আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পঞ্চাশের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি চর্চা সেলিনা বাহার জামান , যা বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা এর অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি চর্চা সেলিনা বাহার জামান
এই দেশ ভাগ বা দেশ ত্যাগের ফলে সেদিন সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছিল নানা রকম সমস্যা। ব্যাপকহারে দেশত্যাগের ফলে সাংস্কৃতিক ভুবনে দেখা দিয়েছিল শূন্যতা। এই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার ছিল না। বিশেষ করে ঢাকার সাংস্কৃতিক জগতের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল।
শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক সব ক্ষেত্রেই এই শূন্যতা ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল সমগ্র সমাজকে। যাই হোক, ধীরে ধীরে এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল এ দেশের মানুষ। বিরুদ্ধ পরিবেশে বহু মানুষের পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল সুস্থ-সাংস্কৃতিক চর্চার এক পরিবেশ। তখনকার মানুষ আজকের মতো উগ্র, হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেনি। মানুষ ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ সহানুভূতিশীল আর পরোপকারী। তাই সে সমাজের সংস্কৃতিও বহমান ছিল শাস্ত্র নদীটির মতো।
১৯৪৭-৪৮ সালে ঢাকার নৃত্যাঙ্গনে প্রায় কোনো শিল্পীই ছিল না। একমাত্র নৃত্য শিক্ষক ছিলেন কেষ্ট পাল, তিনি নিজে পারফর্মার ছিলেন না, কখনো নৃত্য প্রদর্শন করতেন না। একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে অতি ধীরে ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে তিনি অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। নৃত্যনাট্য নয়, একক নৃত্য বা দলনৃত্যে অংশ নিতেন ছাত্রীরা।
এদের মধ্যে টলি রায় পালঠি, মঞ্জু খাসনবীশ, রুনা ভৌমিক ও মঞ্জু ভৌমিক ছিল প্রধান। এদের সঙ্গে যোগ দেয় নার্গিস মুর্শিদা ও সেলিনা বাহার। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিল সর্বকনিষ্ঠ মঞ্জু ভৌমিক। মঞ্জু অজন্তার জাগরণ নৃত্যে অজন্তা সাজত। ওর মেজ বোন রুনু ভৌমিক অজন্তাকে জাগাত।
আর একটি নৃত্য দেবদাসী এতে মঞ্জু নিজেই অংশ নিত। প্রিয়নাথ স্কুল প্রাঙ্গণে (এখনকার নবাবপুর স্কুল) অনুষ্ঠিত হয়েছিল এসব অনুষ্ঠান।নার্গিস মুর্শিদা ইরানি নত্যূ পরিবেশন করত। এটাই প্রধান একক নৃত্য, যা সে বেশি প্রদর্শন করত। নজরুলের গানের তালে জিপসি মেয়েদের পোশাক পরে সে নাচত। গানটি ছিল-‘নাচে ইরানি মেয়ে/মরুর পাশে যেন আধ জোছনা/জিপসি মেয়ে যেন বাঁশি বাজায়।’
সিনেমা হলে (এখন নাম নিশাত, বংশালে অবস্থিত) অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর একটি অনুষ্ঠান। এতে গানের সঙ্গে নৃত্যে অংশ নেয় মঞ্জু খাসনবীশ, রুনু ভৌমিক, মঞ্জু ভৌমিক, টলি রায়, পালঠি ও সেলিনা বাহার। গানটি ছিল রাঙামাটির দেশে/বনের চায়ে/পাতার কুটীর বাঁধি।
১৯৪৯ সালে কলকাতা থেকে নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ঢাকায় এসেছিলেন তার দলবল নিয়ে। সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে বুলবুল তার দল নিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার যক্ষ্মা নিবারণী অভিযান চালাচ্ছিলেন। তার উদ্যোগেই বুলবুলের এই অনুষ্ঠান মঞ্চায়িত হয়।
অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রয়লব্ধ যাবতীয় অর্থ যক্ষ্মা নিবারণী অভিযান ফান্ডে অনেকের হয়তো জানা নেই যে, বুলবুল চৌধুরী বিভাগপূর্ব আমলে কলকাতায় নৃত্য প্রদর্শন করে যথেষ্ট নাম করেছিলেন। কলকাতার মঞ্চে তিনি সেকালের নৃত্য পটিয়সী সাধনা বসুর সঙ্গেও নৃত্য প্রদর্শন (পারফর্ম) করেছিলেন। বুলবুলের আসল নাম রশিদ আহমদ চৌধুরী। কিন্তু নৃত্য জগতে তিনি বুলবুল চৌধুরী নামেই খ্যাত।
ঢাকার মঞ্চে তিনি যেসব নৃত্য প্রদর্শন করেন, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুন্দুভির আহ্বান বা কল অব দ্য নেশন। এতে যুদ্ধের সাজে তিনটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে নৃত্য প্রদর্শন করে, তাদের যুদ্ধ করতে আহ্বান জানায় একজন ড্রাম বাজনার মধ্য দিয়ে। যিনি ড্রাম বাজান তার নাম শম্ভু। যোদ্ধা মেয়েরা হচ্ছেন- চন্দ্রা, রেখা, লক্ষ্মী। চন্দ্রা সাপের খেলা দেখান সাপুড়ে নৃত্যে।
জীবন ও মৃত্যু নৃত্যে লক্ষ্মী এবং ইরানের এক পান্থশালায় রেখা অপূর্ব অভিনয় করেন।
ইরানের এক পান্থশালা একটি নৃত্যনাট্য। এখানে পথিকগণ পান্থশালায় আসে-যায়, সেখানে কত ঘটনা ঘটে, তারই সুন্দর আলেখ্য। পাছে ভুলে না যাই’ বাংলাদেশে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ওপর রচিত নৃত্যনাট্য। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ কেমন করে অভাব অনটনে ভরে গেল, কেমন করে মাড়োয়ারি চোলাচালানকারী, মজুতকারীতে দেশ ছেয়ে গেল।
তারা চাল- ডাল গুদামজাত করল আর দেশে দেখা দিল খাদ্যাভাব, মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হলো। ডাস্টবিন থেকে একই সঙ্গে মানুষ আর কুকুর খাবার খুঁজে খেল, ছেলে কোলে দ্বারে দ্বারে ঘোরে দুটো ভাতের জন্য, এক ফোঁটা মাড়ের জন্য ভুখা মানুষেরা ঘুরে বেড়ায়, ‘মা, দুটি ভাত দাও/ মা একটু মাড় দাও।’
সেই ছবি বুলবুল এঁকেছিলেন তার ‘যেন ভুলে না যাই’ নৃত্যনাট্যে। অপূর্ব সুন্দর সে নৃত্যনাট্য। বুলবুলের স্ত্রী আফরোজা বুলবুল সেলেছিলেন অভাবী গ্রাম্য রমণী, ওদের কন্যা ছোট্ট নার্গিস মায়ের সঙ্গে ভিক্ষা করছিল। আর বুলবুল সেজেছিলেন ‘প্রতারক’- বিদেশি প্রতারক, সুট-টাই পরে সিগারেট হাতে স্টেজে উঠেছিলেন।
বছরখানেক পরে ঢাকার কার্জন হল মঞ্চে আবারও বুলবুলকে দেখা যায়। এবার একটি নতুন নৃত্য প্রদর্শন করেন তার স্ত্রী, চাঁদ সুলতানা । এটি একটি একক নৃত্য। এই নৃত্যের কম্পোজিশন বুলবুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ইতিহাস থেকে কাহিনী আহরণ করে দেখিয়েছেন চাঁদ সুলতানা কেমন করে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর বুলবুল কলকাতা ফিরে যান।
এ সময় কামরুন্নেসা স্কুলের দুই ছাত্রী জয়শ্রী সেন ও রওশন আরা ঢাকার মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শন করত। জয়শ্রীর বাবা ছিলেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ত্রিপুরাশঙ্কর সেন শাস্ত্রী । ১৯৫০ সালের শুরুতে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে জয়শ্রী কলকাতা চলে যায় এবং পরে ছায়াছবিতে অভিনয় করে।
এ সময় আরও অনেকের সঙ্গে কেষ্টপাল বাবু, ভৌমিক পরিবার (বাবা মাসহ ওরা তিন বোন, ঝুনু ভৌমিক যিনি সেকালে ঢাকা রেডিওর সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন, রুনু ভৌমিক, মঞ্জু ভৌমিক), মঞ্জু খাসনবীশ ঢাকা ত্যাগ করেন। মঞ্জুর বাবা সরকারি কলেজের গণিতের অধ্যাপক খাসনবীশ ঢাকায় থেকে যান, কিন্তু পরিবার- পরিজনকে কলকাতায় পঠিয়ে দেন। শুধু এরা নন, সংস্কৃতি জগতের অনেকেই ১৯৪৭-এর পর ১৯৫০-এ ঢাকা ত্যাগ করেন।
১৯৫০-এ কলকাতায়ও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। সে জন্য অনেকে কলকাতা থেকেও ঢাকা চলে আসেন। এদের মধ্যে মোসলেহউদ্দীন আহমদ ও তার স্ত্রী বদরুননেসা আহমদ ঢাকায় আসেন সপরিবারে ১৯৫০ সালে এবং গেন্ডারিয়ায় বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। বদরুননেসা আহমেদ, আশালতা সেনের সহযোগিতায় গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি স্থাপন করেন এবং আশালতা সেন এই সমিতির প্রেসিডেন্ট ও বদরুননেসা আহমদ সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
বদরুননেসা আহমেদের ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে, তার দুই মেয়ে মেহের ও জিনাত, ডাক নামে বড় খুকী-ছোট খুকী নৃত্যে ও খেলাধুলায় দক্ষতা প্রদর্শন করে এবং সাংস্কৃতিক জগতে আলোড়ন আনে। বিশেষ করে বড় খুকী নৃত্যে যথেষ্ট নাম করে। সেকালে মেয়েরা কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিত না পর্দার কারণে। বড় খুকী (মেহের আহমেদ) স্কুলের অনুষ্ঠান ছাড়াও ঢাকার প্রায় সব অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে তখন ছাত্রদের সংস্থা ‘শিল্পী সংঘ’ খুব নাম করেছিল। তারা ঢাকায় অনেক নৃত্যানুষ্ঠান ও নাটক করতেন। তাদের অন্যতম সভ্য সাজেদুর রহমান (যার ডাক নাম মাস্তানা, এই নামেই সবাই তাকে চিনত) ছেলেমেয়েদের নাচ শেখাতেন এবং কম্পোজ করতেন। তিনি নিজে কখনো স্টেজে উঠতেন না, সব সময় নেপথ্যেই থাকতেন। তার ভূমিকা ছিল প্রশিক্ষকের। বহু অনুষ্ঠানে মাস্তানার কাছে নাচ শিখে মেহের স্টেজে উঠেছে, নৃত্যনাট্যে অংশ নিয়েছে।
একবার নজরুলের জন্মদিনে একটি ছায়ানাট্য অনুষ্ঠিত হলো। এতে মেহের নজরুলের ভূমিকায় রূপদান করেছিল। লিলি মমতাজ খান (বাবার নাম বিএ খান) তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী, নাচতেন প্রায়ই । একবার মেহবুব আলী ইনস্টিটিউটে কালো ডুরে শাড়ি পরে সাপ সেজেছিলেন এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্র মতিউর রহমান সেজেছিলেন সাপুড়ে। লুলু বিলকিস বানু (ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর ও সারা তৈফুরের বড় মেয়ে) সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’র সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করেন তখনকার ঢাকার রমনা অঞ্চলে অনুষ্ঠিত শিল্পমেলায়। তার এ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচায়ক ছিল তখনকার রক্ষণশীল ঢাকার সমাজে। এবার নাটক প্রসঙ্গে আসা যাক। ভিক্টোরিয়া পার্ক (এখনকার বাহাদুর শাহ পার্ক) অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় উদয়নালা নাটক।
এই ঐতিহাসিক নাটকে অংশ নিয়েছিলেন অনেকের সঙ্গে সুরেশ দত্ত, প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনিই। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সুরেশ দত্তের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুরেশ দত্ত প্রধানত মেকাপম্যান, ঢাকায় যত অনুষ্ঠান হতো সেটা নৃত্যানুষ্ঠান হোক আর নাটকই হোক সুরেশ দত্তের উপস্থিতি সেখানে আছেই। নাটকের ছেলেমেয়েরা বা নৃত্যশিল্পীদের মেকাপ না দিলে অনুষ্ঠান হতে পারত না।
সুরেশ দত্ত বছরের পর বছর, তার মৃত্যু পর্যন্ত শিল্পীদের মেকাপ দিয়ে গেছেন। সুরেশ দত্তের মেয়ে গীতা দত্ত সেকালে একজন নিয়মিত নাট্যশিল্পী ছিলেন। এখন আর নাটক করেন না । ‘মিসর কুমারী’ আর একটি নাটক, যা ঢাকায় একাধিকবার অভিনীত হয়েছে। এটা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হয়।
কার্জন হলে এ নাটকের অভিনয়ের দিন প্রধান অতিথি ছিলেন আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, তিনি তখন কামরুননেসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক । মিসর কুমারীর নায়িকা নাহরীন চরিত্রেও রূপ দিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ফখরুজ্জামান । নাটকের প্রধান কাফ্রি চরিত্রে রূপ দেন মেডিকেল কালেজের ছাত্র আবুল হাশিম (এখন আবর দেশে স্ত্রীসহ বসবাস করেন। স্ত্রীর নাম মেরিনা পন্নী)।
অন্যান্য চরিত্রে রূপ দিয়ে ছিলেন বদরুল আলম (পরে শিশু চিকিৎসক বদরুল আলম, বর্তমানে প্রয়াত) ও সলফুল আলম (ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে শেষজীবনে ভিওএ-তে কাজ করতেন, এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন ওয়াশিংটনে)।
দুজন ডাক্তার, ডা. সুক্কুর আর ডা. আজম তাদের সঙ্গে অভিনয় করেন। এরা দুজনই সবসময় ছাত্রদের নাটকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এরা আজও জীবিত, বয়স আশির কাছাকাছি। এই সময়কালে আনোয়ারা বাহার চৌধুরী কামরুন্নেসা স্কুলে ‘সুরবিতান’ নামে নৃত্যগীতবাদ্যের স্কুল খোলেন।
এটাই এ জাতীয় প্রথম স্কুল দেশ বিভাগের পর। তখন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন এহসানুল হক। আনোয়ার বাহার চৌধুরী তাকে একটি চিঠি দেন, তার সুরবিতানের জন্য শিক্ষক চেয়ে। এহসানুল হক তাৎক্ষণিক চিঠির জবাব দিয়ে রেডিও স্টাফ ও আর্টিস্টদের স্কুলে শিক্ষকতা করার অনুমতি দেন, যা শিক্ষক সংগ্রহে সহজ হয়। আব্দুল আহাদ রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক হন।
এ ছাড়া আরও আছেন হুসনা বানু খানম, লায়লা আর্জুমান বানু নজরুলগীতি, আবদুল লতিফ আধুনিক গানের, খাদেম হোসেন খান সেতারে, সুরুজ মিয়া গিটারে শিক্ষকতা শুরু করেন। নৃত্যে ছিলেন গওহর জামিল। তার আসল নাম গণেশ নাথ। তিনি ওই সময়কালে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে গওহর জামিল নাম ধারণ করে রওশনারাকে (তার কথা আগে বলা হয়েছে) বিয়ে করেন।
সেকালে এই বিয়ে ঢাকা শহরে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। রওশনারা পরবর্তীকালে রওশন জামিল নামে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। কামরুন্নেসা স্কুল সাপ্তাহিক দুই দিন বন্ধ থাকত। সেই দুই দিন সকালবেলা সুরবিতানের ক্লাস হতো স্কুল ভবনে। স্কুলের অনেক ছাত্রী সুরবিতানে ভর্তি হয়েছিল নাচ শেখার জন্য। রীনা সুলতানা সেতার শিখে দারুণ নাম করেছিল।
১৯৫১ সালে কার্জন হল মঞ্চে সুরবিতানের ছাত্রীরা ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত খুলনার মানুষের জন্য বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ১৯৫১ সালে দেশে প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার ছিলেন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। আবদুর গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা থেকে এ তথ্য জানা যায়। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন দিনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিল কার্জন হল মঞ্চে।
মুজিবুর রহমান খাঁ ও সেতারা সাত্তার (যার আসল নাম আয়শা আক্তার, পরবর্তীকালে সেতারা সাত্তার নামে রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে খ্যাত হয়েছিল) এর প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, রেদওয়ানুর রহমান খান প্রমুখ। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি সংসদও ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গনে বৃহৎ ভূমিকা পালন করে।
১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা মিছিল করলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবুল বরকত, সালাম, শফিউর রহমান, সালাউদ্দিনসহ আরও অনেকে। দেশে শিল্প ও সাহিত্য দারুণভাবে প্রভাবিত হয় এই ঘটনায়। মুনির চৌধুরীর নাটক ‘কবর’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মঞ্চস্থ করে। অনেক লেখার মধ্যে অজিত কুমার গুহের ‘বুলু’ গল্প নামে দারুণ দাগ কাটে। ১৯৫৪ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এলিনর রুজভেল্ট এসেছিলেন ঢাকা সফরে ।
তার সম্মানে অল পাকিস্তান ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকা শাখা বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ‘মেরি এন্ডারসন’ প্রমোদ তরীতে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। ওখানে মধ্যাহ্নভোজেরও আয়োজন করা হয়। তখন সুরবিতানের ছাত্রী মেহের আহমেদ, জিনাত আহমেদ, সেলিনা বাহার, হাসনা বানু সাঁওতালী নৃত্য পরিবেশন করে। পুষ্প জলতরঙ্গ বাজিয়ে শোনায়। ১৯৫৫ সালে আনোয়ারা বাহার চৌধুরী বদলি হয়ে গেলে সুরবিতান বন্ধ হয়ে যায়।
নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার বন্ধু-বান্ধব ও হিতৈষীদের চেষ্টায় মাহমুদ নুরুল হুদার উদ্যোগে ঢাকায় সাত নম্বর ওয়াইজ ঘাটের ওয়াইজ হাউসে বুলবুলের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে (১৭ মে ১৯৫৫) প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (Bulbul Academy of Fine Arts, BAFA) ১ জুলাই ১৯৫৫ সালে একাডেমীর ক্লাস শুরু হয়। বুলবুল চৌধুরীর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী আফরোজা বুলবুলকে একাডেমীর প্রিন্সিপাল করা হয়।
নৃত্য বিভাগে বুলবুলের দলের নৃত্যশিল্পী অজিত সান্যাল ও সেতারে খাদেম হোসেন খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। গিটারের শিক্ষক নিযুক্ত হন বোরহান আহমেদ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিখিল দেব, আধুনিক গানে আবদুল লতিফ, নজরুলগীতিতে বেদার উদ্দিন আহমেদ, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বিমল বাবু শিক্ষক পদে যোগ দেন। পরবর্তীকালে বিমল বাবু বাফার অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
বুলবুল একাডেমীর কার্যানির্বাহী কমিটির সভাপতি ছিলেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, সহসভাপতি মোহাম্মদ মোদাব্বের, সম্পাদক মাহমুদ নুরুল হুদা, সহসম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, সদস্য অজিত কুমার গুহ, এম এ মোহায়মান, সৈয়দ আহমদ হোসেন ও আনিসুজ্জামান (বর্তমানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান)।
১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বুলবুল একাডেমী বুলবুল মেমোরিয়াল কনভেনশনের আয়োজন করে। এ উপলক্ষে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুচিত্রা সেন ও দেবব্রত বিশ্বাস এসেছিলেন ঢাকায়। বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে একাডেমীর খোলা চত্বরে সামিয়ানা টানিয়ে সাত দিন ধরে অনুষ্ঠান চলছিল। একদিন কবিয়াল রমেশ শীলের কবিলড়াই হয়েছিল। আরেকদিন ‘রূপবান’ যাত্রা।
১৯৫৬ সালের মার্চ মাস। বুলবুল একাডেমীর আমন্ত্রণে বিশ্বভারতী থেকে শ্রী শান্তিদেব ঘোষের নেতৃত্বে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক দল ঢাকা আসে। এই দল চার দিন রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে। শ্যামার নৃত্য পরিচালনা করেন প্রফেসর নায়ার। শ্যামার ভূমিকায় ছিলেন উমা গান্ধী আর সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। বজ্রসেন সেজেছিলেন প্রফেসর নায়ার। ঢাকাবাসী মুগ্ধ হয়েছিল শ্যামা নৃত্যনাট্য দেখে।
১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি কলকাতা থেকে ভক্তিময় দাশগুপ্তকে নিয়ে আসা হয় বুলবুল একাডেমীর রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান শিক্ষক করে। ভক্তিময় দাশগুপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তার কাছে চার বছর রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নেন জাহেদুর রহিম, আবু হেনা সাদউদ্দীন চৌধুরী, আবদুর রহিম, বাশিরা বারি (মান্নান), নাসরীন চৌধুরী। পরের বছর আরও তালিম নেন ফাহমিদা মালিক, মিনি জাহানারা, আয়শা খাতুন প্রমুখ ।
নৃত্যে রাহিজা খানম ঝুমু (এখন বুলবুল একাডেমী অধ্যক্ষ), মন্দিরা নন্দী, জ্যাকব পিউরিফিকেশন, অজিত দে, নুরুন্নাহার প্রমুখ প্রথম সার্টিফিকেট লাভ করে। পরে ডালিয়া নীলুফার, দুলাল তালুকদার, লায়লা নার্গিস (হাসান), লায়লী চৌধুরী, জুবায়দা মাহবুব বাফা থেকে সার্টিফিকেট লাভ করে।
১৯৫৬ সালের শেষে চীন থেকে পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। তখন জিন্নাহ এভিনিউয়ে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) সদ্য গুলিস্তান সিনেমা হল হয়েছে (যা কদিন আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে)। এ সিনেমা হলের মঞ্চে পাক-চীন মৈত্রী সমিতি চৌ এন লাইয়ের জন্য বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করে।
বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর (বাফা) ওপর ভার দেওয়া হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বাফা “ইন্টারনেল ফ্রেন্ডশিপ’ বা ‘চিরকালের বন্ধুত্ব’ শিরোনামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে। নৃত্যপরিচালনায় ছিলেন অজিত সান্যাল, আবহসঙ্গীত পরিচালনায় খাদেম হোসেন খান। নৃত্যনাট্যের সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত ।
বুলবুল একাডেমীর ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই ১৯৫৭ সালে জানুয়ারি মাসে ভক্তিময় দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। চণ্ডালকন্যা প্রকৃতি সেজেছিলেন অঞ্জলি আর মা সেজেছিলেন মেহের আহমেদ। বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দ হয়েছিলেন মন্দিরা নন্দী, চুড়িওয়ালির ভূমিকায় রূপ দেন রাজিহা খানম ঝুনু আর দুধওয়ালার ভূমিকায় রূপ দেন শাহিদা আহমেদ (আলতামাস)।
ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শিশুনৃত্যনাট্যের প্রকৃতির লীলা মঞ্চায়িত হয়েছিল। ডালিয়া নীলুফার, লায়লা হাসান, লায়লী চৌধুরী, দুলাল তালুকদার, ইরা ইদ্রিস ছিল এর অংশগ্রহণকারী শিল্পী। এই সময়কালে ‘ঐকতান’ নামে একটি সঙ্গীতগোষ্ঠী ঢাকায় বেশ নাম করে। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আরমানিটোলা হাসিনা হাউসের নাসিরুল হক ও তার স্ত্রী । হাসিনা হাউসের একতলা হলঘরেই প্রথমে এদের অনুষ্ঠান হতো।
রফিকুল ইসলাম, আতিকুল ইসলাম, জাহানারা ইসলাম, হামিদা বানু, নাসরীন চৌধুরী, লায়লী চৌধুরী, বুলু চৌধুরী, মাসুমা খাতুন প্রমুখ ঐকতানের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশনাই ছিল তার প্রধান কাজ।
১৯৫৭ সালের জুন মাসে বুলবুল একাডেমীর আমন্ত্রণে কলকাতা থেকে ‘বহুরূপী’ নাট্যগোষ্ঠী ঢাকায় আসে এবং আরমানিটোলায় নিউ পিকচার হাউস সিনেমা হলের মঞ্চে পরপর চার দিন অনুষ্ঠান করে দুই দিন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ ও দুই দিন ‘ছেঁড়া তার’ নাটক মঞ্চস্থ হয়।
বহুরূপীর সভাপতি গঙ্গাপদ বসু, প্রধান অভিনেতা শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মোহাম্মদ জাকারিয়া, নির্মল মিত্র, অমর গাঙ্গুলী, শিশু শাওলী মিত্র এবং আলোকচিত্রী তাপস সেন, শিল্পী খালেদ চৌধুরীসহ চল্লিশজন এই বিরাট দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
১৯৫৮ সালে হঠাৎ করেই দেশে প্রথম সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। বুলবুল একাডেমীর সম্পাদক কারারুদ্ধ হন। কিছুদিন পর ১৯৫৯ সালের শুরুতে বুলবুল একাডেমী পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যনাটককে নৃত্যনাট্যে রূপ দেয় ।
বাফার নতুন নৃত্য শিক্ষক জি এ মান্নানের (যিনি মনীশ কুমার নামে পরিচিত ছিলেন) নৃত্যপরিচালনায় এবং খাদেম হোসেন খানের সৃষ্ট আবহসঙ্গীতে অপূর্ব ঝঙ্কার তোলে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’।
১৯৬১ সালে উদযাপিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। এ বছর ২৫ বৈশাখ ছিল ৭ মে তারিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসু সর্বপ্রথম ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করে। জন্মদিনের নয় দিন আগে, ২৮ এপ্রিল এ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়েছিল।
এ উপলক্ষে কার্জন হলে মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার একটি অংশ। নৃত্যে প্রকৃতি চরিত্রে রূপ দেন মন্দিরা নন্দী, তখনকার ঢাকার প্রথিতযশা চিকিৎসক ডা. নন্দীর ছোট মেষে। প্রকৃতির মায়ের চরিত্রে রূপ দেন সেলিনা বাহার (বর্তমান নিবন্ধের লেখক)। আর আনন্দ সেজেছিলেন আমিনুল ইসলাম তুলা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সঙ্গীতে প্রকৃতির চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছিলেন হামিদা বানু (বুলু), প্রকৃতির মায়ের চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের কন্যা শিরীন বেগম আর আনন্দর গান গেয়েছিলেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত, কোরাস গানে ছিলেন তিন বোন নাসরীন চৌধুরী, মাহীন চৌধুরী, তাজীন চৌধুরী ও অন্যরা। অজিত সান্যাল পরিকল্পিত এ নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা করেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত।
এর পরপরই ঢাকায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ২৫ ও ২৬ বৈশাখ (৭ ও ৮ মে) খুব জাঁকজমকের সঙ্গে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করে। ৭ তারিখে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (সম্পূর্ণ) মঞ্চায়িত হয়। ২৮ এপ্রিলে অংশগ্রহণকারী সব শিল্পী এবারও অংশগ্রহণ করে। সেই সঙ্গে নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদাও (আংশিক) মঞ্চায়িত হয়। এবারও ভক্তিময় দাশগুপ্তই নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা করেন।
নৃত্য পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন বুলবুল একাডেমীর নৃত্যশিক্ষক বাবু রাম সিং। মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় রূপ দেন জান্নাত গণি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিনের মা) অর্জুন সেজেছিলেন একাডেমীর ছাত্র অজিত দে।
গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বিলকিস নাসিরুদ্দিন আর জাহেদুর রহিম। নৃত্যে আরও ছিলেন ডালিয়া নীলুফার, লায়লা নার্গিস (হাসান), লায়লী চৌধুরী, সেলিনা বাহার আর সঙ্গীতে ছিলেন নাসরীন চৌধুরী, মাহীন চৌধুরী, তাজীন চৌধুরী প্রমুখ ।
সে সময় এই নৃত্যনাট্য ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। রাম সিং বাবুকে দিয়ে প্রথমবারের মতো সিলেট থেকে মণিপুরি পোশাক আনা হয়েছিল। বুলবুল একাডেমীর অনুষ্ঠানের পরপরই ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের হিড়িক পড়ে যায় এবং জন্মশতবর্ষ উদযাপনের জন্য কমিটি তৈরি হয়।
এর একটির সভাপতি ছিলেন বিচারপতি মাহবুব মোরর্শেদ। এরপর জুলাই মাসে আট দিন ধরে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালিত হয়। প্রথম দিন কবিতার আসর, দ্বিতীয় দিন গানের আসর (তাতে অনুরোধের গানও ছিল), তারপর নাটক ‘রক্তকরবী’ ও ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘শ্যামা’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্যামা নৃত্যনাট্যে শ্যামার ভূমিকায় ছিলেন মন্দিরা নন্দী, বজ্রসেন সেজেছিলেন কামাল লোহানী (আজকের বিশিষ্ট সাংবাদিক) আর উত্তীয় চরিত্রে রূপ দিয়েছিলেন বালক কিশোর দুলাল তালুকদার (এখন আমেরিকার বোস্টন প্রবাসী)। এ নৃত্যনাট্যটিরও পরিচালক ছিলেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত।
সঙ্গীতানুষ্ঠানে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল আহাদ, আফসারী খানম, লায়লা আরজুমান বানু, বিলকিস নাসিরুদ্দীন, ফাহমিদা খাতুন, ফাহমিদা (গীতি) মালিক, নাসরীন চৌধুরী, তাজীন চৌধুরী, জাহেদুর রহিম, ওয়াহিদুল হক ও আরও অনেকে।
আবৃত্তিতে যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন ফতেহ লোহানী, খোরশেদী আলম, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, গোলাম মোরশেদ, সেলিনা বাহার, সাবিয়া বেগম, ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ আহমদ হোসেন প্রমুখ। নাটকে ছিলেন মকসুদ উস সালেহীন, বজলুল করিম, হাসান ইমাম, ইকবাল বাহার চৌধুরী ও আরও অনেকে।
একটা কথা এখানে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে যে, এ দেশে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচার ও প্রসারে ভক্তিময় দাশগুপ্তের দান অসামান্য। ১৯৫৬ সালে বুলবুল একাডেমীর রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান শিক্ষকরূপে ঢাকায় আসার পর থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছরের অধিককাল তিনি ঢাকায় তো বটেই, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় গান শিখিয়ে বেড়িয়েছিলেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী দেশের সর্বত্র। ফলে রবীন্দ্রনাথের গান ছড়িয়েছে দিকে দিকে।
১৯৬১ সালের নভেম্বরে ভক্তিময় দাশগুপ্ত ঢাকা ত্যাগ করে কলকাতা ফিরে যান। তার অল্পদিন আগে আতিকুল ইসলাম বুলবুল একাডেমীর শিক্ষক পদে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের কিছুদিন পরেই ছায়ানটের জন্ম। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের আরেক পর্বের শুরু।
আরও দেখুনঃ