আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কেরলের নৃত্যনাট্য কথাকলি এন কে শিবশঙ্করণ , যা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
কেরলের নৃত্যনাট্য কথাকলি এন কে শিবশঙ্করণ
ভারতের অন্যতম ধ্রুপদী নৃত্যকলা কথাকলি আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেছে তার অনন্য নান্দনিক গুণাবলীর জন্যে। কথাকলির জন্ম হয়েছিল কেরলে, বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ের যুগে সপ্তদশ শতাব্দীতে । তাছাড়া এর মূল উৎস ছিল প্রাচীন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক নাটক ও নাট্যকলা।
আর্য ও দ্রাবিড় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে উদ্ভুত কথাকলিতে এসে মিশেছে কেরলের প্রাচীনতম নানা স্টাইলাইজড নৃত্য ও নাট্যকলার উপাদান : যেমন চাকিয়ারকুথু ও কুড়িয়াউম; ভগবতী বা কালী সাধনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা ধর্মীয় নৃত্য, যেমন মুটিয়ে।
থেয়াউম এবং থেয়াম; আধা ধর্মীয় আধা সামাজিক নৃত্য এবং রণনৃত্য যেমন শাস্ত্রকালি, সংঘকালি এবং এঝুমাট্টাকলি; লোকায়ত নাটক যেমন কংসনাটকম, মীনাক্ষীনাটকম; এবং সবশেষে সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনাকালের নৃত্যনাট্য, কৃষ্ণনাউম এবং রামনাট্টম । কথাকলির বিবর্তনে এক লক্ষ্যণীয় উপাদান ছিল কালারি বা জিমনাসিয়ামের ঐতিহ্য।
কালারি ছিল যুদ্ধবিদ্যা শেখার আখড়া, জমির মালিক শ্রেণীর লোকেরা এখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নানা শারীরিক কসরৎ শিখত। তাদের মধ্যে প্রধান ছিল নায়াররা যারা গোষ্ঠীপ্রধান ও কৃষিজীবী হলেও তাদের অনেকেই ছিল যোদ্ধা এবং রণবিদ্যাই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। যুদ্ধ কৌশল শিখত তারা কালারিতে।
কেরলে আর্য অনুপ্রবেশের শুরুতে ব্রাহ্মণরাও কালারিতে শিক্ষা নিতে লাগল এবং তাদের কেউ কেউ সেখানে শেখাতেও শুরু করল। সবকিছুকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ছিল ব্রাহ্মণদের। কালারিকেও তারা সুকৌশলে এক ধর্মীয় মহিমায় আচ্ছন্ন করল। এই থেকে সৃষ্টি হলো সংঘকালি ও চথুরাকালি।
যদিও উৎসব-অনুষ্ঠান শেষ হতো রণকৌশলের প্রদর্শনীতে, শুরু হতো কোনো ইস্ট দেবতার বিষয়ে গাথা কবিতা পাঠ করে আনুষ্ঠানিক পূজার্চ্চনা দিয়ে। দীর্ঘ অনুষ্ঠানের একঘেয়েমি দূর করার জন্য মাঝে মাঝে বিরতি থাকত আর বিরতির সময় দেখানো হতো কমিক চরিত্রের নানা হাস্যকৌতুক।
এইভাবে কালারিতে জন্ম নিল এক ধরনের নাটক যাতে থাকত দৈহিক কসরত এবং মনোরঞ্জনের উপাদান। কালক্রমে দুটি নাট্যকলার উদ্ভব হলো- একটি কমেডি অন্যটি নৃত্যনাট্য। সামাজিক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ছিল কমেডির বিশেষ উপজীব্য। কথাকলির আধুনিক রূপ এসেছে কুড়িয়াট্টম থেকে। কুড়িয়াট্টমে অংশ নিতেন অসামান্য অভিনয়-প্রতিভাসম্পন্ন নৃত্যশিল্পীরা।
সংস্কৃতজ্ঞ অভিজাত শ্রেণী ছিল কুড়িয়াট্টমের পৃষ্ঠপোষক। চাকিয়ার নামের একবিশেষ সম্প্রদায়ের নরনারী কুড়িয়াট্টম অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন । চাকিয়ার কুথু নামের এক একাঙ্ক অনুষ্ঠানের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল কথাকলির ওপর। কুড়িয়াউম ও কুথুর মধ্যে কোনোটি বেশি প্রাচীন তা কেউ বলতে পারে না।
এই দুই নৃত্যনাট্যকলার প্রচলিত রূপের সানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে এলানকোভান রচিত বিখ্যাত তামিল মহাকাব্য চিলগ্নাথিকরম-এ (এলানকোভান ছিলেন খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের চেরা সম্রাট চেরান চেংকুটটুভানের ভাই। এই সম্রাটের রাজধানী ছিল বর্তমান কোচিন দুর্গের কাছেই)। অভিনয়কলায় পারঙ্গম শিল্পী বলে আজও মনে করা হয় চাকিয়ারদের।
চাকিয়ার কুথুর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এক কমেডীয় মেজাজ। সমকালীন সমাজ নিয়ে সবরকমের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করার অধিকার ছিল চাকিয়াদের। এমনকি রাজাকেও তারা ছেড়ে দিতেন না। দর্শকদের মধ্যে কেউ যদি চাকিয়াদের বক্রোক্তির প্রতিবাদে কিছু বলতেন, চাকয়িার অনুষ্ঠান বন্ধ করে মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতেন।
আজও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চিত্তবিনোদনে চাকিয়ার কুথুর তুলনা নেই। এখন এই চাকিয়ার কুথু অভিনীত হয় কুথামাবালামের মন্দির প্রাঙ্গণে একমাত্র কুথুর জন্যে সংরক্ষিত একটি ছোট মঞ্চে। চাকিয়াদের এই অনুষ্ঠানে শিল্পকে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের বিধিসম্মত প্রাচীনতম নৃত্যনাট্য বলে মনে করা হয়।
দক্ষিণভারতের ভগবতী সাধনা থেকে উদ্ভুত নানা ধর্মীয় নৃত্যকলার মধ্যে মুটিয়ে তিরায়াট্টম এবং থিয়াউম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এসব নৃত্যের উপজীব্য ছিল দুর্গার মহিমা বন্দনা এবং তাদের আখ্যানভাগে ছিল দুর্গার অসুর নিধন কাহিনী । এসব নৃত্যানুষ্ঠানে শিল্পীরা খুব বর্ণাঢ্য সাজসজ্জা করতেন দুর্গা আর বিভিন্ন অসুরের ভূমিকায়। দুর্গার রূপসজ্জায় থাকত চোখ ধাঁধানো বর্ণচ্ছটা।
তেমনি অসুরদের সাজানো হতো চরিত্র ও মেজাজ অনুসারে কুশ্রী বীভৎস রঙে-রূপে। কোনো কোনো চরিত্রের জন্য ছিল মুখোশ আবার কোনো কোনো ভূমিকায় অভিনেতা মুখে চিত্রবিচিত্র রঙ মাখতেন প্রচলিত নকশা অনুযায়ী। এসব বিচিত্র সাজসজ্জায় সজ্জিত চরিত্রের সমাবেশ দর্শকমনে জাগাতো ঐশ্বর্য, মহিমা, বর্ণাঢ্যতা ও ভয়ের অনুভব।
চরিত্রগুলোকে মনে হতো তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের লোক । এই নৃত্যগুলোর নানা উপাদান কথাকলির পূর্বসূরি কৃষ্ণনাউমে ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে মুখে নানা রঙের জটিল নকশা, বর্ণাঢ্য এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, বিভিন্ন ধরনের মাথার আবরণ এসব এসেছে ওইসব দ্রাবিড়ীয় আনুষ্ঠানিক নৃত্যকলা থেকে।
কথাকলিতে তাদের আর একটি বিশিষ্ট অবদান হলো আবহ সংগীতে চেনডা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের ফলে জয়দেবের গীতগোবিন্দ কেরলে খুব জনপ্রিয় হয়। উত্তর কেরলের জামোরিন, মানভেদা, যিনি বিখ্যাত গুরুভারুরের কৃষ্ণমন্দিরের দেখাশোনা করতেন তিনি জয়দেবের সুললিত ছন্দোমাধুর্যে আকৃষ্ট হলেন।
তার একান্ত তাগিদে প্রতিদিন মন্দিরে গীতিগোবিন্দ পাঠের ব্যবস্থা হলো। গুরুভরুরের কয়েকজন ভক্ত নামবুদ্রি ব্রাহ্মণ গীতগোবিন্দের আবেগময় সংগীতমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ওই কবিতাটিকে অবলম্বন করে একটি নৃত্যনাট্য রচনা করলেন। এই নৃত্যনাট্য পরে পরিচিত হলো কৃষ্ণনাম বা কৃষ্ণের নৃত্য নামে এবং ওই অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় হলো।
কৃষ্ণনাট্টম ছিল আটরাত্রি ব্যাপী অনুষ্ঠানের এক পালা। সমস্ত কৃষ্ণপুরান কৃষ্ণের জন্ম থেকে স্বর্গারোহণ পর্যন্ত দেখানো হতো পর্যায়ক্রমে। কথাকলিতে যে ধরনের রূপসজ্জা সাজপোশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করা হয় মোটামুটি সেই রকমই ছিল এই নৃত্যনাট্যের কুশীলবদের অঙ্গসজ্জা। অবশ্য কথাকলিতে প্রযুক্ত উচ্চমানের অভিনয়কলা ও নৃত্যভাষা কৃষ্ণনাট্যমে ছিল না।
নৃত্তাংশের প্রয়োগ ছিল বেশি এবং এ ব্যাপারে সম্মেলক নৃত্যবিন্যাস ও নৃত্যচারণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাই কৃষ্ণনাট্টমকে বলা যেতে পারে কেরলের ধ্রুপদী নৃত্যকলা কথাকলির রূপ-ভাবনার অনুপ্রেরণা। লোকগাঁথা বা উপকথা থেকে কথাকলির বিশুদ্ধ রূপ এসেছে।
যদিও কথাকলির জন্য রচিত প্রথম কবিতাটির রচয়িতা বলে মনে করা হয় বীর কেরলবর্মাকে, যিনি ছিলেন কোট্টারাক্বারার রাজা, দক্ষিণ কেরলের এক ছোট গোষ্ঠীপতি। প্রথমে কথাকলি নৃত্যনাট্যের নাম ছিল রামনাট্টম, যেহেতু রামায়ণের কাহিনী ছিল এর বিষয়বস্তু। কিংবদন্তী অনুসারে কেরলবর্মা রামনাম রচনা করেছিলেন কৃষ্ণনাট্টমের রচয়িতা জামোরিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
বলা হয় কোট্টারাক্বারার রাজ্য জামোরিনকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন রাজার বিবাহোপলক্ষ্যে কৃষ্ণান-অট্টমের নাট্যদলটিকে পাঠান। জামোরিন এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন এই যুক্তিতে যে এত উন্নতমানের কাব্য ও শিল্পগুণের নৃত্যনাট্য বোঝার মতো লোক দক্ষিণ কেরলে ছিল না।
অপমানাহত রাজা সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন ধরনের নাট্যকলা রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু এই নাট্যকলার সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। রামনাট্টম খুব জনপ্রিয় হলো, যদিও সাজপোশাকে এখানকার মতো এত জাকজমক তখন ছিল না নৃত্যশিল্পীদের তখন নৃত্যাভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে গান করতে হতো।
উত্তর কেরলের একজন গোষ্ঠীপতি ছিলেন রাজা ভেত্তাথুনাড়। সম্ভবত তিনিও জামোরিনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রামনাট্টমকে আরও সমৃদ্ধ করলেন তার উদ্ভাবিত নানা নৃত্যচারণার (dance movements) সংযোজন করে যার মধ্যে প্রধান হলো কলাসম।
সাজপোশাকে এবং মুখের রূপসজ্জায় অভিনবত্ব এনে আর নাচের সঙ্গে নেপথ্য সংগীতের ব্যবস্থা করে তিনি মূল রামনাট্টমের লক্ষণীয় উন্নতি ঘটালেন। উত্তর কেরলের আর একজন গোষ্ঠীপতি কোট্টায়ামের রাজার কথা উল্লেখযোগ্য। কথাকলির ক্রমবিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ের কৃতিত্ব এই সুপণ্ডিত রাজার বলে মনে করা হয়।
তিনিই প্রথম এক গতিশীল নৃত্যকলা হিসেবে কথাকলির যে অশেষ সম্ভাবনা আছে তা উপলব্ধি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন খুব বিশালমাপের নাট্যকলার পক্ষে রামায়ণের মতো ভক্তিরসের নাট্যবস্তু ও তার ভাবব্যঞ্জনার পরিসর খুবই সীমিত।
তার মনে হয়েছিল মহাভারতের চরিত্রগুলোর বৈচিত্র্য ও গভীরতা এবং তীব্র সংঘাতময় কাহিনীগুলোতে বিষয়বস্তুর নাট্যধর্মিতা অনেক বেশি। রামনাট্টম তাই কথাকলি বা কাহিনী পালার নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত হলো। কোট্টয়ামের রাজা তাই চারিটি অট্টক্কথা বা কথাকলি কাব্য রচনা করলেন যা আজও কথাকলির বিষয়বস্তু নির্বাচনের মূল ভিত্তি।
প্রথমটি বক-বধম, ভীমসেনের বকাসুর বধের গল্প। দ্বিতীয়টি কীড়মিড়া-বধম-এ আছে হস্তিনাপুর থেকে সদ্য নির্বাসিত পাণ্ডবদের কাহিনী। প্রিয়তমা দৌপদীর জন্যে সুগন্ধী ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে ভীমের দুঃসাহসিক কীর্তি-কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয় তৃতীয় কাব্যটি : কল্যাণসুগন্ধীকাম ।
চতুর্থটি, কালকেয়-বধম-এ অৰ্জ্জুন চরিত্রের আপাত-স্ববিরোধ খুব সূক্ষ্মভাবে চিত্রিত হয়েছে। কোট্টায়ামের রাজার আবির্ভাব এবং মহাভারতকে আশ্রয় করার সঙ্গে সঙ্গে রামনাট্যমের স্বাভাবিক মৃত্যু হলো এবং কথাকলির পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পথ সুগম হয়ে গেল।
কথাকলি বিবর্তনের শেষ পর্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি খুব স্মরণীয় নাম হলো কপিলিঙ্গাডু নামবুদিরিপাদ এবং ভাললাথোল নারায়ণ মেনন। প্রথমজন অষ্টাদশ শতকের শেষের এক প্রতিভাবান শিল্পী যিনি কথাকলির পোশাক পরিচ্ছদেরও রূপসজ্জার অনেক উন্নতি করেছিলেন যার ফলে নানা অনুপুঙ্খে এবং বর্ণবৈচিত্র্যে কথাকলি এখন আকর্ষণীয় হয়েছে অনেক।
দ্বিতীয় জন সাম্প্রতিককালের শ্রেষ্ঠ মলয়লম কবি যার প্রতিষ্ঠিত কেরল কলামণ্ডলম কেরলীয় নৃত্যকলাচর্চার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান যেখানে আজকের অনেক অসামান্য প্রতিভার নৃত্যশিল্পী শিক্ষা পেয়েছেন। ভাললাথোলের চেষ্টায় কথাকলি কেরলের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য প্রদেশের বিদগ্ধ মানুষদের আকৃষ্ট করেছে যাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শঙ্কর।
কথাকলি প্রেমিকদের কাছে ভাললাথোল নগরী এক তীর্থক্ষেত্র। এখানে কথাকলির চর্চার প্রথম যুগে যখন কথাকলির কোনো সুসংহত রূপ ছিল না তখন গুরু বাবুন্নি মেনন এবং গুরু কৃষ্ণ কুপুপ এই নৃত্যকলাকে আধুনিক কালের উপযোগী বিশিষ্ট রূপ ও বিধি বিধানে পরিমার্জিত করেন ভাললাথোল ও অন্যান্য রসবেত্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে যারাই কথাকলির অভিনেতা হয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই অসামান্য খ্যাতি পেয়েছেন যেমন কলামন্ডলম কৃষ্ণান নায়ার, কেলু নায়ার, মাধবন, আনন্দ শিবরাম, গুরু গোপীনাথ এবং পরবর্তীকালে রসনকুট্টি নায়ার, পদ্মানাভন আর বিশেষ উল্লেখ্য কলামণ্ডলম গোপী। নাট্য-আঙ্গিকের বিচারে কথাকলি এক বিশেষ রূপান্বিত (stlised) নৃত্যকলা।
এর সামগ্রিক রূপের মধ্যে নানা সূক্ষ্ম ডিটেল একত্রে খুব সুচারুভাবে বুনে তোলা হয়েছে যাতে এক সার্বিক বিন্যাসে সুষমামণ্ডিত হয় কথাকলির অনুষ্ঠান। শুভাশুভের চিরন্তন দ্বন্দ্ব যে শিল্প-ঐতিহ্যে রূপায়িত করা হয় ভরতের নাট্যশাস্ত্রে তা সুত্রাকারে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই শিল্প ঐতিহ্যে সবিশেষ দক্ষতা কথাকলি অনুষ্ঠানের প্রতি অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত যার ফলে অনুষ্ঠান নান্দনিক উৎকর্ষের এক চরম স্তরে পৌঁছায়। কথাকলি তাই শিল্পোৎকর্ষের পরম নিদর্শন যাতে পরস্পরের পরিপূরক বহু অনুপুঙ্খ গ্রথিত হয়ে আছে সপ্রাণ সম্পর্কে এবং নিখুঁত সুষমার।
অনুষ্ঠান শুরু হয় চেড্ডা, মণ্ডলম, চেঙ্গালাই এবং এলাথালামের একদফা একটানা বাদ্যবাদনে যাতে সমস্ত আবহ মন্ত্রিত হয় গম্ভীর ভাবোদ্দীপক নিনাদে যা দর্শককে নিয়ে যায় ছন্দ ও কল্পনার এক ভিন্ন জগতে । কথাকলিতে তাণ্ডব ও লাস্য উভয়বিধ অঙ্গের নাচ সমন্বিত হয়েছে। তবুও কথাকলি অনুষ্ঠনে পুরুষালী ভাবের প্রাধান্যই বেশি।
নান্দনিক উৎকর্ষ ও নিখুঁত অভিব্যক্তির আদর্শ মনে রেখে কথাকলি শিল্পীকে কঠোর সাধনা করতে হয়ে খুব কম করে একটানা বার বছর, যতদিন না চোখ, মুখ, আঙুল ও সারা শরীরের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময় সঞ্চালনে তার যথেষ্ট দখল আসে। নাটকের কাহিনী বিবৃত হয় প্রধানত হস্তমুদ্রার ভাষায় যখন পিছনমঞ্চে শ্লোকম ও পদম গান করেন সংগীতশিল্পীরা।
অতি সুন্দরের সঙ্গে অতি ভীতিপ্রদ উপাদান মিলিয়ে দেওয়া হয় কথাকলিতে খুব সুনিপুণভাবে। যুদ্ধ বা রক্তপাতের দৃশ্য ভরতের নাট্য-শাস্ত্রে নিষিদ্ধ হলেও, কথাকলিতে কিছুই নিষিদ্ধ নয়, সবরকমের দৃশ্যই সমান নৈপুণ্যে উপস্থাপিত করা হয়। যেহেতু কথাকলির চরিত্রগুলো বাস্তব জগতের নয়, তাদের সমুন্নত চেহারার পোশাক পরিচ্ছদ ও রূপসজ্জায় সাজানো হয়।
কথাকলিতে কোনো মুখোশ ব্যবহার করা হয় না যেমন কোনো কোনো চীনা বা জাপানি নাটকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু মুখের মেক-আপ কতকটা মুখোশের মতো মনে হয়। মুখের অভিব্যক্তি মুখোশের আড়ালে থাকে, কিন্তু মেক-আপ করা মুখে নানা ভাব প্রকাশ করা যায়। মুখের রূপসজ্জায় ভ্রু, চোখের পাতা আর ঠোঁট গুরুত্ব পায় বেশি।
চুট্টি নামের একটি সাদা বেড় মুখমণ্ডল ঘিরে থাকে ফলে মুখের রঙ খুব স্পষ্ট হয়। চট্টর বেড় দেওয়া মুখ যেন অন্তরাত্মার মঞ্চ যেখানে অভিনয় করে মনের বিভিন্ন আবেগ। নাটকে রূপায়িত চরিত্র-ধরণ (Type) বিভিন্ন রকমের এবং রূপসজ্জাই বুঝিয়ে দেয় কোন চরিত্র কী ধরনের। প্রথমেই উল্লেখ্য মহৎ ও দৃঢ়চেতা বীরের চরিত্র যাকে বলা হয় ধীরোদত্ত, যেমন নল, যুধিষ্ঠির, ভীম।
এই ধরনের চরিত্রের মুখের রঙ সবুজ, যার জন্যে এদের নাম পচ্চা, মলয়লমে যার অর্থ সবুজ। এদের মাথায় থাকে কিরীটম বা মুকুট। কৃষ্ণের মাথার পোশাক একটু অন্যরকম থাকে বলে মুটি (চুল) পচ্চা চরিত্রের গুণাবলী হলো সাত্ত্বিক। প্রতিনায়ক বা ধীরোদত্তের প্রতি অনুগত চরিত্র ধরনের বলা হয় কাথি (ছুরি)।
এদের রূপসজ্জা পাচ্চাদের মতো, কিন্তু মুখে সবুজ মেক-আপের ওপর গালে লাল রঙে আঁকা থাকে ছুরি। তাছাড়া চুট্টি পুভু বা ছোট সাদা বল নাসাগ্রে বা ললাটের মাঝখানে জুড়ে দেওয়া হয়। কাথির গুণাবলী রাজসিক যেমন, রাবণ, কংস, জরাসন্ধ এবং দুর্যোধন। অর্থাৎ এদের মধ্যে রাজা ও দুয়োধনের চরিত্র- উপাদানের মিশেল থাকে।
খলনায়ক চরিত্র, যেমন কীচক, এই শ্রেণীতে পড়ে। পচ্চা আর কাথির মধ্যে লক্ষ্যণীয় পার্থক্য এই যে পচ্চা কখনও মুখে কোনো শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেন না কিন্তু কাথি প্রয়োজন হলে কখনও কখনও তা করেন। কথাকলির খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো থাটি বা দাড়ি যার মধ্যে তমোগুণের প্রকাশ দেখানো হয়।

বিভিন্ন ধরনের তমোগুণের জন্যে থাটির রঙ ভিন্ন ভিন্ন হয়- লাল, সাদা কালো। অতিমাত্রায় দুর্বৃত্ত চরিত্র হলো লাল থার্টি, যেমন রাক্ষস, বকাসুর, খরাসুর এবং দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র দুঃশাসন। এদের মুখে লাল দাড়ি ছাড়াও থাকে ভয়াবহভাবে চিত্রিত কারো নকশা, মাথায় থাকে কিরীটমের চেয়েও বড়ো শিবস্ত্রাণ। ললাটে আর নাসাগ্রে থাকে বেশ বড় আকারের চুট্টিপুডু।
লাল থাটি এক চিন্তাশক্তিহীন অশুভ বিধ্বসী শক্তি। থাটির রূপসজ্জায় উপস্থাপিত হয় বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র যা কেবল ধ্বংসের যন্ত্র। অনুরূপ যন্ত্র শিবের ক্রোধ থেকে জাত বীরভদ্রও একটি লাল থাটি চরিত্র। বালী ও সুগ্রীবকেও এই বেশে সাজানো হয় বোধহয় বানরেরা চিন্তাক্ষমতাহীন আবেগতাড়িত প্রাণী এই মনে করে। হনুমানে সাজ কিন্তু সাদা থাটি, অর্থাৎ দাড়ির রঙ সাদা।
হনুমান কথাকলির এক বিশিষ্ট চরিত্র এবং তার বেশবাশও স্বতন্ত্র। তার মাথার আবরণ ভট্টমুটি দেখতে কতকটা অষ্টাদশ শতকের ফরাসি টুপির মতো। কারো থাটি লাল থাটির মতোই চরিত্রের ধারণায়, কিন্তু সে খুব ক্রুরচক্রী এবং বিশ্বাসঘাতক। লাল থাটির মতোই তার মুখের রূপসজ্জা কিন্তু দাড়ির রঙ কালো। নলচরিতমের কলি এক কারো থাটি।
কারো থাট নাটকীয় পরিস্থিতি উপযোগী মুখে নানারকম বিকট শব্দ করে। কথাকলির এক জনপ্রিয় চরিত্র কারি যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত রঙ, রূপ, পোশাক সম্পূর্ণ কারো এবং মুখে ক্রুদ্ধ চিৎকার। কারি খুব নিম্ন শ্রেণীর আদিম মানুষের প্রতিনিধি যেমন কীরাতেরা বা দানবী সুর্পণখা এবং তাড়কা। শান্ত নম্র চরিত্রে- বিশেষত নারী ভূমিকায় মিনুক্কু রূপসজ্জা ব্যবহার করা হয়।
পোশাকের কোনো আড়ম্বর থাকে না, কেবল মুখ রঙ করা হয় হলুদ-কমলা রঙে। নারী, সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ, সারথি ও দূত এই শ্রেণীর চরিত্র। কথাকলির রূপসজ্জা যারা কল্পনা করেছিলেন তাদের চেষ্টা ছিল চরিত্রগুলোতে যেন দৃশ্যত ভিন্ন জাগতিক ব্যঞ্জনা থাকে।
শ্রীরাম বা যুধিষ্ঠির, তাদের মতে, অতি সাধারণ মানুষের স্তর থেকে এমন এক ঐশ্বরিক স্তরে উঠে গেছেন যাতে তাদের কোনো পার্থিব মানুষের অনুষঙ্গে কল্পনা করা যায় না। শিল্প প্রেমিকদের এই ভক্তি ও কল্পনায় এই সুন্দর নিখুঁত রূপসজ্জার জন্ম হয়েছিল। অনেকে অবশ্যই মনে করেন যে কথাকলির পোশাক-পরিচ্ছদে কিছু কিছু বিদেশি প্রভাব আছে।
(মলয়লীরা ব্যবসা উপলক্ষ্যে নিয়মিত বিদেশে যেত এবং বিদেশের সঙ্গে এই সংযোগ ছিল কেবল মাত্র বাণিজ্যিক)। তবে বিদেশি পোশাক অনেক পরিবর্তন করে কথাকলির উপযোগী করে নেওয়া হয়েছে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় ভাললাথোল বলেন যে নারী চরিত্রের মাথায় যে একখণ্ড কাপড় থাকে তা সম্ভবত মিশর থেকে এসেছে।
সেখানে মুসলিম মহিলাদের মাথায় ওইরকম কাপড় থাকতো। কথাকলির চরিত্রের অঙ্গসজ্জায় ব্যবহৃত অনেক অলঙ্কারেও বিদেশি প্রভাব দেখা যায়। কৃষ্ণ যে মাথায় মুটি পরেন তা বর্মার রাজার মাথার মুকুটের মতো ।
অভিনেতা তৈরি হন
৬৯ কথাকলি অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পী তার দেহচারণার সঙ্গে এক ছবির মতো ভাষায় বর্ণনা করেন প্রতিটি দৃশ্যের আবহ ও পরিবেশ। সে ভাষা মুকাভিনয় ও মুদ্রার ভাষা। শুধুমাত্র চোখ-মুখের ব্যঞ্জনার এবং মুদ্রার প্রয়োগে তিনি দর্শককে নিয়ে যেতে পারেন কোনো ভয়াবহ রণাঙ্গনে বা কোনো রম্য কাননে যেখানে পদ্ম সরোবরের ধারে বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা।
তিনি কালারিতে শিক্ষা শেষ করেছেন, এখন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে অভিনয়ের চরমতম উৎকর্ষ তার অনায়াস আয়ত্তে । কথাকলি-শিক্ষার্থীর কারারিতে শিক্ষার প্রধান অংশ হলো কঠোর দেহচর্চা, দেহভঙ্গির ভাষা বা মুদ্রা অনুশীলন, পদচারণা (foot work) এবং নানা ব্যঞ্জনার মুখভঙ্গি আয়ত্ত করা।
কালারিতে শিক্ষা শুরু হয় শিক্ষার্থীর দশ বছর বয়সে যখন তার অঙ্গপ্রত্যক্ষ যথেষ্ট নমনীয় থাকে যাতে সে যে কোনো দুরূহতম ভঙ্গিমা আয়ত্ত করতে পারে। তার দেহের পেশি, শিরা ও হাড়ের গ্রন্থি সচল রাখার জন্যে তার সমস্ত দেহ হাত ও পা দিয়ে মাসাজ করা এই কালারি শিক্ষার প্রয়োজনীয় অঙ্গ ।
প্রথমে শিক্ষার্থীর সমস্ত দেহ তৈলসিক্ত করা হয়, পরে তাকে মেঝের ওপর একবার চিৎ একবার উপুড় হয়ে শুতে হয়, আর অঙ্গ-সংবাহক বা মাসাজ-কারী দড়ির দোলায় বসে (যাতে তার দেহের সমস্ত ভার না পরে) গোড়ালি, পায়ের আঙুল বা দুই পায়ের তলা দিয়ে তার সমস্ত শরীর মাসাজ করেন।
ক্রমে কয়েক বছরে শিক্ষার্থীর দেহ নৃত্যকলার সূক্ষাতিসূক্ষ-ভঙ্গিমা আয়ত্ত করার উপযোগী নমনীয়তা অর্জন করে। সমস্ত দেহ এমনভাবে তার নিয়ন্ত্রণে আসে যে সে তার ইচ্ছামতো শরীরের একটিমাত্র অংশকে স্বতন্ত্রভাবে চালনা করতে পারে।
কথাকলি শিক্ষার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাবাভিনয়, যার জন্যে শিক্ষার্থীকে একটি শ্লোক বা কাব্যাংশ কেবলমাত্র চোখের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হয়। অভিনয়ে নৈপুণ্য অর্জনের জন্য তাকে প্রতিদিন বেশ কয়েক ঘণ্টা চোখের ব্যায়াম করতে হয়।
খুব ক্লান্তিকর আর কষ্টসাধ্য সে ব্যায়াম এবং চোখ ব্যথা করে প্রচণ্ড, যতদিন না শিক্ষার্থী সমস্ত প্রকরণটি সম্পূর্ণ আয়ত্তে আনতে পারে। সে যখন চোখের ভাষায় সম্পূর্ণ অভিনয় করতে শেখে তখনই শিক্ষার্থী মঞ্চে চরিত্রাভিনয়ের অনুমতি পায়।
দেহের ব্যায়াম ও হস্তমুদ্রার অনুশীলনও খুব আয়াসসাধ্য। বহুবছর সাধনার পর এই সবে দক্ষতা অর্জন করে কথাকলি অভিনেতা কালারি থেকে বেরিয়ে আসেন।
কথাকলির অনুষ্ঠান
অট্টকথা বা কথাকলির কাব্যকাহিনী শ্লোকে এবং পদমে রচিত হয়েছিল। শ্লোকগুলো রচিত হয়েছে কাহিনী নিয়ে, পদমের বিষয় সংলাপ। এগুলো বিভিন্ন রাগে সুর দিয়ে সংগীতশিল্পীরা গান করেন, সঙ্গে বাজে নানা বাদ্যযন্ত্র । কথাকলির মঞ্চসজ্জা খুবই সরল ও অনাড়ম্বর।
কেবল একটা বড় পিতলের প্রদীপ রাখা হয় অভিনয়ের জায়গায় এবং সবদিক থেকে অভিনেতাদের নৃত্যচারণা সেখানে এসে থামে। একখণ্ড চতুষ্কোণ কাপড় ব্যবহার করা হয় পর্দার জন্যে যাকে বলে থিরশীলা। চেণ্ডা, মড্ডলম, চেঙ্গালা এবং এলাথালম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় অনুষ্ঠানে ।
ঐতিহ্যানুগ কথাকলির অনুষ্ঠান চলে সারারাত ধরে খোলা আকাশের নীচে। কেলিকেটু দিয়ে শুরু হয় সন্ধ্যায়- অর্থাৎ অভিনয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয় কিছুক্ষণ ধরে ঢাকঢোল আর করতালের বাজনা দিয়ে। রাত্রি নটা নাগাদ মঞ্চের ওপর রাখা পিতলের প্রদীপের সামনে মড্ডলম এবং করতাল বাজানো হয় যাকে বলে আরাঙ্গুকেলি।
এর পরের অনুষ্ঠান থোড়ায়াম বা একজন বা দুজনের আবাহন নৃত্য। তারপরে বন্দনা শ্লোক এবং অভিনয় কাব্যকাহিনীর প্রথমপদ গাওয়া হয়। তারপর পুরাপ্পাড়ু যাতে সানচুর কোনো দেবচরিত্র বা নায়ককে মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত করা হয়।
এর শেষে সংগীত শিল্পীরা ও বাদ্যযন্ত্রীরা তাদের সংগীতকলার নৈপূণ্য দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জনের সুযোগ পান— এই অংশকে বলে মেলাপ্পড়ম । মেলাপ্পড়মের পর শুরু হয় আসল নাটকের কাহিনী । পচ্চা ও মিনুন্ধু ছাড়া অন্য চরিত্রেরা যখন মঞ্চে প্রবেশ করে তখন তারা থিরানুক্কু নামের একটা প্রথা অনুসরণ করে।
থিরানন্ধুর উদ্দেশ্য দর্শকদের সঙ্গে চরিত্রগুলোর আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটানো। থিরশীলা বা পর্দার পিছনে প্রদীপের কাছে এসে তারা দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে পর্দা নামানো হয় এবং ঢক্কানিনাদ ও করতালের ঝঙ্কার চলতে থাকে । দর্শকরা চরিত্রগুলোকে এবং তাদের বর্ণাঢ্য রূপসজ্জা খুটিয়ে দেখার সুযোগ পায়। বহু প্রাচীনকালে এই প্রথা চালু হয়েছিল ।
উদ্দেশ্য ছিল নাটকের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রগুলো প্রতি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাতে চরিত্রগুলোর বিশদ রূপসজ্জা দেখে তারা মুগ্ধ হয় এবং চরিত্রের গুণাবলী সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারে। এটি একটি অপরিহার্য প্রথা হিসেবে আজও প্রচলিত আছে। এই প্রথায় অভিনয়ের শুরুতে শক্তিশালী চরিত্রগুলোর মঞ্চপ্রদেশের সঙ্গে সঙ্গে একটা টেমপো গড়ে ওঠে।
উদ্ভাবন
কথাকলি কি আধুনিককালের প্রয়োজনমতো তার প্রাচীন রীতিনীতি ও প্রথাগুলোকে বর্জন বা বদল করতে পারে? প্রায় তিরিশ বছর আগে কলামণ্ডলমের সাবেক ছাত্র গুরু গোপীনাথ নতুন ভাবনায় কথাকলি অনুষ্ঠানের প্রযোজনা করেছিলেন। প্রথানুগ রূপসজ্জা ও পরিচ্ছদ বাদ দিয়ে খুব সরল উপস্থাপনায় সাধারণ ও শিক্ষিত দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেছিলেন।
এই পরিবর্তনের প্রয়োজনও ছিল- কারণ তিনি প্রসেনিয়াম মঞ্চে, প্রদীপের বদলে বিজলী আলোয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। রক্ষণশীলেরা এই উদ্ভাবন (innovation) পছন্দ করেননি, তাদের মতে এই পরিবর্তন কথাকলির মৌলিক চরিত্রই বদলে দেয়। কেউ কেউ এখনও মনে করেন কথাকলির মৌল রূপটিকে অবিকৃত রাখতে হবে।
কিন্তু কোনো শিল্পকলাই চিরকাল এরকম থাকতে পারে না, কথাকলির পরিবর্তনও তাই অনিবার্য । প্রচলিত হিন্দু পুরাণের কাহিনীর পরিবর্তে নতুন কথাবস্তু নিয়ে কথাকলির নতুন প্রযোজনা হয়েছে অনেক।
এই প্রযোজনায় ব্যবহৃত হয়েছিল বাইবেলের গল্প যেমন মেরী ম্যাগডালিন, ডেভিড ও গোলিয়াথ, সালোমি; রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডলিকা; ধ্রুপদী বিশ্বসাহিত্যের রূপ যেমন ‘গ্যোটের ফাউস্ট, আরনলডের সোরাব ও রুস্তম। কিন্তু এসব প্রয়োজনার সাফল্যের সিংহভাগের কারণ গল্পগুলোর সঙ্গে পুরাণকাহিনীর সাদৃশ্য।
এই কাহিনীগুলোর চরিত্রের রূপসজ্জায় কথাকলির প্রচলিত অঙ্গসজ্জা ও মেকআপ সহজেই ব্যবহার করা চলে। কিন্তু ঐতিহাসিক কাহিনী যেমন ঝাসির রাণী বা পাঝাসির রাজা অবলম্বনে কথাকলির অভিনব প্রযোজনা জনপ্রিয় হতে পারেনি।
কারণ আধুনিক কালের কাছাকাছি পরিচিত ঐতিহাসিক চরিত্রের বাস্তবানুগ রূপসজ্জা দর্শকমনে কোনো আবেগ সঞ্চার করতে পারে না। কথাকলির আধুনিক ও অভিনব প্রয়োগের এক দিশারী দৃষ্টান্ত কলামণ্ডলমের প্রাক্তন ছাত্র এরিয়ানকোট্টু শ্রীধরনের মানববিজয়ম। যার বিষয়বস্তু হলো অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং বিশ্বশান্তি ।
ঐতিহ্যানুগ কথাকলি রূপসজ্জায় সজ্জিত চরিত্রগুলো পচ্চা, কাথি, থাটি, কারি ইত্যাদি মঞ্চে আসে যুদ্ধবাজ বা শান্তিকামীর ভূমিকায়। কথাকলির নিজস্ব ভাষায় সৃষ্টিধর্মী এবং প্রতীকী প্রয়োগ হয়েছে বিষয়ের বিশ্বজনীন আবেদনে সমৃদ্ধ মানববিজয়ম-এর প্রযোজনায়।
কোনো শিল্পকলাই যাদুঘরের প্রদর্শন হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে না, তার মধ্যে সমকালীন জীবনের গতিবেগ সঞ্চার করতে হয়। মানব বিজয়ম এর মতো সৃষ্টিশীল অভিনব প্রয়োগেই কেবল কথাকলি আধুনিকও ভবিষ্যতকালে টিকে থাকবে।
আরও দেখুনঃ