Site icon Dance Gurukul [ নৃত্য গুরুকুল ] GOLN

দাওয়ালী গারোদের নাচের উৎপত্তি মতেন্দ্রনাথ মানকিন

দাওয়ালী গারোদের নাচের উৎপত্তি - মতেন্দ্রনাথ মানকিন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় দাওয়ালী গারোদের নাচের উৎপত্তি মতেন্দ্রনাথ মানকিন , যা বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা এর অন্তর্ভুক্ত।

দাওয়ালী গারোদের নাচের উৎপত্তি মতেন্দ্রনাথ মানকিন

পৃথিবীর সকল দেশে, জাতি বা উপজাতির মধ্যেই নাচ, প্রচলিত আছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে হয়তোবা এই নাচ বিভিন্ন জাতিতে বা বিভিন্ন সমাজের বিভিন্ন গোত্রে বিভিন্ন রকম হয়ে তাকে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই তিন পুরীতেই আমরা নাচের কথা শুনি। স্বর্গপুরীতে নাচে হুরপরী, দূতবৃন্দ আর নানা দেবদেবী। মর্তপুরীতে নাচে ডানাকাটা পরী, ললনা, দুলনা আর লবঙ্গ লতিকা।

পাতালপুরীতে নাচে লালপরী, নীলপরী আর পাতালপুরীর রাজকন্যা। তবে সব নাচেরই একই অর্থ-মনের আনন্দকে প্রকাশ করা। গারোদের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বা পূজা পার্বণের সময় বিভিন্ন প্রকারের নাচ পরিবেশিত হয়ে থাকে। নাচ কোথা থেকে, কীভাবে উৎপত্তি হলো নিচে তার বর্ণনা দেওয়া গেল- গারো উপজাতীয়দের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার গোত্র আছে।

 

 

তার মধ্যে দোয়াল একটি। এই দোয়াল গোত্রের প্রাচীন জনপ্রিয় লোকগীতি, খাবিগীতি থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে রিকমা নামে একজন নারী ছিল। এই রিকমা নারীর ছিল সাত ছেলে। তাদের নাম ছিল সিলজ্য, বেনজ্য, আমদ, মমদ, জেমস, পাল রায়, পর্বত রায়।তারা সাত ভাই কাজ করত। প্রতিদিন তারা গোচরণের কার্জ করত বলে তাদের সাত রাখাল বলা হতো।

যে জায়গায় তারা গোচারণের কাজ করত সে জায়গায় ছিল বিরাট একটি বটগাছ। সাত ভাই সেই বৃক্ষের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করত এবং নানা রকম গল্পগুজব করে দিন কাটাত। গল্প কথার ফাঁকে ফাঁকে তারা দিচাং (এক টুকরা বাঁশের তৈরি যন্ত্র), কাল (লম্বা বাঁশের তৈরি বাঁশি) ও গংগ্রা (সরু বাঁশের কাঠি দ্বারা তৈরি যন্ত্রবিশেষ) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ উপভোগ করত।

সেই গোচারণ ভূমির অদূরবর্তী স্থানেই বাস করত এক পরিবার। সেই পরিবারে ছিল দাওয়ালী, সয়ালী, পিয়ারী, সাদারী, গিন্নারী, মিকতি ও চালিনী নামে সাতজন যুবতী। ওই সাতজন যুবতী মাথা নাড়িয়ে, অঙ্গ দুলিয়ে, পা হেলিয়ে, হাস্য পরিহাস করে ঢেঁকিতে ধান ভানত। একদিন তারা সাত বোন যখন ধান ভানতেছিল ঠিক সে সময় অদূরে বটবৃক্ষের তলায় সাত ভাইয়ের মন মাতানো বাজনার সুর শুনে তন্ময় হয়ে উঠল।

সাত বোন বিস্ময়ে পারস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। তারা তখন সবাই মিলে বটতলার দিকে রওনা দিল। বটতলায় গিয়ে তারা এক আশ্চর্য বস্তু আবিষ্কার করল। বটবৃক্ষের তলায় গিয়ে তারা দেখল সাত ভাই তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এক অপরূপ সুরের তরণী বেয়ে চলেছে, অথচ সেই সুরের তরণীতে সহযাত্রী হয়ে পাড়ি দেওয়ার কাউকে তারা সেখানে দেখতে পেল না। ওই দৃশ্য দেখার পর সাত ভাইয়ের প্রতি সাত বোনের মনে ভীষণ দয়া হলো।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সাত ভাই একান্ত নিবিষ্টচিত্তে অনেকক্ষণ যাবৎ তাদের বাজনা বাজিয়ে চলল।সেই সুরের মূর্ছনায় আদিম বনভূমি, আকাশ-বাতাস, গাছপালা, পাহাড়, নদী, দুলে উঠল, আর দুলে উঠল সেই সাত কুমারীর মন। সাত কুমারী আর স্থির থাকতে পারল না। তারা সাত রাখালের কাছে তাদের মনের একান্ত ইচ্ছাকে নিবেদন করে বসল।

ওগো সাত রাখাল, তোমরা যেভাবে একাগ্রচিত্তে তোমাদের বাজনা বাজিয়ে চলেছ, তোমাদের বাজনার চোটে আমাদের যে ভীষণ নাচতে ইচ্ছা করছে।সাত কুমার উত্তরে শুধু বলল, তাহলে তোমরা নাচ ।সাতকুমারী বলল, কী করে নাচব। কী করে নাচতে হয় আমরা যে কিছুই জানি না। তোমরা যদি আমাদের একটু শিখিয়ে দিতে, তাহলে আমরা মন খুলে প্রাণ ভরে নাচতাম।

সাত কুমার তখন দূরে ঝিলের বুকে মনের সুখে স্নানরত একটি পানকৌড়ি পাখির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, দেখ ওই পানির বুকে পানকৌড়ি যেভাবে তার দুই পাখা বিস্তার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে তোমরাও ঠিক তদ্রূপ তোমাদের বাহুদ্বয় প্রসারিত কর এবং উপরে-নিচে ওঠানামা করাও।

তারপর ওই যে পোকা গাছের ওপর যেভাবে কোমর এঁকেবেঁকে চলে, তোমরাও ঠিক বাজনার সঙ্গে সঙ্গে কোমর দোলাও। পা দুটো তালে তালে ডানে-বাঁয়ে আন । সাত ভাইয়ের কথা শুনে সাত বোন প্রথমে হেসে উঠল, পরমুহূর্তেই সাত ভাই যখন তাদের যন্ত্রে অপূর্ব এক সুরের ইন্দ্রজাল রচনা করে চলতে লাগল সাত বোন তখন সেই সুরের আবেগে আর স্থির থাকতে পারল না। তারাও নাচতে শুরু করল।

 

 

তাদের আবিষ্কৃত নাচ তাদের কাছে প্রথমে অসুবিধাজনক বলে মনে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের এই নাচ তাদের কাছে বড় বিস্ময়কর ও উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক বলে মনে হলো । তাদের এই আদিম নাচ দেখে পৃথিবীর গাছপালা, পাহাড় পর্বত, পশুপাখি, সব অভিভূত হয়ে গেল। আদিম মানব-মানবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব কিছুই যেন নেচে উঠল। নেচে উঠল পাহাড়, নদী, বৃক্ষ, লতা আর বনভূমি। তাদের এই নাচ দেখে বাতাস বইতে ভুলে গেল ।

নদীর গতি থেমে গেল। আর সূর্য অস্ত যেতে ভুলে গেল। তাদের আবিষ্কৃত এই নাচ দেখে বিমুগ্ধ হলো ত্রিভুবন। তাদের এই ভুবন ভোলানো নাচ দেখে আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো শুধু একটি কথা-আহা কী অপূর্ব। গারো উপজাতির দোয়াল গোত্রের মতে, তখন থেকেই গারোদের নাচের উৎপত্তি হলো। আর এই নাচের নামই হলো দাওয়ালী। বর্তমানে এই নাচ কিছু বদলেছে বটে কিন্তু মূল ভঙ্গিমা আজও বদলায়নি।

 

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version