের পূর্বাঞ্চলে বহুসংখ্যায় বিদ্যমান। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কতিপয় উপজাতি হলো- ভূমিজ, মুরা, সাঁওতাল ও কুর্মি। হিন্দুবর্ণের লোকজনেরা আশপাশের এলাকাগুলো থেকে এই এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছে। তবে তারা জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশ মাত্র, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় নয়।
শহর খুবই কম, যে কটিও আছে তাও দূরে দূরে অবস্থিত। দুই হাজারেরও বেশি গ্রামে ঘেরা এই অঞ্চল অষ্টিকভাষী গোষ্ঠী ভূমিজরা জনসংখ্যার গরিষ্ঠ ভাগ। তাদের দাবি, তারাই এই এলাকার আদি বাসিন্দা। তাদের এই দাবি সত্যি হতে পারে নাও হতে পারে।
তবে এ কথা সত্য যে, এই ভূমিজ সম্প্রদায় থেকে এক সামন্ত সর্দার শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যারা পরে নিজেদের রাজা ও ক্ষত্রিয় বলে আত্মপরিচয় দেন।
এদের কিছুসংখ্যক হিন্দুধর্মের মূল ধারার দ্বারা প্রভাবিত হন, মন্দির ও দেবদেউল নির্মাণ করান, তা সত্ত্বেও একটা গোটা জনসমষ্টি হিসেবে সম্প্রদায়টি কৃষিজীবী স্তরেই থেকে যায় এবং তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস ও সংস্কারের অনুবর্তী হয়ে চলতে থাকে। এ ধরনের উচ্চাবচ স্তরবিন্যাস আমরা ভারতের অন্যান্য প্রান্তেও লক্ষ্য করেছি, বিশেষত মণিপুরে।
মণিপুরের প্রাকবৈষ্ণব আদিম মেইতি সংস্কৃতি মণিপুরি সমাজের বৈষ্ণব সংস্কৃতিতে অত্যন্ত প্রবল ও ব্যাপকভাবে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পরও সহাবস্থানে আজও টিকে আছে। পুরুলিয়া ছৌ নৃত্য ভূমিজদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়। ছৌ নৃত্যদল গড়ার পেছনে গোটা গাঁয়ের ভূমিকা থাকে এবং সকল স্তরের মানুষ নাচে অংশগ্রহণ করে।
মুরাদের কখনো কখনো বলা হয় মুণ্ডা। এরা ওই তল্লাটের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়। তারাও আদি বসতিকারী দলের মানুষ। সমাজে তাদের কিছু বিশেষ মর্যাদা দেখা যায় এই কারণে যে, সম্প্রদায়ের পুরোহিত শ্রেণীর কাজকর্ম তারাই করে থাকে ।
ময়ূরভঞ্জের বাসিন্দাদের মতো মুণ্ডারাও একই পদ্ধতিতে সূর্য পূজা করে। ময়ূরভঞ্জের অনুষঙ্গে আমরা দেখেছি, কীভাবে সাধারণ স্তরের লোকজনের সূর্যপূজা তত্রস্থ শাসকদের দ্বারা স্বীকৃত হয়ে কালক্রমে কোনারক সূর্য মন্দিরের প্রবলবিক্রম এক সূর্য-উপাসনা প্রথায় রূপান্তরিত হয়। মুরাদের মধ্যে সূর্য ‘সিংগা বোংগা’ নামে পরিচিত, আর ভূমিজরা সূর্যকে বলে ‘ধরম’।
এরই পাশেপাশে রামায়ণ মহাভারতের গল্পকাহিনীও সর্বসাধারণের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। কথকতা, গান ও নাচের সমাজে যেমন, তেমনি নৃত্যেও শিল্পীরা হলো ভূমিজ, নৃত্যের শিক্ষকরা হলো মুরা সম্প্রদায়ের লোক।
এদের বলা হয় ওস্তাদ, শব্দটা এমন যে, ওদের মধ্যে এর প্রচলন মোটামুটি সম্প্রতি হয়ে থাকবে। এটা অসম্ভব নয় যে, তারা গোড়ায় ছিল মন্দির দেবদাসীদের নৃত্যশিক্ষক ও পরিচালক, পরে যখন মন্দিরের সঙ্গে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তারা পুরুলিয়া ছৌ নাচিয়ে বালক ও বয়স্ক পুরুষদের নৃত্যশিক্ষকতার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
কুর্মিরা তৃতীয় আর এক জনগোষ্ঠী। তারাও কিছু কিছু আচারপ্রথা ও আনুষ্ঠানিক সংস্কারাদি গ্রহণ করেছে, তবে হিন্দু ধর্মের পাতলা প্রলেপের তলায় এদের মধ্যে এমন সব কল্পকথা, নানাবিধ বিশ্বাসের বিরাট এক জগৎ লুক্কায়িত রয়েছে, যেমন ধ্যান-ধারণা বিশ্বাসকে নৃত্যাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা সর্বপ্রাণবাদী (অ্যানিমিস্টিক) বলে অভিহিত করে থাকেন ।
চতুর্থ ও শেষ জনগোষ্ঠী হলো ডোম সম্প্রদায়। এরা আবার বাঙালি ডোম ও বিহারি ডোম এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। বাঙালি ডোমেরা পুরুলিয়া ছৌয়ের বংশানুক্রমিক সঙ্গীত দল। ডেমদের ইতিহাসের সূত্র মিলবে নবম শতাব্দী পর্যন্ত উজিয়ে গিয়ে।
নবম ও একাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের ইতিবৃত্তগত সাক্ষ্যপ্রমাণে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না, তবে দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকে এমন নিদর্শন যথেষ্টই মেলে, যা থেকে বোঝা যায় তারা ছিল সৈনিক ও যোদ্ধা । ডঙ্কা বা ঢক্কা বাজানোটা গোড়ায় সম্ভবত ছিল সামরিক বৃত্তির অঙ্গ, পরে নৃত্যনাট্যের এলাকায় সম্প্রসারিত হয়ে থাকবে।
আমরা ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের বেলাতেও এ জাতীয় স্থানান্তকরণের ঘটনা লক্ষ করেছি, লক্ষ করেছি নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে স্থানীয় যোদ্ধা দলের সম্পর্ক। এই যোদ্ধারা পাইক সম্প্রদায়ভুক্ত। ভূমিজ ও মুরারা অংশত কৃষিজীবী, এদিকে ডোমরা ভূমিহীন হওয়ায় তাদের গীতবাদ্যের দ্বারা কিংবা ঝুড়ি, চুপড়ি প্রভৃতি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
এভাবে বাজানিয়া ডোম ও আঙ্কুরিয়া ডোম এই দুই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই নৃবিজ্ঞানঘটিত বহুলতা ও নৃত্যের অনুষঙ্গে প্রতি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ বিশেষ ভূমিকার আরোপ আশা করি এই তথ্য স্পষ্ট করে তুলবে যে, একটি অনুন্নত ও তপশিলী জাতি সমাজেও বিশেষ বিশেষ কৃত্য বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট থাকে।
নাট্যঘটিত কর্মতৎপরতার অভিজ্ঞতা এই সমস্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী উপগোষ্ঠীর মধ্যে ভাববিনিময় ও আদান-প্রদানের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়। এই অঞ্চলের ইতিবৃত্ত অথবা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য স্রোতপ্রবাহের সঙ্গে এর সম্পর্ক পুনর্গঠন করা সহজ নয়। কিন্তু তা হলেও কতকগুলো অর্থপূর্ণ দিকচিহ্নের সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলোর উল্লেখ অবশ্যই করণীয় ।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে তার ধর্মপ্রচার করেছিলেন। জৈন ধর্ম সম্ভবত এর আগেই এই অঞ্চলে প্রচারিত হয়ে থাকবে, তবে এ কথার সত্যতা যাচাইয়ের পক্ষে চূড়ান্ত প্রমাণের অভাব। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী ও দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম আর হিন্দুধর্মও এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বহু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ভগ্নাবশেষের মধ্য দিয়ে এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকের পরে, বিশেষত সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণবধর্মও তার প্রভাব বিস্তার করেছিল। সন্নিহিত বাংলার বীরভূম এলাকায় বৈষ্ণবধর্মের সোৎসাহ চর্চার সমসাময়িক কালীন ঘটনা এটা।
এ রকম হওয়া সম্ভব যে, পুরুলিয়া ছৌয়ের উদ্ভব হয়েছিল বৈষ্ণবধর্মের বিকাশ আর পূর্ববর্তী সংস্কৃতিসমূহের মধ্যে সংস্পর্শ ও সংঘাতের ফলশ্রুতি হিসেবে। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী গ্রহণ করা হয়েছিল, এদিকে গানের ঢঙ পূর্বের মতো ঝুমুরই থেকে গিয়েছিল-ঝুমুর উপজাতি ও গ্রামীণ সম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক গানের একটা সুর।
গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলোর বেলায় এটা একটা লক্ষণীয় সাংস্কৃতির ছাঁচ বলা যায়। কারণ, শিল্পের রূপ পুরোনো রয়ে গেলেও তাতে নতুন নতুন বিষয়বস্তু সংযোজিত হতে থাকে। জনগোষ্ঠীর লোকেরা অন্যান্য ধরনের নাচ নাচে, অন্যান্য ধরনের গান গায়, যে গানের শেকড় বিশুদ্ধ আঞ্চলিকতা কিংবা স্থানীয়তায় অনেককাল থেকে প্রোথিত।
এ ক্ষেত্রেও তারা ভারতের অপরাপর প্রান্তগুলোর ধাঁচ ধরন অনুসরণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এমন সব আনুষ্ঠানিক গান বা নাচ আছে, যা কেবল মেয়েরা গায় বা নাচে। যেমন- ‘নাচনি’ বা ‘খেমটি’। আবার এমন সব নাচ- গান আছে, যা চাষের মরসুমগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয় এবং বীজ বপন, শস্যকর্তন প্রভৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
‘তুসু’ অনুষ্ঠিত হয় শস্যকর্তনের সময়, ‘সর্কুল’ও তাই। আবার ‘জোইয়া’ পর্ব অনুষ্ঠিত হয় বৃষ্টি-বাদলার দিনে, যখন শস্যের চারা রোপণের কাল সমাগত হয়। এ ছাড়া আরও সব গান ও নাচ আছে, যা জনজীবনের নানা জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। যেমন- গরু-মহিষ পালকদের ‘অহির’ গান এবং যোদ্ধাদের ‘কাট্টি’। ‘কৃষ্ণযাত্রা’ নামের এক লোকনাট্যও সুবিদিত।
কাজেই এখানেও চারস্তরের ক্রিয়ার সমাহার লক্ষ করা যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক, কৃষি ঘটিত, বৃত্তি বা জীবিকা ঘটিত ও বিশুদ্ধ পেশাদারি শিল্পচর্চা। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠভূমির পশ্চাৎপটে রেখে এভাবেই পুরুলিয়া ছৌকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
ময়ূরভঞ্জ, সেরাইকেলা, এমনকি পুরুলিয়ার সামন্ত সর্দারেরাও বিগত ২০০ বছর ধরে এসব শিল্পরূপকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে পুরুলিয়ার সামন্ত প্রভুদের স্বত্ব- স্বামিত্বের কাল ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। কাজেই ছৌ নাচ আজকাল কেবল অনুন্নত শ্রেণীর লোকদের দ্বারাই পরিবেশিত হয়ে থাকে।
কোনো কোনো দিক দিয়ে আমরা কুটিয়টম ভাগবতমেলা ও যক্ষগানের ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত কাব্যনাট্যের জগৎ থেকে বহুদূরে সরে এসেছি বলা যায় । অন্যান্য কতক দিক থেকে পুরুলিয়া ও ময়ূরভঞ্জ ছৌ খুব নিকট সাদৃশ্যযুক্ত।
সমসাময়িক স্থানীয় পরিস্থিতির বিচারে এবং স্বল্পপরিমাণ ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এ রকম সিদ্ধান্ত করা হয়তো ভুল হবে না যে, সংস্কৃত ঐতিহ্যের বহু উপাদান শুধু যে গ্রামীণ স্তরেই অনুপ্রবেশ করেছিল তাই নয়, উপজাতীয় স্তরেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল এবং সম্প্রদায় কর্তৃক পরিপোষণ লাভ করেছিল।
তা ছাড়া যা আজ অশিক্ষিত জনগণের ঐতিহ্য বলে মনে করা হচ্ছে, তা একদা ধ্রুপদী ঐতিহ্যরূপে গণ্য হওয়া অসম্ভব ছিল না। ময়ূরভঞ্জ ও সেরাইকেলা ছৌ এবং যক্ষগানের মতো নৃত্যনাট্যের ধরনে পুরুলিয়া ছৌও একটি মুক্তাঙ্গন শিল্পক্রিয়া।
এই নাচে মঞ্চ বলে কিছু নেই, শুধু ২০×২০ ফুট আয়তনের একটি খোলা জায়গা নাচের জন্য ব্যবহৃত হয়, কেবল একটি সংকীর্ণ ৫ ফুট চওড়া পথ ছেড়ে দেওয়া হয় প্রবেশ ও নির্গমনের জন্য। পথটির দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে থাকে। পূর্বোক্ত ২০×২০ ফুট বর্গক্ষেত্রটি নৃত্যাভিনয় পরিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট থাকে ।
তার মধ্যে আবার ঠিক নাচের জায়গাটি হয় বৃত্তাকার, যে বৃত্তের ব্যাস হিসাব করলে ২০ ফুটের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গাইয়ে-বাজিয়েদের বসার জায়গা একপাশে। একাধিক দলের অভিনয় থাকলে প্রতি দলেরই নিজস্ব গায়ক-বাদক থাকে। তারা নৃত্যশিল্পীদের ঠিক পাশেই বসে।
আমরা ময়ূরভঞ্জ ছৌ ও যক্ষগান এই দুইয়ের বেলায় দেখেছি যে, একাধিক শিল্পী দলের যুগপৎ নৃত্য পরিবেশন কিংবা পরে নৃত্য প্রদর্শন করা ওই দুই শিল্পরূপের অনুষঙ্গ একটা সাধারণ ঘটনা। দর্শকবৃন্দ নৃত্যানুষ্ঠান স্থলের তিনপাশ ঘিরে মাটিতে বসে। কেবল মহিলাদের জন্য একধারে উঁচু জায়গার ব্যবস্থা করা হয়।
নৃত্যানুষ্ঠান শুরু হয় সাধারণত রাত নয়টা কি দশটা। এটাই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেরও সাধারণ চলতি নিয়ম। অন্য দুটি ছৌ নাচের মতো বাঁশের খুঁটি খাড়া করা কিংবা ‘যাত্রাঘট’ বা ‘নিশিঘট’ ধরনের নৃত্যপূর্ব আনুষ্ঠানিক কৃত্যাদির বালাই এই নাচে আছে বলে মনে হয় না ।
তবে যেহেতু এখানেও নাচটি বৈশাখ মাসেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সে কারণে মনে হয় এসব ক্রিয়া করণ এখানেও অবিদিত ছিল না, খুব সম্ভব বিগত দশককাল মধ্যে তাদের চল উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যান্য এলাকার নৃত্যনাট্য শিল্পরূপগুলোতে যেমন তেমনি এখানেও নৃত্যাভিনয়ের শুরু হয় বাদ্যবাদকদের প্রবেশের মধ্য দিয়ে। সাধারণত ঢাকবাজিয়ের ওপর এই দায়িত্বটি মুখ্যত বর্তায়, সে নানাবিধ তালের ও ছন্দের বোল মুখে আওড়ে সেই সঙ্গে ঢাক বাজিয়ে এই যন্ত্রে তার নৈপুণ্য প্রকাশ করে।
একজন নট, সে গণেশের মুখোশ পরিধান করে সংকীর্ণ প্রবেশপথের একেবারে দূরের প্রান্তে এসে দেখা দেয়। গণেশমুখোশধারী চরিত্রটির প্রতি দর্শকদের মনোযোগ অচিরেই আকৃষ্ট হয়। কারণ, ঢাকবাজিয়ে সেই মুহূর্তে হঠাৎ বাজনা থামিয়ে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে গাইয়ে গান ধরে। গায়ক স্বভাবতই গণেশ বন্দনা করে।
গণেশের চরিত্রে অভিনয়কারী নট শুধু মুখোশ পরেই ক্ষান্ত থাকে না, সে বাড়তি আরও দুটি কৃত্রিম কাঠের বাহু তার পিঠের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে তার সাহায্যে চতুর্ভূজ গণেশের মূর্তি ধারণ করে। কাঠের বাহু দুটি কতকটা নড়বড়েভাবে পিঠের সঙ্গে লাগানো হয় এবং এই কৃত্রিম বাহুদ্বয়কে দেহের সঙ্গে সংলগ্ন করার উপযুক্ত কোনো সন্ধিস্থল দেহে নেই।
গায়ক যখন বন্দনাগীতি গাইছে নট-নতক তখন একটা দীর্ঘবিরতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলীতে অবস্থান করে, যেন তার স্বরূপত্বের পরিচয় দেওয়া ও দর্শকমণ্ডলীর প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে তোলাই তার এই যতিবিরামের উদ্দেশ্য। এরপরই সে চকিতে নৃত্যশৈলীতে দৌড়ে যায় এবং খুব দ্রুততালে নাচতে আরম্ভ করে দেয়। গণেশ বন্দনার গান সচরাচর ঝুমুরের সুরে গাওয়া হয়।
গণেশের প্রবেশ থেকেই নাট্য আখ্যানের শুরু। এরপর কাহিনী খুব দ্রুতলয়ে এগোতে থাকে এবং তার সঙ্গে তাল রেখে অন্য চরিত্রগুলোর ঝটিতি প্রবেশ ও প্রস্থান ঘটতে থাকে। প্রতি চরিত্র রঙ্গস্থলীতে আবির্ভাবের পূর্বে এক মিনিট কি দুই মিনিটকাল নেপথ্যে অপেক্ষমাণ থাকে।
অন্যান্য অঞ্চলের ছৌ নাচের ক্ষেত্রে যে জাতীয় অবস্থান, হাঁটাচলার ভঙ্গি এবং গতিসৌষ্ঠব লক্ষ করা যায়, সে রকম ধাঁচ-ধরন এখানেও চোখে পড়ে। দৃশ্যত অপরিশীলিত এই নাট্যারম্ভের ধরন দক্ষিণী নৃত্য ঘরানার নির্বাহন এবং সংস্কৃত ঐতিহ্যের দূর প্রতিধ্বনি বলে বোধ হয়।
এ ভিন্ন ভাগবতমেলার ভাগবতরের মতো গায়ক এখানেও এক-দুই ছত্র শ্লোকগানের মধ্যে দিয়ে দর্শকমণ্ডলীর সঙ্গে প্রতিটি চরিত্রের পরিচয় করিয়ে দেয়, কিন্তু অচিরেই ওই চেষ্টা থেকে বিরত হয় । কেননা, তার কণ্ঠস্বর সুষির (বায়ু) বাদ্যযন্ত্রগুলো থেকে উদগত প্রবল ধ্বনির তলায় চাপা পড়ে যায়।
ঢাকের আওয়াজের চেয়েও আরেক কাঠি ওপরে বাজে। সুতরাং গান শোনা যাবে তার জো কোথায়? এতদসত্ত্বেও গায়নশিল্পী তার ভূমিকা যথারীতি পালন করে চলে, সেই ভূমিকা হলো চরিত্র উপস্থাপনার গুরুদায়িত্ব পালন, দৃশ্যাবলি বর্ণন ও একদৃশ্যের সঙ্গে অন্য দৃশ্যের সংযোগসূত্র স্থাপন।
যন্ত্রসঙ্গীত প্রায়ই পুনরাবৃত্তিমূলক হতে দেখা যায়, নাট্যধারার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আগাগোড়াই যন্ত্রসঙ্গীতের সুর বাজতে থাকে। কাহিনী যত এগোয়, নাট্যতৎপরতা তত বাড়তে থাকে, আর দর্শক উত্তেজনায় ও রোমাঞ্চ শিহরণে অভিভূত হয়ে পড়ে। ছৌ ছৌ বলে চিৎকার করে দর্শক তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় ।
আগে চলন্ত আলোবাহকদের মস্তকোপরি জ্বলন্ত মশালের আলোয় অভিনয়স্থল আলোকিত করার ব্যবস্থা ছিল, তারা নাচিয়েদের সঙ্গে সঙ্গে আগেপিছে চলত। কিন্তু ইদানীং কোরেসিন বাতি ও ঢালাও পেট্রোম্যাক্স বাতি ব্যবহারের রেওয়াজ প্রচলিত হয়েছে।
ফলে নাটকের কিছু কিছু অমোঘ জাদু, যেমন মৃদু আলোকে মুকুটের ঝলসানো কিংবা তলোয়ার ঘোরানো সবটাই ছড়িয়ে থাকা ঢালাও আলোয় কেমন যেন হারিয়ে যায় স্বতঃই।
অভিনয় রাত ভোর হওয়া অবধি চলতে থাকে, নায়কের সঙ্গে দানবের সংগ্রামে শেষ দৃশ্যের অবতারণা এবং অশুভের ওপর শুভের জয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি। সমগ্র গল্পাংশটি এক দিনে শেষ না হলে পরবর্তী রাতগুলোতে তার জের চলতে থাকে ।
কখনো একটি দলই মাত্র অভিনয়ে অংশ নিয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো দুটি কি তিনটি দল একসঙ্গে পাশাপাশি অভিনয় করতে থাকে, যেন পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে এমন ভাব। আবার কখনো কখনো এমনও দেখা যায়, একদল অন্য দলের পরে নাচতে গাইতে নামে, তারপর আরেক দল, এমনিভাবে ক্রমানুসরণে অভিনয় চলে।
পুরুলিয়া ছৌয়ের যদিও কার্যত একটাই সুবিদিত রূপ, তবু কথাকলি, যক্ষগান প্রভৃতি শিল্পরূপগুলোর মতো পুরুলিয়া ছৌয়েরও কয়েকটি উপ-বিভাগ রয়েছে। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে বন্দ্যোয়ান, বাগমুণ্ডি, ঝালদা এই কটি ঘরানা বিদ্যমান। অঞ্চলের নামে ঘরানার নাম। এর মধ্যে বন্দ্যোয়ান ঘরানা সবচেয়ে লক্ষণশীল, অন্যপক্ষে ঝালদা ঘরানায় শহুরে প্রভাব ঢুকে পড়েছে।
বাগমুণ্ডি ঘরানার পুরুলিয়া ছৌ ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য ও মিলানা সালভিনির মতো শিল্প ঐতিহাসিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই ঘরানার শিল্পীরা দিল্লিতে তাদের নাচ দেখিয়েছে, বিদেশ থেকেও ঘুরে এসেছে। প্যারিস শহরে থিয়েটার দ্য নেশন্সে তাদের নাচের প্রদর্শনী উল্লেখ্য।
পুরুলিয়া ছৌয়ের অভিনয়ে পালাগুলোর বিষয়বস্তু অধিকাংশ স্থলে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী থেকে নেওয়া। অবশ্য পুরাণের কিছু আখ্যান-উপাখ্যানও তাদের নৃত্যের উপজীব্য। রামায়ণের যে পাঠের অনুসরণে নাচের কাহিনী উপস্থিত করা হয়, তা কিন্তু বাল্মীকির নয়, কৃত্তিবাসের।
কবি কৃত্তিবাস ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের বাংলায় বসে তার রামায়ণ কাহিনী রচনা করেছিলেন। লক্ষণীয়, ভারতের অন্য কতিপয় অঞ্চলে তুলসীদাস কৃত রামায়ণের তর্জমা কিংবা বিচিত্র রামায়ণ সমধিক অনুসৃত হয়। বাল্মীকি যেন কাহিনীর মূলকাঠামোটি উপস্থিত করেই খালাস, আঞ্চলিক রচয়িতাদের ওপর বাকিটা নির্ভর।
অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও কেরালার মতো এখানেও বাল্মীকি রামায়ণ থেকে অনেক অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। রামায়ণের খুব কম নাট্য রূপান্তরেই রাজা দশরথ কর্তৃক বালক তপস্বী সিন্ধুর বধদৃশ্য দিয়ে নাটক শুরু হয়। কিন্তু পুরুলিয়া ছৌয়ে এই ঘটনার ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
এ ছাড়া রামের গুহক ও অন্যান্য নিচজাতীয় লোকের সহিত সাক্ষাৎকারের দৃশ্যাদির ওপরও বিশেষ জোর দেওয়া হয়। রামায়ণ মহাকাব্যটির রূপায়ণ কখনো এক রাতের অভিনয়েই সেরে ফেলা হয়, আবার কখনো কখনো পরপর তিন-চার রাতের অভিনয় দরকার হয় তা শেষ করতে।
বিষয়বস্তু, ঘটনাবলি ও রূপায়ণ পদ্ধতির নির্বাচন আঞ্চলিক সংস্কৃতির মূল্যবোধগুলোর সমাদর লক্ষণীয়। অনুরূপভাবে প্রায় পুরো মহাভারতখানাও পরিবেশন করা হয়, কিন্তু স্পষ্টতই কতিপয় নির্দিষ্ট উপাখ্যান মাত্র বেছে নিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়। আদিপর্ব থেকে বনপর্বকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শেষ যুদ্ধদৃশ্য বেশ নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত করা হয়।
অভিমন্যুর উপাখ্যান হলো নিঃসন্দেহে নাটকের সর্বোৎকৃষ্ট আকর্ষণ। বালক অভিমুন্য পরাক্রান্ত শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রচণ্ড বিক্রমে যুদ্ধ করে চলেছে— এ দৃশ্য দর্শকদের অভিভূত করে ফেলে। নৃত্যের এককেন্দ্রাভিমুখী বৃত্তগতি, ঘড়ির কাঁটার মুখে ও ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে নাচের দোলন, গ্রীবা ও বক্সের ক্ষিপ্র ভঙ্গি এবং বঙ্কিম আবর্তন সব একত্রে মিলিত হয়ে এক নাট্যদৃশ্যের সৃষ্টি করে।
মহাকাব্যদ্বয় ছাড়া পুরাণের গল্পাদি ও বহু সংক্ষিপ্ত রচনাও পুরুলিয়া ছৌয়ের অনুষ্ঠেয় পালাগুলোর অঙ্গস্বরূপ। লক্ষ করার বিষয় যে, নৃত্যের বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে যদিও ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের সঙ্গে পুরুলিয়া ছৌয়ের যথেষ্ট মিল রয়েছে, সেরাইকেলা ছৌয়ের সঙ্গে কিন্তু তেমন মিল নেই।
অন্য নৃত্যানাট্যগুলোর মতো এই নাচেও মেয়েদের কোনো ভূমিকা নেই, যদিও কিছুকাল যাবৎ ঝালদা ঘরানার নাচে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের অভিমত অনুযায়ী কিছু নারীভূমিকা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের দেবদাসী নাচিয়েদের ‘খেমটি’ ঐতিহ্যের নজির এদের নাচে যোগদানের পক্ষে সমর্থন জোগায়।
কিন্তু মনে হয় যেন তারা সিনেমা নায়িকাদের কিছু স্থূল সংস্করণের মতোই বেশি দেখতে। অন্য সাংস্কৃতিক রীতিনীতি থেকে প্রভাব গ্রহণের এই নতুন প্রণালী, যা কিনা কখনো কখনো বিচারবিহীন ও কিম্ভূতভাবে অনুসৃত এমন এক আধুনিক সংগঠন, যা এখনো পর্যন্ত সদর্থক, কোনোরূপ শৈল্পিক অভিনবত্বের নিদর্শন স্থাপন করতে পারেনি।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সাহিত্যিক রচনা, কাব্যিক সৃষ্টি এই সমস্ত নৃত্যশৈলীতে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বের জায়গা অধিকার করে আছে। ঝুমুর গানের আকারে যেসব দ্বিপদী রচনা এই নাচে ব্যবহার করা হয় সেগুলো মাত্র বিভিন্ন দৃশ্যের ভেতর যোগসূত্রস্বরূপ।
কথার সঙ্গে ধ্বনির ও অঙ্গভঙ্গিমার সম্পর্ক, যা কিনা দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যরূপগুলোর একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্য, এখানে প্রায় অনুপস্থিত। এই দিক দিয়ে ছৌ অনেক বেশি গ্রামীণ লক্ষণবিশিষ্ট এবং খুব সম্ভব এই কারণেই তা কেবল একটি লোকনাট্যরূপে অভিহিত হয়ে আসছে।
তা সত্ত্বেও বলা যায়, এই নৃত্যনাট্যের গঠনগত দিকের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরূপগুলোর প্রচুর মিল। সুরের দিকটা কিছুটা সীমিত। পাঁচ স্বরবিশিষ্ট সুর প্রায়ই ব্যবহার হয়, কেবল মাঝেমধ্যে সপ্তস্বরবিশিষ্ট সুরও প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের সঙ্গে সংযোগ নামমাত্র।
ঐক্যতান বাদন দলে সুর ও তালসহ যোগ দুয়েরই ব্যবস্থা থাকে। সানাইয়ের সুর বাজে, তবে এই সানাই হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতে ব্যবহৃত সানাই যন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সানাই ছাড়া আর থাকে দুটি ঢাক, তার মধ্যে একটি হলো ঢোল (দুই ধারবিশিষ্ট পিপাসদৃশ একটি চর্মযন্ত্র), অন্যটির নাম ধুমসা, যা এক ফালি কাঠ বা ধাতুর পাত দিয়ে তৈরি নাকাড়া বিশেষ।
প্রতিটি যন্ত্রে এক বা একাধিক বাদক থাকে, তাই দিয়ে ঐকতান বাদক দলের সৃষ্টি। ধুমসা বাদক বসে বাজায় কিন্তু সানাই বাজিয়েকে দাঁড়িয়ে বাজাতে হয়। ঢোল বাদক স্বতন্ত্র এক শ্রেণীতে পড়ে, কারণ, সে কার্যত অনুষ্ঠানটির পরিচালক, যক্ষগানে ভাগবতরের যে ভূমিকা, ছৌ নৃত্যে ঢোলবাদকের ঠিক সেই ভূমিকা।
সে নটের মুখোমুখি হয়, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, তাকে চালনা করে, তাকে থামিয়ে দেয়, এমনকি নর্তক কীভাবে মেঝে পরিক্রমা করবে তারও নির্দেশ দেয়। শেষোক্ত ব্যাপারটি চমৎকার এক কৌশল, বিশেষ করে সেই মুখোশধারী নাচিয়েদের বেলায়, যাদের দৃষ্টিশক্তি স্বভাবতই কিছুটা আচ্ছন্ন থাকে।
তাদের পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, কেবল ঢোলবাজিয়ের সাহায্য ও সহযোগিতাক্রমেই তারা টাল খেয়ে পড়ার থেকে রক্ষা পায়। ঢোলবাজিয়ে তার বাজনা ও বোলের সাহায্যে নাচিয়েদের ঠিক ঠিকভাবে আগুপিছু চলতে সহায়তা করে। ইতিপূর্বে আমরা গায়কের ভূমিকার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
এদিকে তাল প্রকরণ কিন্তু বেশ জটিল। তবে হিন্দুস্থানী কিংবা কর্ণটী সঙ্গীতের তালপদ্ধতি ও ছৌয়ের তালপদ্ধতির মধ্যে তুলনায় দুটি ধারার মধ্যে সমান্তরাল সাদৃশ্য কিছু দেখা যায় না। ছৌয়ের তালপদ্ধতিতে সম ও বিষম মাত্রার তাল উভয় তালপ্রকারণই প্রযুক্ত হয়। কখনো কখনো এক আওর্ধায় ৪৩টি পর্যন্ত মাত্রার প্রয়োগ হতে দেখা যায়।
অন্য কোনো কোনো তালে এক আওতায় ১৫ মাত্রা কিংবা ৮ মাত্রার বিভাগ দেখা যায়। যদিও বাজনার তালে যতি, স্তব্ধতা, এক-চতুর্থাংশ মাত্রা এবং আড়ি কোয়াড়ি সবই আছে, তবুও ফাঁকের সংখ্যা অগণন। প্রকৃত প্রস্তাবে অন্যান্য নৃত্যঘরানার ঢাক-ঢোল বাজিয়েরা পুরুলিয়া ছৌয়ের তালবাদ্যের ছন্দ লয়ের কাঠামো নিরূপণ করতে গিয়ে রীতিমতো অসুবিধায় পড়ে।
বাজনায় আরও বেশি জটিলতা দেখা দেয়, যখন ধুমসা বাজিয়ে আর ঢোল বাজিয়ে তালে পাল্টাপাল্টি ছন্দের সৃষ্টি করে। অর্থাৎ একজন যখন সুনিয়ন্ত্রিত লয়ে অনেক ‘টুকরা’ বাজিয়ে চলে, অন্যজন স্পষ্ট অনিয়মিত ছন্দের তাল বাজিয় যেতে থাকে। এরূপ জবাব দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়ার সমমাত্রা ও বিষমমাত্রা এই দুই ধরনের তালরীতিই হামেশা ব্যবহার করা হয়।
পুরুলিয়া ছৌয়ের নৃত্য আঙ্গিক অন্যান্য ছৌয়ের নৃত্য আঙ্গিকের সঙ্গে কতকগুলো সাধারণ সাদৃশ্যে এক পর্যায়ে পড়ে, তবে সব জড়িয়ে দেখতে গেলে এর একটা আলাদা বিশিষ্ট দেহভিব্যক্তির ধরন ও প্রণালী আছে, যার প্রকাশ খুবই সুগঠিত ও ঋজু। স্থান অবস্থানগুলোর মধ্যে হাঁটুর অর্ধবাকানো খোলা ভঙ্গি ময়ূরভঞ্জ ও পুরুলিয়া ছৌ নৃত্যে এক ।
প্রবেশের নানা কায়দা কিংবা তরোবারি ধরার ঢঙও একই প্রকারের। কিন্তু দুইয়ের ভেতর সাদৃশ্য এখানেই শেষ। সামরিক হাবভাবের একটি সাধারণ ধারণাগত মিল ব্যস, এই পর্যন্তই। তারপরেই অমিলের পালা শুরু। বিভিন্ন চরিত্রের গতিভঙ্গি আলাদা।
যক্ষগান নৃত্যনাট্যের চরিত্রসমূহের বিভিন্ন গতিভঙ্গিমা ফুটিয়ে তুলতে যে লক্ষণীয় মুদ্রাভ্যাসের প্রয়োজন হয়, এখানেও ঠিক সেই একই মুদ্রাভ্যাস আবশ্যক। এখানেই সেই একই ভঙ্গিমায় নায়কদের, দেবগণের, অসুরদের, আদিবাসীদের, জীবজন্তু ও পাখিদের মঞ্চে প্রবেশ। প্রত্যেকের নিজস্ব ধরন ও গতিভঙ্গি আছে, যা কিনা নাট্যশাস্ত্রের স্থান, মণ্ডল ও গতির অনুরূপ।
পশুচরিত্র চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে, তার চলার ধরন যত বাস্তব এমন আর অন্য কোনো নৃত্যশৈলীতে নয়। পাখিরা তিড়িং তিড়িং করে চলে, লাফিয়ে বেড়ায়। শরীরের সমস্ত অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ নাচের প্রক্রিয়ায় প্রযুক্ত হয়। মাহাত্মাসদৃশ চরিত্রেরা ও দেবতারা ঋজুভঙ্গিতে তাদের বক্ষদেশ প্রলম্বিত করে দাঁড়ায় এবং দীর্ঘ ও তির্যক পদক্ষেপে হাঁটে।
এদিকে অসুরদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি খুবই কঠিন ও উদ্ধত। শিকারীরা শিকার ধরার জন্য বাঁকিয়ে চুরিয়ে চোরাগোপ্তাভাবে হাঁটে। সে যাই হোক, এমনসব ভিন্ন ভিন্ন গতিভঙ্গিমা চোখে পড়ে, যা অন্য দুই ছৌ নৃত্যের ‘উফলি’ ও ‘টপকার’ স্বগোত্র। হাঁটু ভেঙে হাঁটা, হাঁটুর ওপর ভর করে নাচা, এই এক গতিভঙ্গি যা অন্য ছৌ নাচগুলোতে দেখা যায় না।
কিন্তু যক্ষগানের মণ্ডি ভঙ্গিমায় নজরে আসে। এ ছাড়া মাছের জলে ছলাৎ করে ভেসে ওঠার ভঙ্গি, মরালের এঁকেবেঁকে হেলেদুলে চলার ভঙ্গি, কচ্ছপের বুকে হেঁটে চলার ভঙ্গি এবং অন্যান্য জলচর প্রাণীর ঢেউ তুলে জলে ডুব মারার ভঙ্গি এসব ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের ‘উসকা’ ও ‘ডুবা’ গতিভঙ্গির স্বগোত্র।
এ ভিন্ন ন্যূনতম মাত্রায় হাতের মুদ্রাও প্রযুক্ত হয় গোটা দেহের আন্দোলনের দ্বারা ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশ করা হয়, অথবা চরণভঙ্গের ভাব প্রকাশিত হয়। ছৌ নাচের এটি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা তিনটি ছৌকে এক পর্যায়ভুক্ত করেছে। গতি থেকে এমন সব গতিভঙ্গিমার উদ্ভব হয়, যা একেক রূপে একেক চরিত্রকে প্রকটিত করে।

এইসব গতিভঙ্গিমার কোনোটি গণেশের ব্যক্তিসত্তার প্রকাশক, কোনোটি দুর্গার, কোনোটি শিবের, কোনোটি পরশুরামের, কোনোটি হুমায়ুনের, কোনোটি অর্জুনের, কোনোটি আর কোনো দেবদেবীর। বৃত্তি বা জীবিকার প্রকাশক গতিভঙ্গিগুলো আরেকটি গুচ্ছের অন্তর্গত, এ ভিন্ন আক্রমণ ও আত্মরক্ষা ঘটিত গতিভঙ্গিমার সংখ্যাও বড় কম নয়।
এই শেষোক্ত ক্রিয়াগুলো একাধিক নাটকীয় শীর্ষমুহূর্তে (ক্লাইম্যাক্স)কালে খুবই ফলপ্রদভাবে প্রয়োগ হয়, যেমন রাম-রাবণের শেষ যুদ্ধকালে কিংবা অভিমুন্য বধের সময়ে। অনেক হাঁটু ভেঙে নাচার ভঙ্গি ঘূর্ণি নাচ প্রভৃতি সুপ্রচলিত, তা ছাড়া লম্ফঝম্ফ ছৌ নৃত্যশৈলীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঙ্গ বলা যায়।
চমক লাগানো লাফঝাঁপ মেরে অবশেষে নারকের হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসার ভঙ্গিটি এই নৃত্যনাট্যে একটি চমৎকার আকর্ষণ। বক্ষদেশের ঊর্ধ্বাংশের সঞ্চালন ও কোমর, হাঁটু গোড়ালি প্রভৃতি নিম্নাঙ্গের সন্ধিদেশের আবর্তন ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ে যা দেখা যায় তার থেকে এখানে বেশ কিছু আলাদা।
ময়ূরভঞ্জ ছৌ তার সক্রিয় ভাবব্যঞ্জনার জন্য পদদ্বয়ের সম্প্রসারণ ও ফলপ্রদ হাঁটু বাঁকানোর ওপর নির্ভর করে। এদিকে পুরুলিয়া ছৌ সচলতার ভাব পরিস্ফুটনের জন্য ছড়ানো হাঁটুর অবস্থান-চৌকা ও উঁচু লাফ, শূন্যে ঝাঁপ দেওয়া প্রভৃতি ব্যবহার করে।
এই সমস্ত ভঙ্গিমা একত্র হয়ে আধা আলোর পরিবেশে মুকুটের কাঁপা কাঁপা চুমকির দ্যুতির ঝলসানিতে কেমন যেন একটা অন্যজগতের আবহ সৃষ্টি করে। মুখোশসমূহের চকচকে করা উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণসমূহের ঝকমকানি পোশাক-আশাকের রঙের বিপরীত ব্যঞ্জনা ছড়ায় নব কিশলয়ের সবুজের আভা বেশভূষার বর্ণিলতায়।
কখনো কখনো মনে হয় যেন একটা মুখোশ কোথাও কিছু না, শূন্য থেকে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছে। হাতের অথবা মুখের অথবা ঘাড়ের সূক্ষ্ম আন্দোলন কিছু কিছু রয়েছে। তবে দুটি গতিভঙ্গি আছে, যার প্রভাব খুবই কমনীয় এবং যেগুলো লাফ-ঝাঁপের স্থুল ভাবকে নমনীয় করতে যথেষ্ট সহায়তা করে । উদাহরণস্বরূপ একটি শিরোভঙ্গির উল্লেখ করা যায়।
এই ভঙ্গিটি সুনিয়ন্ত্রিত ও কমনীয়—এই ভঙ্গিমায় ঘাড় ও মাথা একদিকে কাত হয়ে থাকে, অন্যদিকে শরীরের অন্যান্য অংশ সচেতনভাবে স্থানু ও ঋজু অবস্থানে বিরাজ করতে থাকে ।
মনে হয় যেন নট-নর্তক সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তায় তার দেহের অবশিষ্টাংশকে প্রায় হিমশীতল করে রাখে, শুধু কারুণ্য ও স্তব্ধতার মুহূর্ত সৃষ্টির জন্য ঘাড়ের ও মাথার শেষ এক গতিভঙ্গি খুবই সার্থকভাবে প্রয়োগ করা হয়।
বস্তুত পণ্ডিতবর্গ এবং শিল্প সমালোচকরা কেবল এই একটি গতিভঙ্গিমার দৃষ্টান্তের ভিত্তিতেই পুরুলিয়ার ছৌ ও বালি নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে ছৌসাদৃশ্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য এটা একটু কষ্টকল্পনা। কারণ, এই দুটি নৃত্য ঐতিহ্যের মধ্যে আর এমন কিছুই নেই, যাকে দুইয়ের ভেতর সাদৃশ্যমূলক সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে।
আর একটি গতিভঙ্গিমা আছে, যা মস্তকের গতিভঙ্গিমার মতোই একই প্রকারের তাৎপর্যপূর্ণ, এটি হলো স্কন্দদ্বয়ের গতিভঙ্গি, এই গতিভঙ্গিও সুনিয়ন্ত্রিত কম্পনের একটা ভূমিকা আছে, যে কম্পন কাঁধের সন্ধিস্থলস্থিত বতুলকে আন্দোলিত করে সম্পন্ন হয়।
মাঝেমধ্যে বক্ষোদেশকেও নৃত্যের কাজে লাগানো হয়, এই প্রক্রিয়ায় ঋজু কঠিন বক্ষদেশের পরিবর্তে তাকে সামনে-পেছনে খুব ঘনঘন আন্দোলিত করা হয়। এভাবে হৃদি সঞ্জাত উত্তেজনার আবেগটিকে প্রকাশ করা হয়। আন্দোলনের মন্থন শুরু হয় পাঁজরের খাঁচার তলদেশ থেকে, তারপর ওই মন্থন বুকের দিকে ক্রমশ উঠে আসতে থাকে।
এই সমস্ত গতিভঙ্গিমা একেবারেই পুরুলিয়ার ছৌয়ের নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। ভারতের অন্য নৃত্যশিল্পরূপগুলোর আঙ্গিক প্রকরণে এসবের প্রচলন দেখা যায় না। ময়ূরভঞ্জ ছৌ এবং সেরাইকেলা ছৌ বুক এবং বুকের ঊর্ধ্বাংশের এমন একটি গতিভঙ্গিমা প্রয়োগ করে, যাতে গভীর নিঃশ্বাস গ্রহণের প্রয়োজন হয় এবং বক্ষদেশকেও একটি মোচড় দেওয়ার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এতে করে যে আবেদনের সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে আধুনিক নৃত্যকলার ‘মার্থা গ্রাহাম’ ঘরানার নৃত্যশৈলীর সংকোচন ও প্রসারণের খুবই মিল আছে। পুরুলিয়া ছৌ-এ কিন্তু এ জিনিস নেই। তার বদলে তাতে আছে ক্ষিপ্র হ্রস্ব ঝাঁকুনি, কাঁপন ও কোণাকুণি নর্তন সমন্বিত বিবিধ গতিভঙ্গিমা। এই নৃত্যশৈলীর বিবরণ সম্পূর্ণ হবে না, যদি না আমরা তার মুখোশঘটিত আর একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেরাইকেলা ও পুরুলিয়া ছৌ দুইয়েতেই মুখোশের ব্যবহার আছে। কিন্তু ময়ূরভঞ্জ ছৌ একটি মুখোশবিহীন নৃত্যনাট্যবিশেষ। মুখোশ নির্মাণের শিল্পপ্রণালী, তাদের পরিধানের পদ্ধতি এবং ওইসব মুখোশের মাধ্যমে যে বিশেষ ধরনের চরিত্রগুলোকে প্রকটিত করা হয় সেসব এই সবকটি নৃত্যশৈলীতেই ব্যবহারের রেওয়াজ আছে।
তবে তাদের ব্যবহার একেক নৃত্যশৈলীতে একেক রকম। সেরাইকেলা মুখোশগুলো হলো বেশ মসৃণ, পরিমার্জিত, দরবারি। এগুলোর এমন একটি আবেদন আছে, যা কিনা যে আর্থ-সামাজিক পরিবেষ্টনের মধ্যে এগুলোর বিকাশ হয়েছিল, বুজিবা তার প্রতি অঙ্গুলিক্ষেপণ করে। মুখে কোনো রেখা বা বলিরেখা আঁকা হয় না, কুঞ্চনভঙ্গি বর্জিত কেবল সরল মুখমণ্ডল অঙ্কন করা হয়।
চোখ দুটি খুব ভাব প্রকাশ করে আঁকা হয় কিন্তু ওই অঙ্কনক্রিয়ায় বাস্তবানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। মুখোশের অন্য অংশগুলোর অঙ্কনক্রিয়া সম্বন্ধেও একই কথা। নানাবিধ বর্ণের স্কুল সূক্ষ্ম প্রলেপণের দ্বারা নানাবিধ প্রতীকী ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করা হয়।
পুরুলিয়ার ছৌয়ে কিন্তু বর্ণপ্রয়োগের বেলায় একই চরিত্রের রূপায়ণে সম্পূর্ণ ভিন্নতর মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হতে হয়। এরা এমন সব চরিত্র, যারা খুবই প্রাণশক্তিসম্পন্ন বলশালী পুরুষ, তাদের স্বভাবে কমনীয়তা কিংবা সৃষ্ট ভাবভঙ্গির লেশমাত্র নেই। মুখের ওপর সেঁটে মুখোশগুলো পরিধান করা হয়।
সেগুলোর আকার মুখের চেয়ে বড় নয়; বরং তাদের বেশ ছোটই মনে হয়। কিন্তু হলে হবে কি, দেখতে সেগুলো খুবই বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়। বাস্তবসম্মত তাদের নৃশংসহতায় ও ভয়াবহতায়। অসুরদের গোঁফ, বাবরি চুল, চিবুকের ওপর দাড়ির আভাস, কপালের বলিরেখা, মোটকথা সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ দানবের মুখ।
রাবণের মুখোশ তৈরি হয় পরপর তাতে দশটি মাথা পাশাপাশি সংযোজন করে। প্রকৃত প্রস্তাবে একজন নৃত্যশিল্পীর পক্ষে এই রকমের একটি মুখোশ মুখে পরে এবং মাথায় আরও ভারী আকারের শিরস্ত্রাণ ধারণ করে লাফঝাঁপ দিয়ে বেড়ানো বাস্তবিকই কঠিন ব্যাপার। যথেষ্ট শক্তিমত্তা ও ভারসাম্যের নৈপুণ্য না থাকলে এ জিনিস হয় না।
অনুরূপভাবে কুম্ভকর্ণের মুখোশ হলো দানবিক ভাবব্যাঞ্জক, পুরুষ কঠিন, বাবরি চুলও করাল দংষ্ট্রাযুক্ত, দাড়ির জঙ্গল সমাচ্ছন্ন প্রকৃতি।
যদিও যক্ষগানের দানব এবং মহীশুর ঐহিত্যের ভূত-প্রেতের অঙ্গসজ্জা দেখতে প্রায় সমান ভয়ংকর, তা হলেও পুরুলিয়ার মুখোশগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে, তাকে দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যশৈলীর অঙ্গসজ্জা প্রকরণের তুলনায় অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক বলে মনে হয়। স্বভাবতই রাম, অর্জুন ও কৃষ্ণের মুখোশগুলো স্থির ও শান্ত ভাবব্যঞ্জক ।
এখানেও পাতলা, নরম বর্ণালী প্রয়োগের রীতি নেই, রাম, অর্জুন আর কৃষ্ণের মুখোশ নীল রঙে রঞ্জিত। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের বর্ণ প্রতীকে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে যে, দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যরূপগুলোর প্রায় সব কটিতেই মহদাশয় ব্যক্তিদের অথবা ধীরোদাত্ত নায়কদের সঙ্গে সবুজ (পক্কাই) রঙকে যুক্ত করে দেখানোটাই হলো বিধি।
কিন্তু এখানে নীল রঙটিকে মৌলিক রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বোধ হয় এই অন্তর্নিহিত ধারণার কারণে যে, নীল হলো বিষ্ণুর গায়ের রঙ। শিবের সাদা মুখোশ, শিবের মাথায় জটা, জটা ঘিরে আছে সাপের কুণ্ডলী, যা কিনা দেখতে সত্যিকারের সাপের মতো, একমাত্র পরিধান অজিন বা মৃগচর্ম।
লক্ষ করার বিষয় যে, যদিও দেবদেবী, সুর ও অসুর, মহানায়ক ও মহাযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় একই প্রকার, কিন্তু একেক এলাকায় তাদের একেক রকমের রূপায়ণের মধ্যে প্রকাশ পায় তত্ত্বৎ এলাকায় বিশিষ্ট আঞ্চলিক মনোভঙ্গি ও এমন এক বিশ্বদৃষ্টি, যা পরস্পরের স্বগোত্র হলেও এক বস্তু নয়।
স্ত্রী চরিত্রগুলো, অন্যসব নৃত্য-নাট্যসমূহের ধাঁচে, স্বাভাবিকভাবেই উপস্থাপিত করা হয়। কখনো কখনো তারা শুধু একটি মাত্র অঙ্গসজ্জায় উপস্থিত হয়, কোনোরূপ মুখোশ পরিধানের রেওয়াজ এ ক্ষেত্রে নেই। অঙ্গসজ্জার বেলায় কথাকলি নৃত্যে বিবিধ চরিত্র রূপায়ণের যে ঐতিহ্য অনুসরণ করা হয় এখানেও সেই একই ঐতিহ্যের অনুসৃতি ।
পুরুলিয়া ছৌয়ের স্বকীয় আর এক বৈশিষ্ট্য হলো আরেক ধরনের মুখোশসমষ্টি, যা পশু- পাখিকে ঘিরে রচিত হয়। ভারতের অন্য নৃত্য-নাট্যগুলোতে জীবজন্তু, পশু কিংবা নরাকার অথবা পশুদেহী দেবতাদের মুখোশ কেবল সেই জীবের মুখ অথবা মাথার সীমায় সীমায়িত থাকে। কিন্তু পুরুলিয়া ছৌয়ে পশু-পাখির রূপায়ণে দেহের গোটা অংশ মুখোশের আবরণে আবৃত দেখানো হয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, বরাহ কিংবা শূকর অবতার। সে কেবল মুখে বরাহের মুখোশ পরে আবির্ভূত হয় না, তার বদলে চার পায়ে হেঁটে গোটা একটা বরাহই যেন নাট্যস্থলীতে প্রবেশ করে, তার পৃষ্ঠদেশ বরাহের দেহ চর্মে থাকে আবৃত।
পুরাণের অন্য চরিত্রসমূহ, বিশেষ করে সাপ ও কচ্ছপ, এমনসব শিল্পীর দ্বারা রূপায়িত হয়, যারা শুধু মাটিতে হাতে-পায়ে ভর দিয়েই চলে না, প্রয়োজন হলে তলপেটের সাহায্যে হামাগুঁড়ি দিয়েও চলে। পাখিদেরও দেখানো হয় এক জোড়া ডানা এবং মুখ ও মাথার মুখোশসমেত, শরীরে থাকে এমন পোশাক, যা পাখির শরীরের প্রতিরূপ।
এদিক দিয়ে পুরুলিয়া ছৌ এমন এক ঐতিহ্যের বাহক, যে ঐহিত্য ভারতের অন্যান্য প্রান্তে তিরোহিত হয়েছে বলে সন্দেহ হয়। নাট্যশাস্ত্রের পুরো একটি অধ্যায় এ বিষয়ের আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট আছে, লোকধর্মী ঐতিহ্য অনুযায়ী মুখোশ ও গাত্রচর্মের সাহায্যে জীবজন্তু ও পাখি, সরীসৃপ প্রভৃতির প্রতিনিধিত্বকরণ এই আলোচনার বিষয়বস্তু।
পুরুলিয়ায় আজ আমরা যা দেখছি তা সম্ভবত ভরত বর্ণিত ঐতিহ্যের ধারানুসৃতি । চলার ধরন, প্রবেশরীতি, গতিভঙ্গিমার বেলায় যেমন, তেমনি নটশিল্পীদের পরিহিত এই সমস্ত মুখোশ, মুকুট বা শিরস্ত্রাণ প্রভৃতির বেলায়ও বেশকিছুটা সূক্ষ্ম শিল্পরীতি ও মুদ্রাভ্যাস লক্ষ্যগোচর হয়। সেরাইকেলা ছৌ নৃত্যে বহু প্রকার মুখোশ ও চরিত্র পরিকল্পনার রকমারি আদল দেখা যায়।
কিন্তু তাতে বড় আকারের মুকুট বা শিরস্ত্রাণ পরার রীতি নেই। পুরুলিয়া ছৌয়ে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র বিভিন্ন রকমের মুকুট পরিধান করে। যদিও এইসব মুকুটের নির্মাণক্রিয়ায় যক্ষগান ও কথাকলির মুড্ডিসদৃশ সূক্ষ্ম কারুকার্য কিংবা জটিল রচনাবর্ত নেই, তাহলেও তাদের নিজস্ব বৈচিত্র্য কিংবা কারুকার্য কিছু কম নয়।
একটা মৌলিক কাঠামোর ওপর নানাবিধ কৃত্রিম মুক্তাপাতি, চুমকি, ফিতা এবং অন্যসব সরঞ্জাম বিভিন্ন চরিত্রের উপযোগী করে বিভিন্ন ছাঁচে সাঁটা হয়। পূর্বে যেসব কম্পনযুক্ত গতিভঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো যখন চারপাশের অর্ধালোকের পরিবেশে এইসব মুকুট শিরস্ত্রাণসমেত অভিব্যক্ত হয়, তাতে করে এক অদ্ভূত আলো-ছায়ার ইন্দ্রজালের সৃষ্টি হয়।
বলাই বাহুল্য, অভিনেতা এই সবকিছুকে চরম এক নাটকীয় উদ্দেশ্যসাধনের অবধারিতভাবে প্রয়োগ করে। ইতিপূর্বে আমরা পুরুলিয়া ছৌয়ের শিল্পীদের শ্রেণী কাঠামোর উল্লেখ করেছি, ভূমিজ ও মুরারা পুরুলিয়া ছৌ নাচে আর ডোমেরা বংশানুক্রমিকভাবে গাইয়ে বাজিয়ের কাজ করে।
পুরুলিয়া ছৌয়ের মুখোশ নির্মাতারাও বাগমুণ্ডির কাছে বসবাসকারী একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। যে গ্রামে বাস তার নাম ছোড়দিয়া বা ছোড়দা। গ্রামে যদিও বহু সম্প্রদায়ের বসতি তাহলেও তাদের ভেতর একটি সম্প্রদায়ই কেবল মুখোশ বানানোর কাজে সবিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে এরাই একমাত্র জাত, যারা পুরুলিয়া ছৌয়ের মুখোশ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। লোকে এই জাতটিকে মুরা বা মুণ্ডাদের মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখানোর চেষ্টা করেছে (মুরাদের মধ্য থেকেই নাচের উস্তাদদের আহরণ করা হয়ে থাকে)।
তবে অপেক্ষাকৃত নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণে ধরা পড়বে যে, মুখোশ নির্মাতা সম্প্রদায় পুরুলিয়া ছৌয়ের ঐতিহ্য ক্রমাগত ওস্তাদ শ্রেণী গম্ভীর মুরাদের থেকে স্পষ্ট আলাদা একটি শ্রেণীরূপে চিহ্নিতব্য ।
ছোড়দিয়ার মুখোশ নির্মাতাকে আবার গ্রামদেবতাসমূহেরও নির্মাতা এবং বর্তমানে তারা হয় পুরুলিয়া ছৌ নাচের পরবকালে অর্থাৎ বৈশাখ মাসে কিংবা দুর্গাপূজার সময়ে খুবই কর্মব্যাপৃত থাকে।
দুর্গাপূজা আজকাল এই অঞ্চলে প্রথাসম্মত পূজা পদ্ধতিরূপে গৃহীত হয়েছে। মুখোশগুলো সেরাইকেলা ছৌয়ের মুখোশের মতো কাঠের তৈরি নয়, সেগুলো স্থানীয় নদীমৃত্তিকা, ন্যাকড়ার ফালি, কাগজ প্রভৃতির সমবায়ে তৈরি। মাঝেমধ্যে অবশ্য কাঠেরও ব্যবহার দেখা যায়। নির্মাণপদ্ধতি সরল।
প্রথমে একটা খসড়া নকশা কিংবা ছাঁচ মাটির দ্বারা তৈরি করা হয়। একে বলা হয় মাটি গড়া। খসড়া ছাঁচটির ওপর তাড়া তাড়া কাগজ লাগানো হয়। ওই কাগজকে বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে বলা হয় কাগজ চিথনা। কাগজসমেত মৃন্ময় ছাঁচটি অতঃপর চিত্রিত করা হয়। যেখানে যেখানে দরকার কাপড়ের টুকরা সাঁটা হয়।
এই প্রক্রিয়াটিকেও বেশ একটা মৃত্তিকাগন্ধী সাদামাটা নামে বলা হয় কাপড় সেঁটানো । একবার এই নকশার কাজ সারা হয়ে যাওয়ার পর গোটা মুখোশটাকে পালিশ করা হয় আর কাঠের হাতুড়ি পিটিয়ে ধারাগুলোকে মসৃণ করে তোলা হয়।
অলংকরণের টুকরো কাজ, চক্ষুদ্বয় ছিদ্রকরণ, নাসারন্ধ্র ছিদ্রকরণ প্রভৃতি একেবারে শেষ ধাপের কাজের সাহায্যে মুখোশগুলোর সম্পূর্ণতা বিধান করা হয়। যে শ্রেণী বা লোকেরা মুখোশ তৈরি করে, মুকুটও তারাই তৈরি করে। তবে মুকুট প্রভৃতি পুরুষের চেয়ে মেয়েরাই বেশি তৈরি করে।
পুরুলিয়া ছৌয়ের পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ের সহাবস্থানের আরেক ইতিবৃত্ত আমরা শুনতে পাই। একদিকে যখন মুখোশ, শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি কালাতীত ও তারিখ চিহ্নবিহীন আদিম উপকরণাদির এক ধারণা গড়ে তোলে, অন্যদিকে তখন সাজসজ্জা, পোশাক-আশাক প্রভৃতি এমন এক অনুষঙ্গের সৃষ্টি করে, যা নিশ্চিতভাবেই সময়সীমার দ্বারা বন্ধ ও চিহ্নিতব্য।
ছৌ নাচের চরিত্রসমূহের ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক-পরচ্ছিদ খুবই সুসমৃদ্ধরূপে জাকালো, সেগুলো ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের আমলের পোশাকের কথাই বহুলাংশে মনে করিয়ে দেয়। এ কথা দক্ষিণ ভারতের কিছু কিছু নাচের পোশাক সম্বন্ধেও মর্মান্তিকভাবে সত্য, বিশেষ করে যক্ষগানের আধুনিক সংস্করণ ও মেলাতুর ভাগবতমেলার পোশাক সম্বন্ধে তো বটেই।
পুরুলিয়া ছৌয়ের বেশভূসা মনে হয় সতেরো শতকের কিংবা আঠারো শতকের গোড়াকার আমলের নবাব ও রাজাদের পরিহিত পোশাক পরিচ্ছদের রীতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল । এই সাজ- পোশাকের শিল্পীরা মনে হয় ওইসব পোশাক-আশাক নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে সময়োচিত সংস্কার সাধন করে কাজে লাগায়।
সুর ও অসুরদের রাজা ও নবাবদের ধরনে রীতিমতো আড়ম্বরপূর্ণ পোশাকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে এই জাতীয় আড়ম্বর ঊর্ধ্বাঙ্গের পরিচ্ছদেই বিশেষভাবে সীমিত থাকে। নিম্নাঙ্গের পোশাক অন্য এক ইতিবৃত্তে কথার সূচনা করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা একটি আঁটসাঁট পায়জামা পরে। বস্তুতপক্ষে আরও স্পষ্টভাবে বললে, চোস্ত পায়জামা পরে।
এই সমস্ত চোস্ত পায়জামার ওপরে নানা বর্ণের গোলাকার সব ফিতার বেষ্টনী থাকে। ফিতাগুলো আবার ভাগে ভাগে দাগকাটা থাকে, তার ফলে যে আদলটির সৃষ্টি হয়, তা হলো এক সৈনিক পুরুষের ও পায়ে ফেট্টি বাঁধা এক রক্ষাকর্মীর (পুলিশম্যান)। এটা ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকের বর্ণাঢ্য বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপার।
ফিতাগুলোর ডোরাকাটা ছক একটা বিশেষ ছাঁচের অনুবর্তন করে। এমনকি একটি অর্থময় প্রতীকেরও সৃষ্টি করে। দেবতাদের এবং বীর নায়কদের ডোরাকাটা ফিতার রঙ সবুজ ও হলুদ, দাবনের কালো ও লাল আবার বিশ্বামিত্র ও হনুমান প্রভৃতি চরিত্রের সাদা। স্পষ্টতই এই বর্ণালীর ভেতর নানা দৃশ্যত-বিসদৃশত উপাদান-উপকরণের অত্যদ্ভূত সহাবস্থান সূচিত হয়েছে।
তা সত্ত্বেও এর মধ্য দিয়েই একটা স্বতঃস্ফূর্ত সজ্জাশৈলী গড়ে উঠেছে। পুরুলিয়া ছৌ নাচের প্রথম চরিত্রটি মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্যটি দর্শকদের মন কেড়ে নেয় । এই জাতীয় অনুরূপ বিসদৃশ ও বিষম উপাদান-উপকরণের একত্র সহ-অবস্থিতি ভারতের অন্যান্য নৃত্য ও নৃত্য-নাট্যরূপগুলোতে চোখে পড়ে।
এইভাবে পুরুলিয়া ছৌ সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক চালচিত্রের অনন্যতার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ প্রক্রিয়ার সূচনা করে। নৃত্যশৈলীটি কতকগুলো অনুন্নত শ্রেণীর লোকেদের এক্তিয়ারভুক্ত একটি শিল্প। বৃত্তিকর্ম ও জীবিকার কর্মের ভিত্তিতে এই সম্প্রদায়ের ভেতর আবার একটি শ্রেণী কাঠামো তৈরি হয়ে উঠেছে।
মূর্তিপূজার পূর্বতন উপাসনাপদ্ধতি এখনো পর্যন্ত বাহিত হয়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কাব্যসাহিত্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং কিছু কিছু পুরাণ কাহিনী এই সমস্ত বিবিধ ঐতিহ্যের স্তর পরম্পরার এমনভাবে জড়াজড়ি, মেশামেশি হয়ে গেছে যে, সেগুলো কালক্রমে এই সমস্ত সম্প্রদায়ের জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
অবশ্য পুরাতন প্রভাবসমূহের ভগ্নাবশেষ এতে মুছে যায়নি, এই সমস্ত বিবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অন্তঃসম্পর্ক সবচেয়ে বেশি সোচ্চার নৃত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে। যদিও এর আগেকার আচার-আচরণ প্রথা ইত্যাদির প্রভাব লক্ষ্য করার মতো, তাহলেও নাচগুলোর কাহিনীগত বিষয়বস্তু মহাকাব্যদ্বয় ও পুরাণগুলোর ঐতিহ্যের ওপর মুখ্যাংশে নির্ভর করে।
অবশ্য চরিত্রগুলোর রূপায়ণের ধারা ও চরিত্রাঙ্কন পদ্ধতি পূর্বপ্রচলিত বিশ্বাস ও অভ্যাস এবং নিতান্ত স্থানীয় প্রসঙ্গগুলো সম্বন্ধে সচেতনতার পরিচয় চিহ্ন পরিষ্কার বহন করছে । গ্রাম্য দেবতাসমূহ ও তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো রাম-রাবণের দুর্গা ও লক্ষ্মীর, অভিমন্যু ও অর্জুনের চরিত্র পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
রূপকর্মের দিক থেকে বিচার করলে পুরুলিয়া ছৌয়ের ঢোলবাদক এবং গায়ককে সংস্কৃত নাট্য ঐতিহ্যের সূত্রধারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে সংস্কৃত নাটকের ঋজু গঠনশৈলীর আদর্শের তেমন কোনো প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও সামান্যই সেই প্রভাব বলা যায়। দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যরূপগুলোতে কিন্তু এই প্রভাব নির্ভুলভাবে প্রকট ।
এই নাচে অভিনয়মূলক কয়েকটি ভাগে ও কোটায় ভাগ করার কোনো রীতি প্রচলিত নেই। কিন্তু অন্য নৃত্যশৈলীগুলোতে এই জাতীয় বিভাজনরীতি বিদ্যমান দেখা যায়। এ আর কিছুই নয়, সংস্কৃত রঙ্গমঞ্চের কক্ষ বিভাগ এর এলাকা বিন্যাসের অনুক্রমণ মাত্র।
এখানে অভিনয়স্থলটি স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা হয়, মঞ্চের বিভিন্ন এলাকাকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ-চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। এ ছাড়া পুরুলিয়া ও সেরাইকেলা নাচে বিদূষক চরিত্রের অনুপস্থিতি অতি প্রকট, অথচ এই বিদূষক চরিত্রই কিনা কুটিয়ট্টম, যক্ষগান ও ভাগবতমেলার ঐতিহ্য একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
কাজেই এ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পূর্বভারতের এই তিন শিল্পরূপ, অর্থাৎ ছৌ ত্রয়ী, সেসব জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মৃত্তিকার শেকড় থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে সম্প্রদায়ের মানুষেরা খুব সম্ভব সংস্কৃত ঐতিহ্যের সরাসরি উত্তরাধিকার লাভ করতে পারেনি, যেমনটা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের শিল্পরূপগুলোর বেলায়।
যে জনগোষ্ঠীগুলো এই শিল্পরূপগুলোর চর্চাকারী তাদের কথা মনে রাখলে এর কারণ বোঝা সহজ হবে, সেইসঙ্গে এ তথ্যও বোধ হয় মনে রাখা দরকার যে, এই তিনটি নৃত্যরূপ আজ আর কাব্যভাষার ওপর নির্ভরশীল নয়। শুধু তাই নয়, উড়িষ্যা, বিহার ও বাংলায় পনেরো ও আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বিকাশমান সাহিত্য ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের কোনো নিগূঢ় যোগও নেই।
পূর্বাঞ্চলের যে বিশিষ্ট শিল্পরূপ বিশুদ্ধ নাট্যদৃশ্যরূপে পরিগণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যসৃষ্টি থেকে তাদের প্রেরণা সংগ্রহ করেছে তার নাম যাত্রা। যাত্রা অথবা চলন্ত নাট্য, শিল্পশ্রেণী হিসেবে উড়িষ্যা, বিহার বাংলা, মণিপুর ও আসাম সর্বত্রই সুপ্রচলিত শিল্পধারার এটি এক সমান্তরাল প্রবাহ, যার সম্পর্কে আমরা স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা কবর ।
তা সত্ত্বেও নৃত্য পরিভাষায় যাকে মার্গী উপাদান বলা হয়, তেমন উপকরণ তিনটি ছৌ নাচেই প্রত্যক্ষ। কাজেই এই শিল্পরূপগুলো যদিও তাদের সমাজতাত্ত্বিক চরিত্রের কারণে ও কাব্যবাণীর অভাববশত নিশ্চিতরূপেই দেশি,
তাহলেও বিশদ আনুষ্ঠানিক খুঁটিনাটি পৌরাণিক বিষয়বস্তু, পরিশীলিত নৃত্যভাষা ও মুখোশশিল্পের ছিমছাম রূপের দরুন তাদের মার্গী বলতেই হয়। সব মিলিয়ে এগুলো এক বৃহৎ নৃত্যগোষ্ঠীর পর্যায়ভুক্ত।
আরও দেখুনঃ