নৃত্যকলা : নৃত্য শব্দটি সাধারণত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গীকে বোঝায়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা মনোরঞ্জন ক্ষেত্রে দেখা যায়। গীতবাদ্যের ছন্দে অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মঞ্চে চিত্রকল্প উপস্থাপনের ললিত কলাই নৃত্য বা নাচ।
![নৃত্যকলা 2 নৃত্যকলা - মনিপুরি নৃত্য [ Ras Lila ]](/wp-content/uploads/2022/05/মনিপুরি-নৃত্য-Ras-Lila-৯-300x169.jpg)
Table of Contents
নৃত্যের সংজ্ঞা
নৃত্যকলার সংজ্ঞা নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতত্ত্বিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর। এই আন্দোলনের নান্দনিক এবং প্রতীকী মূল্য আছে। নৃত্যকে বিভিন্নভাবে শ্রেনীবিভাগ করা যায়। কোরিওগ্রাফি, আন্দোলনের ধরন, ঐতিহাসিক সময়কাল বা উৎপত্তিস্থল উল্লেখযোগ্য। যদিও থিয়েটার ও সামাজিক নৃত্যকে সবসময় আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করা হয় না, তবুও এর উদ্দেশ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। মানুষের মনের অনুভূতি বিভিন্ন দৈহিক ভঙ্গিতে বা মুদ্রায় উপস্থাপনের নামই হলো নৃত্য।

নৃত্যের বৈশিষ্ট্য
শিল্পকলা হিসাবে নৃত্যের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন –
- নৃত্য মানুষের একটি প্রাগৈতিহাসিক কলা।
- নৃত্য মানুষের নান্দনিকতা ও অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম।
- নৃত্য সমস্ত জনগোষ্ঠীর কাছেই সংস্কৃতি চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
- আদিমকাল থেকেই মানুষের আনন্দ প্রকাশ এবং বিনোদনের একটি প্রধান দিক ছিলো নৃত্য।
- পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর নৃত্যের ভঙ্গিমার মধ্যেই একটি বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়।
- প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নৃত্যকলার সাথেই যুক্ত থাকে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র সাজপোশাক।
বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নৃত্যকে ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
- ধ্রুপদী নৃত্য,
- আদিবাসী নৃত্য,
- লোক নৃত্য,
- আধুনিক নৃত্য।

নৃত্যের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক:
শিল্পচর্চার অন্যান্য ধারা গুলির মতো নৃত্যকলার ইতিহাস নিয়েও বহু গবেষক গবেষনা করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন –
- জে অ্যাডশিড ল্যান্সডেল,
- ওয়াং কেফেন,
- শোভনা গুপ্ত,
- গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়,
- রাগিনী দেবী।
![নৃত্যকলা 5 ভরতনাট্যম নৃত্যরত শিল্পী [ Bharatnatym Mudra ]](/wp-content/uploads/2022/05/ভরতনাট্যম-নৃত্যরত-শিল্পী-Bharatnatym-Mudra-5-214x300.jpg)
নৃত্যে ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব:
সামাজিক ইতিহাস চর্চায় নৃত্যের ইতিহাসের একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে । যেমন –
- নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দিকের পরিচয় এবং সামাজিক অনুভূতি প্রকাশের ধরন সম্পর্কে জানা যায়।
- ভারতের নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে “দেবদাসী” প্রথার কথা জানা যায়। প্রাচীনকালে অবিবাহিত নারীরা অনেক সময় দেবতাদের কাছে নিজেদের আত্মনিবেদন করতেন। দেবতাদের বিনোদনের জন্য নৃত্য,গীত সহ মন্দিরে নানা সেবামূলক কাজের সঙ্গে দেবদাসীরা যুক্ত থাকতেন।
- নৃত্য থেকে সামাজিক ইতিহাস চর্চার নানা উপাদানও পাওয়া যায়। উদাহরন হিসাবে আদিবাসী সমাজের নৃত্যের ধরনের কথা বলা যায়। আদিবাসী সমাজে কোন একক নৃত্য নেই। তারা যৌথ ভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। এটি থেকে তাদের জোটবদ্ধ সমাজ জীবনের ঐতিহ্যের কথা জানা যায়।
- সবশেষে বলা যায়, নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে যে কোন নৃত্যের উদ্ভবের পশ্চাৎপটের ইতিহাস এবং নৃত্যকলার বিবর্তনের বিভিন্ন ধারা গুলি সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
![নৃত্যকলা 6 ভরতনাট্যম নৃত্যরত শিল্পী [ Bharatnatym Mudra ]](/wp-content/uploads/2022/05/ভরতনাট্যম-নৃত্যরত-শিল্পী-Bharatnatym-Mudra-3-300x169.jpg)
ভারতীয় নৃত্যকলার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ভারতে নৃত্যের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভারতীয় নৃত্যকলাকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
- ধ্রুপদী বা ক্লাসিক নৃত্য,
- লোক নৃত্য,
- আদিবাসী নৃত্য
(১.) ধ্রুপদী নৃত্য বা ক্লাসিক্যাল ডান্স
ধ্রুপদী নৃত্যকলা হলো ভারতের প্রাচীনতম নৃত্যকলা। এখানে নাচের মুদ্রা ও ব্যাকরন গুলি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। ভারতীয় উপমহাদেশে ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল নৃত্যের ৮ টি ঘরানা লক্ষ্য করা যায় –
- ভরতনাট্যম – তামিলনাড়ু,
- কত্থক – উত্তর পশ্চিম ভারত,
- কথাকলি – কেরল,
- মনিপুরী – মনিপুরী,
- ওড়িশি – ঊড়িষ্যা,
- কুচিপুরি – অন্ধ্রপ্রদেশ,
- মোহিনীঅট্টম – কেরল,
- সত্রিয়া – আসাম।
- ধ্রুপদি নৃত্য শিল্পী
ভারতে ধ্রুপদী নৃত্যকলার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন –
- উদয়শঙ্কর : উদয় শঙ্কর একজন ভারতীয় নৃত্যশিল্পী, নৃত্য পরিকল্পক, অভিনেতা। তিনি ভারতীয় নৃত্যশৈলী, ভারতীয় জাতীয় নৃত্যের ইউরোপীয় থিয়েটারস সমন্বয় পদ্ধতি গ্রহণের জন্য সুপরিচিত।
- অমলাশঙ্কর : অমলাশংকর একজন ভারতীয় ব্যালে নর্তকী। উনি উদয় শঙ্করের স্ত্রী, আনন্দশংকর ও মমতাশংকরের মা এবং রবিশঙ্করের ভ্রাতৃজায়া হন। অমলাশংকর উদয়শংকর পরিচালিত ছায়াছবি কল্পনাতে অভিনয় করেন।
- পন্ডিত বিরজু মহারাজ : ব্রিজমোহন মিশ্র সাধারণভাবে পণ্ডিত বিরজু মহারাজ নামে পরিচিত, ছিলেন ভারতে কত্থক নৃত্যে লক্ষ্ণৌ হতে আগত কালকা-বিনন্দাদিন ঘরাণার একজন প্রধান শিল্পী।
- শম্ভু মহারাজ : পণ্ডিত শম্ভু মহারাজ ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য, কত্থকের লখনউ ঘরানার (স্কুল) একজন গুরু ছিলেন।
- কেলুচরন মহাপাত্র : কেলুচরণ মহাপাত্র একজন কিংবদন্তি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী, গুরু এবং ওডিশি নৃত্যের উদ্গাতা ছিলেন যাঁর কৃতিত্বে বিশ শতকে এই ধ্রুপদী নৃত্যের পুনরুজ্জীবন এবং জনপ্রিয়তা অর্জিত হয়েছিল। তিনি ওডিশা থেকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পদ্ম বিভূষণ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
- রুক্মিণী দেবী : রুক্মিণী হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম ও প্রধান। ইনি বিদর্ভরাজ মহারাজা ভীষ্মকের কন্যা ও রুক্মীর বোন ছিলেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের গুণ ও কর্মে মুগ্ধ হয়ে তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং তার পরিবার চেদিরাজ শিশুপালের সাথে তার বিয়ে ঠিক করতে চাইলে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পত্র লিখে অনুরোধ জানান তিনি যেন তাকে নিয়ে যান।
- মল্লিকা সারাভাই : মল্লিকা সারাভাই ১৯৭৪ সালে আহমেদাবাদের আইআইএম থেকে তার এমবিএ সম্পন্ন করেন এবং ১৯৭৬ সালে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার এ ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি একজন বিশিষ্ট কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পী এবং কয়েকটি হিন্দি, মালায়ালম, গুজরাটি ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন ।
(২.) লোকনৃত্য
লোকনৃত্যে ধ্রুপদী নৃত্যের মতো কোন মুদ্রার ব্যবহার নেই। এটি ধ্রুপদী নৃত্য থেকে অনেকটাই সহজ ও সরল। লোকনৃত্যে অনেকে একসঙ্গে যৌথভাবে নৃত্য করে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের আলাদা আলাদা লোকনৃত্য আছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকনৃত্য হল –
- ছৌ নাচ – পুরুলিয়া,
- রাবনকাটা নাচ – বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া,
- ঝুমুর নাচ – বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া,
- রনপা নাচ,
- রায়বেঁশে নাচ।
(৩.) আদিবাসী নৃত্য
আদিবাসীদের সহজ সরল জীবনধারার মতো আদিবাসী নৃত্যের মুদ্রা গুলিও সহজ সরল। সাধারনত সমান্তরাল তালে আদিবাসী সমাজের নাচের মুদ্রা গুলি প্রদর্শিত হয়। আদিবাসী সমাজে কোন একক নৃত্য নেই। পুরুষ ও মহিলা সকলে সমবেত ভাবে একসঙ্গে যৌথভাবে এখানে নৃত্য পরিবেশন করেন। আদিবাসী নৃত্যের দুটি উদাহরন হলো –
- সাঁওতালি নৃত্য : দাসাই নাচ সাঁওতাল যুবক ও কিশোরদের যৌথ নৃত্য। নৃত্যশিল্পীরা গেঞ্জি বা জামা এবং শাড়ী পরে মাথায় লম্বা কাপড়ের ফেট্টি বেঁধে তাতে ময়ূরের পালক লাগিয়ে নেয় ও কাগজের ফুল গুঁজে নেয়। এছাড়া তারা কানে কানপাশা, গলায় হার, হাতে ময়ূরের পালক এবং পায়ে ঘুঙুর লাগিয়ে নাচে অংশগ্রহণ করেন।
- করম নাচ : দুর্গাপূজার দশমীকে অনুসরণ করে করমগাছের ডাল পূজাকে ঘিরে এ উৎসবের নাম দাশাই করম উৎসব।
অন্যান্য ভারতীয় নৃত্যকলার পরিচয়
- উত্তর ভারতের নৃত্যশৈলী – কত্থক, ওড়িশি।
- দক্ষিণ ভারতের নৃত্যশৈলী – কথাকলি, ভরতনাট্যম।
- পূর্ব ভারতের নৃত্যশৈলী – মনিপুরী, সত্রিয়া, ছৌ নাচ।
- দুটি আঞ্চলিক নৃত্যের নাম – রবীন্দ্রনৃত্য, ছৌ নাচ (বাংলা), ডান্ডিয়া (গুজরাত)।
- দুটি লোক নৃত্যের নাম – রনপা নাচ, ঝুমুর নাচ।
- দুটি আদিবাসী নৃত্যের নাম – সাঁওতালি নৃত্য, করম নাচ।
![নৃত্যকলা 7 রাজা রেড্ডি, একজন জনপ্রিয় ভরতনাট্যম এবং কুচিপুডি নৃত্যশিল্পী [ Raja Reddy, a popular Bharatanatyam and Kuchipudi dancer ]](/wp-content/uploads/2022/05/Raja-Reddy-a-popular-Bharatanatyam-and-Kuchipudi-dancer-183x300.jpg)
নৃত্যের ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ
- ভরত নাট্যশাস্ত্র : নাট্যশাস্ত্র’ আসলেই নাটকের ব্যাকরণ ও প্রকরণ সম্পর্কিত একটি মহাগ্রন্থ যা আচার্য ভারত প্রণয়ন করেছেন আজ থেকে কমবেশি তিন হাজার বছর আগে। প্রাচীনকালে সংস্কৃতে লেখা এই প্রয়োজনীয় গ্রন্থটি অদ্যাবধি পৃথিবীর নানা দেশে নানা ভাষায় অনুদিত হলেও দুই বাংলার নাট্যকর্মীদের মধ্যে এর পঠনপাঠন বা চর্চা-উচ্চারণ খুব একটা চোখে পড়ে না।
- ডান্স অব ইন্ডিয়া – শোভনা গুপ্ত।
- দ্য হিস্ট্রি অব চাইনিজ ডান্স – ওয়াং কেফেন।
- ডান্স হিস্ট্রি : অ্যান ইনট্রোডাকশন – জে অ্যাডশিড ল্যান্সডেল।
- ভারতের নৃত্যকলা – শোভনা গুপ্তা।
- প্রাচ্যের নৃত্যকলা – শেখ মেহেদী হাসান
- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার – কামাল লোহানী
- বাংলার লোকনৃত্য পরিচিতি – ড. মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন
- ধন্যবাদ ভালোবাসা – ফেরদৌসী মাহমুদ
- নাচের কথা – মোঃ নজরুল ইসলাম
- নায়ক আসেনি – ইমদাদুল হক মিলন
- তোমারি ঝরণাতলার নির্জনে – হুমায়ুন খান
- প্রাচ্য নৃত্যের রূপ ও বিকাশ – শেখ মেহেদী হাসান
- বাংলার নৃত্যকলা উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ – মাহফুজুর রহমান
- প্রাচ্যের লোকনৃত্য – শেখ মেহেদী হাসান
- জীবন যখন শুকায়ে যায় – মণীশ রায়
- রবীন্দ্র নৃত্য বিরচনা – স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
- ভারতের নৃত্যকলা – গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়
- নৃত্য – ড. মুকিদ চৌধুরী
আরও পড়ুন: