আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কথক অমিতা দত্ত , যা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য এর অন্তর্ভুক্ত।
কথক অমিতা দত্ত
কথা যে কয় সে হলো কথক এবং তারই কলাবিদ্যার নাম কথক। বলা বাহুল্য এখানে ‘কথা’ শব্দটির অর্থ ‘বাক্য’ ‘উপাখ্যান’-এর প্রতিশব্দ । কথক নৃত্যের উৎপত্ত কবে বা কোথায় হয়েছিল তা সঠিক বলা যায় না, কারণ এ ব্যাপারে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
সংস্কৃত সাহিত্যে ‘কথক’ বা ‘কথাকার’, পালি সাহিত্যে ‘কথিকা’ এবং জৈন ধর্মগ্রন্থে ‘কুহক’দের উল্লেখ আমর পাই। এদের সম্বন্ধে বলা হয় যে, এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন লোকালয়ে ঘুরে ঘুরে নাচ গান-অভিনয়ের মাধ্যমে পুরাণের গাথা জনসমাজের সমক্ষে তুলে ধরত।
মন্দিরে, রাজ-সভায়, তপোবনে, নগরে, গ্রামে- সব জায়গাতেই এদের যাতায়াত ছিল। এই হিসাবে রামায়ণের লব-কুশকে আমরা কথকদের পূর্বসূরী বলে গণ্য করতে পারি। কথক সম্প্রদায়ের শিল্পীরা প্রথমদিকে হয়তো নাচের উপর বেশি প্রাধান্য দিতেন না । লব- কুশের নৃত্যের বর্ণনা আমরা রামায়ণে পাই না।
কিন্তু কালক্রমে এই গান থেকে অভিনয় এবং তার থেকে নৃত্যের উৎপত্তিটি অসম্ভব নয়। বৈষ্ণব সাহিত্যে আবার আমরা কৃষ্ণের নটবর রূপের বর্ণনা পাই। অনেক কথক-শিল্পীদের মতে কৃষ্ণই যমুনা-তীরবর্তী বৃন্দাবনের বংশী-বটের তলায় এই নৃত্যধারা শুরু করেছিলেন। সেখানেই গৎ, পালটা, ফেরি, চাল এবং ভাবাভিনয়ের জন্ম।
পরবর্তীকালের বৃন্দাবনের রাসধারীদের নৃত্য-গীতের মধ্যে আমরা বর্তমান কথকের পূর্বাভাস পাই। কীর্তনের বিভিন্ন পদে নৃত্যের উল্লেখ ও বোলের নমুনা পাওয়া যায়—
নটহি নটবর রাসমণ্ডলে রমণিমণ্ডলমাঝরে।
হেমকরিণী নিকর অন্তরে বিহরে কুঞ্জররাজ রে ॥
কনয়া কঙ্কণ ঝনর ঝন ঝন রতন কিঙ্কিনি রোল রে।
দ্রিমিকি দ্রিমি দ্রিমি তাল তাণ্ডব রাসবসে মন ভোর রে ॥
রাসের সময় কীর্তনের আসরে নৃত্যের প্রয়োগ ছিল এবং অনুষ্ঠানের শুরুতেও পরস্পর কীর্তনের মাঝে মাঝে বিশুদ্ধ নৃৎ পরিবেশিত হতো। কত্থকের উৎপত্তি সম্বন্ধে আরেকটি প্রচলিত মত অনুসারেও এ নৃত্যের জন্ম হয়, অন্যান্য ভারতীয় মার্গীয় নৃত্যের মতো, মন্দিরের প্রাঙ্গণে।
পরে এসব মন্দির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে নৃত্যশিল্পীরা ভ্রাম্যমাণ জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। এটা কতটা সত্য তা বলা যায় না। এমন হয়তো হয়েছিল যে মন্দিরের নৃত্যশিল্পীরা যাযাবর কথকদের সঙ্গে যোগদান করে পূরাণের কাহিনী বিন্যাস প্রথায় নৃত্যের যোগসূত্র স্থাপন করেন।
এই বিভিন্ন মতের কোনটি যে ধ্রুবসত্য এটি বলা অসম্ভব। সবই অনুমান মাত্র। আমাদের প্রাচীন মধ্যযুগের সাহিত্যে কথক নৃত্যশিল্পীদের উল্লেখ আছে এবং তাদের নৃত্যের বর্ণনাও আছে, কিন্তু কথকের শুরু সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আমরা কোথাও পাই না । কথকের উৎপত্তি সম্বন্ধে যাই মতবিরোধ থাকুক, বিদ্বানরা নির্দ্বিধায় ভানুজীকে বর্তমান কথকের প্রথম শিল্পী হিসাবে মেনে নেন।
ভানুজী এক সাধুর কাছে শিবতাণ্ডব শিখেছিলেন এবং সেটি তার পুত্র মালুজীকে শিখিয়েছিলেন। এই নৃত্যে লাস্য অঙ্গ ছিল না। মালুজীও যথাক্রমে তার দুই পুত্র লালুজী ও কানুজীকে এই নৃত্যপ্রথায় পারদর্শী করে তোলেন। কানুজীর কিন্তু এ নাচে মন ভরল না। তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে বৈষ্ণব নৃত্যধারায় প্রভাবিত হয়ে এই তাণ্ডব রস নৃত্যে নিয়ে এলেন কমনীয়তা, লাসা, লাবণ্য।
ভানুকী এবং তার বংশধরেরা ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং এর পরে বহুদিন ধরে কথক সম্প্রদায়ের শিল্পীরা ব্রাহ্মণ সমাজ থেকেই আসতেন। সমবেত জনগণের সামনে নৃত্যের মাধ্যমে এনারা ধর্ম উপাখ্যান ও তত্ত্বকথা প্রচার করতেন। কথক যখন এভাবে হিন্দু-ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে লাগল তখন হঠাৎই শুরু হলো ভারত-ইতিহাসে মুসলমান আধিপত্যের যুগ।
প্রথমে আক্রমণকারী রূপে আবির্ভূত হয়ে এই ভিন্নধর্মী বিদেশিরা ক্রমশ ভারতকে জয় করে নিজেদের অধীনে নিয়ে এল। প্রথমদিকের মুসলমান সুলতানরা ছিলেন যোদ্ধা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই ফুলে-ফলে ভরা স্বপ্নের মতো সুন্দর দেশকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে আনা। ছিল না তাদের এদেশের সূক্ষ্ম কলাবিদ্যা বোঝার বা সমাদর করার সময়, রুচি বা জ্ঞান।
(তার উপরে কোরানের মতে এরকম শিল্প ছিল নিষিদ্ধ) ১৪শ শতাব্দীর পর থেকে যখন মোঘল সাম্রাজ্যের স্থাপনা হলো তখন কিন্তু নৃত্য তরঙ্গ আবার পাল্টা গতিতে চলতে শুরু করল। এতদিনে দেশ জেতা হয়ে গেছে। বিশাল সাম্রাজ্যের মালিকদের এখন কলাবিদ্যার প্রতি নজর দেওয়ার সময়ও এসেছে। মোঘল সম্রাটদের মধ্যে সর্বপ্রথম মনে আসে আকবরের কথা।
তার রাজসভায় গুণী, পারদর্শী শিল্পী ও বিদ্বানরা যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি পেতেন। বাদশাহ নিজে নৃত্যগীত বাদ্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আবার ভারতকে আপন করে নেওয়ার ইচ্ছায় তিনি এ দেশের সবরকম বিদ্যাকেই মর্যাদা দিতে শুরু করলেন।
মোঘল মিনিয়েচার চিত্রগুলোতে এবং আবুল ফজলের ‘আইনই আকবরী’তে আমরা আকবরের রাজসভায় নৃত্যের যে প্রচলন ছিল, এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই। আকবরের পরে জাহাঙ্গীর ও শাওজাহানও এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা অটুট রেখেছিলেন।
যে সব কথক শিল্পীরা মুসলমানদের ভয়ে স্তম্ভিত ছিলেন, তারা এবং তাদের বংশধরেরা আবার আকবর এবং তার পরবর্তী দুই বাদশাহের সভায় এসে নতুন প্রাণ পেলেন। কিন্তু তাদের কলাবিদ্যাকে সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা বাধ্য হলেন।
এতদিন রামায়ণ মহাভারত পুরাণ কাহিনীভিত্তিক অভিনয় ছিল নৃত্যের প্রধান উপাদান এবং নৃৎ বা বোল, পরণ ইত্যাদি নাচা হতো শুরুতে আসর জমানোর জন্য এবং মধ্যে মধ্যে দুটি কাহিনীর মাঝে বিরতি হিসাবে।
এখন কিন্তু ওই নৃৎকেই করতে হলো মুখ্য অঙ্গ। কারণ মুসলমান সম্রাটদের হিন্দু দেব-দেবীর বিবরণ শোনার কোনোই ইচ্ছা ছিল না কথক-শিল্পীরা কিন্তু এসব অভিনয়ভিত্তিক নৃত্য নিজেদের মধ্যে রেওয়াজ করে যেতে লাগলেন এবং একই সময় নৃৎ-এর উপরে গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা করে নতুন নতুন ছন্দ, লয়, তাল, লয়কারীর সৃষ্টি করলেন।
ছন্দের ব্যবহারে তারা অনুপ্রাণিত হলেন আকবর-জাহাঙ্গীরের সভার অন্য গুণী ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তানসেন প্রমুখ গায়করা যেমন গীতরসকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন, তেমন কথক শিল্পীরা স্বর- মালা থেকে, পাখওয়াজের বোল থেকে, নৃৎ-এর আঙ্গিক থেকে ধারণা নিয়ে নিজেদের কলাকে নব নব ভঙ্গি ও রসে বিকশিত করে তুললেন ।
নৃত্য প্রদর্শনের আঙ্গিকে অভিনয় যে একেবারে উঠে গেল তা নয়। কথক-শিল্পীরা চিন্তা করে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মন জয় করার মতো সৎ তৈরি করলেন। তাই একে একে আবির্ভূত হলো বিভিন্ন গৎ। যেমন হুসনু, সেলামি, আদা, মেহবুবা, মুস্করাটি, নাচ, ঘুঘট। আবার প্রেমভিত্তিক গজলও ভাবের মাধ্যমে পরিবেশিত হতো।
মোঘল সম্রাটরা এই নৃত্যের ছন্দ, গতি, চাঞ্চল্য ও সৌন্দর্যে বেশ আকৃষ্ট হয়ে উঠলেন এবং মনে করলেন যে এই বিদ্যা সুন্দরী যুবতীদের দ্বারা পরিবেশিত হলে আরও কত না রুচিশীল হবে। তাই তারা মধ্য এশিয়া থেকে সুন্দরী নারীদের আনিয়ে কথক শিল্পীদের কাছে নৃত্য বিদ্যা শেখালেন।
এবং এসব নর্তকিরা যেহেতু কৃতদাসী ছিলেন তাই তারা অনেক সময় নৃত্য-শিল্পী ছাড়া ভোগেরও বস্তু ছিলেন। মোঘল সম্রাটদের দেখাদেখি অন্যান্য রাজা, বাদশাহেরা তখন এবং পরবর্তী কালে, বিশেষ করে যখন আওরঙ্গজেব সকল সংগীতশিল্পীকে বহিস্কৃত করলেন সে সময়ে, তাদের রাজসভায় এই ধরনের নাচের মেয়ে বা নাচ-ওয়ালীদের রাখতে শুরু করলেন।
এরা সেই কৃতদাসী সম্প্রদায়েরই ছিল এবং শিল্পের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকদের মনোরঞ্জনই তাদের কাম্য ছিল । হায় কথক, সে শিল্প ধর্ম প্রচার এবং তত্ত্বকথা সম্বন্ধে সকলকে অবহিত করার জন্য শুরু হয়েছিল । এসব নাচওয়ালী বাঈজিরা যে সবাই কেবল ভোগ-বিলাসের বস্তু ছিলেন তা নয়। এদের ভিতরে অনেকে সার্থক নৃত্যশিল্পীও ছিলেন।
বলা যেতে পারে যে এদের প্রচেষ্টাতে অনেকদিন ধরে কথক বেঁচে ছিল, যখন কোনো ভদ্র-সন্তান এ বিদ্যা আহরণ করতে ভয় পেত কিন্তু আবার এই বাঈজিদের মধ্যে অনেকেই সহজ উপায়ে পয়সা কামানোর লালসায় কথকে অপভ্রংশ ঘটালেন। সূক্ষ্ম রস ও অঙ্গে ও লয়ের কঠিন কাঠামো উপক্ষো করে তারা এই শিল্পে নিয়ে এলেন স্থুল রস।
যে শৃঙ্গার রস ব্যঞ্জনার মাধ্যমে আভাসিত হতো সেটি এরা অসংযতভাবে ব্যক্ত করে পৃষ্ঠপোষকদের খুশি করতেন। এসব বাঈজিদের নৃত্য ধীরে ধীরে এতই নিম্ন প্রকৃতির হয়ে যেতে লাগল যে ভদ্র সমাজের নারীরা এর প্রদর্শন দেখতেই লজ্জা পেতেন। এই অধঃপতনের সময়েও উল্লেখ্য দুই নৃপতি, যারা তাদের রাজত্ব পর্যন্ত বলি দিয়েছেন এই নৃত্যের পূজার অর্ধরূপে।
তারা দুজনেই একাধারে নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৯শ শতকে আউধে দেখা দিয়েছিলেন একজন ওয়াজেদ আলি শাহ রূপে এবং অন্যজন ২০শ শতকে রায়গড়ের রাজা চক্রধর সিংহ রূপে। এদের প্রচেষ্টাতেই আদি কথাকারদের বংশ এবং নৃত্যকলা দুইই রক্ষা পেয়েছিল।
ওয়াজেদ আলি শাহ মুসলমান হলেও ধর্মের গোঁড়ামির গণ্ডী থেকে মুক্ত ছিলেন। তার পিতামহ আসফ-উদ-দাউলার সময়ে জয়পুর থেকে লক্ষনৌ আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ঈশ্বরী প্রদাস বলে এক কথক শিল্পী। তিনি এবং তার পুত্র প্রকাশ কথক ছিলেন লক্ষনৌ দরবারের রাজ-নর্তক।
প্রকাশ কথকের পুত্র ঠাকুর প্রসাদ ওয়াজেদ আলি শাহের নৃত্যগুরু ছিলেন এবং এর দুই পুত্র বিন্দাদিন মহারাজ ও কালিকা প্রসাদ নবাবের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। ওয়াজেদ আলি শাহ তার দরবারের শিল্পীদের যথাযথ সম্মান ও দক্ষিণা দিতে কোনো কার্পণ্য দেখাননি। তাই তারাও প্রাণ ভরে নৃত্য চর্চা করে এ শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিন্দাদিন মহারাজ ছিলেন ধার্মিক, সাত্ত্বিক, কৃষ্ণভক্ত। তার ছিল ভাবের ঘরে অবাধ গতি । কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে তিনি বহু ভজন, অষ্টপদী ও ঠুমরী রচনা করে সেগুলোর নৃত্যরূপ দিয়েছিলেন। কালিকা প্রসাদের দক্ষতা ছিল লয়ের ও তালের ওপর। এইভাবে দুই ভাই মিলে কথকের নৃৎ ও নৃত্যকে সমৃদ্ধ করে তুললেন।
এদের প্রচেষ্টায় এক নতুন লাবণ্যময় কথকের সৃষ্টি হলো, যার নামকরণ হলো লক্ষনৌ ঘরানার কথক। কালিকা প্রসাদজীর তিন পুত্র- অচ্ছন মহারাজ, লচ্চু মহারাজ ও শম্ভু মহারাজ। অচ্ছন মহারাজের পুত্র বিরজু মহারাজকে এখন কথকের প্রধান শিল্পী হিসাবে গণ্য করা হয়।
শম্ভু মহারাজের দুই পুত্র রামমোহন ও কৃষ্ণমোহনও এই শিল্পের অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছেন। কথকের আলোচনায় লক্ষনৌ ঘরানার সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে হয় জয়পুর ঘরানার নাম। যদিও এই দুই ঘরানা পরস্পরকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। লক্ষণৌ রাজদরবারের প্রথম কথক (বিরজুমহারাজের বৃদ্ধ প্রপিতামহ) জয়পুর থেকেই আউধে গিয়েছিলেন।
আবার পরবর্তীকালে জয়পুর ঘরনার জয়লালজী ও সুন্দর প্রসাদজী বিন্দাদিন মহারাজের কাছে নৃত্যশিক্ষা করেছিলেন। তবুও জয়পুর ঘরানার পৃথক অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যেহেতু জয়পুর ঘরানার কথক বহুদিনের, এই শৈলী বিভিন্ন পরিবারের শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশিত হতো।
এদের মধ্যে আবার আত্মীয়তা বা বৈবাহিক সম্পর্কও ছিল কারণ কথক সম্প্রদায়ের মধ্যেই এদের বিবাহ হতো। জয়পুর ঘরানার মধ্যে নমস্য শিল্পীরা হলেন হরি প্রসাদ ও হনুমান প্রসাদ, শ্যামলাল, চুনীলাল, দুর্গাপ্রসাদ, গোবর্দ্ধনজী ও বদ্রি প্রসাদ। চুন্নীলালের দুই পুত্র জয়লাল ও সুন্দরপ্রসাদ এবং এদের সমসাময়িক নারায়ণ প্রসাদ শুধু কৃতী নৃত্যশিল্পীই ছিলেন না, তারা স্রষ্টাও ছিলেন।
তাদের হাতে জয়পুর ঘরানার বোল-তোড়া পরণ এর ভান্ডার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। জয়লালের দুই সন্তান জয় কুমারী ও রামগোপাল অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। সুন্দর প্রসাদের শিষ্যদের মধ্যে অগ্রগণ্য মেনকা, রোশন কুমারী, দুর্গা লাল ও কুমুদিনী রাখিয়া এবং নারায়ণ প্রসাদের শিষ্যদের মধ্যে নাম করা যায় কুন্দনলাল, পুস্প রাট্রা ও রাণী কর্ণার ।
বেনারসে জানকী প্রসাদ ঘরানা বলে এক পৃথক কথক শৈলী আছে যার বিশেষত্ব এই যে এরা বিশুদ্ধ নৃত্যের বোল ব্যবহার করেন। নৃত্যের বোল অর্থাৎ- ‘তা থেইতৎ তিগধা দিগদিগ”। এই ঘরানায় পাখওয়াজ বা অন্য বাদ্যযন্ত্রের বোলের ওপর নাচের বোল গঠিত হয় না। এই ঘরানার শিল্পীরা আবার তাদের নৃত্যে লাবণ্যের উপরই বেশি গুরুত্ব দেন, চোখ ধাধানো কসরতের ওপর নয়।
এই বেনারস ঘরানার পূর্বপুরুষেরা জয়পুর থেকেই আসেন। এদের মধ্যে সোহন লাল ও মোহন লালের খ্যাতি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯শ শতকের শেষের দিকে কত্থকের প্রাণ-প্রাচুর্য যেন থেমে আসছিল। এদিকে ১৮৫৬ সালে লক্ষনৌ-এ স্থাপিত হলো ব্রিটিশ রাজ এবং ওয়াজেদ আলি শাহ প্রায় বন্দি হয়ে চলে এলেন কলকাতায়।
জয়পুর ও বেনারস ঘরানা তেমন পৃষ্ঠপোষক পাচ্ছিল না। নবাব বাদশাহেরা কত্থকের শৈলীর চেয়ে তার মনোহরী রূপটিই বেশি পছন্দ করতে লাগলেন। অতএব ঘরানাদার কথকদের চেয়ে নাচওয়ালিরাই দরবারগুলোতে আশ্রিত হতে লাগল ।
এই অবস্থায় ১৯শ শতক কেটে গেল। ২০শ শতাব্দীর প্রথমেই কথক পেল এক উচ্চ শ্রেণীর সার্থক গুণগ্রাহী পৃষ্ঠপোষক রায়গড়ের রাজা চক্রধর সিংহের মধ্যে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের ছত্রিশগড় অন্তর্ভুক্ত রায়গড়। ওই রাজ্যে নাচ-গানের সমাদর বহুদিন ধরেই চলে আসছিল । কিন্তু রাজা চক্রধর সিংহ তার অসামান্য কলা-আনুগত্যকে সৃষ্টির সংরক্ষণের কাজে লাগালেন।
গণেশ চতুর্থীর সময় তার সভায় পক্ষাতীত কাল ধরে নাচ-গানের মেলা চলত। আমন্ত্রিত ও রবাহুত সকল সংগীত পারদর্শীকেই রাজা অতিথিরূপে বরণ করে নিতেন। এবং এদের ভিতরে রাজা যাদের বিশেষভাবে গুণী মনে করতেন, তাদের সভাসদ করে রেখে দিতেন। তারা রাজার মনোরঞ্জনের জন্য নাচতেন আবার রাজাকে শেখাতেনও।
রাজা তার কর্মচারীদের পুত্রদের মধ্য থেকে চারজনকে বেছে নিয়েছিলেন যারা সভার ললিত-কলা-বিদ্বানদের কাছে নাচ-গান শিখতেন এরা হচ্ছেন কার্তিক রাম, কল্যাণ, ফিরতু ও বেমান। রাজার কৃপায় এরা তখনকার কথকের দিকপাল লক্ষনৌয়ের অচ্ছন মহারাজ ও জয়পুরের জয়লালের কাছে শিক্ষার সৌভাগ্য পেয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয় এই যে রায়গড়ও ব্রিটিশ অধীনে চলে গেল এবং কথকের দরবারও বন্ধ হয়ে গেল। এই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে কিছু কিছু সার্থক শিল্পী যে বেরিয়ে এলেন না, তা নয়। এরা কিন্তু হয় কথক সম্প্রদায়ের, না হলে সমাজের নিম্ন ও সীমান্তবর্তী স্তরের।
আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথ ও উদয়শংকর জগৎ-জন-সমক্ষে ভারতীয় নাচের যে ভাণ্ডার খুলে দিলেন, তাই থেকে কত্থকও লাভবান হলো। পুরনো নৃত্যধারা সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় অনেক ধনী গুণগ্রাহী ব্যক্তি প্রচুর অর্থ ও সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। স্বাধীনতার পর সরকার থেকেও কথকের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলল ।
আজকে বাঙালিদের ঘরে ঘরে যে কথকের এত প্রচলন তার জন্য আমরা বিশেষভাবে ঋণী মাদাম মেনকার (লীলা রায়) কাছে। বরিশালের ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারের পিয়ারীলাল রায়ের কন্যা লীলা নাচকে বেছে নিয়েছিলেন তার জীবনসঙ্গী হিসেবে। এবং তিনি এই একক কথক নৃত্যকে নব রূপ দিলেন নৃত্য-নাট্যের মাধ্যমে।
রাগভিত্তিক গানের মাধ্যমে, চাঞ্চল্যকর অথচ মার্গীয় সুরের মাধ্যমে কথক বিশ্ব দরবারে পরিবেশিত হতে লাগল। স্বয়ং আনা পাভলোভাও তার নাচ দেখতে এসেছিলেন। তার শিল্পী গোষ্ঠীদের অনেকেই পরে কথকের নামী প্রদর্শক হয়ে ওঠেন, যেমন রামনারায়ণ মিশ্র, দময়ন্তী যোশী, শিরিন বজিফদার।
বর্তমান কত্থকের যুগে আমরা এখন এসে পড়েছি। বিভিন্ন শহরে এখন কত্থকের চর্চা, সমাদর। কথক প্রদর্শন এখন নানা শহরে, দেশে-বিদেশে হচ্ছে। শিক্ষিত, রুচিশীল পরিবারের সন্তানেরা এই বিদ্যা গ্রহণ করতে আগ্রহী।
দিল্লিতে বিরজু মহারাজ, দুর্গালাল, উমা শৰ্মা, রামমোহন, শাশ্বতী সেন, ভাস্বতী মিশ্র; আমেদাবাদে কুমুদিনী লাকিজয়া, বম্বেতে সীতারা দেবী, রোহিণী ভাটে, রোশন কুমারী, দময়ন্তী যোশী, গোপীকৃষ্ণ এবং কলকাতায় বেলা অর্ণব, বিজয় শংকর, সুস্মিতা মিশ্র, বন্দনা সেন প্রমুখ অনেক গুরুই অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের এই কলাবিদ্যালয় পারদর্শী করে তুলছেন।
এবার আসা যাক কত্থকের শৈলী বা বিশেষত্বের আলোচনায় । পুর্বোক্ত ঐতিহাসিক বিবৃতি থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কথক যুগে যুগে স্থান কাল অনুসারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।
একই সঙ্গে এর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে নাটকীয় রূপে উপাখ্যান বর্ণনার ধারা, কীর্তন-ধ্রুপদ-ভজন ঠুমরীভিত্তিক অভিনয়ের মাধুর্য, লয়-তাল-ছন্দ সমন্বয়ে দ্রুত পা ও অঙ্গ সঞ্চালনে তোড়, মুসলমান প্রভাবও নৃত্যনাট্যের আঙ্গিকে ‘ব্যালে’ রচনার নতুনত্ব।
উত্থান- পতনের মধ্য দিয়ে কথকেরা কখনও সাজানো রাজসভা-দরবারে, কখনও দীন গ্রামে বাস করে, কথককে কিন্তু নানা বৈচিত্র্য ও বর্ণময় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব ধারা আধুনিক কালের কথক শিল্পীরা পরিবেশন করেন। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা কত্থকের শৈলী নির্ণয়কালে ভরতমুনির হিসাবে এই নৃত্যবিদ্যাকে বিভক্ত করব।
এই সময় এ কথা বলে নেওয়া দরকার যে যদিও কখকের গুরুরা নাট্যশাস্ত্র অনুসরণ করে নাচ শেখান না, তবুও কত্থকের অনেক আঙ্গিক, রীতি-নীতি, শৈলী, প্রকারভেদে নাট্যশাস্ত্রের বর্ণনার সঙ্গে মেলে। ভরত নাচকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। নৃৎ, নৃত্য ও নাট্য।
নৃৎ হলো সে ধরনের নাচ যেখানে আমরা কোনো অন্তঃনিহিত অর্থ পাই না। এটিতে ছন্দ- লয় এবং সঞ্চালনের মাধুর্যই উপভোগ্য। অন্যান্য ভারতীয় নৃত্যের তুলনায় কথকে নৃৎ-এর অংশ খুব বেশিই প্রাধান্য পায়। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। কথকে নানা রকমের আঙ্গিক আছে যেগুলোর ভিত্তি তাল-লয়-ছন্দের উপরে।
অবশ্য এর মধ্যেও কয়েকটিতে ভাবেরও ছোঁয়া এসে যায়। নৃত্যশিল্পী রঙ্গমঞ্চে বা দরবারে এসে প্রথমে রঙ্গমঞ্চ কি টুকরা, নমস্কার বা সেলামি করেন। এগুলো নৃত্যের বোলের উপরে নাচা হয় এবং এর সঙ্গে বিশুদ্ধ অঙ্গ সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি, নমস্কার ও সেলামের মুদ্রাসহকারে ভাব দেখানো হয়। নৃত্যের বোলগুলো হলো ‘তা থেই তৎ তিগধা দিগদিগ’ জাতির।
এ পরিবেশনাগুলোর সময় মূল লয় থাকে খুবই ঢিমা বা মন্থর এবং নৃত্য এর সমান, দুগুণ এবং চৌগুণ গতিতে চলে। ভরত নাট্যশাস্ত্রে বলেছেন যে শিল্পীর রঙ্গমঞ্চকে পূজা করা উচিত। কথকেও আমরা রঙ্গমঞ্চে পুষ্প প্রদানের মুদ্রা পাই। এরপরে রঙ্গমঞ্চ ও সমবেত দর্শকদের নমস্কার জানানো হয়।
বলা বাহুল্য যে এই নমস্কারের পরিবর্তে মুসলমান পৃষ্ঠপোষকদের সেলাম করা হতো এবং এই প্রথা থেকেই সেলামির উৎপত্তি। এরপরে শুরু হয় বিশুদ্ধ নৃৎ। তবলায় বেজে ওঠে উঠান এবং সারেঙ্গী বা অন্য সহযোগী বাদ্যযন্ত্রে লহরা বা নাগমা। কথকের পরিভাষায় একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান আবহের শব্দ লক্ষণীয়।
যে তালে নাচ হবে, সেই তালেই লহরা বাজে। কথকে সবচেয়ে প্রচলিত তার হলো ত্রিতাল যার মধ্যে ১৬ মাত্রা ও চার চার বিভাগ খুব সহজেই সকলের বোধগম্য। ধামার তালের (১৪ মাত্রা) ব্যবহারও প্রায় হয় এবং এতে জোরদার নৃত্য পরিবেশিত হয়।
অন্যান্য তারের মধ্যে ঝাপতাল (১০ মাত্রা), রূপক (৭ মাত্রা) এবং একতাল (১২ মাত্রা) বেশ প্রচলিত। যদিও মাঝে মাঝে গুণীজন সমাবেশে পঞ্চম সওয়ারী (১৫ মাত্রা) ও শিখর (১৭ মাত্রা) এবং অন্যান্য দুরূহ তালও নাচা হয় ।
নাগমার মাধ্যমে একটি তারের কাঠামো তৈরি করা হয়। কয়েকটি প্রচলিত রাগ যেমন কলাবতী, চন্দ্রকোষ, দেশ, জয়জয়ন্তীতেই বেশির ভাগ নাগমা দেওয়া হয়। অবশ্যই এ ব্যাপারে কোনো বাধা ধরা নিয়ম নেই। তালের পুরো আমেজটি নাগমার মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
যেমন ত্রিতালে কলাবতীর ও চন্দ্রকোষের নাগমা :
+ ২ ০ ৩
তবলা : ধা ধিন ধিন তা । ধা ধিন ধিন তা । না তিন তিন তা। তেটে ধিন
ধিন তা
কলাবতী : স- র্স র্স । ণ পণ্ স । ণ প ণ্ গস । গ প ধ ণ
চন্দ্রকোষ : র্স- র্স র্স । ন দ ন র্স । ন দ ম গস । গ ম দ ন
এই নামগা বারবার কানে বাজতে থাকে এবং এর উপরে তবলার উঠান বাজে। নৃত্যশিল্পী তাল-লয়-ছন্দ-সুরের সমন্বয়ে অনুপ্রেরণা পেয়ে তার নাচ আরম্ভ করেন। দর্শকের কানেও নাগমাটি পুনরাবৃত্তির ফলে একটি আমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
এবারে এই তারকে ধ্রুবতারা হিসেবে নিয়ে শুরু হয় লয়ের খেলা। প্রথমদিকে নাগমা খুবই ঢিমা লয়ে থাকে, কিন্তু এর মধ্যে নানা লয়-বৈচিত্র্য কখনও ধীর-মন্থর কখনও দ্রুত চঞ্চল পরিবেশিত হয়। লয়ের আন্দাজ শিল্পী দেখান ছোট ছোট তেহাই দিয়ে সমে আসার মাধ্যমে।
যে কোনো মাত্রা বা অর্ধমাত্রা থেকে উঠে তেহাই দিয়ে সমে পড়ে তার তালের ওপর দখল ও অনায়াস গতি দেখিয়ে এবারে শিল্পী ঠাট বাধেন। ঠাটে নৃত্যের গতি গম্ভীর। তাড়াহুড়ো একেবারেই নেই। প্রাণ প্রাচুর্য যেন শক্ত বাধনে ধরে রাখা হয়েছে।
প্রতিটি সমে একটি নতুন কায়দায় দাঁড়ানো এবং পরবর্তী মাত্রাগুলোতে খানিকক্ষণ এই স্থিতির পর ধীরে অঙ্গ সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে ঠাট একটি ফুলেরই মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে বিকশিত হয়। ঠাটে পায়ের ব্যবহার খুব সীমিত। ভুরু, গ্রীবা, মণিবন্ধ ও স্কন্ধের ব্যঞ্জনাময় সঞ্চালনেই ঠাটের রূপ ফুটে ওঠে।

কখনও ঠাটের মধ্যে কেবল চোখ ও ভুরু দিয়েই সম দেখানো হয়, আবার কখনও পদসঞ্চালনের দ্বারা ছোট কিন্তু জোরদার তেহাইয়ে। ঠাটে নৃত্যশিল্পীর স্বয়ং অনুভুতি ব্যক্ত হয়। তার নিজের আন্দাজেই সে নাচে। কোনো কাঠামোর দ্বারা সে বদ্ধ থাকে না । ঠাটের পর শুরু হয় আমদ। এই ফার্সি শব্দটির অর্থ ‘আজমন’, ‘আসা’। আমাদের নামকরণ সম্বন্ধে মত বিরোধ আছে।
কিন্তু বিদ্বানের মতে এই বোলগুলো প্রথমে নাচা হয় বলে এগুলো ‘আমদ’। কিন্তু অন্যেরা বলেন যে, শিল্পী তো আর এটি নাচতে নাচতে দর্শকের সামনে আসছেন না। বরং এগুলোতে সমে আসার বা আগমনের বিশেষ কায়দা প্রদর্শিত হয় বলে এগুলো এই নামকরণ।
আমাদের বোলগুলো কেবল “তা থেই তৎ’ বাণী দিয়ে তৈরি এবং এগুলো খুব বেশি চাঞ্চল্যের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় না। লাবণ্য ও কমনীয়তাই আমদ নাচার ধর্ম। বিভিন্ন রকমের ছন্দে আশ্রিত সব আমদ স্বচ্ছ সুন্দর তেহাইয়ের মাধ্যমে সমে আসে। অবশ্য মাঝে মাঝে।
আসর জমানোর জন্য আমাদের পূর্বে পরণ নাচা হয় এবং এই থেকেই শুরু হয় লক্ষণৌ ঘরানার বিখ্যাত পরণ-জোড়ি আমদ-‘ধাতাকেথোঙ্গ…’ আমাদের মাঝে মাঝে তেহাই ও ছোট ছোট লয়ের কাজও পরিবেশিত হয়। এবং তারপর শুরু হয় দ্রুতগতি ও জটিল লয়-বিন্যাসের পালা।
লয়কারী দেখানো হয় পায়ের কাজে, পরণে ও তোড়ায়। নাগমা ধীর গতিতে চললেও এর দ্বিগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ থেকে শুরু করে ১৬ গুণ অবধি লয়ে নাচ দেখানো যায়। অনেক সময়ে লয় যখন খুবই দ্রুত হয়ে যায় আর ছন্দের বৈচিত্র্য যখন নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে ইনিয়ে- বিনিয়ে চলে তখন কেবল পায়ের মাধ্যমেই ছন্দ-রূপ প্রকাশিত হয়।
এতে অঙ্গের সৌন্দর্যের দ্বারা দর্শকরা আলোচিত হওয়া থেকে মুক্তি পান। সময়ের বিভাগ অঙ্কের মতো পরিস্ফুট হয় এবং সময়ের এই নানা বৈচিত্র্যময় বিভাগে তারা আকৃষ্ট হন। পায়ের কাজ প্রদর্শিত হয় লড়ির মাধ্যমে। লড়ি অর্থাৎ চলতি বাংলায় যাকে বলে ‘নারী’ যেমন ‘সাতনরী’ হার। এই লড়িগুলো আসরে ছন্দ বৈচিত্র্যেরই মালা।
একটি বিশেষ ছন্দকে ঘিরে এগুলো তৈরি হয় এবং সে ছন্দের প্রকারভেদ ও লয়ভেদের মাধ্যমে লড়ি বিকশিত হয়ে ওঠে। পায়ের ব্যবহার কথকে লক্ষণীয়। অনেকে এই নাচে পায়ের নানা রকম শব্দ দেখে আশ্চর্য । হন।
ভালো কাঠের স্টেজে ঠিক ভাবে পায়ের কাজ করলে তবলার মতোই নানা বৈচিত্র্যময় শব্দের সৃষ্টি হয়। সোজা পা ফেরাতেও কত রকম ভেদ! তা শব্দতে ঠিক চড়ের মতো, থেই এ টানা আওয়াজ, তৎ এ আবার হাল্কা নির্দিষ্ট শব্দ।
তারপরে গোড়ালি দিয়ে দিগদিগ (যাতে পা মাটিতে থাকে এবং কেবল গোড়ালির দিকটি ওঠানো ও মারা হয়), ধিন (এটিতে আঙুলের দিকটি মাটি ছোঁয় না, কেবল গোড়ালি দিয়ে মাটি আঘাত করা হয়) ঘেনে গোড়ালির বাইরের পাশটি মাটিতে জোরে ফেলে এই শব্দের সৃষ্টি। ক্রান ও ঘোরান-এ আবার দুপা এক সঙ্গে ব্যবহার হয়।
ধেরেধেরে জাতির বোলে পায়ের চেটোর পরিবর্তে পাশের দিকটি মাটিতে ফেলা হয় । আবার নানানানা তে আঙুলের দিকটি দিয়েই মাটি স্পর্শ করা হয় । কখনও কখনও আবার মাটি না ছুয়ে পায়ের গোছের সঞ্চালনের দ্বারা ঘুঙুর বাজানো হয়। সার্থক কথক শিল্পীদের পায়ের গোছ ও গুলের মাংসপেশীর উপরে খুব বেশি রকমের দখল থাকে।
এবং এর ফলে তারা অনায়াসেই স্বেচ্ছায় ঘুঙুরের শব্দ বাড়াতে ও কমাতে পারে । প্রধান বা নাগমার লয় তিন প্রকারের ঢিমা, মধ্য ও দ্রুত। নৃত্য প্রদর্শনের সময়ে ধীরে এক থেকে অন্যে এই ক্রমে বিন্যাসিত হয়। কিন্তু এই মূল লয়ের উপরে আবার বিভিন্ন লয়কারী দেখানো যায়। নাগমা তালের গতি ধরে রাখে এবং নৃত্যশিল্পী তার সময়ের ঘরের কারুকার্য দেখান।
লয়কারীর বিভিন্ন রকমফের আছে। একটি হলো জাতিভেদ। জাতি পাঁচ প্রকারের : তিশ্র, চতুরশ্র, খন্ড, মিশ্র ও সংকীর্ণ এবং এগুলোতে যথাক্রমে ৩, ৪, ৫, ৭ ও ৯ এর ছন্দ প্রদর্শিত হয়, আবার মূল লয়ের অনেক সময়ে দেড় বা সওয়া গুণে কোনো বোল নাচা হয়। এরও প্রকারভেদ আছে, যেমন পৌনে, সয়াই, আড়ি কুয়াড়ী, যেগুলো মূল লয়ের % ১১%, ও ৪ গুণ লয়ে চলে ।
কথক নৃত্যের আঙ্গিকে বোলের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বোল বিভিন্ন ছন্দে ও লয়ে নানারকম বাণী সহকারে পরিবেশিত হয়। বোলের শেষের দিকে শব্দগুচ্ছগুলো তিনবার পুনরাবৃত্ত হয়ে তেহাই এর মাধ্যমে সমে আসে। কোনো কোনো বোল আবার সম্পূর্ণ পদ-সমূহ সহিত তিনবার পুনরুক্ত হয়ে সমে আসে। এগুলোকে বলে চক্রদার।
যদিও সাধারণত সমে এসে বোলের সমাধান হয়, তাও মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষম বোল পরিবেশিত হয়। এগুলো সমের ঠিক আগে বা ঠিক পরে শেষ হয় এবং এগুলোর নাম যথাক্রমে অনাগৎ বা অতীত । শব্দ সমুহের ব্যবহার হিসাবে বোলের নানা নামকরণ হয়েছে। যে বোলে কেবল নাচের বাণী পাওয়া যায় তাকে বলা হয় নাচ বা নটবরী টুকরা।
এগুলোতে তা থেই তৎ তিগদা দিগদিগ ত্রাম এর ব্যবহার লক্ষণীয়। পাখওয়াজের বাণী আশ্রিত বোলকে বলা হয় পরণ এবং যে বোলে নানা ধরনের বাণী- যেমন নাচ এবং বিভিন্ন যন্ত্রাদি যথা- পাখওয়াজ, নাল, ডাল, ঝাঁঝ, মন্দিরা- ব্যবহৃত হয়, তাকে বলে পরমেলু, অর্থাৎ ‘পর’ বা ভিন্নের মিলন বা ‘মেলা’।
যে কোনো ছোট বোলকে টুকরা বলা যায় এবং এর গুচ্ছকে বা বড় বোলকে তোড়া বলা হয়। কিছু কিছু বোল প্রথম থেকে শেষ অবধি সমান লয়ে চলে। এগুলোকে সম লয়ের বোল বলে। কিন্তু বেশির ভাগ বোলেই ছন্দের ও লয়ের বৈচিত্র্য দেখা যায়। গোপুচ্ছ বোলের গরুর ল্যাজের মতো মোটা বা ধীর গতিতে শুরু হয়ে দ্রুত বা সূক্ষ্ম হয়ে যায়।
স্রোতগাথা বোল গতি আবার নদীর মতো চলে : প্রথমে দ্রুত ও চঞ্চল, পরে ধীর-মন্থর। ডমরুতির বোল প্রথমে ও শেষে ঢিমাচালে চলে কিন্তু মাঝে চলে উদ্দাম গতিতে আবার মৃদঙ্গ যতিতে এর গতি ঠিক উল্টো- প্রথমে ও শেষে দ্রুত এবং মধ্যভাগ মন্থর। এসব বোলে পা, হাত, সম্পূর্ণ দেহ ও চোখের ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
পায়ের কাজে বোলের বাণী ফুটে ওঠে এবং হাতের নানা ভঙ্গিতে বোলের আভাস বিকশিত হয়ে ওঠে। দেহের ব্যবহার সীমিত কিন্তু সুন্দর। নাট্যশাস্ত্রের করণ, চারী ও মণ্ডল ইত্যাদি আমরা কথক নৃৎ-এ পাই না। অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্রুত চক্কর, পাল্টা চক্কর, কলাই বা মণিবন্ধের দ্বারা চালিত হস্তের কায়দা এবং চোখের ব্যঞ্জনাময় ব্যবহারই এই নাচের রীতি।
নৃৎ-এর সৌন্দর্য পুটে ওঠে গতি ও স্থিতির তুলনামূলক বৈষম্য প্রদর্শনে। এক নৃত্যশিল্পী নাচছেন : পা চলছে দ্রুত গতিতে, অঙ্গসঞ্চালনের বেগে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, দ্রুত চক্করে দর্শকের মন আলোড়িত হচ্ছে, হঠাৎ সব থেমে গেল; সমে এসে এই প্রাণোচ্ছ্বাসকে স্বেচ্ছায় বেধে ফেলা হলো। উদ্দাম পাহাড়ি নদী যেন হঠাৎ বরফ হয়ে গেল।
গতিও ছিল যেমন চমৎকার তার এই নীরব প্রস্তরীভূত স্থিতি ও তেমনই উম্মাদনার কারণ। তাই নৃত্যশিল্পী সমে আসার পর দর্শকমণ্ডলী করতালি সমেত অভিনন্দন জানান। নৃৎ-আঙ্গিকের মধ্যে তারানা, সবার-জবাব ও তৎকারও আসে। তারানা গানের মাধ্যমে নৃৎ পরিবেশিত হয় এবং সুর সংযোগে এর আবেদনও বেড়ে ওঠে।
এর মাঝে আবার বোল ও লড়িও পরিবেশিত হয়। এ ধরনের রচনাকে তারানা বলা হয়। আগেকার দিনে রাজা ও নবাবেরা অনেক সময় দুই নৃত্যশিল্পীর মধ্যে বা নৃত্যশিল্পী ও যন্ত্রীর মধ্যে একটি লড়াই বাধিয়ে দিয়ে পরস্পরের পাণ্ডিত্য যাচাই করতেন। এই থেকেই শুরু · হলো সবাল-জবাব বা প্রশ্ন-উত্তরের পালা। এটি নানাভাবে প্রকাশ পায়।
সব চেয়ে সরল হিসাবে একজন একটি ছন্দ দেখায় এবং অপরজন এর পুনরাবৃত্তি করে। আরো জটিল স্তরে একজন একটি বোল দেখায় এবং অন্যজন এর ‘জোড়া’ বা একই ধরনের অথচ ভিন্ন বোল তৎক্ষণাৎ দেখায় । তৎকার নৃত্যপ্রদর্শনের শেষ নিবেদন স্বরূপ আসে। দ্রুত ত্রিতালে পা চলতে থাকে এবং এই লয়ে নানা ছন্দের ও লয়ের খেলা চলে।
মূল বা নাগমার লয় ক্রমশ বাড়ানো হয় এবং নাচতে নাচতে শেষে শিল্পী একটি লয়ে গিয়ে পৌঁছান যার ওপরে আর যাওয়া সম্ভব নয়। সময়কে আর বিভক্ত করা সম্ভব নয়। এই লয়কে বলে অনুদ্রুত এবং এখানেই তেহাই দিয়ে নৃত্যের সমাপন । নৃত্য ও নাট্যের মূল বক্তব্য অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। কথকে অভিনয় তিনভাবে দেখানো হয়।
প্রথমটি কথার সাহায্য না নিয়ে, দ্বিতীয়টি গানের মাধ্যমে এবং তৃতীয়টি ছন্দ সহকারে। গৎ, গৎ নিকাস ও গৎভাবে কথার ব্যবহার হয় না। এগুলো কোনো বিশেষভাবে, পরিস্থিতি বা চরিত্র এবং অনেক সময় একটি সম্পূর্ণ ঘটনা বা কাহিনী দর্শকদের সামনে ব্যক্ত করে। গতে বিভিন্ন নায়িকা ও নায়ক দেখানো হয়।
নায়িকা প্রকার ভেদে তিন রকম ও অবস্থা ভেদে আট রকমের হয়। প্রকার ভেদে : যে নারী ধীর, শান্ত, কোমল সে ‘ধীরা’, যে স্কুল অশালীন সে ‘প্রগলভা’, এবং যে এর মাঝের স্তরের সে ‘মধ্যা’। এই প্রতিটি নারী তার প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কে নানা ভাব প্রকাশ করে।
যখন সে প্রেমিকের সঙ্গে গোপন মিলনে উদ্যত তখন সে অভিসারিকা, সাজ-সজ্জায় লিপ্ত থাকলে সে বাসকসজ্জা, কপট ঝগড়ায় ব্যস্ত থাকলে সে খণ্ডিতা আবার প্রেমিকের সোহাগে আনন্দের সময়ে সে বিপ্রলব্দা।
কথকে গ নিকাসের মাধ্যমে নানা গতির- যেমন বিভিন্ন পশু-পক্ষীর (গজ, হংস, ময়ূর, সিংহ), বিভিন্ন চরিত্রের (রাম, কৃষ্ণ, রাধা, পার্বতী) ও দৈনিক কাজের (জল আনা, ঘোমটা দেওয়ার)- ছবি দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়। আবার এগুলোর মধ্যেও সূক্ষ্ম প্রকারভেদ দেখানো হয়।
যেমন ঘোমটা বা ঘুঙ্ঘট নানাভাবে দেওয়া যায় আবার নানা অবস্থায় ও মনোভাব সহকারে। এসব প্রকার গতির মাধ্যমে পরিস্ফূট করা হয়।
শিল্পী কখনও সুসজ্জিতা সুন্দরী হিসাবে সগর্বে এক হাতে ঘোমটা ধরে এগিয়ে যান আবার কখনও ছল প্রেমিকের উপরে রাগ দেখিয়ে ঘোমটা টেনে মুখ ঘুরিয়ে নেন; কখনও লজ্জিতা আনয়না হয়ে ঘোমটার মধ্যে মুখ ঢাকেন আবার কখনও তারই ফাঁকে ফাঁকে প্রেমিকদর্শন লোভে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করেন।
এসব গতিগুলোর মধ্যে শৃঙ্গার রসের প্রাধান্যই বেশি কারণ এই আদি রসের মধ্যেই তো ভাব-ব্যঞ্জনার সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সামান্য নর-নারীকে ঘিরে শৃঙ্গার না দেখিয়ে কথকরা রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করেই বেশির ভাগ গৎ সৃষ্টি করতেন।
এতে সমসাময়িক মানবজীবন থেকে দুরত্বও থাকে আবার একটি সর্বজনীন আবেদনও থাকে। কৃষ্ণের জবিন থেকে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গৎ বা গৎ ভাব রচিত হয়, যেমন কালীয় দমন, গিরি গোবর্ধনধারণ, মাখন চুরি, নৌকা বিলাস, রাস লীলা, হোরি ইত্যাদি। রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের মধ্যে যে রাগা- রাগি, মান-অভিমানের পালা বয়ে যেত সেটিও ছেড়-ছাড় প্রমুখ গতে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করা হয়।
আবার রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের আরও অনেক কাহিনীর উপরেও গৎভাবে তৈরি ও নাচা হয়, যেমন- রাম বিবাহ, রাম বনবাস, অহল্যা উদ্ধার, সীতা হরণ, সীতার পাতার প্রবেশ দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ, মহাভারতের যুদ্ধ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, হিরণ্যকশিপু বধ, গজরাজ মোক্ষ ইত্যাদি।
এসবগুলোতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত নবরসের প্রয়োগ পাওয়া যায়। এ রসগুলো হলো শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রুদ্র, বীর, ভয়, বীভৎস, অদ্ভুদ ও শান্ত। গভাবে কোনো কথা ব্যবহার না করে মুখের ভাব, অঙ্গভঙ্গি ও গতির মাধ্যমে উপাখ্যান নাটকীয় রূপে তুলে ধরা হয় এবং কথকে একই শিল্পী প্রতিটি চরিত্রের চিত্রণ করেন।
তাই গভাবে কেবল দক্ষ ও পরিপূর্ণ শিল্পীর দ্বারাই প্রস্তুত করা সম্ভব। এই ধরনের জটিল নিবেদন কেবল কথকেই পাওয়া যায় । এবারে আসা যাক গীত-আশ্রিত ভাবের অভিব্যক্তিতে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বন্দনা খাতে ভক্তি রসের মাধ্যমে কোনো বিশেষ দেব বা দেবীর রূপ বা গুণ বর্ণনা করা হয়।
বন্দনার মধ্যে সরস্বতী, বিষ্ণু, গণেশ ও গুরু বন্দনাই বেশি প্রচলিত। বৈচিত্র্য হিসাবে রাম, হরপার্বতী, কৃষ্ণ এবং অন্যান্য দেব-দেবীরও স্তুতি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের গানের উপরে ভাব প্রদর্শন হয় এবং এসব গানের নাম অনুসারেই নিবেদনগুলোর নামকরণ হয়।
গানের সঙ্গে অভিনয়ের মধ্যেও শিল্পীর কৃতিত্ব ফুটে ওঠে কারণ গানের প্রতিটি পঙক্তি যতবারই পুনরাবৃত্ত হয় ততবারই সেটিকে নবরূপে, নব আভাসে রঞ্জিত করা হয়। যেমন হরিকে যখন বলা হচ্ছে ‘তুম সবকো দুখ নিবারা’ তখন প্রতিটি পুনরাবৃত্তিতে হরি নানা অবস্থায় যে কত মানবের দুঃখ নিবারণ করেছিলেন তাই দেখানো হয় ।
প্রহ্লাদ, সীতা, দ্রৌপদী, অহল্যা ইত্যাদি প্রত্যেকের উপাখ্যান ভাবের ও ভঙ্গির মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়। কথকে গানের মাঝে অভিনয় করা হয় কীর্তন ও অষ্টপদীর সঙ্গে। এগুলো প্রাচীন যুগ থেকেই কত্থকের ভাণ্ডারে ছিল।
তারপর এল ধ্রুপদ, ধামার, হোরি। ধ্রুপদের লয়ের খেলাতে কথক শিল্পী তার ভাব ব্যক্ত করার নতুন প্রেরণা পেলেন। ধামার তালাশ্রিত লয়কারী বিশিষ্ট গানগুলো যেগুলোকে ‘ধামার’ বলা হয়, সেগুলো ও হোলির উপরে গানগুলোও নানাভাবে, নানা লয়ে, নানা ব্যঞ্জনায় শিল্পীরা বর্ণময় করে তুললেন।
হোলির বর্ণনায় রাধা-কৃষ্ণ সখীদের পরস্পরের ভাব পরিস্ফুট করার সুযোগ পাওয়া গেল এবং রস-বৈচিত্রের ভাণ্ডার শিল্পীরা উজাড় মধ্যযুগে কথকে এর গজল, গীত ও ভজনের প্রভাব। বিভিন্ন গজলে শৃঙ্গার রস ও ভজনে ভক্তিরস ব্যক্ত করতে লাগলেন কথকরা। এবং তার পরে এল দাদরা, চৈতি ও কাজরীর প্রভাব ।
দাদরা তাদের গাওয়া। এই গানগুলো সুর ও ছন্দের দোলায় শিল্পীমনকে ভরিয়ে দিল এবং লোকসংগীত থেকে বেছে নেওয়া হলো চৈত্রী ও কাজরী। ওয়াজেদ আলি শাহের দরবারে ঠুমরীর উপরে কথকের ভাব প্রদর্শিত হতে শুরু হলো অনেকের মতে নবাব স্বয়ং ঠুমরী রচনা করেন।
পা ফেলার সময় যে ‘ঠুমকা’ পড়ে— কথাটি ‘ঠুমক চলত রামচন্দ্র’তে পাওয়া যায় তার থেকেই এ ধরনের গীতের নামকরণ। তাই বলা যেতে পারে যে নাচের জন্যই বা নাচ দেখেই ঠুমরী গঠিত হয়েছিল। ঠুমরীর কবিতাগুলো আকারে খুবই ছোট কিন্তু এগুলোতে নানা সুরের ও ভাবের বিস্তার করা যায়।
নৃত্য ও গীতিশিল্পী নিজের নানা অনুভূতির রঙে এগুলোকে রাঙিয়ে, অলংকৃত করে এর ভাবের প্রাচুর্য সৃষ্টি করেন। অনেক সময় অন্তনির্হিত অর্থ ব্যক্ত করেন আবার অনেক সময় আপন মন থেকে মানে বের করে এতে আরোপ করেন। যেমন এই ঠুমরীটি নেওয়া যাক- ‘সাঝ ভয়ী ঘর আও কানহাইয়া’। নাচের শুরু হলো। যশোদা ঘরের বাইরে তার ছেলেকে খুঁজছেন।
দুষ্টু বাইরে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। বকে বলছেন সন্ধ্যা হয়ে এর ঘরে আসার নাম নেই? এই ভাবের বিস্তার খানিকক্ষণ চলার পর হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে গেল। এবার রাধা ও সখীদের দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের প্রেমিককে ডাকছে সন্ধ্যায় প্রেমবিলাসিতার জন্য। নানা প্রেমিকা নানাভাবে তার মনোভাব ফুটিয়ে তুলছে।
শেষে দেখা যাচ্ছে কবি নিজে বা শিল্পী বলছেন যে আমার জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, হে দেবতা তুমি ঘরে এসো, আমায় আশ্রয় দাও, আমায় উদ্ধার কর । ঠুমরীর ভাব-বিস্তার অপরিসীম। কবিতাগুলোকে নানাভাবে ব্যক্ত করা যায় এবং অনেক সময় এগুলো বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে।
শুনেছি শম্ভু মহারাজজী একবার ‘কোন গলিন গয়্যে শ্যাম’-এর বিস্তার করতে গিয়ে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কথকে আরেক শ্রেণীর রচনা আছে যাকে বলে কবিতা, কবিত-পরণ বা কবিত-তোড়া।
ছন্দোবদ্ধ এই কবিতাগুলো খুব দ্রুত উচ্চারিত হয় এবং তার সঙ্গে ভাব ব্যক্ত করা হয়। যদিও কবিতাগুলো শুনতে ভালো লাগে, দ্রুতগতি লয়ে মাধ্যমে ভাববিস্তারের সম্ভাবনা সীমিত হয়ে যায় বলে অনেক শিল্পী এগুলো অপছন্দ করেন।
এগুলো কয়েকটি বিশুদ্ধ কবিতা হয় এবং কয়েকটিতে মাঝে মাঝে বোল থাকে, যেমন— মুরলী কী ধুন সুন বাজত মৃদঙ্গ ধুন ধুধিকিট ধুধিকিট ধুকিট ধুকিট ধা… এই পরিধির মধ্যে আমরা কত্থকের নানা বর্ণময় ও বৈচিত্র্যময় রূপের কিছুটা আভাস পেলাম ।
বর্তমান কথক। শিল্পীর কাছে ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার অফুরন্ত। স্থান-কাল দর্শক বুঝে তিনি এ থেকে আনন্দসহকারে বেছে নৃত্য পরিবেশন করতে পারেন। পোশাক ও সহযোগী বা আবহ সংগীতের বিবরণ না দিলে কোনো নাচেরই আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না। অতএব এ দুটি বিষয় সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার।
কত্থকনৃত্যের ছবি আমরা যে সব ক্ষুদ্রচিত্রে ( Miniature paintings) পাই তাতে দেখা যায় যে পোশাক প্রধানত দুরকমের। রাধা ও গোপীদের পরনে ঘাগরা, চোলী ও লম্বা ওড়না যেটির একটি দিক কুঁচি করে কোমরে গোঁজা এবং অন্যদিকটি মাথায় ও গায়ে দেওয়া। মুসলমান দরবারের নর্তকীদের পরনে হাতওলা পা অবধি ফ্রক এবং মাথায় ওড়না।
কিছু ছবিতে আরো দেখা যায় যে পাতলা ফিনফিনে লম্বা ফ্রকের ভিতর থেকে রঙিন কারুকার্য করা পাজামা দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো নর্তকির আবার মাথায় টুপি। বর্তমান কালে নর্তকিরা এই দুরকম পোশাকই ব্যবহার করেন। ঘাগরা বা লেঙ্ঘা, চোলী আর ওড়নাও পরা হয়। আবার মুসলমান প্রভাবের ফ্রক বা ‘অঙ্গরখী’ ও পরা হয়।
ছেলেরা ধুতিও পরেন ও ‘অঙ্গরখা’ও পরেন। কথকের আবহ সংগীতের কথা ভাবলেই প্রথমে মনে আসে তবলার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো যে কথকের সঙ্গে তবলার পরিচয় ওয়াজেদ আলি শাহের দরবারে। তাই কথকের বোলে তবলার বাণী বিরল।
এখন কিন্তু তবলার প্রাধান্য সব চেয়ে বেশি এবং পাখওয়াজ বা মৃদঙ্গ- যেটি আগে কথকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল- প্রায় উঠেই গেছে। কথকে নাগমা রাখা হয় সারেঙ্গী এবং হারমোনিয়ামে যদিও এখন সেতার, সরোদ এবং বাঁশিতে রাখা হচ্ছে। গায়কের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ আগেকার মতো শিল্পীরা নিজেরা গান না গেয়ে সহযোগী শিল্পীকে দিয়ে গাওযান।
কথক এক সময় কেবল মহফিলে পেশ করা হতো। দর্শকরা তিন পাশে বসতেন, একপাশে থাকতেন যন্ত্রীরা এবং শিল্পী মধ্যমণি হয়ে নেচে, গেয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করতেন। এখন আগেকার মতো ধনীজনের মেহফিল বিরল।
বর্তমানে রুচিশীল মধ্যবিত্ত সমাজই কথকের পৃষ্ঠপোষক এবং এই নৃত্য পরিবেশিত হয় বড় বড় রঙ্গমঞ্চে। তাই আধুনিক শিল্পীদের নিজেদের নাচকে যুগের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। এবং সেটি যে তারা অনায়াইে পেরেছেন তা কেবল ভারত নয় জগৎ দরবারে কথকের সমাদর দেখেই বোঝা যায় ।
আরও দেখুনঃ