নম নটরাজায়

আজকের আমরা নম নটরাজায় সম্পর্কে আলোচনা করবো।

দেবাদিদেব মহাদেবেরই এক নাম নটরাজ। নটরাজের যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখি, তা’ নৃত্যরত শিবের মূর্তি। শিবকে সাধারণভাবে শখ, সংহারের দেবতা বলে মনে করা হয়, কিন্তু শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে : বিরহ্মাণ্ডের সংষ্টি, স্থিতি ও লয়ের মলে দেবতা তিনিই। তিনিই কখনো রজোগুণে অবলম্বন করে ব্রহ্মরূপে ভগৎ সৃষ্টি করেন, সত্ত্বগুণেবিশিষ্ট হয়ে বিশ্বরূপে পালন করে জগৎকে আবার তমোগুণের আধারভূত হয়ে তিনিই বুধোপে হন সংহার। বিপেরাণেও শিবের বিভিন্ন মূর্তি’র উল্লেখ আছে। শিবের মাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হয়েছে; সূর্য যেমন আরোগ্যের দেবতা, অগ্নির দ্বারা যেমন ধনলাভ হয় এবং মুক্তির বরদাতা যেমন বিশ্ব শিব হ’লেন তেমনি জ্ঞানের দেবতা।

 

নম নটরাজায়
নম নটরাজায়

 

নম নটরাজায়

সংগীত তথা নৃত্যের আদি স্রষ্টা বা গরুরূপে শিব সকল সংগীতত্তোদের নিকট পূজো। তাই তাঁকে বলা হয় নটরাজ।

‘অভিনয়দপ’ণ’-এর প্রারম্ভিক মঙ্গলাচরণ শ্লোকে বলা হয়েছে :

আঙ্গিকং ভুবনং যস্য বাচিকং সব ৰাঙ ময়ম ।
আহার্যং চন্দ্রতারাদি তং নমঃ সাত্ত্বিকং শিবম ।।

সমগ্র ভুবন যাঁর ‘আঙ্গিক’ অভিনয়ের দ্বারা পরিব্যাপ্ত, যাঁর বাক্য বা”বাচিক অভিনয় দ্বারা সমগ্র শান্ত গঠিত, চন্দ্রতারকাদি যাঁর আহায সেই ‘সাত্ত্বিক’ অভিনয়ের প্রতিমূর্তি’ শিবকে প্রণাম করি।

মহাভারতেও শিবের স্তব করে দক্ষ বলচেন আপনি নতনশীল মুখবাদ্যকারী, পদ্মোপহারা ও গীতবাদ্যপ্রেমী, আপনাকে নমস্কার।

আমরাও মহাজনদের সেই রীতি অনুসরণ করে নাত্যের পাঠ আরম্ভ করার পূর্বে নতোগরে, নটরাজকে প্রাভরে স্মরণ করি এবং তাঁকে জানাই আমাদের সভত্ত্বি প্রণাম।

 

নম নটরাজায়
নম নটরাজায়

 

শিবের সর্বাধিক প্রিয় নতা তান্ডব। তাই তাঁর নটরাজ মূর্তিও পরিকল্পিত হয়েছে তাণ্ডবন তারত অবস্থায়। এই নৃত্য-সৃষ্টির রহস্য সম্বন্ধে শাস্ত্র ও পুরাণাদিতে যেসব কাহিনীর উল্লেখ আছে তা’র দু’-একটির সংক্ষিপ্তসার এখানে উন্নত করা হচ্ছে।

অমৃত মন্থনের সাকল্যে প্রসন্নচিত্ত ব্রহ্মা দেবাদিদেব মহাদেবের সম্মুখে তাঁর নাট্যকৃত্য ‘ত্রিপুরেদাহ’ প্রদর্শনের জন্য ভরতকে আদেশ করলেন। গন্ধব’ ও অঙ্গরাদের নিয়ে ভরত মহাদেবের সমক্ষে সেই নাট্য নত্ত ও নৃত্য প্রদর্শন করেন। শংকর সন্তুষ্ট হন। তিনি প্রস্তাব করেন, বিভিন্ন করণ• ও অঙ্গহারাদি দ্বারা অলংকৃত তাঁর উদ্ধৃত নতো পর্বে’রঙ্গ বিধি হিসেবে প্রয়োগ করার জন্য ।

পরমোল্লাসে ব্রহ্মা সম্মত হলেন এবং অনরোধ করলেন সেই নতা ভরতকে শিক্ষা দেবার জন্য। তখন শংকর রেচক, অঙ্গহার এবং পিণ্ডীবধাদি দ্বারা নত্তে রচনা করে তাঁর অন্যতম গণ (অনচের ) তত্ত্বকে সেই নত্তে শিক্ষা দিয়ে আদেশ করলেন ভরতকে শিখিয়ে দোর জন্য। সেই আদেশ অনুসারে ‘গানভাণ্ড সমন্বিত’ যে নত তত্ত্ব ভারতকে শিক্ষা দিলেন, তাকেই বলা হয় উদ্বৃত্ত বা তাণ্ডব নত্তে ( নাট্যশান্ত দ্রষ্টব্য) ।

 

নম নটরাজায়
নম নটরাজায়

 

লিঙ্গ পুরাণে বর্ণিত আরেকটি কাহিনী

দারকাসুর নিধনের জন্য শংকর মহাকালীর সৃষ্টি করেন। অতঃপর প্রণালিনী কালী যখন সংহারের উন্মাদনায় উন্মত্তা, কিছুতেই তাঁকে নিরস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন ভগবান শংকর স্বয়ং এক শিশুর রূপ ধারণ করে মহাশ্মশানে গিয়ে করণ রুদন রোলে আকাশ বাতাস মথিত করে তুললেন। সেই কান্না নে কালীমাতার হৃদয় বিগলিত হ’ল। পরম স্নেহভরে তিনি শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে স্তন পান করাতে লাগলেন। নিরেপেী ভগবান সেই সময় স্তন্য পানের অছিলায় দেবীর হৃদয় হতে সমস্ত কোপ ডুবে নিলেন। ( এই বালকই ক্ষেত্রপাল নামে অভিহিত। ) দেবীর কোপ প্রশমিত হল। তখন দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভগবান তাণ্ডব না আরম্ভ করলেন । —

যোগীনীগণ সহ ং পার্বতীও সেই নতো সহযোগিতা করলেন। পৃথিবী শান্ত হল ।

 

নম নটরাজায়
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

শৈবাগম-এ বর্ণিত হয়েছে :

একবার ভোলানাথ শংকর দিগম্বর রূপে বিচরণ করতে করতে সুমের পব’তে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সুমের পরতিবাসিনী ঋষিপত্নীরা ভোলানাথের সেই দিগম্বর মূর্তি দর্শন করে এমনই মুগ্ধ হয়ে পড়লেন যে, তাঁদের পাতিরত্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ল । ঋষিপত্নীদের সেই বিচলিত অবস্থা দেখে ঋষিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। দিগম্বরের এতাদর্শে আচরণে। অত্যন্ত কুপিত হয়ে অনন্যোপায় ঋষিরা তখন যাগযজ্ঞাদি দ্বারা নানা কৃভোর প্রয়োগে তাঁকে বিনাশের চেষ্টা করলেন ।

বেপরোয়া শিব অম্লানবদনে ঋষিদের সেই প্রচেষ্টাকে আত্মসাৎ করে নিলেন! ভীত বিস্মিত ঋষিরা তখন ধ্যান যোগে জানতে পারলেন ইনি দেবাদিদেব মহাদেব। পরম নিশ্চিন্তে তখন তাঁরা শিবান, চরদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে দেবতার স্মৃতিতে মগ্ন হলেন। মনিঋষিদের স্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে শিব সেই সময় যে নৃত্য প্রদর্শন করলেন, সেই নৃত্যই তাণ্ডব নৃত্য নামে অভিহিত।

নটরাজের মূর্তি ‘তে ভগবান শংকরকে আমরা যে-মাদ্রায় দেখি, বিশাখদত্ত-এর ‘মাদ্রারাক্ষস’ গ্রন্থে তার বর্ণনা নিম্নরূপে। এখানে বলা হয়েচে, ত্রিপুরাসুরকে বধ করে শিব এই দঃখনতো করেছিলেন।

এই নতাকালে তাঁর তীব্র পাদবিক্ষেপে যদি পৃথিবী রসাতলে যায়, তাই, পৃথিবীর আধোগমন নিবারণের জন্য, তিনি ধীর পদক্ষেপে নত্য করেছিলেন । তাঁর ভুবন অতিক্রমকারী বাহগুলি প্রসারিত করে নতো করলে যদি সমস্ত ভুবন ধ্বংস – অর্থাৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তাই তিনি। বাহ গালিকে সংকুচিত করে ননৃত্য করেছিলেন । তার ভয়ঙ্কর ললাট-নয়নের অগ্নিস্ফুলিংগে যদি সমস্ত দগ্ধ হয়ে যায়, সেজন্য তিনি কোন দ্রষ্টব্য বস্তুর ওপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন নি। অতএব, বিশ্বের আধার-পদার্থ গুলি রক্ষার ইচ্ছার মহাদেবের এই দঃখনতো আমাদের রক্ষা করকে ।

 

নম নটরাজায়
নম নটরাজায়

 

আগম মতে, নটরাজের মূর্তি নিম্নরূপে লক্ষণযন্তে হওয়া উচিত— নটরাজের যে-চারটি হাত, তার মধ্যে সম,খস্থ ৰাম দিকের যে-হাতটি দত্তহস্ত বা গজদত্ত মাদ্রাসহ দেহের দক্ষিণদিকে প্রসারিত, তা অভয় প্রদানের অভিব্যক্ত সংচিত করে। পিছন দিকের বাম হস্তে ধারণ করা প্রজ্বলিত অগ্নি হল—সংহার বা প্রলয়ের দ্যোতক। বহি, দেশে সর্প বলয় শোভিত সম্ভ্রম,খস্থ দক্ষিণ হস্তের অভয়ম,প্রা সূচিত করে অভয় প্রদান। পিছনের দক্ষিণ হস্তে ডমর,—যার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে ব্যাকরণের চোদ্দটি সূত্র তথা সংগীত-স্বরের আধারভূত স্বরবর্ণাদি । হস্ত-পদের মধ্যমাঙ্গলী ব্যতীত সব আঙ্গলেগলিতে শোভা পাচ্চে অঙ্গরীয়। কনাই ও হাঁটুতে জড়ানো রয়েছে কেয়রে- বাজবে।

দক্ষিণ পদ ঈষৎ বংকিমভাবে পদতলঞ্ছিত ‘অপস্মার’ (অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা ) পরুষের পৃষ্ঠেদেশে স্থাপিত । বাম পদও ঈষৎ বংকিম ভঙ্গিতে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত।

জটাজটে মণ্ডিত শিরে শোভা পাচ্ছে আকন্দ ও ধাতুরা ফুলের মালা, ফণাধর ফণীন্দ্র, রক্তঝরা নরম, ন্ড, বক্রাকৃতি চন্দ্রমা, পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা প্রভৃতি। দেহের ওপর লবমান যজ্ঞোপবীত। সমস্ত দেহ ঘিরে জ্যোতি বিকীরণ করচে সূর্যেলায়র মত ব্রহ্মামণ্ডল ।

সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোভাব ও অনগ্রহ— এই পঞ্চকৃত্যের প্রতীক স্বরূপে নটরাজ মূর্তি আজও চিদম্বরম প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়া যায় । সেই সঙ্গে দেখা যায় নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত একশ আট প্রকার নৃত্যের বিচিত নৃত্যভঙ্গিমা।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment