ইতিহাসের সম্মুখ রেখায় বাংলাদেশের নৃত্য সেলিম আল দীন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ইতিহাসের সম্মুখ রেখায় বাংলাদেশের নৃত্য সেলিম আল দীন , যা বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা এর অন্তর্ভুক্ত।

ইতিহাসের সম্মুখ রেখায় বাংলাদেশের নৃত্য সেলিম আল দীন

সমবেত গৌড়জন

বাংলাদেশের অন্যতম নৃত্যদল নৃত্যধারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলার নৃত্য সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। এই শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। ফসল কাটে যে কৃষক আর ফসলের ক্ষেত দেখে যে কবি, তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতার দুটি ভিন্ন স্তর থাকে। একজন শ্রমের মধ্য দিয়ে শস্যক্ষেত গড়েন তারই শ্রমজাত শস্য আহরণের নিমিত্তে। আর অন্যজন স্বর্ণসম্ভারশোভা বিমোহিত। তিনি না জানেন চাষ, না জানেন বুনন কিংবা কর্তন।

আমার অবস্থাও তাই। যে শিল্পের সঙ্গে আমি রক্তঘামে মিশে নেই, তার সম্পর্কে আমার বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকতে পারে। তবুও আমি মনে করি, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী দৃষ্টিতে যে শিল্পরূপের সন্ধান লভ্য, তা বিচিত্র ধারায় নানা বিভাজন সত্ত্বেও অদ্বৈতে সংহত। শিল্পের নানা রূপের মধ্যে আমরা তো সেই ঐক্যের অন্বেষী, যা চিত্রকলার রঙকে অচিরাৎ পরিবর্তন করে সংগীতের গুঞ্জনে। নাট্যের বিস্তারকে করে তোলে উপাখ্যানধর্মী, উপাখ্যানকে মিলিয়ে দেয় মহাকাব্যের সঙ্গে।

সেই বিশ্বাসে বুঝতে পারি নৃত্য এবং নাট্য নিশ্চিতই ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’ শিল্প। তাতে আমার অংশগ্রহণ না থাকলেও অমন্ত্রণের ঘাটতি নেই।সমকালীন বাংলা নৃত্যের এক সংকটঘনকালে আমরা একটি স্থির বিশ্বাসে পৌঁছতে চাই, একটা আধুনিক ও সৃষ্টিশীল পর্বে উপনীত হওয়া আমাদের জন্য খুব জরুরি। সেই বিবেচনায় বাংলার নৃত্যের আদিকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত আমার অন্বেষণ।

সেই সঙ্গে এ বিষয়টিও আমাদের বিবেচনাধৃত হতে পারে যে, সহস্রবর্ষব্যাপী নৃত্যনাট্যের যুগল সম্মিলনে বাঙালির শিল্পরুচির কোনো একটি বিশেষ প্রবণতা দেশকালের যৌক্তিকতায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল কি না । কারণ, তা আবিষ্কৃত হলেই বাঙালির নৃত্যরীতি সম্পর্কে আমাদের আঁধি, নির্বিচার উৎকেন্দ্রিকতার অবসান ঘটতে পারে। আমরা খুঁজে নিতে পারি আমাদের নৃত্যধারার সঠিক সম্মুখরেখা।

 

ইতিহাসের সম্মুখ রেখায় বাংলাদেশের নৃত্য সেলিম আল দীন

 

আজ থেকে অনেক বছর আগে মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলাম। তাতে বাংলা নাট্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের একটা বিস্তৃত অন্বেষণ ছিল। এই নিবন্ধ বহুলাংশে সেই গ্রন্থজাত। যাদের গ্রন্থটি পাঠ করা আছে তারা ভালো করেই জানেন, তাতে নাট্য ও নৃত্য বহুক্ষেত্রে সমার্থকরূপে গৃহীত হয়েছে। ভরসা ছিল সেই গ্রন্থ বাংলা নৃত্যের ইতিহাস অন্বেষণে অন্যদের উৎসাহিত, সৃষ্টিশীল ও সচেতন করে তুলবে।

কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক তা হয়নি। অনুমান করি বাংলা নৃত্যের উৎস অনুসন্ধানে আমাদের উৎসাহের অভাব আছে কিংবা এক অব্যাখ্যেয় জাড্য। নৃত্যে হয়তো আমরা নির্বিশেষ আহরণবৃত্তির কারণে বিশেষ হয়ে উঠতে পারিনি। বাংলার সংস্কৃতির সামগ্রিক পেক্ষাপটে আমাদের সমকালীন নৃত্যরীতি নব নব সৃষ্টি ও রক্ষা নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টিতেও অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে।

কারণ, যার অতীত নেই তার ভবিষ্যত্ত নেই। সুতরাং বর্তমানটা আধি ও বিভ্রান্তিতে ঠাসা। কিন্তু আমরা শুরু করতে পারি নতুন করে। নতুন বিশ্বাসে, নতুন উদ্যমে বাংলার নৃত্যের এক সূচির ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মঞ্চে বসলে উঠতে পারে আপনাদেরই চেষ্টা ।

নৃত্যধারার এক বছর পূর্ণ হলো। দিন গণনার সঙ্গে বিশ্ব আবর্তনের এক সৌরজাগতিক মিল কাউকে কাউকে এক অসম্পূর্ণ আনন্দরেখা থেকে পরিপূরণের পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। তারই মধ্যে কালের হিসাব ঋতুপ্রবাহের সাদা সবুজ সোনালি। তারই মধ্যে বাঁচা-মরা, বেড়ে ওঠা। আমাদের কর্মের সঙ্গে দিন-মাস মিলে সৌৱাবর্তনের সংযোগ এভাবে স্থাপিত হয়। যাকে কাল বলি, তা মহাকাশের পথে পৃথিবীর যাত্রাপথ ব্যতীত আর কী।

তখন শিল্প প্রাত্যহিকতার সুবর্ণচূর্ণের সঙ্গে ওই বিপুল আবর্তনে যুক্ত হয়। আমাদের চিন্তার ভেতর এই আবর্তনের বোধ এ কথা মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা মহাকালের সন্তান। নৃত্যধারার শিল্প অন্বেষণ পর্বে বাংলার নৃত্যবৈচিত্র্যের অন্বেষণ ও সংরক্ষণের সংকল্প বিবৃত হয়েছে। আমরা জানি এবং মানি যে, বাংলা নৃত্যের অনিকেত অন্বেষণ, উৎসহীনতা, একান্তরূপে ভিন্ন ভূগোল মৃত, দেশকালজ্ঞানহীন উৎপন্ন যাত্রা একে নিশ্চিতই এক বিবর্ণ ও পাণ্ডুর শিল্পে পরিণত করেছে।

ঊষার কৃত্যের নিষ্ফল যোগ, মুদ্রার নিরুৎস বর্ণিলতা, ভিন্নভাষীর শাস্ত্রের প্রথানুগত্য বাংলার নৃত্যকে করেছে দিকভ্রান্ত। বস্তুতপক্ষে উনিশ শতকে বাংলা শিল্প- সংস্কৃতির আধুনিকতা পর্বে বাঙালি মানস শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্য ও চিত্রকলার প্রতি যতটা মনোযোগ দিয়েছিল, নৃত্যে তার অনুবিন্দুও নয়। নৃত্যকে সর্বোতভাবে শাস্ত্রীয় কৃত্য ও বাঈজির নৃত্যসত্ত্বে বাধা শিল্পরূপে বিবেচনা করেছিল। সেকালের অভিজাত, সামন্তশ্রেণীর মানুষেরা।

সংগীতে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ ধামারের ব্যাপকতা, পৃষ্ঠপোষকতা বাঙালির সঙ্গীত চিন্তার সর্বভারতীয় প্রেসারের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবু তা থেকে নিধুবাবু নতুন ধাঁচের টপ্পার জন্ম দিয়েছিলেন। কথা শ্রবণ-প্রবণ বাঙালির মর্মে তা নতুন আবেগের তরঙ্গ সৃজনেও সমর্থ হয়েছিল। অবশ্য হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল গানের বিরুদ্ধে বাংলার অমোঘ বর্ম ছিল কীর্তন। সে কীর্তনের আবার স্থানভেদ ছিল।

মধ্যযুগের ধারাবাহিকতায় কীর্তন কলকাতার সামন্ত ও আধুনিক বাঙালির সংস্কৃতি বর্মরূপে গণ্য হতে দেখা যায়। এ ছাড়া ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, দাশরথির সুর হিন্দুস্তানি সুর প্রবাহের অপ্রতিরোধ্য বিস্তারকে খানিকটা হলেও থমকে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু কীর্তনাশ্রিত নৃত্য ব্যতিরেকে অন্যবিধ বাংলার নৃত্য তরজা, আখড়াই, যাত্রা বা নব্য পাঁচালীর দর্শকসীমায় আবদ্ধ ছিল। কেবল সে ক্ষেত্রেও একজনই মহত্তম পুরুষ ইউরোপীয় অভিজ্ঞতায় বাঙালির নৃত্যকে সুসজ্জিতকরণে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

তিনি রবীন্দ্রনাথ। তবে তিনি ইউরোপীয় অভিজ্ঞতায় অপেরার কাঠামোটাকে সঙ্গীত বা গীতনির্ভর কাব্যে রূপান্তরিত করেছিলেন। নামকরণও তার ‘নৃত্যনাট্য’, ‘গীতিনাট্য’। বাল্মিকী প্রতিভা, মায়ার খেলা, কালমৃগয়া প্রভৃতি গীতি নৃত্যনাট্য বাংলার নৃত্য ও নাট্যের ইতিহাসে এখনো অতুলনীয়। কিন্তু তা একক প্রয়াস এবং অচিরাত উত্তরাধিকারহীন, নৈঃসঙ্গের অন্ধকারে থেকে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ বাংলার নৃত্যকে গীতি কাহিনীর আঙ্গিকে বিন্যাসপূর্বক বাংলা নৃত্যনাট্যের এবং নৃত্যের এক অভূতপূর্ব অগ্রগতির সংকেত রচনা করেছিলেন। আর তা কী বিচিত্র ও স্বাধীন বিভঙ্গে অগ্রসরমান, দেখে অভিভূত হতে হয়। ফাল্গুনী, শারদোৎসব, তাসের দেশ, চিত্রাঙ্গদার নৃত্য কৌশলে শাস্ত্রীয় তাল লয় মুদ্রাকে এতটা সৃষ্টিমুখর স্বাধীন গতিতে ন্যস্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যে, বাঙালির নৃত্যচিন্তায় তা অমোঘ অবিকল্প আধুনিকরূপে আজও গ্রাহ্য।

এক চিত্রাঙ্গদার কথা মনে রাখলেই দেখা যায়, সাধারণী নৃত্যের ভঙ্গিমায় মণিপুরি কৃত্য কীভাবে সেখানে আধুনিক প্রকাশের তাগিদে আরলব্ধ আধুনিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। উত্তরকালে উদয়শঙ্কর একই আবেগ ও শিল্পবুদ্ধিতে সব বিচিত্রতাকে আরস্থ করে সৃষ্টি করেছিলেন শিবের সৃষ্টিপ্রলয় কী যন্ত্রসভ্যতার সংকট।

তাতে ইসাডোরা ডানকানের মতো বিশ্বজয়ী নৃত্যকী বগলেরিনা পর্যন্ত মুগ্ধ রুমাঞ্চিত এবং বাঙালি সৃষ্ট ভারতীয় নৃত্যকলার আধুনিক রূপকে আরম্ভ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।একদা দীলিপ রায়ের সঙ্গে বাঙালির সঙ্গীত চারিত্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে ডিসকোর্স হয়েছিল তা সংক্ষেপে এ রকম যে, বাঙালির কানমন সুর ও কথায় সমান প্রাধান্যে স্ফূর্তি পায়।

নৃত্যের ক্ষেত্রে ওই একই কথাকে ঘুরিয়ে বলা যায় যে, বাঙালি শুদ্ধ সঙ্গীত বা তান প্রাধান্যের ধৃত সঙ্গীত ও কৃত্য-নৃত্য বা ধ্রুপদী নৃত্যের পরিবর্তে গীত নাট্যভিত্তিক নৃত্যেই উৎসাহী। অন্তত সহস্র বছরের বাংলা নৃত্যে সেই স্বাক্ষর বিদ্যমান। কিন্তু সহস্র বছরের বাংলা নৃত্যের ধারাটা কেমন ছিল । আজ নতুনতর নৃত্যভাবনায় সে প্রসঙ্গটা জরুরি কি না তা বিবেচনার প্রয়োজন।

আধুনিক পর্বে বাঙালির শিল্পচর্চার নানা মাধ্যমের ইতিহাস ও অনুসন্ধান কিংবা তার শিল্পরূপের নানা প্রসঙ্গের সন্ধান বিস্তৃত। জাতিগত ইতিহাস, নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, কাব্য, নাট্য, উপন্যাস, চিত্রকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্যকলার ঐতিহ্যের আবিষ্কার প্রয়াস ন্যূন নয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাঙালির নৃত্যধারার উৎস সন্ধান সংক্রান্ত কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা এ যাবৎ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্যদিকে বাংলা ভাষার নৃত্য সংক্রান্ত যেসব গ্রন্থ দৃষ্ট হয় তা সর্বভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের কলাকৌশল ও বিষয় বিবরণ সংক্রান্ত।

নৃত্য সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে ইতিহাসহীনতার ঘোলা আবর্ত আমাদের নৃত্য শিক্ষার্থীদের উৎসভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমাদের নৃত্যচর্চা পরভূত শিল্পচর্চারই নামান্তর। ফলে বৃহৎ জনজীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের নৃত্যের বিশেষ কোনো যোগাযোগ ঘটেছে বলে মনে হয় না।

যদি তাই হতো, আমরা ইতিহাসের নানা পারবিক অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে একটা নান্দনিক শৃঙ্খলা আবিষ্কারে সমর্থ হতাম, তাহলে নৃত্যের অন্তরাবেগের সঙ্গে আমাদের সর্বমানুষের একটা আরিক যোগ স্থাপিত হতো। আমাদের সুখে-দুঃখে, প্রেমে-সংগ্রামে, পরাজয়ে-বিজয়ে নৃত্য হয়ে উঠত এক জীবন্ত শক্তি। আজ এই পরাভূত নৃত্য গৃহশয্যার আইকনরূপে কেবলই নয়নরঞ্জক আর সৌন্দর্যবর্ধক হয়ে থাকত না।

বৈশাখী ঝড়ে, ঘনবর্ষণের জলনম্র মেঘে বিদ্যুতে, আমাদের সারদীয় মেঘের শুভ্রসঞ্চালনে, বিচিত্র নদীর বাঁকে, পাহাড়ের ভাঁজের দৃশ্যমানতায় নৃত্য আছে। আমাদের গণবিপ্লবের বিশাল অভ্যুত্থানে মিলিত কণ্ঠের মিছিলে নৃত্য আছে। আমাদের অন্তর্গত জীবনের স্বপ্ন ও ভাঙনের বেদনার ভেতর নৃত্য আছে, যা সুরে চিহ্নিত হয়েছে, যা নাট্যে দৃশ্যায়িত ও উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে, চিত্রে নানা রঙে ছাপ ফেলেছে তা নৃত্যে কেন সমাহিত হবে না।

দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের আলোকে আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, যা সুরে বৃত্ত তা নৃত্যেও ধৃত হতে পারে, রঙে বিচিত্রিতায় সে হয়ে উঠতে পারে অপ্রতিরোধ্য চিত্রকলা। কিন্তু আমরা নৃত্যের সঙ্গে এসব কথা ভাবিনি। হয়তো সে চেষ্টা উদয়শঙ্কর, বুলবুলের মধ্যে ছিল এবং যার উৎসভূমি এক অনন্য সর্বদেশ সর্বলোক আলোকিত করা রবীন্দ্রনাথ।

নৃত্যচ্ছলে বাংলাদেশে ক্ষমতা তোষণের একটা পথ বের করেছিল পঞ্চাশ-ষাটের ঢাকা । স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকের নানা দূত-অপদূতের সামনে নিজ জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক তুষ্টির জন্য একটা কল্পিত মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা নৃত্যের ঘরানা যারা রচনা করেছিলেন, তাদের ততটা দোষ দেওয়া যায় না।

কারণ, নৃত্য একটি প্লাস্টিক আর্টটাই ছিল পাকিস্তানিদের ধর্মান্ধ দর্শনের বিরুদ্ধে। কাজেই সেসব শিশুতোষ নৃত্য (যা অদ্ভুতভাবে লোকনৃত্য নামে ডাকা), অন্তত মুসলমানদের নৃত্যের অধিকার রক্ষা করে চলেছিল।

আজ স্বাধীনতার প্রায় তিন যুগ পরে স্বাধীন বাংলাদেশে নব নৃত্যধারার সৃষ্টিশীল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। তবে সেই আয়োজন বাংলা নৃত্যের প্রত্নরূপ সন্ধানের নৃত্যের প্রকৃত নান্দনিকতার ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের। ইতিহাসের লুপ্ত স্রোতের নূড়ী পাথর তুলে দেখা যে, যথার্থই তা স্রোতগন্ধী কি না ।

নতুন সৃষ্টির উদ্ভাসন মুহূর্তে দেখতে হবে বাঙালি জীবনে সহস্র বছরে নৃত্যের আঙ্গিকগত ও রূপগত বৈশিষ্ট্য কী। আধুনিককালে তাকে যথার্থই জীবনের নিত্যকার কর্মের মধ্যে উদ্ভাসিত শিল্পাবয়বে আবিষ্কার সম্ভব কি না। যে অর্থে উপাখ্যানবর্তী নাট্য, নৃত্যকে সে স্থলে দাঁড় করানোর দরকার আছে কি না।

একেবারে শুরুতেই মনে রাখা দরকার, বাঙালির নৃত্য আদিতে ছিল কৃত্যেরই নামান্তর। আর কৃত্য বাংলার ক্রম প্রসারিত বহু দর্শনের মধ্য দিয়ে উপাখ্যান পরিবেশনের সীমা পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছিল। স্বতন্ত্ররূপে বিশেষ ধরনের নাট্য সম্পূর্ণতই নৃত্যের অধীনে ছিল, যেমন চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকের ডঙ্ক নাট্য, নাথ সম্প্রদায়ের হনুমান ও অপ্সরা বা বিদ্যাধরী নৃত্য। কিন্তু সব সময়েই বাংলার নৃত্য ছিল অভিনয় বা নাট্যেরই নামান্তর। অবশ্য তাতে এই দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পমাধ্যমের অবয়ব বিশেষরূপে দূরবর্তী হয়ে ওঠেনি।

যেকোনো বাংলা উপখ্যানেই নাচটি সুনির্দিষ্টভাবে থাকত, সঙ্গে সুর, তাল, লয়। আর বাঙালির নাগরিক অংশ প্রাচীন গৌড়বঙ্গে দশম দ্বাদশ শতকে উচ্চকোটি নৃত্যের আমদানি করেছিল। সে প্রমাণ ইতিহাসে লভ্য। ‘আর্যাপ্তশতী’ গ্রন্থে প্রাচীন গৌড়বঙ্গে শাস্ত্রীয় বিশেষত দাক্ষিণাত্যের প্রচলন থাকার প্রমাণ লভ্য। নাট্য ও নৃত্যের অভিন্ন রূপ হিন্দুস্তানি নৃত্যেও বিদ্যমান। ‘ভরতনাট্যম’ নৃত্যশাস্ত্র সত্ত্বেও তা একই সঙ্গে দশরূপকের শাস্ত্রগ্রন্থ।

তাতে আবার নাট্যপ্রকরণের বিস্তারিত শ্রেণীকরণ ও বিষয় নির্দেশ রয়েছে। আনন্দকুমার স্বামী বা হিন্দু আইকনোলজিস্ট টি এ গোপীনাথ রাওয়ের আলোচনা থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, কালীদাসকৃত শকুন্তলা মুদ্রা, করণ ও তাল, লয়যোগে পরিবেশিত হতো। তবে সংস্কৃত নাট্য আহার্যাদি হাবভাব সহযোগে কেবল নাটকরূপেও যে মঞ্চস্থ হতো সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভারতীয় অনার্য দেবতা সর্বপ্রাণবাদী সম্প্রদায়ের উপাস্য শিবকে কেন্দ্র করে নৃত্যের উদ্ভব।

সে ক্ষেত্রে শিবের লৌকিক অর্থাৎ প্রাক্ত রূপনির্ভর আদি বাংলার নৃত্য আর আর্যায়নের শিবকেন্দ্রিক শাস্ত্রীয় নৃত্য একরকম ছিল না। আজও এ বিষয়ে জীবন্ত প্রমাণ লভ্য যে, গাজন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে নৃত্য সাধারণী এবং বৃত্ত অস্পষ্টরূপে অঙ্কিত।

অন্যদিকে ভরতনাট্যশাস্ত্রের স্রষ্টা শিব নিদের্শিত নাট্য মুদ্রা, করণ, চারী দ্বারা এক অনন্য শাস্ত্রীয় নৃত্য।ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটের একটা ভগ্নাংশ মনে রাখার দরকার এই জন্য যে, তাতে বাংলার নৃত্যচারিত্র্য সম্বন্ধে এবং এর প্রবণতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা খানিকটা স্পষ্ট হতে পারে।

চর্যাপদে বুদ্ধনাটকের যে উল্লেখ পাই তা আদ্যন্ত কথানৃত্য। কথানৃত্য বলতে আমরা বুঝব যে, সুনির্দিষ্ট পদগানের নৃত্যে কাহিনীর বিবৃতি । ১৭ সংখ্যক চর্যায়

ঃ নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী

বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই ।

এর অর্থ বজ্রধর নৃত্যপর এবং দেবী সংগীত পরিবেশনা করল (অর্থাৎ উল্টোভাবে) এবং এই জন্য বুদ্ধ নাটকের পরিবেশন বিপন্ন হলো বা তা উল্টো প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হলো। এই নৃত্য বৌদ্ধ সহাজিয়া ও তান্ত্রিক দর্শনজাত। চর্যায় পদ্মনৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, ঃ এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ি

তঁহি চড়ি নাচই ডোম্বী বাপুড়ি।

অর্থাৎ চৌষট্টি পাপড়িসংবলিত একটি পদ্ম, তথায় চড়ে নাচছে ডোম্বী ।

একে ‘পদ্মনৃত্য’ বলাই সঙ্গত। অন্তত একালের পরিভাষায়, হয়তো সেকালে এর নাম ছিল ‘পাখুড়ি নৃত্য’। সে নৃত্যের মুদ্রা কিরূপ ছিল তা একালে জানার উপায় নেই। জানলে তাকে ফিরিয়ে আনা যেত আধুনিকের সৃষ্টিশীলতায়।

তবে তিব্বতে প্রাপ্ত চর্যাকারদের রেখাচিত্র (সূত্র : সৈয়দ আলী আহসান)সমূহ নাট্যশাস্ত্রের বিপরীতে বাঙালিদের বিশেষ ধরনের চারী, করণ ও মুদ্রা সংকলিত যোগসাধনার ইঙ্গিত প্রদান করে। কাহ্নপা, ডোম্বীপা প্রমুখ সিদ্ধাচার্যের করণ, বিশেষত কাহ্নপার ক্ষেত্রে ত্রিচরিত্রবিশিষ্ট নৃত্যের ইঙ্গিত আছে। জালব্ধীরপার চিত্রটি বিবৃত করলেই এর সত্যতা অনুধাবন করা যাবে। এ সম্পর্কে মত্রচিত মধ্যযুগের বাংলা নাট্যে আছে-

: জালন্ধর দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গ, বামপায়ের ওপর, পায়ের ভঙ্গি কৌণিক, ডান পায়ের গোড়ালি কাঁধের ওপর। তার পায়ের পাতার উল্টো দিক ডান হাতের ভাঁজে, দুই হাত মস্তকের ওপরে পরস্পর সংবদ্ধ। এখানেও ডানদিকে এক নারী, তার দুই হাতে পাত্রের মতো কিছু একটা ধরা। তালু ঊর্ধ্বমুখী, ডান হাতের ভঙ্গিটি অস্পষ্টতার কারণে বোঝা যায় না কিন্তু তার হাতের মুদ্রা এবং জল থেকে উত্থিত সেই একই রকম নারী, প্রণামধৃত হাত। সম্ভবত এই নারী নৈরামণী দেবী।

চর্যাপদের কালেই (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) নাট্য ও নৃত্যের ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র এবং আহার্যের সন্ধান পাওয়া যায়। দশসংখ্যক চর্যায় নড়পেড়া বা নটপোটিকার উল্লেখ লভ্য। এ থেকে দেখা যায়, নৃত্যাভিনয়ে প্রাচীন বাংলায় নট নটীরা সাজপোশাকের জন্য পেটিকা সংরক্ষণ করতেন (সূত্র-আচার্য শশিভূষণ দাশগুপ্ত) । বাঙালির আদি নৃত্যপর্বের কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা নৃত্যে ধারাবাহিকতা, নৃত্যের শৈলী, বিষয়, পরিবেশনারীতির একটা বিস্তৃত সন্ধান মেলে, বিভিন্ন উপাখ্যান, প্রচলিত দেবদেবীর কৃত্যে, পীর-ফকিরদের অলৌকিক মাহারধৃত আসরকেন্দ্রিক উপস্থাপনায় । নাথপন্থীদের উদ্ভব ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বকাল ধরা যায়। বৌদ্ধ কায়া সাধনার বিচিত্র পন্থায় এর উদ্ভব ও বিস্তার।

এই নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত ধারণা, সংখ্যা যোগতন্ত্রের আদিউৎস বাহিত এই ধরার চীনে তাওপন্থী-উত্তরকালে ইরানি সুফিতত্ত্বকেও প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিল । কায়াকে বিচিত্র বিভঙ্গে ঐশ্বরিক করে তুলতে গেলে দেহের নানান প্রকাশ ভঙ্গিমার প্রয়োজন, সর্বপ্রাণবাদী দর্শনের প্রয়োজন। সেই সূত্রেই প্রাচীন বাংলায় উদ্ভব ঘটেছিল গোর্খনৃত্যের।

গোরক্ষক থেকে উদ্ভূত অন্য নাম গোর্খনাথ । এই ধর্মগুরুর নৃত্যে আঙ্গিকাভিনয়, বাটিক, সাত্ত্বিক এবং সুসজ্জিত অঙ্গাভরণ অর্থাৎ আহার্যের সংস্থান ছিল। নৃত্যের বিষয় ছিল গুরুশিষ্যের লীলাভিনয়-

: নাচেন্ত গোর্খনাথ তালে করি ভর।

মাটিতে না লাগে পদ আলগ উপর।

দেখা যাচ্ছে গোর্খনৃত্যে তাল ছিল এবং এ নৃত্যের পদবিক্ষেপে মৃত্তিকা থেকে ঊর্ধ্বে উত্থানের কৌশল অবলম্বন করা হতো। ঊর্ধ্বে উত্থানের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় যে, তা পায়ের আঙুলের ওপর ভর করা নৃত্যকৌশল-

: নাচেন্ত যে গোর্খনাথ ঘাঘরির রোলে

কায়া সাধ কায়া সাধ মাদল হেন বোলে ।

এ নৃত্যে মাদলের ব্যবহার ছিল এবং আহার্যাভিনয়ে ঘাঘরি ব্যবহৃত হয়েছে। সেই ঘাঘরিতে নৃত্যের তালে তালে রোল বা সম্মিলিত সুমিষ্ট শব্দ উত্থিত হতো। ঘাঘরি রাজস্থানের রমণীদের পোশাক। তাতে দেখা যায় প্রাচীন বাংলায় পুরুষ অর্থাৎ নৃত্যকে রমণীর বেশ ধারণপূর্বক নৃত্য পরিবেশন করত। একই পদে নৃত্যকৌশলের একেবারে দৃশ্যমান বর্ণনা লভ্য। তাতে প্রাচীন বাংলার নৃত্য পদ্ধতি বুঝতে আর অসুবিধা হয় না-

: হাতের থমকে নাচে পদ নাহি লড়ে।
গগন মণ্ডলে যেন বিজলি সঞ্চারে

অর্থাৎ নৃত্যকে হাতের থমকে বা বাহু সঞ্চালনের মাধ্যমে হার ও ভাব প্রকাশ করছে। সম্ভবত সেই মুদ্রায় আকাশ ও বিদ্যুতের ইঙ্গিত ছিল। গোর্খনাথ পদযুগল মৃত্তিকায় নিবন্ধপূর্বক নৃত্যকৌশল প্রদর্শন করেছিলেন। এও নিঃসন্দেহে প্রাচীন বাংলার নৃত্যরীতি। তবে সেকালে নৃত্যকে নাট এবং নৃত্যকারীকে নাটুয়া বলা হতো। নাটুয়া শব্দটি একালেও লোকনাট্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ।

প্রাচীন বাংলায় শিবনৃত্যের পরিচয়ও বিবৃত হতে দেখি। ‘গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাসে’ আছে যে, নিরঞ্জনের পরিচয় পেয়ে শিব গীতে মেতে উঠল আর খটকও ডমরুসহযোগে ঠমক বা থমক নৃত্য শুরু করল । এই নৃত্যকে থমক বা ঠমক নৃত্যরূপে গণ্য করাই শ্রেয়।

তবে মনে রাখতে হবে, প্রাচীন বাংলায় নাট্য ও নৃত্য দ্বৈতাদ্বৈতরূপা, বহুস্থলে একে অন্যের পরিপূরক এবং পরস্পর নির্ভরশীল যুগল শিল্পরূপে আর প্রকাশ করেছিল। সেই ধারার লোকনাট্যের আঙ্গিকে আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অন্য এক প্রকার নাচের প্রচলন ছিল প্রাচীন বাংলায়, যাকে ‘বিদ্যাধরী নৃত্য’ নামে অভিহিত করা যায়।

গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাসে এই নৃত্যের সুবিস্তৃত বিবরণ লভ্য। এতে নৃত্যের তাল, বাদ্যযন্ত্র, আঙ্গিকাভিনয় ও রস নিষ্পত্তির কৌশল এবং মঞ্চসজ্জা প্রসঙ্গ বিশদভাবে বিবৃত হতে দেখি- :

বাম হস্তে চন্দনের বাটা দক্ষিণে সুবর্ণ ঝাঁটা
আইল এক বিদ্যাধরী।
পরিধানে পাটের শাড়ি আগে ছিল ছড়া ঝাড়ি
আমোদিত করিল চন্দনে

হস্তেতে তৈলের খুরী দিউটি জ্বলে সারি (সারি)
সূর্য যেন উদিত গগনে
সন্ধ্যা রজনী গতে বিদ্যাধরী শতে শতে আইল প্লাবিয়া কান্তাপুর।
অধর অরুণ আভা
মুখ যেন পুষ্প জবা
হীরা যেন দত্ত মতীচুর।

অর্থাৎ নৃত্যকীর বাম হাতে সোনার বাটা, ডান হাতে সোনার ঝাড় বা সুবর্ণ পুচ্ছ। তার পরিধানে মূল্যবান পাট করা শাড়ি, অর্থে বিদ্যাধরী, সেই পুচ্ছ ও ছড়া বা মালা সহকারে তার মঞ্চে বা নৃত্যস্থলে আগমন, অঙ্গে চন্দনের ছাপ। তৎপর বিদ্যাধরীর হাতে তেলের খোরা বা আধারে। আর মঞ্চে দীপাবলি জ্বলছে সারে সারে।

নৃত্য আরম্ভ হলো উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়। শত শত বিদ্যাধরী এসে নৃত্য শুরু করল। তাদের ঠোঁট লাল বর্ণে রঞ্জিত হাস্যমুখর দত্তপভুক্তি হীরার ঔজ্জ্বল্যে আভাময়। শত দীপের বিকীর্ণ আলোয় ঝলমলে তাদের বসনভূষণ লাবণ্যে ও রূপ।

এ নৃত্যকেই উত্তরকালে কবি আবদুল হাকিম (১৮শ শতক) ‘তাফা’ নৃত্যরূপে উল্লেখ করেছেন। তাফার অর্থ অপ্সরী অর্থাৎ বিদ্যাধরী নৃত্য তাফা নৃত্য নামেও অভিহিত হওয়ার যোগ্য। এই নৃত্যে আহার্য, হাব-ভাব ও আঙ্গিকাভিনয় দ্বারা প্রকাশিত হওয়ার বিবরণ দৃষ্ট হয়।

: তাল ঝুনাঝুনি খোল মৃদঙ্গ শুনি

করে কত কত তাল ।

শতেক নাচনে নিৰ্ত্ত সৰ্ব্বজনে।

পদের সাথে সাথে তাল ।

পা এর নেপুর ঝুমুর ঝুমুর

চলিতে চাপালি চম্পকের কলি।

ছটকে যেন দামিনী॥

চলিতে সুনাদ শুনি।

তাল ঝুনাঝুনি-তালের সঙ্গে নূপুর গুঞ্জন এবং তা খোল ও মৃদঙ্গ সহকারে। করে কত কত তালের সঙ্গ অর্থ অনেক রকম ভঙ্গি। নৃত্যকী দর্শক সম্মুখে উপস্থাপন করছে ‘শতেক নাচনে নির্ভ সৰ্ব্বজনে’-পায়ের সঙ্গে রক্ষা করেছে তালসঙ্গতি। বিদ্যাধরী পায়ে নূপুর পরিহিত এবং পদ সঞ্চালনে তা নিক্কণিত। ‘চলিতে চাপালি’ ইত্যাদি অর্থ নানা ভঙ্গি প্রকাশের জন্য পদবিক্ষেপে মঞ্চ প্রদক্ষিণ, যাকে নাট্যশাস্ত্রে বলা হয় ‘চারী’।

এই নৃত্যে ‘মধু মধু বচন’ অর্থাৎ বাচনিকতা ছিল। কোমরে কিঙ্কিণী এবং মাঝেমধ্যে ‘রসে রসে তোলে পাও’। অর্থাৎ তা নৃত্যের করণ, অন্যদিকে এ বিদ্যাধরী নৃত্যে ‘কাঁচলী’ পরিহিত নর্তকী আঁখির মটকে অর্থাৎ দৃষ্টি ভেদ দ্বারা বহুরূপভাব প্রদর্শন করল (করে কত কত ভাব)। এই নৃত্যে নাট্যশাস্ত্র নির্দেশিত নৃত্যকলার প্রভাব আছে বলে ধারণা করা যায়।

তত্রাচ, এই বিশদ বিবরণ থেকে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, দশম দ্বাদশ শতকে দাক্ষিণাত্য থেকে আহৃত গৌড়ীয় নৃত্যের ধারা সপ্তদশ-অষ্টদশ শতকেও বাহিত হয়েছিল। বাঙালির প্রাচীন নৃত্যধারায় নাথগীতিকায়প্রাপ্ত নৃত্যের বর্ণনাগুলে নাচাড়ির আকারে মঞ্চে পরিবেশিত হতো।

শিববিষয়ক নৃত্যে হালের বলদ, জমিকর্ষণ এবং শস্য কর্তন অভিনয়ের প্রচলন ছিল এতদ্ব্যতীত প্রাচীনকালে গাজন উপলক্ষে গম্ভীরা নৃত্য গাজনের তৃতীয় দিনে মুখোশ নৃত্য, চতু দিনে ভূতপ্রেতের রূপসজ্জায় নৃত্য প্রদর্শিত হতো। শিববিষয়ক নৃত্যে নিদ্রাভঙ্গ বা যোগভঙ্গ নৃত্যের প্রমাণ আছে।

প্রাচীন বাংলায় ইঁদ বা ইন্দ্ৰ নৃত্য, বাস্ত্র নৃত্য ও ভাদুপরব নৃত্যের প্রচলন ছিল। এখনো বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে বিদ্যমান আছে। এ ছাড়া ঝমাল বা ঝুমুর নৃত্যও প্রাচীনকালের।’সেক শুভোদয়া’ গ্রন্থ দৃষ্টে মনে করা যায়, ‘ভাদুপরব নৃত্যে’ দুই ধরনের নৃত্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল। একটি গঙ্গাস্নান উপলক্ষে ব্রতভিত্তিক, অন্যটি ডাকিনী নৃত্য। এই ডাকিনীদ্বয় সেখ জালাল উদ্দিন তাবরেজিকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছিল। ‘ডাকিনী নৃত্য’ দ্বাদশ শতকের।

লক্ষণ সেনের রাজসভায় নৃত্যের প্রচলন ছিল। সে নৃত্য ধ্রুপদী ঘরানার বলেই মনে হয়। জয়দেবের স্ত্রী পদ্মাবতী, গাঙ্গোনট এবং তার স্ত্রী বিদ্যুৎপ্রতা ও নর্তকী শশিকলার নাম উল্লিখিত হয়েছে।মুসলমানেরা যে সংগীত-নৃত্যকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তার প্রমাণও ‘সেক শুভদয়া’তে লভ্য।

সেক শুভদয়ায়’ আছে- : তারপর সেখ সমস্ত ধন আনিয়া অগ্রে জয়দেব মিশ্রের স্ত্রী পদ্মাবতীকে কঙ্কণ দুটি প্রদান করিয়াছিলেন। তারপর হলায়ুধ মিশ্রকে কুণ্ডল দুটি দিয়া নিজের গৃহে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। গোবর্ধন আচার্যকে দুটি কুণ্ডল দিয়াছিলেন। বিদ্যুৎপ্রভাকে দুটি কঙ্কণ দিয়াছিলেন। শশিকলাকে দুটি কঙ্কণ দিয়াছিলেন।

‘শূন্যপুরাণে’র পাঁচালিতে নৃত্য প্রসঙ্গ আছে। এতে কোনো কোনো গীত নৃত্য সহকারে পরিবেশিত হতো। এর টিকা প্রতিষ্ঠায় নাটগীত বা নাট্যগীতের প্রসঙ্গ আছে। নাটগীত আর কিছুই নয়, গীত-সুর-তাল-লয়ে নৃত্যাভিনয় । সেকালে ‘নারদ নৃত্য’ নামে একটি বিশেষ ধরনের নৃত্যের প্রচলন ছিল। এ নৃত্য ছিল হাস্যরসাত্মক বা কৌতুক রসাশ্রিত। এই নৃত্য পরিবেশনের রীতিও পাওয়া যাচ্ছে। নারদ ঢেঁকিপিঠে আরোহণ করছে যোগেশ্বর বা শিবের উদ্দেশ্যে।

তার নৃত্য ‘তেঠঙ্গ’ বা ‘ত্রিভঙ্গ’, কণ্ঠে ব্যাঙের ডাক (তেঠঙ্গ হইয়া জাঅ/ভেকর সঙ্গীত গাঅ)। ধর্ম মঙ্গলের অন্য কাহিনী ‘রাজা হরিশচন্দ্রের পালা’। নেপালে ‘হরিশচন্দ্র নৃত্য’ নামে একটি নাটকের খোঁজ পাওয়া গেছে। ‘শূন্যপুরাণে’র ধারায় ধর্মমঙ্গল রচিত হয়। এতেও কৃত্যমূলক নৃত্যের নানা দৃষ্টান্ত আছে। যেমন ‘ফুলচাপানো’ ও ‘উতুরিখোলা’ নৃত্য। এ নৃত্য ধর্মঠাকুরকেন্দ্রিক।

প্রাচীন বাংলার নৃত্যরূপে ‘ছৌয়ের উল্লেখ করা যায়। এ নৃত্য ‘ভোগতা’ বা শিবের ভক্তদের দ্বারা পরিবেশিত হয়। পুরুলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে এর প্রচলন রয়েছে। ‘ছৌ’ আদ্যন্ত বীররসাশ্রিত নৃত্য। এতে দুর্গা নাচ, মহিষাসুর বধ, কিরত-অর্জুনের যুদ্ধ, বালিবধ প্রভৃতি আখ্যানকে কেন্দ্র করে নানাবিধ নৃত্য পরিবেশিত হয়। ‘ছৌ’ নৃত্যে গণেশ অন্যতম পূজ্য দেবতা।

প্রাচীন বাংলায় নৃত্যের স্বরূপ অন্বেষণে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ অন্যতম প্রামাণ্যরূপে বিবেচিত হতে পারে। গীতগোবিন্দ মূলত গীতিনাট্য। জয়দেবের উক্তিতেই এই নাট্যটি যে নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশিত হতো তার প্রমাণ আছে। অর্থাৎ-

যদ গান্ধর্ব-কলাসু কৌশল মনুধ্যানষ্ণ যদবৈষ্ণবং

যচ্ছৃঙ্গার-বিবেক তত্ত্বমপি-যৎ কাব্যেষু লীলায়িতম।

তৎসৰ্ব্বৎ জয়দেব পণ্ডিতকরে : কৃষ্ণকতানতুন

সানন্দ : পরিশোধযুক্ত শ্ৰী গীতগোবিন্দত :
‘গীতগোবিন্দের’ অন্যত্র আছে ‘তব চরণে প্রণতাবয়মিতি ভাবয়’। আচার্য সুকুমার সেনের মতে, ‘বয়ম’ কথাটার সঙ্গত অর্থ হচ্ছে গীতনাট্যের গায়ক বাদক দল ।

অনুমান করা যায়, পদ্মাবতী দ্বাদশ স্বর্গে বিভক্ত এই নৃত্যে নাট্যের মূল ভাবটি একেকটি খণ্ড, নির্বাচিত কয়েকটি খণ্ড, একনাগাড়ে একাধিক দিনে অথবা পরপর সব খণ্ড নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করতেন। আঙ্গিকের বিচারে ‘গীতগোবিন্দ’ নিঃসন্দেহে বাঙালি রচিত প্রথম সংস্কৃত মহাকাব্য। কিন্তু তা সর্বোতভাবেই সংস্কৃত নাট্যরীতির বিপরীত। এই নিবন্ধকারের মতে, ‘গীতগোবিন্দ’ নাটগীত শ্রেণীর রচনা।

এর অন্তর্গত সুর হচ্ছে ‘মঙ্গলগীত’। আচার্য সুকুমার সেনের মতও তাই। অর্থাৎ তার মতে এটি ‘মঙ্গলগীত’।
আহম্মদ শরীফ মনে করেন, ‘গীতগোবিন্দ’ একটি নৃত্যসংবলিত গীতিনাট্য। তবে গীতগোবিন্দের অভিনয় ও নৃত্য বিভিন্ন রাগ-রাগিণীনির্ভর। যেমন এর প্রথম স্বর্গের প্রথম গীতের রাগ হচ্ছে ‘মালবগৌড়’ এবং তাল হচ্ছে ‘রূপক’।

কে. বাসুদেব শাস্ত্রী ‘গীতগোবিন্দের’ নৃত্যরীতির শাস্ত্রীয় বিন্যাস এভাবেই দেখিয়েছেন। ১। প্রলয় = পতাক পরিমর্দিত দৃষ্টি আকাশে।
২। পয়ধিজল = পতাক হস্তের তল স্বস্তিনীকৃত ।
৩। ধৃতমানসি = দৃষ্টি অধদেশ, ইত্যাদি।

আমাদের বিবেচনায় বাঙালির ‘মঙ্গলনাট্যের ধারায় রচিত ‘গীতগোবিন্দ’, ‘ভরত নাট্যশাস্ত্র’ নির্দেশিত পথে অভিনীত হওয়ার কথা নয়। কারণ, এ কাব্যের রসবিচারের সঙ্গে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘উজ্জ্বলনীলমণি’র রসনির্দেশের একটা নিগূঢ় ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।

রাজস্থানীয়, গুজরাটি, দাক্ষিণাত্য প্রভৃতি নৃত্যের প্রভাব প্রাচীন বাংলায় কীভাবে বিস্তৃত হয়েছিল, তা বলা কঠিন। সম্ভবত তীর্থ যাত্রা, ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে নানা অঞ্চলের মানুষের সম্মিলন, বাণিজ্য ও যুদ্ধের মাধ্যমে এসব নৃত্যধারার সঙ্গে বাংলার পরিচয় ঘটেছিল সে নিয়ে সন্দেহ নেই। গৌড়ীয় উচ্চবিত্ত রাজ অমাত্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় নাট্যশাস্ত্র নির্দেশিত নৃত্য ও নাট্যের সঙ্গে সমগ্র দেশের কোনো যোগ ছিল না।

তারপরও কল্পনা করা যায়, ওইসব নৃত্য গৌড়ে এসে বঙ্গীয় ছাপ লাভ করেছিল। কারণ, ষোড়শ শতকের আগে বাঙালির নন্দনভাবনায় সংস্কৃত সাহিত্যের বা শিল্পাদর্শের কোনো প্রভাব যে আপতিত হয়নি সে বিষয়ে সব গবেষকই নিঃসন্দিগ্ধ। সে ক্ষেত্রে বাঙালির নৃত্যধারায় দাক্ষিণাত্য প্রভৃতি অঞ্চলের নৃত্যশাস্ত্র অনুসৃত হয়েছিল তা স্বীকার করা যায় না। কাজেই ‘বিদ্যাধরী নৃত্য’, ‘গোর্খনৃত্য’, ‘পাখুড়ি নৃত্য’, ‘রামায়ণ নাট’ আবহমানকালের বঙ্গীয় নৃত্যধারাতেই অনুসন্ধানাই ।

ধ্রুপদী সংগীতে যেমন বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবিত কিছু রাগ গৃহীত হয়েছিল, তেমনি ভাবা যায়, নৃত্যের ক্ষেত্রে সেরূপ কিছু ধ্রুপদী নৃত্যেরও সৃষ্টি হয়েছিল, যা কালপর্বে লুপ্ত। গীতের সমান্তরাল নৃত্য, কাজেই বাঙালির ধ্রুপদী রাগের সঙ্গে নিজস্ব ঘরানার ধ্রুপদী নৃত্যের অস্তিত্বের ধারণা অসম্ভব বা অবাস্তব কিছু নয়।

সুতরাং ‘বুদ্ধ’ বা ‘নৈরামণী নৃত্য’, ‘পাখুড়ি নৃত্য’, ‘বিদ্যাধরী নৃত্য’, ‘গোর্খনৃত্য’, ‘রামায়ণ নৃত্য’, শিবনৃত্য’ প্রভৃতি বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী ধারার নৃত্যরূপে গ্রাহ্য। উত্তরকালে অর্থাৎ চৈতন্য, চৈতন্য পরবর্তীকালে বাংলার নৃত্য ক্রমেই বহুধারায় বিস্তারিত রূপ লাভ করেছিল।

আদি ও মধ্যযুগে বাঙালির নৃত্যকলা বহু ক্ষেত্রে মৌলিক, লোকনাট্য আশ্রিত। প্রাচীন
গৌড়বঙ্গে উচ্চকোটি সমাজে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচলন ছিল, এ কথা উল্লিখিত হয়েছে আদিমধ্যযুগের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’, ‘নারদ নৃত্যের’ উল্লেখ আছে-

: পাকিল দাড়ি মাথার কেশ। বামন শরীর মাকড় বেশ
নাচ এ নারদ ভেকের গতি।
বিকৃতবদন উম্মত মতি
ক্ষণে ক্ষণে হাসে বিনা কারণে।
ক্ষণে হএ খোঁড় ক্ষেণেকে কানে
নানা পরকার করে অঙ্গভঙ্গ।
তাক দেখি সক লোকের রঙ্গ॥

এ নাট্যের শুরুতে কৌতুক রসাশ্রিত নৃত্যের অবতারণা যে ছিল তা বোঝা যায়। অন্যদিকে সমগ্ৰ ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন’ নাটগীতরূপে অভিনীত হওয়ার ফলে ধারণা করা যায়, এর বহুস্থলে নৃত্যের অবতারণা হতো। যেহেতু এ নাট্যের পদমধ্যে ধ্রুবপদ বা ধুয়া ছিল, ধরে নেওয়া যায় সেই পদগুলো দোহারদের দ্বারা গীত হতো।নাট্যগীতের প্রসঙ্গ আছে কৃত্তিবাসে। নাট্যগীত নাটগীতেরই নামান্তর। কৃত্তিবাসে আছে,

: নাট্যগীত দেখি শুনি অতি কুতুহল ।
কেহ বেদ পড়ে কেহ পড়ায়ে মঙ্গল৷৷
নানা শুভ নাট্যগীত হিমালয় ঘরে।

পরম আনন্দে লোকে আপনা পাশরে। মালাধর বসুর (চতুর্দশ শতক) ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ পাঁচালির আঙ্গিকে রচিত এবং এতে
সেকালে রাজদরবারে পরিবেশিত নৃত্যনাট্যের বিষয় ও প্রসঙ্গ বিস্তারিতরূপে উল্লিখিত হতে ‘দেখা যায়। এ শাস্ত্রীয় নৃত্য এবং রাজদরবারে অভিনীত হওয়ার কারণে একে ‘দরবারী নৃত্য’ বলা যায়।

: হেথা সব নটগণে
দৈত্যরাজ বিদ্যমানে
আরম্ভিলা নানা নৃত্যকলা।

এতে ‘রামায়ণ নাটের’ নানা কাহিনী নৃত্যনাট্যরূপে পরিবেশনের বিবরণ আছে। এ নৃত্যে আঙ্গিক, সাত্ত্বিক, বাচিক, আহার্য অভিনয়ের প্রমাণ লভ্য-

: আর সে নর্তক যত
তারা হইল নানা মত
বেশ ধরি বিবিধ বিধানে।
বহুবিধ রূপ ধরে
অভিনব কলেবরে
কশ্যপ মুনির বরদানে

এ নৃত্যে ভদ্রনট নামে এক নৃত্যকলা বিশারদের নামও পাওয়া যাচ্ছে। রাজ-আজ্ঞাতেই এ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

: হেন রামায়ণ-নাট নাচিল নৰ্ত্তকে।

মোহিত কৈইল নটে সকল দৈত্যকে।

এক নাট নাচিয়া নর্তৃক নাচে আর।

‘আজ-ইন্দুমতী-কথা’ ‘গঙ্গা-অবতার’

দ্বিজমাধবের ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গলে’ ‘তাণ্ডব’ নৃত্যের উল্লেখ আছে-

রুষিল বনমালী পলায় নাগ কালি

গরুড় সম হরি ধাড়ি (!)

কৌতুক ফণিমুণ্ডে চড়ি

রঙ্গে শ্রীরঙ্গ রুচির অঙ্গভঙ্গ

সকল কলা আদিগুরু

কালিয়া বিষধর শিরসি নটবর

পরম তাণ্ডব কারু।

‘তাণ্ডব নৃত্য’ বাঙালির নৃত্যরুচিতে কীভাবে এল তা গবেষণাযোগ্য। তবে পাঁচালি নাট্যে, শাস্ত্রপ্রোক্ত ‘তাণ্ডব নৃত্যে’র উল্লেখ থাকলেও তা যে পরিবেশনের ধারায় গৃহীত হয়নি সে ব্যাপারে নিশ্চিত।

কৌতুক নৃত্যের অন্য একটি ধারা “বড়ায়ি নাচে’ বিদ্যমান ছিল দুখী শ্যামদাসের ‘গোবিন্দমঙ্গলে’ তার প্রমাণ আছে, যেমন-
: অষ্ট অঙ্গে বাঁকা বুড়ী পড়ে পীতাম্বর।
নড়ি ধরি দণ্ডাইল কানুন গোচর

দুখী শ্যামদাসের কাল ষোড়শ শতক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধারায় কৃষ্ণবিষয়ক নৃত্যনাট্যে ‘নৌকাখণ্ড’ পূর্ণাঙ্গরূপেই ‘লীলানৃত্যে’র ধারায় পরিবেশিত হতো।

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রচিত ‘মাধবসঙ্গীত’ উপাখ্যানে শাস্ত্রীয় নাট্য ও নৃত্যের উল্লেখ আছে। তত দিনে বাঙালি সমাজে ‘নাট্যকলা’ শব্দটি সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে গৃহীত হতে দেখা যায়-

: মঞ্জুলা বিন্দুলা সাম্রা মৃদুলাদিবালা।

রাধিকার অর্থে শিক্ষা করে নাট্যকলা

এই নাট্যকলা নৃত্যেরই নামান্তর। চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বিচিত্র ধরনের নৃত্যের জন্ম হয়েছিল। বৈষ্ণব সমাজের মধ্যেই
তা হয়তো সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিককালে বাঙালির নিজস্ব নৃত্য রচনার কাজে সেই কালের নৃত্যপন্থাগুলো আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নানা ভাঁজে গৃহীত হতে পারে।

চৈতন্যদেব প্রবর্তিত নৃত্যসমূহের মধ্যে রয়েছে-রুক্মিনী হরণ নাট্য, স্বানুভব নৃত্য ইত্যাদি। ‘উদ্বগু নৃত্য’ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত নাম সংকীর্তনের নৃত্য। উদ্বৃত্ত একই অর্থে উদ্বাহু নৃত্য’ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। এতে দুই হাত ঊর্ধ্বমুখী, দৃষ্টি ঊর্ধ্বমুখী, দু পা পরস্পর কৌণিকভাবে তালে ছন্দিত আবর্তিত হয়। হাত পতাক মুদ্রারূপে কখনো উত্থিত কখনোবা আনমিত।

সেকালে অর্থাৎ পঞ্চাশের শতাব্দীতে ‘ডঙ্কনৃত্যে’র প্রচলন ছিল। ‘ডঙ্কনৃত্য’ হচ্ছে সর্পভয় নিবারণমূলক নৃত্য। এতে নাগরাজের পোশাকে নৃত্যকর কৃষ্ণলীলার মাহাত্ম প্রচার করতেন। চৈতন্য ভাগবতে আছে-

: মনুষ্য শরীরে নাগরাজ মন্ত্র বলে

অধিষ্ঠান হইয়া নাচেন কুতুহলে।
‘ডঙ্কনৃত্য’ মূলে কালীয়দমন নাট।

বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যভাগবতে’ সেকালে প্রচলিত ‘শিবনৃত্যের’ও বিবরণ দিয়েছেন। এ নৃত্যে নৃত্যক গৃহপ্রাঙ্গণে বৃত্তাকারে নৃত্য পরিবেশন করত ।

: আইল করিতে ভিক্ষা প্রভুর মন্দিরে।
গাইয়া শিবের গীত বেড়ি নৃত্য করে।

“স্বানুভব নৃত্যে’ চৈতন্যদেব কৃষ্ণের নানা অবতারের চরিত্রে আবেশমগ্ন নৃত্য পরিবেশন করতেন। তবে সে নৃত্যের আঙ্গিক, বাচিক বা আহার্য অভিনয়ের রূপ কেমন ছিল তা আজ আর জানার উপায় নেই। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবতে’ ‘যমনৃত্যের’ বিস্তারিত বিবরণ আছে।

এতে আঙ্গিক,বাচিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক এই চতুর্বিধ নৃত্য বা নাট্যস্বত্ব রক্ষিত হতে দেখা যায়। ‘যমনৃত্যে’ চরিত্রসমূহ পৌরাণিক, যেমন-চিত্রগুপ্ত, শঙ্কর বা শিব, কার্তিক, গণেশ, কষ্যপ, নারদ, ব্রহ্মা প্রমুখ। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন-

উঠিলেন যমদেব কীৰ্ত্তন শুনিয়া

চৈতন্য পাইয়া নাচে মহামত্ত হইয়া
‘রুক্মিনী নৃত্যের’ প্রসঙ্গ আছে ‘চৈতন্য ভাগবতে’।

রুক্মিনী, পুরাণ মতে লক্ষ্মীরই পার্থিব রূপ।
: মধ্যখণ্ড কথা ভাই শুন একমনে।
লক্ষ্মী কাছে প্রভু নৃত্য করিলা যেমনে

একদিন প্রভু বলিলেন সভাস্থানে ।
আজি নৃত্য কারিবাও অঙ্কের বন্ধনেঃ
চৈতন্যদেব নৃত্যপারঙ্গম ছিলেন।

বৃন্দাবন দাস চৈতন্যদেবের নৃত্য প্রসঙ্গে বলেন,
: জগত জননী-ভাবে নাচে বিশ্বম্ভর।
সময় উচিত গীত গায় অনুচর।
এ থেকে দেখা যায় এ শ্রেণীর লীলানাট্যে দোহারের সংযোগ ছিল।

জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল ষোড়শ শতকের মধ্য ভাগে রচিত। জয়ানন্দ কীর্তন কেন্দ্রিক নৃত্যকে বলেছেন ‘সংকীর্তন নাচ’। তাতে চৈতন্যদেবের অঙ্গাভরণের বিবরণও পাওয়া যায়-

: একদিন গৌরচন্দ্র সংকীৰ্ত্তন নাচে। নটবর বেশে অকিঞ্চন প্রেম জাচের
খেনে শিখি পুচ্ছ চূড়া গলে গুঞ্জা দাম ।
খেনে গৌরচন্দ্র খেনে মেঘারম্ভ শ্যাম… ইত্যাদি।
লোচনদাশে (১৫৭৬ খ্রিঃ) চৈতন্যদেবের ‘রুক্মিনী নৃত্য’ যা প্রকারান্তরে ‘গোপীকা নৃত্য’,
তার অনুপুঙ্খ বিবরণ লভ্য-
: এখন কহিয়ে শুন
সাবধানে সৰ্ব্বজন,
গোপীকা আবেশ বশ প্রভু
হৃদয়ে কাঁচালির পরে
শঙ্খ কঙ্কণ করে
দুটি আঁখি রসে ডুবু ডুবু
পট্টবসন পরে
নূপুর চরণ তলে
মুঠে পাই ক্ষীণ মাজাখানি

চৈতন্যদেবের কালে ‘জলনাট্য’ বা নৃত্যের প্রচলন ছিল। এর অন্য নাম ‘কয়া’। সেকালে
নদীতে কিংবা সুবৃহৎ কোনো পুকুরে নানা ধরনের নৃত্য ও নাট্যমূলক কাহিনীর অবতারণা হতো। সচরাচর বাদক দল নদীর পারে বা হাঁটু জলে নেমে বাদ্য পরিবেশন করত এবং কলাকুশলীরা বিভিন্ন পোশাকে পানিতে নেমে ভেসে-ডুবে নানাভাবে নাট্যাভিনয় প্রদর্শন করত।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ বিষয়ে ১২৮৯ বঙ্গাব্দে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন যে- ঃ এই সময়ে একজন বৈষ্ণব এক নতুন পদ্ধতি অবলম্বনপূর্বক এক পুষ্করিণীর ওপর কৃষ্ণযাত্রা অভিনয় করেন। পুষ্করিণীটি বড় সুন্দর সাজানো হয়েছিল। তার নাম কালীয় হ্রদ দেওয়া হয়েছিল, মধ্যস্থলে এক অজগর কালীয় সর্প, জল হইতে ফণা বিস্তার করিয়াছে, সেই ফণার ওপর শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়াইয়া বেণু বাজাইতেছেন, আর মধ্যে মধ্যে নয়ন ঢোলাইয়া নৃত্য করিতেছেন।

নৃত্য পীড়নে কালীয়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে। চারপাশে তার স্ত্রীগণ জল হইতে অর্ধাঙ্গ তুলিয়া জোর করে কৃষ্ণকে মিনতি করিতেছে- কখনো তাহা কথায় কখনো বা গীতে। নিকটে এক মাচার ওপর মৃদঙ্গ, করতাল, খরতাল বাজিতেছে, তথায় বসিয়া ‘যাত্রাওয়ালা দোয়ার্কি করিতেছে। (সূত্র- বঙ্গদর্শন) চৈতন্য চরিতামৃতে লগুড় নৃত্যের বিবরণ আছে।

লগুড় নৃত্য অন্য কিছু নয়, নৃত্যের তালে লাঠি খেলা। লগুড় খেলা হয়েছিল চৈতন্যদেব ও তার শিষ্য অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে। লগুড় নৃত্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, তবে এ স্থলে এর স্থান উড়িষ্যার পুরীতে, কৃষ্ণজন্মযাত্রার কালে।

পুরুষদের যূথ নৃত্যের প্রবর্তকও শ্রীচৈতন্যদেব। ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’ আছে চৈতন্যদেব চতুমাসা শেষে গোপবেশ ধারণ করলেন। সঙ্গে তার ভক্তবৃন্দ। শুরু হলো অনুকৃষ্ণনাট্য। চৈতন্যদেবের কাঁধে দধি দুগ্ধের ভাঁড়, তার শিষ্য কানাই নন্দবেশ ধারণ করেছে, জগন্নাথ মাহিতী সেজেছে রাধা, মিশ্রকাশী সেজেছেন উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র এবং এদের সবাইকে নিয়ে চৈতন্যদেব নৃত্যে মেতে উঠলেন। আর ছিটালেন দধি, দুগ্ধ ও হরিদ্রার জল-

: ঞিহা সব লইয়া পভু করে নৃত্যরঙ্গ।

দধি দুগ্ধ হরিদ্রাজলের বরে সবার অঙ্গ।

চৈতন্যচরিতামৃতে হনুমান নৃত্যের পরিচয় আছে। ধারণা করা যায়, বিজয়াদশমীর দিনে লঙ্কার পতন ঘটেছিল রামের হাতে। তবে বিস্মৃত হলে চলে না যে, বাংলা নৃত্য নাট্যেরই নামান্তর। একে মধ্যযুগের ভাষায় ‘নাট’ বা ‘নাট্য’ বললেও তা নৃত্যনাট্যও বটে রয়েছে। এ নাট্যে রচয়িতা স্বয়ং রামনন্দ রায় উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র নারায়ণের মন্ত্রী চৈতন্যচরিতামৃতে রামানন্দ রায় কর্তৃক রচিত ‘জগন্নাথবল্লভ নাটকম’ পরিবেশনের প্রসঙ্গ ছিলেন।

চৈতন্যচরিতামৃতের অন্ত্যলীলার পঞ্চম পরিচ্ছেদে (সূত্র-সুকুমার সেন) উড়িষ্যায় প্রচলিত শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিবরণ আছে। ‘জগন্নাথবল্লভ নাটক’কে ‘ক্ষুদ্রায়তন সঙ্গীত নাটক’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। (সূত্র এস কে দে)। নৃত্যের মাধ্যমে এ নাট্যের অভিনয় নিষ্পন্ন হয়েছিল। কারণ, এর মহড়ার বিবরণে আছে যে, রামনন্দ রায় দুই দেবতুল্য কিশোরীকে নিজ নাটকের গানের সুরে নৃত্যশিক্ষাদান করেছিলেন—

: দুই কন্যা হয় পরম সুন্দরী।

নৃত্যগীতে নিপুণতা বয়সে কিশোরী।

তাহা দোঁহা লঞা কয় নিভৃতে উদ্যানে।

নিজ নাটক-গীতের গান শিখায় নর্তনে

এই নৃত্যে সঞ্চারী, সাত্ত্বিক ও স্থায়ীভাবের লক্ষণ যথা, শিরভেদ, দৃষ্টিভেদ, অঙ্গ-করণ ও নৃত্যে পরিস্ফুটনের শিক্ষা দান করা হয়েছিল। এই নৃত্যরীতি উড়িষ্যার, এর সঙ্গে বাংলার নিজস্ব নৃত্যের বিশেষ কোনো মিল ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু একটা বিষয়ে বাংলার নৃত্যধারার সঙ্গে এর সাযুজ্য ছিল বলে মনে করা যায়, তা হলো সুনির্দিষ্ট কাহিনীকে অবলম্বন করেই নৃত্যের উপস্থাপনা।

উপরন্তু ‘জগন্নাথবল্লভ নাটকম’-এর আঙ্গিক বাংলা মঙ্গলগীতি বা পাঁচালির। কারণ, এও ‘মঙ্গলউজ্জ্বলমগীতি’ গীতগোবিন্দের গীতি ভাষারীতি, কাব্যকৌশল প্রসূত।রূপগোস্বামীর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রশাসিত নন্দনতত্ত্বের প্রচল ভাঙা এক রসতাত্ত্বিক গ্রন্থ। ষোড়শ শতক পর্যন্ত বাঙালির নিজস্ব শিল্পরস বিচারের কোনো শাস্ত্র গ্রন্থ ছিল না। রূপগোস্বামী গৌড়ীয় রসবিচারের ধারায় উজ্জ্বলনীলমণি রচনাপূর্বক সে অভাব বিদূরিত করেন।

এ গ্রন্থে প্রায় ৩৩৬টি রস প্রসঙ্গ বিবৃত হতে দেখা যায়। তাতে নায়ক, নায়িকা ভেদ, ভাব- অনুভাবের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দার্শনিক ব্যাখ্যা ধ্রুপদী সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বের বিরুদ্ধে এক অভিনব শিল্পকর্ম রচনা করেছিল।রূপগোস্বামী ‘বিদগ্ধমাধব’ ও ‘ললিত মাধব’ নামে দুটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্র সম্মত নাট্যও রচনা করেছিলেন। বৃন্দাবনে এ নাট্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন আসামের কবি-নাট্যকার শঙ্করদেব।

উজ্জ্বল নীলমণি পদাবলি সাহিত্যের রসনিষ্পত্তি নির্দেশিকা। আবার সেই তত্ত্ব রূপগোস্বামীর নাট্যেও প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। সুতরাং তা একালের দৃষ্টিতে বাঙালির নৃত্যশাস্ত্ররূপেও গ্রাহ্য হতে পারে। এতে অঙ্গিকাভিনয়ের ক্ষীণ পরিচয় যেমন- অঙ্গসম্বরণ, ক্রকম্পন ইত্যাদি ব্যতিরেখে মুদ্রা বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনো বিবরণ নেই।

এতদসত্ত্বেও আধুনিককালের নৃত্যধারায় উজ্জ্বলনীলমণির রসশাস্ত্রবিষয়ক তত্ত্ব অবলম্বন করে নতুনতর নৃত্যের উদ্ভাবন ঘটতে পারে। ময়ূরভট্টের ‘ধর্মমঙ্গলে’ বিদ্যাধরী নৃত্যের বিবরণ আছে। এই নৃত্যে নৃত্যকীর নৃত্যে নানাবিধ বাদ্যের প্রয়োগ, উর্বশীতুল্য সাজসজ্জা, সুদীর্ঘ বেণি, চন্দনের বিন্দু ও সুরঞ্জিত তীক্ষ্ণ নখের প্রসঙ্গ লভ্য।

: চিকুর চামুরি ঝুরি সামারি চারু বেণী অঙ্গভাগ নগভগখগ আহারিনি
নৃত্যকীর শীর্ষে মেঘবাহন ভূষণপ্রসঙ্গও উল্লিখিত হতে দেখা যায় ।
অন্যত্র মানিক রামের ধর্মমঙ্গল (ষোড়শ শতক) নটিনী নৃত্যের উল্লেখ লভ্য। সে নৃত্যে নর্তকীর নাকে মুক্তা গ্রন্থিত ‘বেশর’ ছিল।
মানিকরামের ধর্মমঙ্গলে নাট্যশালার উল্লেখ আছে। নাট্যশালা নাট্য বা নৃত্যশালারই নামান্তর।
: নাট্যশালা তুল্যা দিল বার দিবার ঘর।
সুবর্ণ পতাকা উড়ে চালের উপর।

মানিকরামের ধর্মমঙ্গলে (১৭১১-১২ খ্রিঃ) দলীয় নৃত্যের প্রসঙ্গ আছে। অপ্সরা, ‘অশেষ- বিশেষ’ বেশধারণপূর্বক নৃত্যসভায় চলল। তার সঙ্গে সহচরী ছয়জন। তাহলে একুনে নৃত্যকীরসংখ্যা দাঁড়াল সাত ।
এই পাঁচালি নাট্যে ‘বেত্র নৃত্যের’ প্রসঙ্গ আছে-

: গাজনে আমার
তনয় তোমার
ভকত সকল সাথে।

ডাকে ধৰ্ম্ম জয় পদ্যবাদ্যময়
নাচে লুই বেত্র হাতে
সেকালে নদীয়াতে নাটক, নাটিকা এবং কাব্যকলা বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল-
: অধ্যাপক পণ্ডিত সকল মোর বশ।
নাটক নাটিকা দেখ কাব্যকলা রস৷৷

পাঁচালির পরিবেশনায় নাচাড়ির সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ ছিল, এ কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। উপাখ্যান পরিবেশনায় পাঁচালির আঙ্গিকে সচরাচর পরিবেশনার নিম্নলিখিত নির্দেশগুলো অনুসৃত হতো। যেমন- ১. দিশা। ২. কথা। ৩. বোলাম। ৪. নাচাড়ি। ৫. পদ। ৬. শিকলি ।

এই ক্রম গায়েন বা পরিবেশনকারী কিংবা রচয়িতা ধারাবাহিকভাবে নয়, বরং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিনয় রসের প্রয়োজনে পরপর দুটি পদেও নাচাড়ির প্রয়োগ হতো। যেমন জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে কোনো কোনো পদে নাচাড়ির নির্দেশ উল্লিখিত হওয়ার পরবর্তী পদে তত নাচাড়ি নির্দেশিত হতে দেখা যায় ।

নৃত্য নয় বরং বাঙালি নৃত্যকে নাচ, নাট, ক্ষেত্রবিশেষে নাট্য এবং নাচাড়ি এই মোট চারটি নামে অভিধান্বিত করেছে। পরবর্তীকালে নাচাড়ি নেপালি নাট্যে নাচাড়ি নামে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নাচাড়ির সুনির্দিষ্ট স্থান সম্পর্কে বিজয়গুপ্ত বলেছেন, ছিকলির ছন্দে পয়ার মধ্য লাচাড়ি অর্থাৎ শিকলির ছন্দ মধ্যে পয়ারের বা পদের মাঝেমধ্যে লাচারির প্রয়োগ করতে হবে। লাচাড়ি নাচাড়িরই আঞ্চলিক উচ্চারণ।

প্রকৃতপক্ষে মনসামঙ্গলে বেহুলার স্বর্গসভায় নৃত্য প্রসঙ্গে বিচিত্র নৃত্যকৌশল, বেশভূষা, অঙ্গসজ্জা, বাদ্যভাণ্ড, আঙ্গিক, বাচিক ও সাত্ত্বিক অভিনয়ের সুবিস্তৃত বিবরণ লভ্য। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে আছে স্বর্গসভায় শিবের সম্মুখে বেহুলা গীত সহযোগে হাতে বাদ্য বাজিয়ে নৃত্য পরিবেশন করছে।

: বুঝিয়া শিবের মন বেউলার কৌতুক ।

আরম্ভিল নৃত্যগীত শিবের সম্মুখ

কোকিলের রব যেন বলে মধুর স্বরে।

মধুর স্বরে গায় গীত পায়ে নাটপুরে॥

হাতে বাদ্য বাজায়ে বেউলা মুখে গায় গীত ।

নানাবিধ বিধি গাহে গীত শুনি সুললিত॥

তবে মধ্যযুগের বাংলা নৃত্যের সবচেয়ে বিস্তারিত পরিচয় নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গলে (পঞ্চদশ শতক) প্রত্যক্ষ করা যায়। দেবসভায় বেহুলার নৃত্যের আয়োজন থেকে সেকালের অভিজাত সম্প্রদায়ের সম্মুখে পরিবেশিত নৃত্যের আঙ্গিক ও বিষয় কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না । বেহুলা এখানে স্বর্গের অপ্সরি ঊষারূপে আত্মপ্রকাশ করেছে-

: নৃত্যের শুরুতে দেবসভা সুসজ্জিত হলো। বিদ্যাধরীরা নৃত্যে প্রবেশ করল। যে যে যন্ত্র বাজাবে, সে সেই যন্ত্র নিয়ে গীতবাদ্য শুরু করল। বিধ্যাধরী, অপ্সরা এবং গান্ধর্বগণ গীত শুরু করল। চিত্রসেনের হাতে মৃদঙ্গ। অতঃপর অনুক্রমে নানাবেশ পরিধানপূর্বক উর্বশী মেনকা ও রম্ভার প্রবেশ। তাদের পেছনে নৃত্যপরা জয়া ও বিজয়া। এ সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্রা, শচী ও বিদ্যাধরী।

এই যৌথ মাঙ্গলিক নৃত্যের পরে সুরপতি অর্থাৎ ইন্দ্র ঊষাকে নৃত্য শুরু করার নির্দেশ দিলেন। বিদ্যাধরের ঢাক এবং মৃদঙ্গ ধ্বনি উত্থিত হলে সুন্দরী ঊষার নৃত্য শুরু হলো। সে নৃত্যের অনুপুঙ্খ বিবরণও দিয়েছেন নারায়ণদেব-

: হরষিত কর যোড়ে
প্রনমিল মহেশ্বরে,
দেবগণ দেখি সানন্দিত
আড় নয়নেতে চায় প্রাণ হরি লয়ে যায়,
মোহিল মদন কাম বাণে ।

শুদ্ধ মতে নৃত্য করে দেবসভার ভিতরে,
প্রাণহরে কটাক্ষ চাহনো
সম্মুখ বিমুখ করি
নাচে বিপুলা সুন্দরী,

ভঙ্গিমা করিয়া নটবেশে
দেখিয়া নয়নটান,
মোহে যায় দেবগণ,

সবাকে মোহিত করে লাসে
কাঁচা শরায় দিয়াপা, নাচে চমকিয়া গা,
পাক ফিরে ভ্রমর আকার

স্বর্গসভায় পরিবেশিত বেহুলা নৃত্যের একটি পর্ব ছিল ‘কাঁচা সরা নৃত্য’। এর অর্থ নৃত্যস্থলে কাঁচা সরা বিন্যাসপূর্বক নৃত্যকী তার ওপরে উঠে সরা থেকে সরায় প্রদক্ষিণপূর্বক হাবভাব প্রদর্শন করতেন। কাঁচা সরা অত্যন্ত ভঙ্গুর মৃৎপাত্রের ঢাকনি, পোড়াবার পূর্বে রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া হয়।

এই শুকনো অবস্থাতেই তা নৃত্যে ব্যবহৃত হতো। শরীরের ওজন, নৃত্য পারঙ্গমতা, সরাটি পায়ের চাপে না ভাঙ্গা ইত্যাদি বিষয়ে সূক্ষ্মতার পরিচয় দিতে হতো নর্তকীকে। সরা স্থাপনের রীতি কাঁচা সরা নৃত্যের আঙ্গিক নির্ধারণ করত। এই সরা সম্ভবত বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত কিংবা সর্পিলাকারে বিন্যাসিত হতো বলে ধারণা করা যায়। এই শ্রেণীর নৃত্য নিঃসন্দেহে বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবনা।

জগজ্জীবন ঘোষাল (১৭০০ সাল)-এর মনসামঙ্গলে বেহুলার নৃত্যের অঙ্গাভরণ বিষয়ে যে বিস্তারিত উল্লেখ তা সমগ্র মধ্যযুগের অন্য কোনো কাব্যে দৃষ্ট হয় না। বেহুলার নৃত্যের রূপসজ্জার উপকরণ ও দ্রব্যসামগ্রী নিম্নরূপ-

ঃ চাকিকোড়ি, মকরকুণ্ডল (কর্ণাভরণ), বেসরফুল (নাসিকা), কাঁচুলী (বুকে), প্রবালমালা (কণ্ঠদেশে), কনককঙ্কণ হার (হাতে), কেজুর (বাহুতে), আঙ্গুরী (আঙ্গুলে), নূপুর পায়ে), গুজরাটি ঘুঙুর (পায়ে), মেঘডম্বুর শাড়ি (বস্ত্রসজ্জা), কুসুম উড়ানি (মসলিনের আবরণ)। এও উচ্চকোটির নৃত্য। ‘গুজরাটি ঘঙ্গুর’ কথাটা থেকে বোঝা যায় বাংলায় এক সময়
গুজরাটি নৃত্যের ধারা প্রচলিত হয়েছিল।

মধ্যযুগের বাংলায়, দাক্ষিণাত্য, রাজস্থানী নৃত্য, গুজরাটি নৃত্য প্রচলিত ছিল বলে অনুমান করা যায়। দাক্ষিণাত্য নৃত্যের প্রসঙ্গ আছে মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে, গোর্খনৃত্যে আছে রাজস্থানী রূপসজ্জার বিবরণ ।
মুকন্দ রামের চণ্ডীমণ্ডলে বিবৃত নৃত্যও শাস্ত্রীয় নৃত্যরূপে গ্রাহ্য। এতে মৃদঙ্গের তাল বোল সবই আছে-

তাতিনি তাতিনি তিনি

মৃদঙ্গ মন্দিরা

ঘন বাজে কঙ্কণ তরল

গণেশ পাখুজ পাণি
নন্দি ভৃগু ধরে করতাল
এই নৃত্যে কাঠের মুখোশ ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায় ।

মুকুন্দরামের মতে, এ নৃত্য ইন্দ্রের অনুচর মালাধর কর্তৃক পরিবেশিত। এতে নৃত্যে কাঠের মুখোশ ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়। এ কৃষ্ণের লীলানৃত্য। মধ্যযুগের বাংলা নৃত্যে কৃষ্ণের লীলানৃত্য নানা বিষয় অবলম্বনপূর্বক অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ লভ্য।

এর মধ্যে রাসনৃত্য (মণিপুরি সম্প্রদায় পরিবেশিত), দলনৃত্য (বাংলা অঞ্চলে পরিবেশিত), বালকৃষ্ণলীলাভিনয় ও কালীয়দমন নৃত্য। মনসা পূজার বিরোধী বৈষ্ণবদের হাতে ‘কালীয়দমন নৃত্যনাট্য’ মধ্যযুগের বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘কালীয়দমন’ যাত্রা থেকেই অষ্টাদশ শতকে বাংলা যাত্রার উদ্ভব ।

মুকন্দরামে রত্নমালার নৃত্যের বিবরণ আছে। রত্নমালা স্বর্গের অপ্সরা তাণ্ডব নৃত্য করেছিল-
: ধরি মনোহর লীলা
নাচে বামা রত্নমালা
তাণ্ডব দেখিলা দেবগণঃ

এ নৃত্যে দ্রুত পদবিক্ষেপ বা চারী সেই সঙ্গে নূপুর ঝঙ্কারের উল্লেখ আছে। রত্নমালা পরেছিল পাটশাড়ি। তার হাতে ছিল সোনার চুড়ি। এতে মাঙ্গলিক শঙ্খ ব্যবহৃত হওয়ার উল্লেখ আছে। রত্নমালা দুই হাত ধরে নৃত্যকালে শঙ্খে ফুৎকার প্রদানপূর্বক নৃত্যারম্ভ করেছিল।

‘অন্নদামঙ্গলে’ ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পর্ব দরবারে পরিবেশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই উপাখ্যান নাটোর পরিবেশনায় নৃত্যের বোল থেকে প্রমাণিত হয় যে, গায়েন অথবা বিদ্যাসুন্দররূপী চরিত্র বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশন করত। একটি পদ দৃষ্টে বলা যায়, এতে নৃত্যের তাল হুবহু। এমনকি ভারতচন্দ্রের কুশলী বর্ণনায় মৃদঙ্গের তালধ্বনি ব্যতিরেকে অর্থজ্ঞাপক শব্দেও ধৃত হয়েছে।

: নব নাগরী

নাগর মোহনীয়া।

রতি কাম নটী

নট মোহনীয়া।…

রস সিদ্ধ তরে

ভবতারনীয়া ।

নূপুর রণ রণ

কিঙ্কিণী কণ কণ॥….

সখী সকল মিলিত

মধুমঙ্গল গাবত

ততকার তরঙ্গত

সঙ্গত নাচতা

ঘন বিবিধ

মধুর রব যন্ত্র বাজাবত

তাল মৃদঙ্গ

বণী বনিয়া

ধি ধক্কট ধি ধক্কট

ঝিঁ ঝিঁ তকঝিমতক

ঝিমি ঝমক ঝমক ঝেই

তত তঞ্চত তা ভা

থু থু থেই থেই৷

ভারত মানস

মাননীয়া

তবে উত্তরকালে যাত্রারূপে বিদ্যাসুন্দর গৃহীত হওয়ার পরে বিশেষত অষ্টাদশ শতকের শেষে এ উপাখ্যান অধিকতর নাট্যমূলক, ক্রমে চরিত্রাভিনয়ে পরিণত হয়।শিবনৃত্যের একটি শাখা কৃষ্ণলীলা নৃত্যনাট্যরূপে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে চালু হয়েছিল। গালবাদ্য অর্থাৎ মুখে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সৃজনপূর্বক তা নৃত্যে প্রযুক্ত হতো।

রামেশ্বরের ‘শিবায়ণে’ আছে-
: সুরসাল বাজে গাল নাচে ভালবিধু। শিঙ্গা গায় দ্রুত আয় আয় কোঁচ বধূ এ পদ স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। লৌকিক ছন্দে লৌকিক তাল প্রযুক্ত হওয়ারই কথা। এ শ্রেণীর শিবনৃত্যে গৌরীনৃত্যে, ছড়াকেন্দ্রিক নৃত্য প্রভৃতির প্রচলন ছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে তা সুনির্দিষ্ট কাহিনীভিত্তিক নাট্যপর্বেরই অংশ, স্বতন্ত্ররূপে নৃত্য নয়।

দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ (ষোড়শ শতক) ও সাবিরিদ খাঁ (ষোড়শ শতক) রচিত বিদ্যাসুন্দর নাটকগীতরূপে উপস্থাপিত হতো। দ্বিজ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দরে’ ‘মালিনী নৃত্যের’ উল্লেখ পাওয়া যায়।

বিদ্যাসুন্দরকে কেন্দ্র করে বাংলা থেকে নেপালেও ‘বিদ্যা’ ‘সুন্দর’ ও মালিনীবিষয়ক কাহিনীনির্ভর নৃত্যের প্রচলন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে নেপালে সপ্তম-অষ্টাদশ শতকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচলন ছিল। নেপালে রচিত বিদ্যাসুন্দর নামে বিদ্যাবিলাপ নামাঙ্কিত। “মুদিতকুবলায়াশ্ব’ নাটকে নচাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।

নচাড়ি বাংলা নাচাড়িরই নেপালি রূপান্তর। নাচাড়ি বা নচাড়ি বা লাচাড়ি হলো পদভিত্তিক নৃত্য। তা নৃত্যের কোনো একটি স্বতন্ত্র ধারা নয়। হাবভাব সহযোগে নৃত্যের ছন্দে পদস্থিতবিষয়কে উপস্থাপনের নির্দেশ হলো নাচাড়ি । শাহ মুহাম্মদ সগীরের (চতুর্দশ শতক) ‘ইউসুফ-জোলেখা’ রাগরাগিণীভিত্তিক পাঁচালি।

এতেও বিদ্যাধরী নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়—
: বিদ্যাধরী কুমারী নাচ এ নানা ছন্দে।

সুর সিন্ধু শৃঙ্গার মদন রস বন্দো ষোড়শ শতকের লাইলি-মজনু উপাখ্যানে বাঙালির নানা নৃত্য প্রসঙ্গ উল্লিখিত হতে দেখা যায়। এতে রমণীদের কৌতুক নৃত্যের বিবরণ আছে।

: অবলা সুন্দরীগণ সুবেশ উত্তম।
কৌতুক করএ নাট অতি মনোরম
মুহাম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’ প্রেমকাব্য। এতে নারী ধামালীর উল্লেখ আছে- : কেহ হাসি করে অঙ্গে পড়ে টলি টলি ।
ধরাধরি ঠেলাঠেলি খেল এ ধামালী ॥

ধামালী বাঙালিদের অতি প্রাচীন নৃত্যধারার একটি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও ধামালী শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরকালে ময়মনসিংহ, সিলেট হয়ে তা আসামেও বিস্তৃত হয়। ধামালী দুই প্রকার-
১। কৃত্যধামালী। ২। রঙ্গধামালী।

ধামালী সপ্তদশ শতকে গোপিনী নৃত্য নামে আখ্যায়িত হয়। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’তে দাক্ষিণাত্য নৃত্যের উল্লেখ আছে। দাক্ষিণাত্য ভরত ‘নাট্যশাস্ত্র’ প্রোক্ত নৃত্য-

: চারিশব্দ মেলি বায়
গায়ন্ত সুস্বর রায়,
পায় দাক্ষিণাত্য নাচে
তালে নাচে বেশ্যা নটীগণ ।
নানা ছন্দে কাছে কাছে,
হস্তে নৃত্য সাধু সম্মিলন।

‘হস্তে নৃত্য’ কথাটার সঙ্গত অর্থ ‘হস্ত মুদ্রা’, তা নিঃসন্দেহে শাস্ত্রীয়।সোনাগাজীর সয়ফুলমুলুকে (১৮০০ শতক) রঙ্গধামালীর উল্লেখ আছে। আবার এই সঙ্গে জলখেলা নৃত্য প্রসঙ্গ আছে। একে জলুয়া খেলা নৃত্যও বলা চলে।
: গাহ এ রসের গীত যথ সোহাগিনী রঙ্গের ধামালী সহেলা নাচনিঃ

বিদ্যাধরী নৃত্যের অন্য নাম ছিল তাফানৃত্য। এ নৃত্য আদ্যন্ত শৃঙ্গার রসাত্মক
: সাজ করে সুকুমার
নৃত্য করে নাটুয়া সোন্দর।
স্থানে স্থানে তাফাগণে
নাচে এ আনন্দ মনে
নানান কৌতুক মুনহরা

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ‘তাফা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অপ্সরা। মাধ্যযুগে নৃত্যশিল্পীদের নৃত্যক, নৃত্যকী, নট, নটী, তাফা, বিদ্যাধরী, নৃত্যকারী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হতো।বাঙালির নিজস্ব ধারার নৃত্যের বিস্তারিত বিবরণ এই ক্ষুদ্রায়তন প্রবন্ধে বৃত্তি সম্ভব নয়। বিচিত্র নৃত্যরীতির প্রধান প্রসঙ্গসমূহ কেবল এতে উদ্ধৃত হলো।

কথকতা, পাঁচালি, জীবনীমূলক আখ্যান, পদাবলি কীর্তন প্রভৃতি ধারায় এসব নৃত্যের সন্ধান লাভ করা যায়। কিন্তু বাংলা নাট্য ইতিহাসের মতো নৃত্যেরও কোনো শাস্ত্রগ্রন্থ না থাকায় এসব নৃত্যের মুদ্রা, চারী, করণ, অঙ্গহার, দৃষ্টিভেদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য যথার্থই দুষ্প্রাপ্য।

উপরন্তু এর ধারাবাহিকতা উপনিবেশকালেই খণ্ডিত হয়ে যায়। বাঙালির নৃত্যের সুবিশাল আয়োজন অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে ‘বাঈজি’ নৃত্যের পঙ্কে লুপ্ত হয়। কিন্তু এখনো এ কথা বলা যায় যে, লোকনাট্যের ধারায় বাঙালির লৌকিক জ্যারীতি আজও অস্তিমান। ঘাঁটু, নেটো বা লিটো, গাজীর গান, মাদার পীরের জারী, কৃষ্ণলীলা-বিশেষত নৌকাখণ্ড, মহররমের জারি নৃত্য, ঘোড়া নৃত্য, মুখোশ নৃত্য, নিঃসন্দেহে আমাদের বলিষ্ঠ মৃত্য ঐহিত্যের স্মারক।

কিন্তু সেসব নৃত্যের তাল, লয়, ছন্দ, মুদ্রা নিয়ে আজও যে আমাদে নৃত্যবিশারদগণ একটুও মাথা ঘামান না, সে বড় দুর্ভাগ্যের, অনতিক্রম্য বেদনারও বটে।

গাজীর গানের নৃত্যছন্দ, মুদ্রা, দৃষ্টিভেদ, কৃষ্ণলীলা থেকে পৃথক। আবার কৃষ্ণলীলা নৃত্যের সঙ্গে মহুয়া, দেওয়ানা মদিনার চারী কিংবা হাবভাব সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যদিকে চুটকি জাহি ও বিষাদ জারি দুটোই ভিন্ন প্রকৃতির নৃত্যকৌশল। বিষাদ জারির দীপ্ত পৌঁছে নৃত্য ভাত নাট্যশাস্ত্র কথিত তাণ্ডব নৃত্যের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয় ।

কিন্তু অন্যের শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে বাঙালি চিত্তের স্ফূর্তি কখনোই সম্ভব নয় এবং তা হে সম্ভব হয়নি তার প্রমাণ সমকালেই আছে। উল্লেখ্য, এ নিবন্ধে বারবারই এ কথা প্রমাণের চে হয়েছে যে, কাহিনীনির্ভর আখ্যানকে কেন্দ্র করেই বাঙালির নৃত্য আয়োজন। ইঙ্গিত মুদ্রার সংকেত নয়। নৃত্য বাঙালি জীবনে কাহিনী নিরপেক্ষ কোনো স্বতন্ত্র শিল্পরূপেও সমাদৃত হতে দেখা যায় না। ‘ডঙ্ক’ বা ‘লীলা’ শ্রেণীর নৃত্যে দেখা যায় সম্পূর্ণ হলেও তা আখ্যানমূলক।

বংলা নৃত্যের ধারা আবিষ্কারে সমকালকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরূপে বিে কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগে সৃষ্ট বহু ধরনের নৃত্য লুপ্ত হলেও আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্মীয় কৃত্য মধ্যে বিচিত্র নৃত্যের খোজ আজও লতা। আমরা নাগরিক বিবেচনায় জেলোকে লোকনৃত্য বলি, প্রকৃতপক্ষে সেইসব নৃত্যের রূপ ও রীতি স্বভূমিজ, আমাদের নিজস্ব। আর অন্যদিকে আধুনিক অহমিকায় আমরা যাকে নৃত্য বলে সাধারণ বুদ্ধিতে জানি বা চর্চা করি, তার অনেকখানিই উষ্ঞবৃত্তিজাত।

সাধারণভাবে বাঙালির লুপ্ত ও অস্তিমান নৃত্যসমূহের একটা খসড়া তালিকা চিহ্নিত হতে পারে- যেমন, বুদ্ধনৃত্য (একার্থে নৈরামণী নৃত্য), পদ্ম বা পাখুড়ি নৃত্য, বিদ্যাধরী নৃত্য, গোর্খ নৃত্য, ঠমক নৃত্য (শিব নৃত্য), তাণ্ডব নৃত্য (গৌড়ীয়), তাফা নৃত্য (মুসলমানদের দ্বারা পচলিত), ডাকিনী নৃত্য, ভাদু নৃত্য, ছৌ নৃত্য, কৃষ্ণবিষয়ক নৃত্য-ক. কালীয়দমন নৃত্য খ. বাড়ায়ি নৃত্য গ নারদ নৃত্য ঘ. নৌকাখণ্ড নৃত্য

৫. ডঙ্ক নৃত্য চ. স্বানুভব নৃত্য ছ. উদ্দণ্ড নৃত্য জ. কালীয়দমন ও মুখোশ নৃত্য ঝ. গোপিনী নৃত্য ঞ. ধামালী বা ঢামালী নৃত্য ট, রঙ্গ ধামালী ঠ. রুক্মিনী নৃত্য ড. সংকীর্তন নৃত্য ঢ. হনুমান নৃত্য ণ. লগুড় নৃত্য ত. কৃষ্ণ ধামালী থ. লীলানাট্য । শিবকেন্দ্রিক ক. কুচুনী নৃত্য খ. গৌড়ী নৃত্য। বিদ্যাসুন্দর নৃত্য, মালিনী নৃত্য, জলনাট্য নৃত্য, নটিনী নৃত্য, তোনাই মোনাই নৃত্য (নাথগীতিকার ধারায় মুসলমানদের দ্বারা পরিবেশিত),

জারি নৃত্য, ক. বিষাদ জারি (ব্যালে শ্রেণীর) খ. চুটকি জারি নৃত্য, গ. ঘোড়া নৃত্য, কাঁচা সরা নৃত্য, মাদার পীরের নৃত্য, ঘাঁটু নৃত্য, ওঝা নৃত্য (গাজীর গান), সারি নৃত্য (নৌকাবাইচ সংক্রান্ত), জলুয়া খেলা নৃত্য, জলখেলা নৃত্য, ফাগু নৃত্য, ভাসান নৃত্য বেইল্যা (বেহুলা) নৃত্য ইত্যাদি।

এইসব নৃত্যের অনুসরণে একটা উচ্চাভিলাষী ইতিহাসের তাগাদা আছে এ কথা স্বীকার করেও বলা যায়, ইতিহাসের সুড়ঙ্গপথেই ফসিলের সন্ধান-একটির সঙ্গে আরেকটি মিলিয়ে এ অবয়ব দেখার চেষ্টা নিতান্ত নিষ্ফল নয়। তত্রাচ যেসব নৃত্য নাম তার অনেকগুলো একালের শিল্প প্রেরণাজাত এবং সেসব নাম সেরূপে গৃহীত হলেই কেবল নামানুযায়ী বা নামকৃত নৃত্যের রূপাবয়ব সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে, এই ভরসা করি।

প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে পরিচিত গীতিকাগুলো সংগীত, নৃত্য ও সংলাপ সংযোগে পরিবেশিত হতো। মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাঞ্চনকন্যা, দেওয়ানা মদিনা, দ্বিজবংশী দাসের ‘মনসামঙ্গল’ ও চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ প্রভৃতি গীতিকা লোকনৃত্যের ধারাতে পরিবেশিত হতো বলে মনে করা যায় । এই গীতিকাগুলো গায়েন দোহার পরিবেশিত বিধায় এতে নৃত্যাংশ গায়েন দ্বারাই নিষ্পন্ন হতো। এই নৃত্যে মূল চরিত্রের হাবভাব ও রস ফুটিয়ে তুলতে হতো গায়েনকে।

এই নৃত্যের কিছুটা দৃষ্টান্ত গাজীর গানে আজও বিদ্যমান। তবে, ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলে গীতিকাগুলো পরিবেশনের নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। বহুক্ষেত্রে গীতিকামাত্রই ট্র্যাজেডি, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই গীতিকাগুলো পরিবেশনের মাধ্যমে প্রকৃতির হৃদয় হরণ, প্রকৃতির আনুকূল্য লাভ ছিল এর উদ্দেশ্য।

উপরন্তু প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকাকে কেন্দ্র করে ভাটিয়ালির পাঁচটি ধাঁচ-ভাওয়াইয়া, মুড়াই, হাইলদা ফাটা, পাহাড়ি মুড়াই প্রভৃতি বিশেষ রীতির বাঙালি সুরের উদ্ভব ঘটেছিল। এই সুরগুলো গানের আঁধারে নৃত্যসহযোগে পরিবেশিত হতো। এর মধ্যে ভাওয়াইয়া সম্পূৰ্ণত নৃত্য ও নাট্যমূলক। কারণ, ‘ভাও’ শব্দের অসমীয় অর্থ হচ্ছে ভাব প্রদর্শন। দোনাগাজীর ‘সয়ফুলমুলকে’ ভাওয়াইয়ার উল্লেখ আছে। তাতে দেখা যায়, ভাওয়াইয়া পরিবেশনকারী ঘুরেফিরে বারবার ভাব প্রদর্শন করছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধারায় বাংলার সীমান্ত অঞ্চলে বিশেষত সমকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব অপূর্ব, অবিমিশ্রিত নৃত্যের প্রচলন আছে তা বাংলাদেশেরই নৃত্য। এই ভূখণ্ডের অধিবাসী হিসেবে আমরা বিপুল অহঙ্কারে সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারি।

মারমাদের মধ্যে বেশ কয়েক ধরনের নৃত্যের প্রচলন আছে, যা বৌদ্ধ ধর্মজাত। মারমারা সর্বপ্রাণবাদী। বৌদ্ধ ধর্মের অনাত্মবাদ গ্রহণ করা সত্ত্বেও শেষ অবধি তারা সর্বপ্রাণবাদীই থেকেছে। মারমা নৃত্যের নানা ধারার মধ্যে দুটি হলো পাংখু নৃত্য ও জ্যা।
মনরি ‘মাংসুমুই’ পাংখু নৃত্যের ধারায় পরিবেশিত হতে দেখা যায়। মারমা জ্যা আলংনাবা, মা চ ক্যান নাট্য, ‘জ্যা’ রীতির নৃত্যাশ্রয়ী। পাংখু নৃত্যে হাত, পা ও কটিদেশের কাজ প্রতিমুহূর্তেই সচল, শক্তিমান ও অর্থবহ।

১৯৯৩-৯৪ সালে ঢাকা থিয়েটার এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ মনরি মাংসুমুই অবলম্বনে মারমা সুর ও নৃত্যভঙ্গিমায় ‘একটি মারমা রূপকথা’ মঞ্চস্থ করে। তাতে বহুবিধ আধুনিক উপাদান সংযোগ সত্ত্বেও ‘পাংখু’ নৃত্যের বৈশিষ্ট্য প্রায় সর্বত্র অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছিল। মারমা জ্যা আলংনাবাহ অবলম্বনে আফসার আহমদ মা চ ক্যান, জ্যা নৃত্যের ধারায় আধুনিকতার সংযোগে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রযোজনায় মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন।

এ ছাড়া জ্যা নৃত্যের ধারায় মারমাদের ‘সাবায়া জ্যা থু’ মঞ্চস্থ হয়েছে। মারমাদের বিচিত্র নৃত্যলীলা যেকোনো সৃষ্টিশীল নৃত্যশিল্পীর জন্য নতুনতর নির্মাণের আহ্বান বয়ে আনতে পারে। কিন্তু প্রমাদবশে আমরা তাদের হীনজ্ঞান করি এবং শাস্ত্রীয় প্রচলের মাকড়সা জালে আটকে যাই। সে জন্য বাংলার নৃত্যে নতুন কালের আলো-আভা কিংবা বৃহৎ শিল্প বাসনা আর প্রত্যক্ষ করা যায় না। আলংনাবাহ নাট্যের তিনটি নৃত্যরীতি আছে—

১। পুইউ (নাচের বন্দনা অংশ)
২। তুইছাদুঙ্গা (প্রেমমূলক নৃত্য)
৩। লেছামায়ূইং (লে চাষবাসের জমি ও এতদসংক্রান্ত নৃত্য )
(সূত্র-আফসার আহমদ)

চাকমাদের নৃত্যে কিছু কিছু স্বকীয়তা থাকলেও এই সম্প্রদায়ের নৃত্য ঐতিহ্য উৎকেন্দ্রিক আধুনিকতার চাপে নিঃশেষিত হওয়ার পথে। তবে মান্দি বা গারো সম্প্রদায় মিশনারীদের চাপটা খানিক অগ্রাহ্য করেই তাদের কিছু কিছু নৃত্যের ধারা আজও বজায় রেখেছে। এরাও সর্বপ্রাণবাদী। ‘নস্তুনুপান্তু’ এদের স্রষ্টা আর ‘তাতারা রাবুগা’ প্রধান দেবতা, ‘সালজং’ সূর্য দেবতারূপে মাদ্রি সমাজে পূজ্য।

বস্তুতপক্ষে, গারোদের নৃত্যের নানাধারা বাংলার আধুনিক নৃত্য সৃষ্টিতে গৃহীত হতে পারে। লুৎফর রহমানের ‘নৃগোষ্ঠী নাট্য গারো’ অবলম্বনে ‘ওয়ানগালা’ উৎসব উপলক্ষে ৪৫-৫৬ প্রকার নৃত্যের প্রধান কয়েকটির উল্লেখ করা হলো :

১ । গ্রংদকআ (শিং বাজানো নৃত্য)।
২ । দক্রুসুআ (ঘুঘু পাখির লড়াইভিত্তিক নৃত্য)।

৩। দুরাত্তারাত্তা (উঁচুতে লম্বমান শস্যের শীষ নত করে শস্য সংগ্রহের ভঙ্গিসহ নৃত্য)।
8। আপিংরাত্তা (আগাছা পরিষ্কার করার ভঙ্গিসম্পন্ন নাচ)।
৫। রুমেআমা (প্রবীণ-প্রবীণা সেজে সন্তান কাঁকালে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য)।
৬। দামা জাজকা (ঢোল পরিবর্তনের ভঙ্গিসমেত নৃত্য)।

৭। মাত্মানা জেং অনা (মহিষকে ঘাস খাওয়ানোর ভঙ্গিতে নৃত্য)।

৮। আস্প্রে তং মুজেকা (আমড়া গাছ ঝাঁকিয়ে ফল পাড়ার মুদ্রাসহ নৃত্য)।
৯। নমিল দোমিসু আলা (তরুণী কর্তৃক মুরগির পালক বিতরণ সম্পর্কিত নৃত্য)।

১০। নমিল পাছে সল্লি দিং আ (তরুণ-তরুণীর পরস্পরের প্রতি পরস্পরকে
আকর্ষণের নিমিত্তে প্রদর্শিত নৃত্য)।
১১। নমিল কাম্রাংদন নুয়ে রিংআ (তরুণী কর্তৃক গোপনে ধূমপানের মুদ্রাসমেত নৃত্য)।

১২। সালাম কা আ (নৃত্যের ভঙ্গিতে উপস্থিত সভাজনকে সালাম প্রদর্শন) ।
১৩। রারা সুগালা (কাপড় কাচার ভঙ্গিতে প্রদর্শিত নৃত্য)।

১৪। দোসিক মেগারো চা আ (টিয়া পাখি কর্তৃক যবের শীষ ভক্ষণের মুদ্রাসমেত
নৃত্য)।

১৫। চাম্বিল মেসা আ (চাম্বল ফল পাড়ার ঢঙে বাঁদরের অনুকরণে নৃত্য)।
১৬। আমাক মিখপ চা আ (বানরের ভুট্টা ভক্ষণের ভঙ্গিসহ নৃত্য)।

১৭। নমিল জাজং নিদুয়া (তরুণীর চাঁদ দেখার ভঙ্গিসহ নৃত্য)।
১৮। খিল পূআ (তুলা বীজ বপন সংক্রান্ত নৃত্য)।

১৯। গ্রীক্কা, ঘোরির আ (ঘোড়ার মূর্তিসমেত যোদ্ধৃবেশে নারীদের নৃত্য)।
২০। জিক সেকাকু রিম আ (স্ত্রী হরণকারীকে ধৃত করণমূলক নৃত্য)।

২১। মেমাংমি পূজা (ভূত-পেত্নির ধান ভানার নৃত্য)।
২২। চাম্বিক দেম আ (চাম্বলগাছ কাটার মুদ্রাসহ নৃত্য)।
২৩। হাঃবা দাঙা (জমি তৈরির নৃত্য)।
২৪। বল দেন আ (গাছ কাটা)।
২৫। মিগি ইয়া (ধান রোপণ) ।
২৬। সামচেং বাসিয়া (আগাছা নিধন) ।
২৭। মি রাস্তা (ধান কাটা) ।
২৮। মিঃ সুঃ আ (ধান ভানা)… ইত্যাদি। (সূত্র : লুৎফর রহমান ও পরাগ রিসিল)

গারোদের নৃত্য তাদের দৈনন্দিন জীবনের শ্রমশ্বাস থেকে উৎসারিত। জুম, কৃষি, গৃহস্থাপনা, ফল সংগ্রহ, প্রেম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুর কৃত্যকে অবলম্বনপূর্বক এইসব নৃত্যের উদ্ভব। আচুদুংফা, খামছুদুংফার নৃত্য শিক্ষা কাহিনীতে সিসি থাপ্‌পা বলে মনে আনন্দ থাকলেই নাচ আসে। এই সরল উক্তির মধ্যে এই সম্প্রদায়ের জীবনদৃষ্টির একটি বিশেষ দিক উন্মোচিত হয়।আমাদের নৃত্যকলায় গারোদের ওয়ালজানি শেরিং পালার মতো পালা নবরূপায়ণে গৃহীত হতে পারে।

গারোদের নৃত্যে পদসঞ্চারণ, হাতের মুদ্রা, করণ এমনকি অঙ্গাভরণের উপাদান আমাদের আধুনিককালের নৃত্যে সংকলিত করা যায়। কারণ, আমরা দেখেছি মণিপুরি নৃত্যছন্দের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার মণিপুরি অঙ্গাভরণও রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন। আবার ওই একই নাট্যে সাধারণী নৃত্যের মুদ্রাও সংযুক্ত হতে দেখি ।

কাজেই সৃষ্টিশীল বিবেচনায় বাংলাদেশের নানা সম্প্রদায়ের নৃত্য ও নৃত্যকৌশল মঞ্চে গৃহীত হলে তাতে আমাদের নৃত্যের সংকীর্ণ সীমার প্রসার ঘটবে। এক বিপুল সর্বশিল্পগ্রাহী দৃষ্টিভঙ্গিই বাংলার নৃত্যকে পুষ্ট ও ফলবতী করতে সক্ষম। এইসব নৃত্যের হাবভাব, পোশাক, অলংকার, পদবিক্ষেপ, হাতের মুদ্রা একটি থেকে অন্যটি পৃথক। অথচ তারা একই গুচ্ছধৃত চাবি।

যারা অনাস্বাদিত জীবনের তালা খুলে দেয়। অন্যদিকে মণিপুরি সম্প্রদায়ের রাসনৃত্য আমাদের নৃত্যে যোগাতে পারে অপরূপ ছন্দ। মণিপুরি ‘লাইহারবা’ নারীদের নৃত্য তা প্রেম ও যৌন উদ্দীপনামূলক। আবার ‘নটপালা’ বৈষ্ণব ধর্মকৃত্য সংশ্লিষ্ট পরিবেশনা।

এই পালা গৌরাঙ্গ বন্দনা, গুরু বন্দনা ও বৈষ্ণব বন্দনা এমতো তিনটি ধাপে নিম্পন্ন হয়। শেষাংশে মনশিক্ষা (দেহতত্ত্ব) বিষয়ে গীতসংবলিত মূল পালায় বিবৃত হয় রাধাকৃষ্ণের প্রেম মিলনবিরহের বিবিধ পর্ব। আসামের অঙ্কিয়া নৃত্যও আধুনিক বাংলা নৃত্যধারায় গৃহীত হতে পারে। উল্লেখ্য, মণিপুরি নৃত্যের আরও নানা ভাগ আছে। সেসব নৃত্যের অভিজ্ঞতাও আধুনিক নৃত্যমননে সংযুক্ত হওয়া দরকার। এতদ্ব্যতীত, আসামের ‘বিহুনাচ’ ও ‘বিহুগীতের’ ধারাও গবেষণা করে দেখা দরকার।

তবে আমাদের লোকনৃত্য ব্যতীত অন্যত্র শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রভাবই বেশি। বাংলার নৃত্য সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ, শাস্ত্রীয় পরিবেশনার নিষ্ফল অন্ধকারে মাথা কুটে মরছে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, সর্বভারতীয় নৃত্যের শাস্ত্রকৌশলসমূহ প্রয়োজনে আমাদের নৃত্যের ধারায় গৃহীত হবে না।

ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের ইউরোপে কমেডিয়া দেল আর্টের প্রায় জগাখিচুড়ি নৃত্য ইউরোপের সাধারণী নৃত্য ‘এক্সট্রাভ্যাগেঞ্জা’-কে অবলম্বন করে সপ্তদশ শতকে উদ্ভব ঘটে ব্যালে বা ব্যালে নৃত্যের। শুরুতে ব্যালের কোনো শাস্ত্র ছিল না। অন্তত ষোড়শ শতকে ওই ধারার নৃত্যের কোনো শাস্ত্র রচিত যে হয়নি তার প্রমাণ আছে। কিন্তু মাত্র ১০০ বছরে (সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে) রাশিয়ায় ব্যালে হয়ে উঠল এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পমাধ্যম।

একদা চায়কোভিস্কি রূপকথাকে অবলম্বন করে রাজকুমার ও রাজকুমারীর যে প্রণয়গাথার সোনাটা তৈরি করলেন তা সমগ্র ইউরোপের চিত্ত প্লাবিত করল। আন্না পাবলোভো, নিজনস্কি, ঈসাডোরা ডানকান (যুক্তরাষ্ট্র) ও উত্তরকালে বিংশ শতাব্দীতে মায়া মেরিনা প্রিসেৎস্কায়ার আবির্ভাব ঘটল। সোয়ান লেকের রূপকথার আবহ ছেড়ে রুশ ব্যালের উত্তরণ ঘটল ক্যারমেনের মতো অসাধারণ ও অপ্রচলিত বিষয়বস্তুর নৃত্যে। ক্যারমেনের বিষয় ছিল করিজিদোর কর্তৃক গাভী হত্যা।

ফরাসি কোরিওগ্রাফার মাহলারের রচিত ‘দ্য রোজ মেলাদ’-এর মতো গীতি ও গতির ব্যালে, ‘রোমিও জুলিয়েটের’ মতো জটিল কাহিনীও এর অগ্রযাত্রার পথে গৃহীত হলো। ইসাডোরা ডানকান ভারতীয় মুদ্রার ব্যবহারে ব্যালেকে নতুনরূপে উজ্জীবনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। পিকাসোর মতো চিত্রশিল্পীও এক সময় ব্যালের মঞ্চসজ্জায় নতুনতর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন।

অথচ রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে বাঙালির নৃত্যের যে সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়েছিল আমরা তাকে উত্তরাধিকারের গৌরবে কখনোই বহন করিনি; বরং তাকে ঘরে সাজানোর এন্টিক করে রেখেছি। রবীন্দ্রনাথ এ কথা বুঝেছিলেন যে, বাঙালির নৃত্যের রসপিপাসা নাট্যচ্ছলে ব্যক্ত হবে। সে কারণেই চণ্ডালিকা, শ্যামা কিংবা চিত্রাঙ্গদার মতো কালজয়ী নৃত্যনাট্য।

ইংরেজ উপনিবেশ আমলে বাঙালির নৃত্যের সঠিক প্রবাহটি রবীন্দ্রনাথই চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে নজরুলের গীতি প্রবণতার মধ্য দিয়ে বাংলা নৃত্যের খানিক উদ্ভাস দেখা দিলেও নজরুল পরবর্তীকালে তা আধুনিক মনন ও মেধার সংস্পর্শ বঞ্চিত হয়ে রইল।

বাংলার কবি, ঔপন্যাসিক কিংবা অন্য যারা আধুনিকতার শিল্পকৌশলের সঙ্গে পরিচিত বাংলার নাচের প্রতি তাদের একটা নিভৃত প্রত্যাখ্যান লক্ষ্য করি। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, নৃত্যযেকোনোভাবেই হোক আধুনিক জীবন যন্ত্রণার কিংবা জীবনের বহুস্তরের জটিলতার ভাবনার প্রকাশ মাধ্যম হতে পারে না। এ কেবলই দেবতার আরাধনা, রবীন্দ্র ভাবালোকের কৃত্য। আর কৃত্য আধুনিকের সঙ্গী হতে পারে না ।

 

ইতিহাসের সম্মুখ রেখায় বাংলাদেশের নৃত্য সেলিম আল দীন

সাতাশি সালের দিকে নৃত্যকলার শাস্ত্রীয় দিকটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল স্বামী আনন্দকুমার কৃত নন্দিকেশ্বরের অভিনয় দর্পণের সঙ্গে অনুবাদ ও সম্পাদনা সূত্রে। তাতে স্নায়ু বিজ্ঞানের তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলাম যে, নৃত্য শিল্পকলা ও প্লাস্টিক আর্টের উৎস নিতান্তই স্নায়ুজৈবিক। নৃত্য সম্পর্কে সে গ্রন্থের ভূমিকায় অনেক ধারণা ব্যক্ত করেছিলাম। ভেবেছিলাম গ্রন্থটি এ দেশের নৃত্যভাবুকদের খানিকটা হলেও অনুপ্রাণিত করবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গ্রন্থটি আপনাদের দৃষ্টিধৃত হয়নি। তাতে আমি বলেছিলাম যে, শাস্ত্রীয় অগ্নিতে পরিশুদ্ধ নৃত্য থেকেই নতুনকালের নৃত্য সৃষ্টির প্রণোদনা জাগতে পারে। কাজেই আমার এই প্রবন্ধের মর্মে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রতি কোনোরূপ অনীহা নেই। কিন্তু এতে নানাভাবে এই ভাবনা ব্যক্ত হয়েছে যে, কেবলই কতগুলো শাস্ত্রের বাঁধনে গ্রন্থিবদ্ধ নৃত্য বাঙালির তুমুল জীবনের শিল্পস্পৃহাকে উদ্ভাসিত বা শনাক্ত করতে পারে না।

কাজেই আমাদের বিবেচনায়, নৃত্য কেবলই শাস্ত্র নয়। আজকের পণ্য সভ্যতায় বিপ্লবে, উপদ্রবে, গণ-অভ্যুত্থানে, রক্তাক্ত নদী তীরে তার আহ্বান ধ্বনিত হতে পারে। সমাজজীবনের নানা জটিলতর ভাঁজ উম্মোচিত করতে পারে নৃত্য। ঘৃণা প্রেমের-আলো অন্ধকারে সে আবর্তিত হতে পারে উজ্জ্বল গৌরবে। তাকে হওয়া চাই সর্বগ্রাহী।

সমকালকে তুচ্ছ করে কেবলই কতগুলো দৈব নির্দিষ্ট মুদ্রার আরাধনা নয়। বাংলাদেশের চিত্ত মুক্তির স্থলে তাকে দাঁড়াতে হবে। সে আয়োজন ও প্রস্তুতি যদি নৃত্যধারার থাকে তবেই এ দলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পূর্ণ সার্থকতা।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment