নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

 

নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

 

নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

প্রাচ্যনৃত্য বিশারদ উদয়শংকর শব্দ বাংলারই নয়—সমগ্র ভারতের এক উজ্জ্বল রত্ন । সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙ্গালী তথা ভারতীয় যিনি জগৎ সভায় ভারতীয় নৃত্যকলার প্রদর্শনও প্রচার করে প্রভূত যশ ও খ্যাতি অর্জন করেচেন। অবশ্য তারও আগে—তাঁর পিতৃদেবই লন্ডনে ভারতীয় নৃত্যের ভিত্তি স্থাপনা করেন । বাঙ্গালী হিসেবে একথা ভাবতেও আমরা গর্ব বোধ করি। উদয়শংকরের নাম আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেক নৃত্যশিল্পী তাঁদের নামের সঙ্গে ‘শংকর’ যত্ত ক’রে নিজেকের গৌরবান্বিত করেন ।

১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে উদয়পরে ( রাজস্থান ) এক বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ পরিবারে এই মহান শিল্পীর জন্ম। নাম তাই উদয়শংকর। পিতা ব্যরিস্টার শ্যামশংকর চৌধুরী সে সময় ঝালোরের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী । সঙ্গীত ও নাটকের বিশেষ অনরোগী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শ্যামশংকর । সেইজন্যই বালক উদয়ের সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি আকর্ষণ দেখে তিনি পত্রেকে নিরুৎসাহ করেননি। ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে বোম্বাইয়ের জে. জে. স্কুল অব আর্টস-এ চিত্রাঙ্কন ও গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে সঙ্গীত-শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর প্রথম সঙ্গীতগরে, ছিলেন বিনয়ক ব বা পটবর্ধন ।

 

নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

 

তিন বছর বোম্বাইতে থাকার পর পিতা শ্যামশংকরের নাটকাভিনয়ে সাহায্যের জন্য উদয়শংকর যান লন্ডনে । প্রথম মহাযুদ্ধে আহত ভারতীয় সৈনিকদের সাহায্যকল্পে শ্যামশংকর এই অনষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। ঝালোর- মহারাণার নৃত্যকার এই উপলক্ষে কয়েকজন বিদেশিনীকে নাত্য শিক্ষা দিতেন । শংকরও এই সুযোগে কিছুদিন নাত্য শিক্ষা করেন। তারপর তিনি ভর্তি হলেন স্থানীয় রয়্যাল কলেজ অব আর্টস-এ। প্রতিভাবান শংকর এখান থেকে বিশেষ যোগ্যতা সহ চিত্রকলায় গ্র্যাজয়েট হন এবং “স্পেনসার” ও “জর্জ ক্লসেন” ( George Clausen ) নামক পরে কার দুটি লাভ করেন । …

রুশীয় নর্তকী অ্যানা পাভলোডা (Anna Pavlova) একবার “ভারতবর্ষে এসে অজন্তা, ইলোরার চিত্র ও অন্যান্য প্রস্তরখোদিত মাতি’গলি দেখে এতই প্রলব্ধে হন যে, ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েই তিনি রয়্যাল কলেজের স্যার উইলিয়ম রথেনস্টাইন-এর ( Sir William Rothenstein) কাছে এমন একজন নত্য সঙ্গীর অনুসন্ধান করেন, যিনি ঐ সব চিত্র ও ভাস্কর্যে’র প্রতিমূর্তি’ হুবহু, নকল করতে সমর্থ। উদয় শংকর ছাড়া এ বিষয়ে যোগ্য আর কোন লোককে তিনি পেলেন না । শংকর পাড় লোভার নত্য সহচর হলেন ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে ।

তৎকালীন খ্যাতনাম্নী নৃত্যপটিয়সী পাড়া লোভার সঙ্গে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে নাত্যপ্রদর্শন করে শংকর অবেই জনপ্রিয় হলেন । “তব; ভরিল না চিত্ত”। তাই প্রায় বছর দেড়েক পরে ঐ দল ত্যাগ করে তিনি ফিরে এলেন নিজ বাসভূমে — ভারতবর্ষে।

 

নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর

 

এদেশে ফেরার পর শংকর প্রথম একক নৃত্য প্রদর্শন করেন কলকাতায়– ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে । এই প্রদর্শনীতে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ভয়সী প্রশংসা করেন অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

দেশবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা ও প্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে তিনি একটি দল গঠন করেন। এই দলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য সঙ্গীত শিল্পী সর্বশ্রী তিমিরবরণ, বিষ্ণুদোস শিরালী, নৃত্য শিল্পী কণকলতা (শংকরের ভগিনী ), অপরাজিতা নন্দী, ফরাসী শিল্পী মাদাম সিমকী প্রভৃতি । বহু অনষ্ঠানে শ্রীমতি কনকলতা তাঁর নৃত্যসঙ্গিনী ছিলেন। এই দল নিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমণ করে প্রচুর যশ ও অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পুনরায় ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের অন্যতম গুণী সঙ্গীতাচার্য’ উদ্ভাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবও প্রায় বছর খানেক শংকরের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ করেচেন।

ভারতে ফিরে এসে (১৯৩৮ খ্রী.) তিনি নিজের মনোমত একটি নৃত্য শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন উত্তর প্রদেশের আলমোড়ার কাছে সিংলা নামক স্থানে। তৎকালীন সরকার তাঁকে এজন্য প্রায় ৯৪ একর ( ? ) জমি প্রদান করেন। “উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচের সেন্টার” প্রতিষ্ঠায় তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেন ইংল্যান্ডের শ্রী ও শ্রীমতী এল. এমহার্স্ট ( L. Elmhirst) ও নিউইয়কের মিস বিয়েবিচ, স্ট্রেট ( Beatrice Straight )। তাছাড়া পৃষ্ঠপোষকতা করেন সর্বশ্রী রোম রোল্যা, রবীন্দ্রনাথ, প. জওহরলাল নেহের, শ্রীমতী সরোজিনী নায়ডু, স্যার উইলিয়ম রথেন,স্টাইন, ন্যার চুনীভাই মাধোলাল, স্যার ফিরোজ খাঁ নান প্রভৃতি। খুবেই দঃখের বিষয় এই কেন্দ্রটি শেষ পর্যন্ত নানা কারণে স্থায়ী হতে পারে নি ।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, সোমবার সকাল ৬-১০ মিনিটে উদয় শংকর ক্যালকাটা হসপিটালে অস্ত গেলেন। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী অমলাশংকর খ্যাতনাম্নী নৃত্যশিল্পী। পূর্ব আনন্দশ করও সঙ্গীত ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেচেন। অনজে প. রবিশংকরের যশ আজ বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত।

বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতির প্রচার আজ নিতান্ত অনায়াস- সাধ্য ব্যাপার। কিন্তু এই মহান কর্মে’র অগ্রদত হিসেবে ভারতীয় ইতিহাসে উদয়শংকর-এর নাম থাকবে সকলের শীর্ষে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment